ঢাকা, শনিবার   ২৩ নভেম্বর ২০২৪

মানুষের কল্যাণে কাজ জীবনকে করে ছন্দময়

প্রকাশিত : ১৬:০০, ১৫ মে ২০১৯ | আপডেট: ১৬:২২, ১৫ মে ২০১৯

ছবি: প্রতীকী

ছবি: প্রতীকী

নবীজীর (স.) হাদীস অনুসারে, সৃষ্টির সেবায় কাজ এতেকাফের চেয়েও বেশি সওয়াবের। আমেরিকার বিখ্যাত ব্যবসাভিত্তিক সাময়িকী ফোর্বস-এর উদ্যোগে একবার একটি সমীক্ষা চালানো হয়। এতে একদল স্বেচ্ছাসেবককে বিভিন্ন অংকের কিছু ডলার দেওয়া হয়। তাদেরকে দুটি দলে ভাগ করা হয়। একদলকে বলা হয়, তারা তাদের প্রয়োজনমতো সেটি খরচ করতে পারেন আর অন্যদলকে বলা হয় যে, তারা যেন অর্থটা ব্যয় করেন অন্যের জন্যে, অন্যের কল্যাণে, সেই ব্যয়ের পরিমাণ যত অল্পই হোক। দিন শেষে দেখা গেল, যারা অন্যের কল্যাণে ব্যয় করেছিলেন তারা তুলনামূলকভাবে বেশি সুখী ও উজ্জীবিত ছিলেন।

যুক্তরাষ্ট্রের মিশিগান বিশ্ববিদ্যালয়ের সোশ্যাল সাইকোলজিস্ট সারা কনরাথ একটি গবেষণায় দেখেছেন যে, কেবল নিজের জন্যে নয় বরং অন্যের জন্যে, বিশেষত নিঃস্বার্থভাবে যারা অন্যকে সহযোগিতার কথা ভাবেন, এমনকি অচেনা-অপরিচিত মানুষের সেবায় এগিয়ে যান, কাজে নেমে পড়েন তাদের দীর্ঘজীবী হওয়ার সম্ভাবনা বেশি। গবেষণায় দেখা গেছে, এই শ্রেণির মানুষেরা অন্যদের চেয়ে তুলনামূলকভাবে চার বছর অবধি বেশি বাঁচতে পারেন। তিনি বলেন, এর কারণ বুঝি এটাই যে, অন্যের জন্যে নিঃস্বার্থ সেবায় মনে যে আনন্দ-অনুভূতির সঞ্চার হয়, তার ফলে শরীরে অক্সিটোসিন হরমোনগুলোর প্রবাহ বাড়ে। আর এ হরমোনটি শরীরের স্ট্রেস হরমোনগুলোর কার্যকারিতা কমিয়ে দেয় এবং শরীরকে রাখে টেনশন ও অস্থিরতার প্রভাবমুক্ত। এ জন্যেই তো সূরা বাকারা-র ২৭৪ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে, ‘যারা তাদের উপার্জন থেকে দিনে বা রাতে, প্রকাশ্যে বা গোপনে দান করে তাদের জন্যে পুরস্কার রয়েছে। তাদের কোনও ভয় বা পেরেশানি থাকবে না।

আসলে নিজের কল্যাণ নিয়ে দার্শনিক কনফুসিয়াস-এর সুন্দর একটি বাক্য রয়েছে, যে ব্যক্তি অন্যের কল্যাণের ইচ্ছা পোষণ করে, সে প্রকৃতপক্ষে নিজের কল্যাণই নিশ্চিত করে। আসলে আমরা যখন অন্যের জন্যে কিছু করার চিন্তা করি প্রকৃতির প্রতিদানস্বরূপ তা আমাদের জন্যে জমা থাকে-সাফল্য, প্রশান্তি নিশ্চিত হতে থাকে। আমরা যা-ই দেবো প্রকৃতি শতগুণে তা আমাদের দিকে ফিরিয়ে দেবে। হাসি দিলে-চারপাশের সবাই আমাদের দেখে হাসি দেবে। মানুষকে সম্মান করলে, শতগুণ সম্মান আমাদের দিকে ফিরে আসবে। অর্থ দান করলে চারপাশ থেকে অর্থের প্লাবন আসতে থাকবে। পেতে হলে আগে আসলে দিতে হবে। যা দান করব তার প্রতিদান আমরা পাবই। আজ না হয় কাল অথবা ভবিষ্যতের কোনোদিন।

যখন একজন মানুষ অন্যের কল্যাণে সচেষ্ট হয়েছেন তার ভালো থাকার পরিমাণ বেড়ে গিয়েছে। বৈজ্ঞানিক গবেষণায় যেমন এটি এসেছে ঠিক তেমনি এসেছে ধর্মীয় নির্দেশনায়। অন্যের কল্যাণে দান করার ফলে যে প্রথমে নিজের কল্যাণ হয়, সে-কথা মহান আল্লাহ পবিত্র কোরআনেই বলেছেন। সূরা বাকারা-র ২৭২ নম্বর আয়াতে আছে, ‘(হে মানুষ!) যে অর্থবিত্ত তোমরা দান করো, সে দান তো তোমাদের নিজেদের কল্যাণের জন্যেই। তোমরা তো আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্যে ব্যয় করো। অতএব দানের পুরোপুরি প্রতিদান তোমাদেরকে অবশ্যই দেওয়া হবে। তোমাদের হক কখনও নষ্ট করা হবে না’।

দান আমাদের নিজেরই জীবনে সমৃদ্ধি আনে। তার একটি ঘটনা বর্ণিত হয়েছে মুসলিম শরীফে। একবার এক লোক পাহাড়ে হেঁটে বেড়ানোর সময় মেঘের ভেতর থেকে আওয়াজ শুনতে পেল যে, ‘অমুকের বাগানে পানি দাও’। কিছুক্ষণ পরই বৃষ্টি শুরু হলো এবং পানি পাহাড়ের পাশে একটি ঝর্ণা দিয়ে গড়াতে লাগল। লোকটি কৌতূহলী হয়ে ওই নালাকে অনুসরণ করল। যেতে যেতে এক জায়গায় পৌঁছে সে দেখল, জনৈক ব্যক্তি কোদাল দিয়ে মাটি কেটে ওই পানি তার বাগানে ঢুকাচ্ছে। নাম জিজ্ঞেস করতেই সে চমকে উঠল। কারণ এই নামই সে শুনেছিল গায়েবি আওয়াজে। তার কাছে জানতে চাইল যে, সে কী এমন পুণ্যের কাজ করেছে যে, প্রকৃতি এভাবে তাকে সহযোগিতা করছে। সে তখন বলল, আমি এ বাগানের ফসলকে তিন ভাগ করি। একভাগ পরিবারের ভরণ-পোষণের জন্যে, একভাগ জমিতে বিনিয়োগের জন্যে এবং বাকি একভাগ দানের জন্যে ব্যয় করি। এজন্যেই হয়তো আমি এভাবে সহযোগিতা পাই। সূরা সাবা-র ৩৯ নম্বর আয়াতে আল্লাহ বলছেন, তোমরা অন্যের জন্যে যা-কিছু ব্যয় করবে, তিনি তার প্রতিদান দেবেন। তিনিই শ্রেষ্ঠ রিজিকদাতা।

দানের মাধ্যমে মানুষের কল্যাণে অংশ নেওয়া নিজের জন্যে অনেক সৌভাগ্যের একটি সুযোগ। এই দান যেমন অর্থ দিয়ে হতে পারে, তেমনি শ্রম দিয়ে, সময় দিয়েও হতে পারে। এখন প্রশ্ন হচ্ছে, আমাদের এই ব্যস্ত জীবনে আমরা কীভাবে দান করতে পারি?

আসলে আমরা যদি সবসময় অন্যের কীভাবে ভালো করতে পারি, উপকার করতে পারি এই দৃষ্টিভঙ্গিটা নিজের মধ্যে রাখি তাহলেই আমরা অন্যের কল্যাণ করতে পারব। অন্যের কল্যাণে কাজ করব-এই ইচ্ছা থাকতে হবে। তাহলেই দৈনন্দিন জীবনের খুব সাধারণ কাজের মাধ্যমেই অন্যের কল্যাণ করা সম্ভব হবে। যেমন-রাস্তা দিয়ে চলার সময় একটা কাচের টুকরো বা কলার খোসা নজরে এলো, সেটা পাশ কাটিয়ে চলে না গিয়ে পথ থেকে নিজেই সরিয়ে ফেলতে পারি। ক্ষুদ্র হলেও অনেক বড় উপকার করা হবে মানুষের। কারণ কারো পায়ে কাচের টুকরো ঢুকে গেলে বা কলার খোসায় পিছলে আছাড় খেয়ে আহত হলে তার শারীরিক, আর্থিক অনেক ক্ষতি হতে পারে। ভালো কাজ যে কতভাবে করা যায়, তার কোনো হিসাব নেই। ক্লান্ত মানুষকে একটু বসার জায়গা দেয়া, পথহারা মানুষকে পথ দেখিয়ে দেয়াও কল্যাণকাজ।

যদি মনে করি কিছুই নেই তাহলে আমাদের যে জ্ঞান আছে তা-ই বিতরণ করতে পারি। ধরুন, কারো এসিডিটির অসুবিধা আছে। রাতের দাওয়াতে দেখলেন যে, তিনি শসা পাতে তুলে নিচ্ছেন। তখন তাকে বিনীতভাবে বলতে পারি খনার সেই বচনের কথা যে, শসা আর ক্ষীরা হলো দিনের হিরা, রাতের কিরা। মানে শসা-ক্ষীরা দিনে (সকালে বা দুপুরে দারুণভাবে শরীরকে পানির অভাব থেকে মুক্তি দেয় কিন্তু এসিডিটিতে যারা ভুগছেন রাতে খেলে তাদের কষ্ট হতে পারে।) এই যে তথ্য দিয়ে উপকার, এটি শুনলে হয়তো তিনিও মেলাতে পারবেন যে, না যেদিন যেদিন এ রকম খেয়েছিলাম, সেদিনগুলোতে কষ্ট হয়েছে। তিনি যদি খাওয়া থেকে বিরত থাকেন, এটি আমাদেরকে একটি কল্যাণকাজে যুক্ত করল।

এই যে এখন চলছে রমজান মাস। খাদ্য নিয়ে সংযম করতে আল্লাহ বলেছেন এবং ইবাদত নিয়ে, ভালো কাজ নিয়ে ব্যস্ত থাকতে বলেছেন।

মনে রাখবেন, নিজের প্রাপ্তির চিন্তা জীবনকে ক্লান্তিকর বোঝায় পরিণত করে। তাই আমরা দিয়ে সুখী হবো।


Ekushey Television Ltd.










© ২০২৪ সর্বস্বত্ব ® সংরক্ষিত। একুশে-টেলিভিশন | এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি