‘মুক্তিদাতা, তোমার ক্ষমা তোমার দয়া রবে চির পাথেয় চির যাত্রার’
প্রকাশিত : ১৪:০৫, ১৭ মার্চ ২০১৯
রবীন্দ্রনাথের ‘সমুখে শান্তি পারাবার’গানটি, বিশেষ করে তার দুটি লাইন শুনলে আমার বঙ্গবন্ধুর কথা মনে পড়ে। এই দুটি লাইন হলো—‘মুক্তিদাতা, তোমার ক্ষমা, তোমার দয়া/রবে চির পাথেয় চির যাত্রার,’রবীন্দ্রনাথ এই গানটি শেখ মুজিবুর রহমানকে উদ্দেশ করে লেখেননি। কিন্তু টুঙ্গিপাড়ায় বঙ্গবন্ধুর সমাধির সামনে গিয়ে দাঁড়ালেই আমার মনে হতো এই গানটি বঙ্গবন্ধুকে উদ্দেশ করেই লেখা। শেখ মুজিবুর রহমান নামের এই মানুষটি শুধু বাঙালি জাতিকে পুনর্জন্ম দেননি, তিনি তাদের লিবারেটর, মুক্তিদাতা।
স্বাধীনতা লাভের পর আফ্রিকার একেবারে অনগ্রসর দেশগুলোর বেশির ভাগই বিদেশি ঔপনিবেশিক শক্তির চাপিয়ে দেওয়া তাদের দেশের নাম মুখে মেনে আগের অরিজিনাল নামে ফিরে গেছে। স্বাধীনতা লাভের সঙ্গে সঙ্গে উত্তর রোডেশিয়া জিম্বাবুয়ে নামে ফিরে যায়। ইংরেজ রোডস সাহেব সোনা ও অন্যান্য খনিজ সম্পদের লোভে দেশটি দখল করার পর তার নাম বদল করে রাখা হয় রোডেশিয়া। উত্তর রোডেশিয়া স্বাধীন হওয়ার পর জিম্বাবুয়ে নামে ফিরে যায়।
পাকিস্তান হওয়ার পর বাংলাদেশের বেলায় ঔপনিবেশিকে ঘৃণ্য নীতি অনুসরণ করা হয়। পাকিস্তান গঠিত হয়েছিল পূর্ব বাংলা, পশ্চিম পাঞ্জাব, সিন্ধু, উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশ ইত্যাদি প্রদেশ নিয়ে। পূর্ব বাংলা ছাড়া কারো নামই পরিবর্তন করা হয়নি। কিন্তু পূর্ব বাংলার নাম এবং তাদের অধিবাসীদের নামও বদল করে ফেলা হয়। পূর্ব বাংলার নাম করা হয় পূর্ব পাকিস্তান, তার অধিবাসীদের বাঙালি নাম মুছে ফেলে করা হয় পূর্ব পাকিস্তানি। তার ওপর কেন্দ্রীয় মন্ত্রী হিসেবে খাজা নাজিমুদ্দীনের ছোট ভাই খাজা শাহাবুদ্দীন বাংলাদেশের মানুষকে উপদেশ দেন, তারা যেন পূর্ব পাকিস্তান নামটিতে বাংলা পূর্ব শব্দটি ব্যবহার না করে ‘মাশরেকি’এই শব্দটি ব্যবহার করে। অর্থাৎ বাংলাদেশ বা পূর্ব পাকিস্তানকে বলতে হবে মাশরেকি পাকিস্তান। একই সঙ্গে চলে শুধু দেশের ও তার অধিবাসীদের নামের ওপর নয়, তার ভাষা, সংস্কৃতি ও লোকজ ঐতিহ্যের ওপর হামলা।
এই প্রতিটি হামলা প্রতিরোধের আন্দোলনে ছিল বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্ব। শেষে ছয় দফা আন্দোলনের সময় তিনি ঢাকার পল্টনের মাঠে বিশাল সমাবেশে ঘোষণা করেন—‘আজ থেকে পূর্ব পাকিস্তান নয়, এই অঞ্চলের নাম বাংলাদেশ। আমাদের পরিচয় বাঙালি।’বঙ্গবন্ধুর এই উক্তিকে চ্যালেঞ্জ জানান পশ্চিম পাকিস্তানের এক জামায়াত নেতা মিয়া মোহাম্মদ তোফায়েল।
তিনি বলেন,‘মুসলমানদের ভৌগোলিক কোনো জাতীয়তা নেই। সারা বিশ্বের মুসলমানরা এক জাতি।’ এই বক্তব্যকে সমর্থন জানায় ঢাকার আজাদ এবং মর্নিং নিউজ পত্রিকা—দুটি কাগজই এখন নেই। ঢাকায় পল্টনের এক সভায় বঙ্গবন্ধু এই জামায়াতি বক্তব্যের জবাব দেন।
তিনি বলেন, মুসলমানেরা যদি ধর্মভিত্তিক এক জাতি হবে, তাহলে মধ্যপ্রাচ্যে সৌদি, ইরাকি, জর্দানি, ইরানি, ইজিপ্টশিয়ান, তুর্কি—এরা একই ধর্মের লোক এবং অনেকে একই আরবি ভাষী হওয়া সত্ত্বেও বিভিন্ন ভৌগোলিক জাতি হিসেবে পরিচিত এবং আলাদা আলাদা রাষ্ট্র কেন? এক দেশের মুসলমানদের অন্য মুসলিম দেশে যেতে ভিসা-পাসপোর্ট লাগে কেন?
বঙ্গবন্ধু আরো বলেন, “আমাদের রাসুল (সা.) পর্যন্ত ভৌগোলিক ও ভাষাভিত্তিক জাতীয়তার বিরোধী ছিলেন না। বিভিন্ন দেশের সঙ্গে চুক্তি করার সময় তিনি চুক্তিপত্রে নিজের যে নাম ব্যবহার করতেন, তাতে তিনি রাসুলুল্লাহ কথাটিও বেশির ভাগ সময় লেখেননি। তিনি লিখতেন ‘মোহাম্মদ বিন আবদুল্লাহ আল আরাবি, আলমক্কী।’ অর্থাৎ তিনি নিজেকে আরবের লোক পরিচয় দিয়েই শান্ত হননি। তিনি যে মক্কার অধিবাসী সে পরিচয়ও দিতেন।”
বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সূচনায় লন্ডন থেকে ‘সানডে অবজার্ভারের’ বিখ্যাত কলামিস্ট সিরিল ডান এসেছিলেন ঢাকায়। তিনি লন্ডনে ফিরে গিয়ে ‘অবজার্ভারে’ বঙ্গবন্ধুর ওপর এক দীর্ঘ কলাম লেখেন। সেই কলামেও তিনি বঙ্গবন্ধুকে ‘পোয়েট অব পলিটিকস’ বলে অভিহিত করেন। বাংলাদেশের কবি নির্মলেন্দু গুণ বঙ্গবন্ধুকে মহাকবি এবং তাঁর ৭ই মার্চের ভাষণকে মহাকাব্য আখ্যা দেন।
ব্রিটিশ কলামিস্ট সিরিল ডান তাঁর অবজার্ভারের কলামে বঙ্গবন্ধু সম্পর্কে লিখেছিলেন—‘এই নেতা জনগণকে মন্ত্রমুগ্ধ করার মতো বজ্রকণ্ঠের অধিকারী (Voice of thander) বক্তা। দীর্ঘদেহী শ্যামল কান্তির মানুষ। সম্ভবত তিনি বাঙালির একমাত্র নেতা, যিনি গায়ের রং, মুখের ভাষা, চলনে-বলনে, আকারে এককথায় নৃতাত্ত্বিকভাবেও খাঁটি বাঙালি। তাঁর সংগ্রাম শুধু স্বাধীনতা লাভের জন্য নয়, এই সংগ্রাম বাঙালির ন্যাশন হুড পুনরুদ্ধার এবং ন্যাশন স্টেট প্রতিষ্ঠার।’
বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর ব্রিটেনের হাউস অব লর্ডসের তৎকালীন বিখ্যাত মানবতাবাদী সদস্য প্রয়াত লর্ড ফেয়ারম্যান (নামটি সঠিকভাবে লিখতে পেরেছি কি না জানি না) মন্তব্য করেছিলেন, ‘পৃথিবীতে বহু ক্ষণজন্মা নেতা জন্মেছেন, যেমন—জর্জ ওয়াশিংটন, গান্ধী, আতাতুর্ক প্রমুখ। তাঁরা বিদ্যায়-বুদ্ধিতে শেখ মুজিবের চেয়ে বড় হতে পারেন, কিন্তু একটা ব্যাপারে তাঁরা কেউ মুজিবের সমকক্ষ নন। তাঁরা সবাই নিজের দেশকে একবার স্বাধীন করেছেন, কিন্তু মুজিব তাঁর দেশকে দুবার স্বাধীন করেছেন। একবার পাকিস্তানিদের সঙ্গে যুদ্ধে নেতৃত্ব দিয়ে, আরেকবার পাকিস্তানের কারাগার থেকে ফিরে এসে ইন্দিরা গান্ধীকে অনুরোধ জানিয়ে বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার তিন মাসের মাথায় মিত্র ভারতীয় সেনাবাহিনীকে বাংলার মাটি থেকে বিদায় দিয়ে।
এই মানবতাবাদী লর্ড অত্ত্যুক্তি করেননি। পাকিস্তানি সেনাবাহিনী ছিল বাংলাদেশের শত্রুপক্ষ। হানাদার বাহিনী নারী ধর্ষক এবং গণহত্যাকারী। বাংলাদেশ থেকে তাদের তাড়াতে তাই যুদ্ধ করতে হয়েছে। ভারতের সেনাবাহিনী বাংলাদেশের শত্রু ছিল না। ছিল মিত্রপক্ষ। বাঙালির মুক্তিযুদ্ধে সহযোদ্ধা। বাংলাদেশের মানুষ তাদের কাছে কৃতজ্ঞ। তথাপি বঙ্গবন্ধু যদি দেশটি স্বাধীন হওয়ার পরের মাসেই (১০ জানুয়ারি ১৯৭২) দেশে ফিরে আসতে না পারতেন, পাকিস্তান জল্লাদেরা তাঁকে হত্যা করতেন, তাহলে ভারতীয় সেনাবাহিনীকে বাংলাদেশের যুদ্ধবিধ্বস্ত অভ্যন্তরীণ অবস্থা স্থগিত না হওয়া পর্যন্ত অবস্থান করতে হতো।
কোনো দেশেই মিত্র বিদেশি সৈন্যের দীর্ঘকালীন অবস্থানও সুখের হয় না। দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের পর বার্লিন ও প্যারিসে মিত্রপক্ষের অবস্থান (বার্লিনে প্রায় ৪০ বছর) জনমনে অসন্তোষ তৈরি করেছিল। এদিক থেকে বঙ্গবন্ধুর অনুরোধ শোনামাত্র বাংলাদেশ থেকে ভারতীয় সৈন্য অপসারণ ছিল ইন্দিরা গান্ধীর মহানুভবতা ও দূরদৃষ্টির পরিচায়ক। অন্যদিকে বঙ্গবন্ধু দেশ স্বাধীন হওয়ার মাত্র তিন মাসের মাথায় ভারতীয় সৈন্যদের সম্মান জানিয়ে বাংলার মাটি থেকে বিদায় দিয়ে তাঁর নেতৃত্বের বিশাল শক্তি ও অতুলনীয় দেশপ্রেমের পরিচয় দিয়েছিলেন।
১৯২০ সালের ১৭ মার্চ এই ক্ষণজন্মা মানুষটির জন্ম। আজকের ১৭ মার্চ (২০১৯) তিনি বেঁচে থাকলে তাঁর বয়স হতো ৯৮ বছর। তিনি যদি ফিদেল কাস্ত্রোর মতো দীর্ঘ বয়সেও বেঁচে থেকে দেশ শাসন করতে পারতেন, তাহলে তাঁর স্বপ্নের সোনার বাংলায় সমাজতান্ত্রিক, অসাম্প্রদায়িক পরিণত ছবিটি হয়তো আমরা এখন দেখতে পেতাম। কিন্তু তাঁকে হত্যা করে দেশটিকে পরিণত করা হয় বধ্যভূমিতে। এই বধ্যভূমিতে দাঁড়িয়ে বাংলার কবিকে কান্নাভরা কণ্ঠে গাইতে হয়েছে :
‘জন্মভূমি, কোথায় তুমি আবার কবে ফিরে পাব রক্তে ভেজা সোনার দেশে আবার কবে ফুল ফোটাবো?’এই কান্নাভেজা প্রশ্নের জবাবেই হয়তো বঙ্গবন্ধুরই কন্যা শেখ হাসিনার জননেত্রী হিসেবে রাজনীতিতে আবির্ভাব। পিতার সোনার বাংলা গড়াতে অসমাপ্ত স্বপ্ন সফল করার কাজে তাঁর এই নিরন্তর দীর্ঘ সংগ্রাম। এই সংগ্রাম এখনো চূড়ান্তভাবে সফল না হলেও সফল হওয়ার পথে। আর এই সফল হওয়ায় পথের দীর্ঘ যাত্রায় ১৭ মার্চ নিরন্তর প্রেরণা। রবীন্দ্রনাথ তাঁর ‘সমুখে শান্তি পারাবার’ গানটিতে লিখেছেন—‘তুমি হবে চিরসাথী, লও লও হে প্রাণপাতি।’ আজ ২০১৯ সালের ১৭ মার্চ সেই প্রাণপাতিই জানাচ্ছে, বাংলাদেশের ইতিহাসের শ্রেষ্ঠ সন্তান বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে। তিনি আমাদের মুক্তিদাতা, আমাদের স্বপ্নে ও জাগরণে চিরসাথি।
২০২০ সালের মার্চ মাসে তাঁর জন্মশতবার্ষিকী পালনের বিশাল আয়োজন হয়েছে। আমার গর্ব, আমি মুজিব যুগের বাঙালি। ২০২০ সাল পর্যন্ত বেঁচে থাকব কি না জানি না। আমার বন্ধু সব্যসাচী লেখক সৈয়দ শামসুল হক বলেছিলেন, ‘আমি বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবার্ষিকী দেখে যেতে চাই।’ তিনি পারলেন না। আমিও পারব কি না জানি না। তাই এ বছরের ১৭ মার্চ তারিখেই এই যুগোত্তীর্ণ মহামানবকে জন্মশতবার্ষিকীর প্রণতি জানিয়ে রাখছি। বঙ্গবন্ধু যুগ যুগ জিও।
টিআর/