মা নেই - না, মা তো আছেন
প্রকাশিত : ১৫:৪৬, ২৪ আগস্ট ২০২০
বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ ড. সেলিম জাহান কানাডা ও যুক্তরাষ্ট্রের একাধিক বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করেছেন। সর্বশেষ নিউইয়র্কে জাতিসংঘ উন্নয়ন কর্মসূচির মানব উন্নয়ন প্রতিবেদন দপ্তরের পরিচালক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। এর আগে বিশ্বব্যাংক, আইএলও, ইউএনডিপি এবং বাংলাদেশ পরিকল্পনা কমিশনে পরামর্শক ও উপদেষ্টা হিসেবে কাজ করেছেন। তার প্রকাশিত উল্লেখযোগ্য বই- বাংলাদেশের রাজনৈতিক অর্থনীতি, অর্থনীতি-কড়চা, Freedom for Choice প্রভৃতি।
সবে বক্তৃতা শেষে মঞ্চ থেকে নেমে আসছি। সঙ্গে লাতিন আমেরিকা ও ক্যারীবীয় দ্বীপপুঞ্জ অর্থনৈতিক কমিশনের নির্বাহী পরিচালক এ্যালিসিয়া ইবারা আর চিলিতে জাতিসংঘের আবাসিক প্রতিনিধি সিলভিয়া রুকস। দু'জনেই বন্ধু মানুষ। কমিশনের বিশাল মিলানায়তন উপচে পড়া শ্রোতারা দাঁড়িয়ে গেছেন এবং দন্ডায়মান শ্রোতাদের করতালি বেজেই চলেছে।
কিন্তু ভয় ছিল আমার। স্প্যানিশ ভাষা-ভাষী দেশে ইংরেজীতে বলব- জানি অনুবাদের ব্যবস্থা আছে, তাও? এবং বক্তৃতার শিরোনাম 'চিলির মানব উন্নয়ন - ইতিহাসের নিরিখে'। সাবধান ছিলাম প্রথম থেকেই - রুক্ষ রসকষহীন একটি পাঠ্যসূচীর বক্তব্য না হয়ে যায়। সমাজের নানান স্তর থেকে শ্রোতারা এসেছেন। এখন তাঁদের প্রতিক্রিয়ায় বুঝতে পারছি যে ব্যর্থ হইনি তাঁদের কাছে পৌঁছুতে।
মঞ্চের নীচে এসে দাঁড়াতেই ঘিরে ধরলেন আমন্ত্রিত অভ্যাগত অতিথিরা - বিশিষ্ট ব্যক্তিবর্গ এঁরা। করমর্দন ও প্রশস্তি উচ্চারণের জোয়ার বয়ে যাচ্ছে - খুব স্বস্তিকর পরিস্থিতি নয় আমার জন্য। তারমধ্যেই দেখতে পাই পেছন থেকে ঠেলেঠুলে সামনে আসছে এক ঝাঁক তরুণ-তরুণী কলকল করতে করতে। বুঝতে পারি এরা সান্টিয়াগো বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী। এরপর শুরু হয়ে যায় সত্যকারের প্রশ্নোত্তর। কত যে জিজ্ঞাসা এদের, কত যে অনুসন্ধিৎসা - ভালো লাগে জবাব দিতে, বিতর্ক করতে।
ওদের সঙ্গে কথা বলার সময়ে চোখ চলে যায় শ্রোতারাশির পেছন দিকের সারিতে। দেখতে পাই এক বৃদ্ধাকে ধরে ধরে সামনে নিয়ে আসছেন এক মধ্যবয়সী মহিলা, তাঁদের পেছনে একটি তরুণী। তাদের চলার ভঙ্গি দেখেই বুঝতে পারি তাঁরা আসতে চাচ্ছেন আমার কাছেই। কিন্তু আমার চারপাশের ব্যূহ ভেদ করতে পারছেন না।
দু' হাতে আশেপাশের ভীড় ঠেলে আমিই এগিয়ে যাই তাঁদের দিকে। দেখি বৃদ্ধা মহিলাটি সামনে হাতড়াচ্ছেন আর পরিস্কার ইংরেজীতে বলছেন, 'কই, সে কই?' বুঝতে পারি বৃদ্ধা পুরোপুরি অন্ধ। পাশের নারীটি তাঁর হাতটি ধরে আমার হাতে রেখে বলেন, 'এই তো মা, এখানেই'। বৃদ্ধা আমাকে দু'হাতে জড়িয়ে ধরেন। আমি টের পাই তাঁর শীর্ণ হাত কাঁপছে, তাঁর হৃদপিন্ডের ধুকধকানি শুনতে পাই, বুঝি তাঁর অশ্রুজলে ভেসে যাচ্ছে আমার কোটের সামনেটা।
চিত্র: লেখকের মা ও চিলির মা।
তিনি ফিসফিসিয়ে বলেন, 'আমার ছেলে আর ছেলে বৌ নিঁখোজ হয়েছে ১৯৭৪ সালে। যারা নিখোঁজ হয়েছে, তাদের কথা কেউ আর বলে না, বাবা। তুমি যে বললে, তাতেই আমি খুব শান্তি পেয়েছি।' পাশের নারীটি বলে ওঠেন, 'আমার মা। স্কুল শিক্ষয়িত্রী ছিলেন। চিলির ইতিহাসের ওপর কোন অনুষ্ঠান হলেই সেখানে যান। আমি আর আমার মেয়ে নিয়ে যাই তাকে'। তারপর পেছন ফিরে তরুণীটির দিকে তাকিয়ে বলেন, 'এটি আমার মেয়ে'। তরুণীটি স্মিত হাসে।
বৃদ্ধাটি আমার কাঁধ থেকে মাথা তোলেন। একটু বিব্রতভাবেই বলেন, 'আমি কি তোমাকে এককাপ কফি খাওয়াতে পারি'? আমি পেছনে তাকাই - সবাই অপেক্ষা করছেন আমার জন্য। আমি বৃদ্ধাকে এক মিনিট অপেক্ষা করতে বলে দৌড়ে যাই এ্যালিসিয়া আর সিলভিয়ার দিকে - বলি তাঁদের, মিনিট ১৫ পরেই আসছি আমি। চেনেন দু'জনেই তাঁরা ভালো করে আমাকে। কথা বাড়ান না আর।
ওঁরা তিনজন আর আমি বসি গিয়ে ক্যাফেটেরিয়ার এক কোনার টেবিলে। ঐ জায়গায় হেঁটে আসার সময় বৃদ্ধা শক্ত করে ধরে রেখেছিলেন আমার হাত। সবাই বসার পরে তাঁর মেয়ে বলল, 'আমি কিনে আনছি কফি'। 'না', দৃঢ় কণ্ঠে বললেন বৃদ্ধা, 'আমি ওকে আমন্ত্রণ জানিয়েছি। আমি দাম দেব'। নাতনীর সাহায্য নিয়ে প্রয়োজনীয় পয়সা বার করলেন, লজ্জিত মুখে বললেন, 'দেখতে পাই না তো, দেরী হয়'। তাঁর মেয়ে আর নাতনী চলে গেল কফি আনতে।
'আপনি এত ভালো ইংরেজী শিখলেন কেমন করে?' জিজ্ঞেস করলাম আমি। লালের একটা ছোপ পড়ল তাঁর মুখে - যেন লজ্জা পাওয়া এক কিশোরী। ভারী ভালো লাগল আমার। লজ্জারক্তিম মুখেই বললেন, 'আমার ছেলে-মেয়ের বাবা যে ইংরেজ ছিল গো। নাবিক হিসেবে এসেছিলো এ দেশে। আমার বয়স তখন ১৯। এক নাচের আসরে পরিচয় হলো, ভালো লাগল দু'জনেরই দু'জনকেই, ভালোবাসা হলো। তারপর তো বুঝতেই পারছো।' হেসে উঠলাম আমি। তিনি আবারও রক্তিম হলেন।
ততক্ষণে কফি এসে গেছে চার কাপ। কফি তে চুমুক দিয়ে বৃদ্ধার মেয়েকে জিজ্ঞেস করলাম, 'আপনার মনে আছে ভাইকে, ভাইয়ের বৌকে'? 'মনে থাকবে না? আমি তো ভাইয়ের চেয়ে মাত্র তিন বছরের ছোট। আর ওর বৌ তো আমারই বান্ধবী। আমরা সবাই তখন বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র।' থামেন একটু তিনি। তারপর যেন অনেক পেছনে তাকিয়ে আছেন, তেমন করে বলেন ভারী মৃদু স্বরে, 'কি যে প্রাণবন্ত ছিল দু'জনে, বিশ্ববিদ্যালয়ের উজ্জ্বলতম দু'টো নক্ষত্র'! বলতে বলতে গলা বুঁজে আসে তার, চোখ টলটল করে জলে। চেয়ে দেখি তরুণীটিও চোখ মুছছে - তার না দেখা মাতুল আর তার স্ত্রীর কথা ভেবেই হয়তো।
'কিন্তু আমি সংগ্রাম চালিয়েই যাচ্ছি। আমার মতো সব মা'দের নিয়ে গড়ে তুলেছি 'সন্তান-হারা মায়েদের সংঘ'। দাবী করছি ইতিহাসের, সত্যের, চাইছি বিচার। আমার যা গেছে তা'তো গেছে, কিন্তু আর কোনদিন যেন কোন মা'কে হারিয়ে যাওয়া সন্তানের অপেক্ষায় বসে থাকতে না হয়'। বৃদ্ধার কণ্ঠের দৃঢ়তার সঙ্গে সঙ্গে দেখি জলধারা গড়িয়ে পড়ছে তাঁর গাল বেয়ে।
চোখের কোনা দিয়ে দেখি এ্যালিসিয়া এসে দাঁড়িয়েছে দরজার কাছে। বুঝলাম, এখন উঠতে হবে। উঠতে উঠতে হাতের রুমাল দিয়ে বৃদ্ধার চোখ মুছে দিলাম। তিনি আমার হাতটি ধরে নরম কণ্ঠে বললেন, 'তোমার মা আছেন?' বললাম 'না'। আমার মাথায় হাত রেখে তিনি বললেন, 'অনেক বড় হও বাবা'।
মনে হলো, মিথ্যে কথা বলেছি, এই তো মা আছেন আমার সামনেই - মা না'হলে কি মা'য়ের মতো কেউ বলতে পারে? বাইরে তাকিয়ে দেখি নরম রোদ এসে পড়েছে শীতের চিলির পাহাড় চূড়োর বরফে।
এনএস/
** লেখার মতামত লেখকের। একুশে টেলিভিশনের সম্পাদকীয় নীতিমালার সঙ্গে লেখকের মতামতের মিল নাও থাকতে পারে।