ঢাকা, শনিবার   ২৩ নভেম্বর ২০২৪

‘মা’ ছাড়া ঈদ

মোহাম্মদ ফিরোজ

প্রকাশিত : ১০:১৬, ১৫ মে ২০২১ | আপডেট: ১০:১৮, ১৫ মে ২০২১

ঘুম ভাঙতেই বুকটা ছ্যাৎ করে উঠল। কান্নায় বুকটা ফেটে যাচ্ছে- এমন অবস্থায় সারা রাত কান্না করেছি। প্রতিদিন গাড়ি ড্রাইভ করে জেদ্দা থেকে মক্কায় যেতে হয় চাকরিতে, যেতে যেতে ফোনে সেজ ভাই-এর সাথে কথা বলতে পারছিলাম না, যতদূর গেছি, মক্কা পর্যন্ত কান্না আর কান্না করতে করতেই গেছি।

হায়রে প্রবাস জীবন! গত বছর আমার মা ঈদের সময় ছিল এই দুনিয়ায়, ঈদের নামাজ পড়ে আগে মায়ের সাথে ফোন করে কথা বলতাম আর কান্না করতাম। ঐ প্রান্তে মাও কান্না করত, এক সময় কান্না থামিয়ে মা আমাকে শান্তনা দিত- বাবা, আগামী ঈদে চলে আয় এক সাথে ঈদ করব। আজ ঈদ আসছে কিন্তু আমার মা এই ঈদে নেই।

চাকরি শেষ করে ভোরে বাসায় ফিরে পাঁচটার সময় ঈদের নামাজ পড়তে বাসা থেকে বের হয়ে রাস্তায় কান্না মাখা মুখে অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে ছিলাম, শুধু মা-এর কথাই মনে পড়ছিল। ঈদের নামাজ পড়ে সবার সাথে কথা, সালাম বিনিময় করছি ঠিকই কিন্তু আমার অন্তরে একটুও আনন্দ নেই, মনটা অনেক অনেক খারাপ। শুধু মা, মা, আর মায়ের কথাই মনে পড়ছে।

মাকে ঈদের নামাজ পড়ে এসে ফোন দিতে পারিনি মা বলে ডাকতে পারিনি। মা, তুমি আমাকে ছেড়ে কেন চলে গেলে? আজ তোমার ছেলে ডাকছে তোমায়, কে দেবে শান্তনা!

মা, ঈদের সময় আমি যতক্ষণ ফোন করে নতুন শাড়ি পরতে না বলতাম ততক্ষণ পরত না, আজ মা ছাড়া ঈদ কার কাছে ফোন করব, কাকে বলব- তুমি ঈদের নতুন শাড়ি এখনও পরনি মা? মা! এই একটা শব্দ আমাদের জীবনে জীবনের সমান। আমাদের জীবনে মা একটা এমন জায়গা, যা আমরা ঠিক সুস্পষ্টভাবে ব্যাখ্যাই করতে পারিনা। 

মা আমাদের সেই গাছ তলা যেখানে জীবনের কঠোর তপ্ত রোদের মধ্যে এক ফালি ছায়া, যেখানে আমরা চলার পথে কিছুটা বিশ্রাম পাই। মা আমাদের বাড়ির সেই কোণটা, যেখানে আমরা সবকিছু ভুলে গিয়ে বসে নিঃশ্বাস নেই। আমাদের জীবনে আমাদের মা-ই একমাত্র মানুষ, যে এক্কেবারে ভেতর থেকে বোঝে, মায়েদের কিছু বলে দিতে হয় না। মুখ দেখলেই কেমন করে যেন আমাদের মনের অবস্থা বুঝে ফেলেন। 

গত বছর জুনের ২৯ তারিখ আমার মা আমাকে ছেড়ে এই পৃথিবীর মায়া ত্যাগ করে আল্লাহর ডাকে সাড়া দিয়ে চলে গেছে আমাকে এতিম করে। তখন খুব খারাপ সময় পার করেছি, বৈশ্বিক মহামারী করোনা ভাইরাস সংক্রমণের কারণে সৌদি আরবসহ পৃথিবীর প্রায় দেশে কঠোর লকডাউন চলছিল।

জুনের ২০ তারিখ বুধবার, আমি রাতে আমার মায়ের সাথে কথা বলেছি। তখন মায়ের শরীরটা একটু খারাপ ছিল, মা তখন আমার ভাই-এর বাসায় ছিল। আমি ভাবীর ফোনে ইমোতে কল দিয়ে মায়ের সাথে কথা বলছি। মাকে জিজ্ঞেস করলাম, মা, তোমার চেহারা এমন দেখাচ্ছে কেন? মা বলল, না কিছু না, এমনি শরীর ভালো লাগছে না। 

তখন আমি ফোনটি ভাবীকে দিতে বলি, আর ভাবীকে বলি, মাকে ডাক্তার-এর কাছে নিয়ে যাও। ভাবী ঠিক আছে বলে মায়ের হাতে আবার ফোন দিল। মা তখন ভাত খেতে চায়নি। আমি ফোনে তাকে জোর করে খেতে বলি। তারপর ফোনটি রেখে দিলাম আর বাসায় এসে কাজ কর্ম সেরে ঘুমাতে ঘুমাতে রাত হয়ে যায়। 

২১ জুন বৃহস্পতিবার, ভোরে আমার সেজ ভাই ফোনের পর ফোন করে। আমি বলতে পারি না। হঠাৎ ঘুম ভেঙ্গে দেখি ভাই-এর অনেকগুলো মিসকল। আমি ভয়ে তাড়াতাড়ি ফোন করি আর ভাই ফোন রিসিভ করে বলে- মা খুব অসুস্থ, মাকে শহরে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। আমি ফোন কেটে দিয়ে মাকে ফোন করি, মা ফোন রিসিভ করতে পারছে না। তখন আমি কান্নায় ভেঙে পড়ি। 

কান্না করতে করতে ভাতিজাকে ফোন করি, তখন সে রিসিভ করে আর ভিডিও কলে আমাকে দেখায়। আমি মা মা করে কান্না করতে করতে ভেঙে পড়ি। মা শুধু বলেছিল ও পুত, আমি মনে হয় আর বাঁচব না! 

আজও মায়ের সেই শব্দ আমার কানে বাজে, মাকে এইভাবে হারিয়ে ফেলব কখনও কল্পনা করতে পারিনি। মায়ের আত্মা দেহ ছেড়ে চলে যায়। ওই মুহুর্তগুলো আমার জীবনের চির স্মরণীয় হয়ে থাকবে। তখন থেকে আমার নতুন নামকরণ হলো এতিম ছেলে। আমি এতিম হয়ে গেলাম সারা জীবনের জন্য। আর এটাই ঠিক। 

আমার কাছে মা মানে শুধু একটা রক্ত মাংসের অবয়ব নয়। কিছু প্রশ্ন, কিছু উষ্ণ সমস্যা, কিছু অসম্ভব কষ্টের সময়ে পাওয়া খানিকটা আরাম আর অনেকটা ভালোবাসা সীমাহীন, অর্থহীন, স্বার্থহীন ভালোবাসা।

আমরা যারা প্রবাসে থাকি, তাদের জন্য ঈদ অনেক কষ্ট আর বেদনার প্রকোপ মাখা, ইচ্ছা করলে যেতে পারি না প্রিয় জনের কাছে, ইচ্ছা করলে যেতে পারিনি মায়ের মৃত্যুর আগে বা পরে! হায়রে প্রবাস জীবন! সবার জন্য আজ ঈদ! কিন্তু আজ আমার শোকের দিন।

দেশে বসে সুন্দর সুন্দর গল্পের ইতি টানা যায়, দেশে বসে প্রবাসের অনুভূতি নেয়া যায় না। কষ্টের, হৃদয়ের দহন অনুভব করা যায় না। প্রত্যেক প্রবাসীর রয়েছে অব্যক্ত, নীল কষ্ট। এ যেন সংগ্রামী জীবনযুদ্ধের এক একটি উপাখ্যান। 

প্রবাসে প্রত্যেক প্রবাসীর কর্মব্যস্ততার মাঝেও মনটা থাকে দেশে। সবকিছুর পরেও প্রবাসীদের জীবন চলে নিরন্তর। লক্ষ্যের পেছনে অক্লান্ত পরিশ্রম করে এ যোদ্ধারা। এ জীবনে যখন তারা ব্যর্থতার তিক্ত স্বাদ পায়, তখন চোখ বুজে সয়ে যায় সব। ঝিনুক যেমন নীরবে সয়ে যায়, হাসিতে মুক্তা ফলায়।

আজ এক বছর হতে চলছে প্রায়। মা আমাকে ছেড়ে পরপারে চলে গেছেন। মাকে ছাড়া এটাই প্রথম ঈদ।  মাকে হারিয়ে কোথাও কোনো সান্ত্বনা খুঁজে নেওয়ার জায়গা অবশিষ্ট থাকল না। বাবা ছয় বছর আগেই চলে গেছেন। বাবা চলে যাওয়ার পরেও মা কখনও বুঝতেই দেননি বাবার শোক। সবসময়ই আগলে রেখেছেন আমাকে। আমার অন্য ভাই-বোনদের চেয়ে মা আমাকে বেশি আদর করতেন, ভালোবাসতেন। তাই আমার সব ভাই বোনেরা বলতো মাকে, তুমি শুধু ওকে বেশি ভালোবাসো, আদর করো। 

এই মধুময় সুন্দর দিনগুলো আর আসবে না। মা, তুমি চলে গেছো। কিন্তু তুমি যে সুন্দর, মধুময় দিনগুলো রেখে গেছো, সেই দিনগুলো কখনও ভুলতে পারব না। সারাজীবন ওই দিনগুলো ধরে রাখতে হবে এবং তোমার কথা মনে পড়বে। মা তুমিতো চলে গেছ। যাওয়ার পর আমার যে কি অবস্থা, কি কষ্ট তা বলে বোঝাতে পারব না। মা জানো, এতিম হবার যে কত যন্ত্রণা তা আগে বুঝতে পারিনি, এখন বুঝি। কত যন্ত্রণা। 

প্রত্যেক মানুষের কোনও না কোনও কষ্ট থাকে। তবে আমার কষ্টটা একটু ভিন্ন। আমার জীবন সব সময় অম্লান বেদনায় ভরপুর। যা সব সময়ই থেকে যাবে। এ কষ্টের আর শেষ হবে না। কষ্ট সব সময় আমার পিছু হাঁটবে। প্রিয়জন হারানোর কত দুঃখ, কান্না, বেদনার তা এখন আমি বুঝি। প্রিয়জন হারালে মনে হয় পৃথিবীর সব কিছু হারিয়েছি। প্রিয়জনের মধ্যে সবচেয়ে কাছের মানুষ হচ্ছে মা। প্রিয় মাকে যদি কেউ হারায় তাহলে মনে হয়, পৃথিবীর সব কিছু হারালো সে।

লেখক- প্রবাসী সাংবাদিক, জেদ্দা, সৌদি আরব।

এনএস/


** লেখার মতামত লেখকের। একুশে টেলিভিশনের সম্পাদকীয় নীতিমালার সঙ্গে লেখকের মতামতের মিল নাও থাকতে পারে।
Ekushey Television Ltd.










© ২০২৪ সর্বস্বত্ব ® সংরক্ষিত। একুশে-টেলিভিশন | এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি