ঢাকা, বৃহস্পতিবার   ১৩ মার্চ ২০২৫

Ekushey Television Ltd.

মা মিরাকল

মাহমুদ হাফিজ

প্রকাশিত : ১৫:৫৫, ২১ মে ২০২৪ | আপডেট: ১৮:৪৩, ২১ মে ২০২৪

Ekushey Television Ltd.

সনো হাসপাতালের সাততলায় দখিন জানালার শার্শিতে বোশেখ বিকেলের তীব্র রোদ। এ  সময় বৃষ্টিবাদলের কথা থাকলেও আবহাওয়া বৃষ্টি ও বাতাসহীন। কেমন এক দু:সহ গুমোটগরমে চারদিকে হাসফাঁস। বিছানায় শায়িত মা অজ্ঞান অবস্থাতেই আমার হাতটি শক্ত করে চেপে ধরার চেষ্টা করলেন। ছোট্টবেলায় পাড়ার ছেলেদের সঙ্গে গোল করার সময় যেভাবে শক্ত করে হাত চেপে কান মলতে মলতে বাড়িতে নিয়ে আসতেন, এই চেপে ধরা সেরকম না, ভিন্নতর। 

এই হাত ধরার মধ্যে নির্ভরতার আকুতি, বাঁচার তীব্র এষণা। ঠোঁট নাড়িয়ে কিছু একটা বলতে গেলেন। ভরজীবন যিনি বলেছেন কতো কথা, প্রতিদিন এই ঠোঁট নেড়ে কতো কতো অজিফাবই পাঠ করেছেন পাঞ্জেগানা নামাজের পর, সে ঠোঁট-জিহ্বায় তাঁর বলার আকুতি অস্ফূটই রয়ে গেল। ঠোঁট নড়লো, চোখ দিয়ে পানি বের হয়ে এলো,  কোন কথা বের হলো না। নিজেও বলতে পারলাম না কিছু। চারপাশে লোকজন। কান্না চেপে কিংকর্তব্যবিমূঢ় রইলাম। 

যে মা প্রায় শতবর্ষজুড়ে সন্তানসন্ততিসহ প্রজন্মের চারপুরুষের দেখভাল-তদারকির ভার নিজ স্কন্ধে বহন করেছেন, তাঁর ভার এখন অন্যের ওপর। জ্বলজ্যান্ত এক জীবন্তের এরকম চলশ্বক্তিসক্ষম নিয়ত নি:শ্বাসটুকু শুধু চালিয়ে যাওয়ার কষ্ট সন্তানের পক্ষে দেখা প্রায় অসম্ভব। তাই তিনি এক দুপুরে পৃথিবীর মায়া ত্যাগ করলেন।

মা আমার ছিলেন স্বশিক্ষিত এক গ্রামীণ গৃহবধূ। জীবনের ত্যাগ-তিতিক্ষা, পরিশ্রম, ধৈর্য্য, সুবিবেচনা ও ন্যায়ের প্রতি অবিচল আস্থার জেরে জীবনে সফল হয়েছেন। তাঁর এই শেকড়ের সফলতা গ্রাম, রাজধানী এমনকি মার্কিনমুলুকের মাইক্রোসফটের মতো বিশ্বখ্যাত কোম্পানি পর্যন্ত বিস্তৃত। বয়সের দিক থেকে শতবর্ষের প্রান্ত ছুঁয়ে তিনি ছিলেন স্বত:শ্চল অশ্বত্থসম ছায়াবৃক্ষ- যার দিবারাত্রির শ্রম-ঘাম নিয়োজিত নাতপুতির প্রতিষ্ঠা ও জীবনচিন্তায়। ব্যক্তিগত সুখ পরিহরি তিনি জীবনকে নিবেদিত-নিয়োজিত করেছিলেন পরিবার, পাড়াপ্রতিবেশী ও  আত্মীয়ের সার্বক্ষণিক কল্যাণে। সন্তান-সন্ততি, নাতি-পুতি মিলে অর্ধশত মানুষের শিক্ষাদীক্ষা ও প্রতিষ্ঠার মূল কারুকার ছিলেন। 

বিশ্বাসী, সৎ, কর্মনিপুণ ও সুবিবেচক হওয়ায় ভরজীবন ছিল তার মিরাকলময়, জাদুবাস্তবতাপরিপূর্ণ। কোন বিপত্তি-বাধা মায়ের কর্মকুশলতা ও ইচ্ছের সামনে কোনদিন বাধা হয়ে দাঁড়াতে দেখিনি। জাদুবলে আপনা আপনি ঘোর মুশকিল আসান করে ফেলতেন তিনি। 

স্মরণ আসে মায়ের মিরাকলময় জীবনের বিচ্ছিন্ন ক’টি ঘটনা। 

এক.
ক’বছর আগের কথা। মাকে ঢাকা নিয়ে আসবো। বাড়ি তিনি ছেড়ে শহরমুখো হতে চান না। এই না চাওয়া শুধু স্বামীর ভিটে আঁকড়ে থাকা কিংবা প্রিয় ছেলে নাতি-পুতিদের মায়াতেই নয়, তার শরীরও বয়সের ভারে দূর্বল। অশীতিপর বৃদ্ধা মা'র শরীর দূরযাত্রায় পারমিট করে না। ঢাকা, দিনাজপুর, শরীয়তপুর এমনকি কুষ্টিয়া শহর- যেখানে তাঁর আত্মার আত্মীয়রা থাকে, সেখানে যাওয়ার কথা শুনলেই তিনি শঙ্কা-দুশ্চিন্তায় পড়েন।  ঢাকাযাত্রায় তাঁর বিরক্তি সবচে' বেশি। সব যানবাহনেই্ ঢাকা-যাত্রার অতীত অভিজ্ঞতা তাঁর সুখকর নয়। তাঁর  মনোবল চাঙ্গা করতে একবার অভয় দিলাম, কুমারখালী থেকে ঢাকা বাসে মাত্র চারঘন্টা। ঘন্টাদুই ঘুমিয়ে থাকলে দেখতে দেখতে ঢাকা পৌঁছানো যায়। জানি, এটা নিছক অভয়। আরিচা ঘাটে ফেরি পার হয়ে কুষ্টিয়ার কুমারখালী থেকে ঢাকা পৌঁছতে চারঘন্টা থেকে দশঘন্টা পর্যন্ত সময় লাগে। সচরাচর ছয়ঘন্টা। ফেরি পারাপারের জটিলতায় চারঘন্টার যাত্রাটি তাত্ত্বিক মাত্র ! এ গল্প পদ্মা চালু হওয়ার আগের। 

সেবার জননীকে স্বস্তিদায়ক ঢাকা-যাত্রা উপহার দেয়ার জন্য শুক্রবার সকাল সাতটার বাসে টিকেট বুকিং দিই। সুপরিসর চেয়ারকোচের সামনের দিকে একলাইনে চার আসন। মায়ের জন্য পাশাপাশি দু'টি, আমি আর ভাতিজা সহযাত্রীর জন্য দুটি আসন। পরিবহন সংস্থা লালনের ব্যবস্থাপনা পরিচালক লিটন আব্বাস অনুজপ্রতিম। মা  যাত্রা করছেন শুনে আরও সামনের সারিতে আসনের  ব্যবস্থা করে দেন। লালনের  ফ্লিটের বাছাই করা নতুন বাস  ট্রিপটিতে বরাদ্দ হয়। যাত্রার দিন ছুটি থাকায় রাস্তাঘাট ফাঁকা। গাড়ি ছুটে চলছে দ্রুত। দুটি আসনে মায়ের জন্য কাপড়চোপড় ব্যাগ দিয়ে পুটলি বানিয়ে কুশনের মতো করে দিই। দূরযাত্রায় তিনি যাতে নড়েচেড় বসে-আধশোয়া হয়ে যেতে পারেন। যাত্রার ধকলে তাঁর অস্বস্তি শুরু হওয়ার আগেই গাড়ি আরিচাঘাটে কাছে পৌঁছে যায়। 

অন্যদিন যেখানে দেড়ঘন্টা বা বেশি লাগে, আজ ঘন্টার মধ্যেই অদুরে ঘাট দেখা গেল। মনে আল্লাহ আল্লাহ জপ করছি, ঘাট পারাপার যেন মায়ের জন্য মুশকিল না হয়ে 'আসান' হয়ে যায়।  বাসে যতোই আরামের ব্যবস্থা করা হোক, পারাপারে কারও হাত নেই সে ভবের ঘাটে হোক বা অন্যঘাটে। এপথযাত্রার সবচেয়ে বিরক্তিকর পার্ট আরিচাঘাট। 

কয়েক জেলার মানুষের ঢাকাযাত্রা কষ্টকর ও দূর কি বাত হয়ে আছে শুধু ঘাট বিড়ম্বনায়। ঘন্টাকাল থেকে চারঘন্টা পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হয় এখানে । আল্লাহ'র এমন কাম, আজ দেখি  মা'কে পার করার জন্য ফেরি  অপেক্ষা করছে ঘাটে। বোঝাই হওয়ার পর একটিমাত্র বাসের জায়গা খালি। মাকে বহনকারী বাস সরাসরি ফেরিতে গিয়ে উঠতেই ফেরির ইঞ্জিন চালু হয়ে গেল। হাঁফ ছেড়ে বাঁচলাম।  চারঘন্টায় ঢাকা পৌঁছার যে অভয় দিয়েছিলাম মাকে, তা রাখতে পারবো ভেবে মন চাঙ্গা হয়ে উঠলো। পার হওয়ার পর বাসের গতি বাড়লো, মা তন্দ্রাচ্ছন্ন হলেন। মাঝে একবার চোখ খুলে বললেন, ‘বাবা, সাভার  আইছি ?’ 

কিছুক্ষণের মধ্যে বাস থামলো। বাস থেকে নেমে প্রাইভেট কারে বাসার যাওয়ার ব্যবস্থা। শুক্রবার নামাজের আগে ঢাকার রাস্তাও একদম ফাঁকা। একটানেই বাসায় আসা গেল। গাড়ি লিফটের গোড়ায় থামলে মা ঝিমুনিভাব থেকে উঠে জিজ্ঞেস করলেন, আমরা কোথায়? বললাম বাসায় এসে গেছি, ওঠো, নামো। লিফটে উঠতে উঠতে তিনি বললেন, কয়টা বাজল? উত্তর, বেলা এগারটা পার হয়েছে। বললেন, ‘এতো তাড়াতাড়ি ঢাকা ?তাহলে ঢাকা আসতে তো তেমন কষ্ট নাই।'

বাসায় মধ্যাহ্নভোজের আয়োজন চলছে। এখানে আজ এক দুর্লভ ও মহা অতিথি মা। বছরের পর বছর প্রতীক্ষায় থেকে, বহুবার নাকচের  পর এই অতিথিকে পাওয়া গেছে। যার অতুলনীয় আত্মত্যাগ, নিরন্তর শ্রম-ঘাম, চিন্তা-দুশ্চিন্তা আর যত্ন-আত্তির জন্য আমাদের জন্ম, বেড়ে ওঠা ও প্রতিষ্ঠা। তাঁকে সামান্য ফিরিয়ে দেয়ার প্রতিটি মূহুর্ত যেন অমুল্য, দুর্লভ ও স্বপ্নময়। তাই বাসায় আমার স্ত্রীর আয়োজন প্রথাগতের চেয়ে অনেকটাই বাড়তি। খানাপিনার এই মহোৎসবে মায়ের আগ্রহ অবশ্য সামান্যই। সপ্তব্যঞ্জনে যেমন তাঁর আগ্রহ নেই, তেমনি ভুরিভোজনেও। ভরজীবন যিনি পাড়ি দিয়েছেন কষ্টেসৃষ্টে, মিতব্যয়িতার মধ্য দিয়ে তিল তিল করে অর্থ জমিয়ে লালন করেছেন ছেলেমেয়েদের, খাবারের প্রাচুর্য তার কাছে বাহুল্য অপচয় মনে হলেও হতে পারে। 

মা'র ঢাকা অবস্থান কোনভাবেই যেন মানসিক ও শারিরীক দিক থেকে কষ্ট- বিরক্তির  না হয়, সেজন্য আমরা সচেষ্ট সতর্ক। তাঁকে নিয়ে বাইরে বের হলেই অস্থির থেকেছি। কায়মনোবাক্যে কামনা করেছি যা আমাদের হাতের বাইরে, তার কষ্ট যেন মাকে স্পর্শ না করে। পরে একটার পর মিরাকল ঘটেছে। মাকে কোন বিরক্তি ও অস্বস্তি স্পর্শ করতে পারেনি।

দুই.
ঢাকায় মা'র বাইরে বেরুনোর প্রথম দিন মহাখালির প্যারাগন সেন্টার। বিকাশের কাস্টমার সার্ভিস অফিস। গাড়ি থেকে নামার পর লিফটে উঠে চারতলায় যেতে হবে। ভাবলাম, মা তো বেশিক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকতে পারেন না, গাড়ি থেকে নেমে বহুতল ভবনের লিফটের গোড়ায় লাইনে অপেক্ষা করে যদি ওপরে উঠতে হয়, মা'র কষ্ট হবে। আমার কাছে হুইল চেয়ারও নেই। এই ভাবনার মধ্যে ভবনের নিচতলায় পৌঁছে দেখি লিফটের দরজায় আমরাই প্রথম, আমরা ওঠার পর  পেছনে আসা লোকজন উঠলো। চারতলার অফিস খুলতে  তখনও মিনিট দশেক বাঁকি। লোকজন গিজ গিজ করছে লবিতে। আমাদের মতো অফিস সময়ের আগেই এসেছে সেবাপ্রার্থীরা। দরজামুখে প্রহরারত দারোয়ান কাউকে ভিতরে ঢুকতে দিচ্ছে না। 

এ পরিস্থিতিতে আর দশজন সেবাগ্রহিতার মতো মাকে যদি দাঁড়িয়ে থেকে ভেতরে ঢুককে হয়,তাহলে অবস্থা শেষ ! মিরাকলটি হচ্ছে, লিফট থেকে নামার সঙ্গে সঙ্গেই অফিস ইউনিফর্ম গায়ে পিয়নগোছের একজন উচ্চস্বরে গার্ডকে বললো, মুরুব্বিরে ভিতরে ঢুকতে দ্যান। দারোয়ান অন্যদের যেখানে বাধা দিয়ে দরজা আগলে রেখেছে, আমাদের সেখানে ভিআইপি ট্রিটমেন্টে ভিতরে ঢুকিয়ে সোফাতেই বসানো হলো না,একনম্বর সেবাগ্রহিতা হিসাবে আমাদের কাজটিও করে দেয়া হলো। পেশাসূত্রে জীবনে বেশিরভাগ ক্ষেত্রে প্রায়োরিটি পেয়েছি-পাই, আজ মায়ের সম্মানে প্রায়োরিটি পেয়ে ভিন্ন অনুভূতিতে মন ভরে গেল!

তিন.
মা নদীবিধৌত গাঁয়ের মানুষ। তাঁর বাবা সেকালের গ্রাম্য বিদ্বান-পণ্ডিত মানুষ হলেও সখের বশে নদী থেকে মাছ ধরতেন। ইলিশের পাশাপাশি তিনকাটা (বাতাসী), বাঁশপাতা (কাজলী), পাবদা, চিংড়ি অহরহ ধরা পড়তো।  বাজার থেকেও নদীর মৎসাদি আসতো কোমরভোগ-রমানাথপুরের মোল্লাবাড়িতে। আবার বৈবাহিক সুবাদে হাওড়-বিল এলাকায় জীবনের বেশিরভাগ সময় কাটানোয় কই, পুঁটি, ট্যাংরা, টাকি এসব মাছও মা রেঁধেছেন এন্তার। গ্রামে আজ এসব মাছ নানাকারণে মেলানো দুস্কর। 

তাই নদী ও বিলে হয় এমন মাছের একটা বড় লিস্ট করে প্রতিদিন মাকে মাছ খাওয়ানোর পরিকল্পনা হলো। আশঙ্কা, সপ্তাহ দেড়েক ঢাকা অবস্থানের মধ্যে তালিকা অনুসারে দেশি মাছ মিলবে কী না। ঢাকার বেশ কয়েকটি বাজারে কয়েকদিন ভোরবিহানে ঢুঁ দিয়ে চক্ষু চড়কগাছ। যে প্রজাতি ও সাইজের মাছ সচরাচর পাওয়া যায় না, তা নিয়ে পসারী দিব্যি হাঁক ছাড়ছে। এমনকি দামও আগের তুলনায় কম। যে সাইজের দেশি তাজা রুই, পাবদা, ট্যাংরা, পুঁটি, বাতাসী, টাকি পেলাম প্রার্থিত দামে, তা অন্য সময় পাওয়ার কথা ভাবা যায় না। 

এক সকালে কাওরানবাজারে গিয়ে দেখি তরকারি বিক্রি হচ্ছে পানির দামে। পূর্বরাতে ঝড় বৃষ্টি হওয়ায় ফড়িয়ারা আসেনি। দূরদূরান্ত থেকে আসা পাইকারি সবজি ব্যবসায়িরা বাজারে সবজি নামমাত্র মূল্যে ঢেলে দিয়ে যাচ্ছে। ঢাকায় কাঁচামরিচ তিনশ’ টাকা কেজি দরে কেনার অভিজ্ঞতা আমাদের অনেকের আছে, এদিন দেখি দশ টাকা দরে বিকোচ্ছে! 

চার.
মা নাতবউ'র মুখ দেখবেন। গ্রামদেশে নতুন বউ'র প্রথমদর্শনকে 'মুখদেখা' বলে। এ সময় সেলামি হিসাবে উপহার দেয়ার নিয়ম। গ্রামের কেউ শহরে এলে এলাকা থেকেই এর ব্যবস্থা করে আসে। মাকে এই হুড়হাঙ্গামা করতে  বারণ করেছিলাম। যেদিন  মুখ দেখা হবে সেদিন উপহারটা কিনে দেবো বলে বলেছিলাম। বাইরের ব্যস্ততার মধ্যে ফোনে খবর এলো মার সঙ্গে নাতবউ'র দেখা হয়ে যাচ্ছে...ঘরে ফেরার সময় উপহার আনতে হবে আজই। এ জাতীয় উপহার সোনার আঙটি, কানের দুল, চেইনজাতীয় কিছু হওয়াই প্রথা। সন্ধ্যায় উপহার কিনতে গিয়ে দেখি সোনার দোকান তো দুরের কথা সব মার্কেটই বন্ধ। কয়েক মার্কেট ঘুরে সম্বিত হয় আজ পয়লা মে,  ঢাকার সব মার্কেট-শপিংমল বন্ধ করে কমর্চারি মে দিবস পালন করছে। 

ইতোমধ্যে সন্ধ্যা পেরিয়ে রাত নেমেছে। ভাবলাম কোথাও কোন দোকান খোলা থাকলেও এখন বন্ধ করে বাড়ির পথ দেখছে সেলসম্যানরা। ব্যর্থ মনোরথ হয়ে ফেরার পথে ভেবে শিউড়ে উঠেছি আজ মা'র লজ্জায় মাথা কাটা যাবে। উপহার দেয়ার বিষয়টা তো দোকান বন্ধের কথা বলে বাকি রাখা যায় না। কী আশ্চর্য, বাড়ির কাছাকাছি পৌঁছে দেখি রাস্তার ধারের আপন জুয়েলা্র্সের শো রুমটি দিব্যি খোলা। ভেবেছিলাম, মার্কেটই যেখানে খোলা না, সেখানে রাস্তার পাশের বিচ্ছিন্ন শো রুম খোলা থাকার প্রশ্ন আসে না।  

আলো ঝলমল শো রুমে ঢুকে দেখি তেমন খরিদ্দার নেই। বন্ধের সময় হলেও সেলসম্যানরা এখনো প্রাণবন্ত, অপেক্ষমান। তারা সাদর সম্ভাষণই জানালেন না, একটা আঙটির কথা শুনে অসংখ্য বক্স মেলে ধরে রকমারি আঙটি দেখাতে লাগলেন। ভাবলাম, সোনার বড় দোকানে ছোট গহনা কিনতে গেলে সেলসম্যানরা অনুৎসাহী ও বিরসবদনে মুখ চাওয়াচাওয়ি করে, দুয়েকটা দেখানোর পরই  বিরক্ত হয়। আজ এদের কি হয়েছে? কোন আলোয় উদ্ভাসিত এরা? পাথর বসানো দৃষ্টিনন্দন একটি আঙটি কিনে বাসায় গিয়ে যখন মায়ের হাতে দিলাম, তখন তিনি স্বভাবসুলভ ভঙ্গিতেই বললেন, আমি জানতাম, যতো রাতই হোক তুমি এটা আনবাই।' আমি লা জওয়াব।
 
পাঁচ.
মা'র ডায়াবেটিস নেই। তিনি মিষ্টি খান। রসগোল্লা তাঁর প্রিয়। ঢাকার মিষ্টির দোকানগুলো খুব কমই রসগোল্লা বানায়। যা বানায় তা সাদাগোল্লা, রসছাড়াই বিক্রি হয়। ক্যান্টমেন্ট এলাকার ভাগ্যকূল মিস্টি দোকানে গেলাম। রসগোল্লার কথা শুনে পরিচিত সেলসম্যান বলল, স্যারের ভাগ্য ভাল। রসগোল্লা খুব কমই চলে। আজ যা বানানো হয়েছে বিক্রি প্রায় শেষ, তবে এখনো ডিসের মধ্যে এক কেজির বেশি আছে। বললাম, কথা না বলে মাপো। গ্রাম এলাকায় রসগোল্লা কেজিতে বিশ বাইশটা আর বাদামি রঙের হয়। ভাগ্যকুলেরটা দক্ষ ময়রার হাতে বানানো। বড়, সাদা এবং বিশেষ স্বাদের। বাসায় আনার পর স্ত্রী বললেন, আমরা অন্য মিষ্টি দিয়ে চালাবো। রসগোল্লাটা মা'র জন্য ফ্রিজে রক্ষিত থাক। শেষ না হওয়া পর্যন্ত উনিই খাবেন। মিষ্টি খেয়ে মা তৃপ্ত, আমরা তৃপ্ত ঢাকায় রসগোল্লা পেয়ে। 

ছয়.
বাড়ি ফিরে যাওয়ার দিন বাসা থেকে টেকনিক্যাল বাসস্ট্যান্ড পর্যন্ত আবহাওয়া ভালই ছিল।  আজকের যাত্রী তালিকায় আমি নেই, মা আর ভাতিজা যাচ্ছে। আসন পূর্ববৎ। মা  যখন ঢাকা ছাড়ছেন তখন সাতসকালে আকাশঝেঁপে বৃষ্টি। মনে হলো ঢাকা আজ প্রাণ উজাড় করে কাঁদছে। বৃষ্টির মধ্যেই মায়ের বাস ক্রমশ আমার দৃষ্টির আড়ালে চলে গেল। পরে জেনেছি, বৃষ্টির শীতল পরশ যাত্রাপথে মাকে বিভোর ঘুমের আবেশ এনে দেয়। বাড়ি পৌঁছাতে তাঁর খুব বেগ পেতে হযনি। ফলে বৃষ্টি বিপত্তি না হয়ে উপকারীই হয়েছে।

এদিকে ফেরার পর ভাবতে পারিনি মা বাসায় নেই। যে ঘরটিকে মা কয়েকদিনের জন্য তাঁর ইবাদতখানা বানিয়েছিলেন, সেটা  স্তব্ধ, নিরব, শূণ্য।  সকাল সন্ধ্যা বা দুপুরে উঁকি দিলেই দেখা যেতো খাটের কোণে সফেদ শাড়িতে ঘোমটা ঢাঁকা মুখ। দু'হাতে ধরা অজিফার বই। মাথাটি ঈষৎ দুলছে অজিফা বই পড়ার সঙ্গে তাল রেখে। ঘরের মধ্য থেকে উঠছে চমৎকার অপূর্ব শ্রুতিমধুর এক স্বর্গীয় সুর। আজ রাজ্যের শুন্যতা জেঁকে আছে ঘরজুড়ে। ততোক্ষণে বাইরে বৃষ্টি থেমে গেছে। আমাদের চোখের বৃষ্টি আর থামছে না, ঝরছে অবিরাম।

পাদটীকা:  আমাদের জীবনে এমন অনেক কিছু ঘটে, যার ব্যাখ্যা সহজে মেলে না। যুক্তি ও লৌকিকতার ঊর্ধ্ব বহুকিছুকে তখন বিশ্বাসের নিরিখে বিশ্লেষণ করতে মন চায়।

এএইচ


Ekushey Television Ltd.

© ২০২৫ সর্বস্বত্ব ® সংরক্ষিত। একুশে-টেলিভিশন | এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি