ঢাকা, শনিবার   ২৩ নভেম্বর ২০২৪

মুক্তিযুদ্ধবন্ধু ফাদার রিগন

প্রকাশিত : ১৩:২২, ২১ অক্টোবর ২০১৭ | আপডেট: ১৮:২৮, ১ নভেম্বর ২০১৭

মুক্তিযোদ্ধা ফাদার মারিনো রিগন আর নেই। তাঁর মৃত্যুতে বাংলাদেশ একজন সত্যিকারের প্রকৃত বন্ধু হারালো। একুশে টেলিভিশন অনলাইনের পক্ষ থেকে ফাদার রিগনের প্রতি গভীর শ্রদ্ধা রইলো। রিগনের প্রিয় বন্ধু ও স্নেহভাজন বাংলাদেশের পুঁথি শিল্পী কাব্য কামরুল তাঁকে নিয়ে বেশ কিছুদিন আগে একটি লেখা প্রকাশ করেছিলেন। পাঠকদের উদ্দেশ্যে সেই লেখাটি প্রকাশ করা হচ্ছে -

১৯৭১ সাল। চারদিকে যুদ্ধের দামামা। বাঙালি জাতির মহান মুক্তিযুদ্ধ। প্রাণপণ যুদ্ধ করছে এদেশের আবাল-বৃদ্ধ, জনতা। এরকম নাজুক পরিস্থিতিতে দলে দলে বিদেশিরা চলে যাচ্ছে নিজ দেশে। বহির্বিশ্বে প্রচার পেল বাংলাদেশের ভয়াবহতা সম্পর্কে। কিন্তু কিছু বাংলাপ্রেমী মহান বন্ধু সেই দুঃসময় বাঙালির পাশে ছিলেন নিছক মানবতার মূলমন্ত্র নিয়ে। তাদের মধ্যে ফাদার মারিনো রিগন অন্যতম। যিনি ঝুঁকি জেনেও বাঙালির ন্যায্য সংগ্রামে নিজেকেও জড়িয়ে ফেলেন একজন দেশপ্রেমিক বাঙালির মতো।

তিনি যুদ্ধকালীন সময়ে ছিলেন গোপালগঞ্জের মুকসুদপুরের বানিয়ারচর ক্যাথলিক মিশনে। প্রধান পুরোহিত হিসেবে তখন দায়িত্ব পালন করছিলেন তিনি। নিরাপত্তাহীনতার কারণে বহুসংখ্যক নিরীহ বাঙালি শহর থেকে গ্রামে আশ্রয় নিতে লাগল। বানিয়ারচর গ্রামেও আশ্রয় নিতে লাগল বিপদগ্রস্ত মানুষ। খ্রিষ্ট সমাজ নিরাপত্তার কথা বিবেচনা করে আপত্তি তুলল জোরেশোরে। অনেকেই বিশেষ করে হিন্দুদের আশ্রয় দিতে অপারগতা প্রকাশ করতে লাগল। সাপ্তাহিক প্রার্থনা সভায় ফাদার রিগন দরাজ কণ্ঠে ঘোষণা করলেন, আশ্রয় প্রার্থীকে অবশ্যই আশ্রয় দিতে হবে। এটা আমাদের নৈতিক দায়িত্ব। নিপীড়িত মানুষের পাশে দাঁড়ানো যীশুখ্রিষ্টের মহান বাণী। তার কথা শুনে এলাকাবাসী উদ্বুদ্ধ হয়ে তাদের মত পাল্টালেন এবং ফাদারের সঙ্গে এককাতারে দাঁড়ালেন। ফাদার রিগন তার চিকিৎসা কেন্দ্রটিকে নতুন করে ঢেলে সাজালেন। কেন্দ্রের ডাক্তার ও নার্সদের নিয়ে যুদ্ধপীড়িত ও যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধাদের চিকিৎসা সেবায় ঝাঁপিয়ে পড়লেন। কৌশল হিসেবে যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধাদের চিকিৎসা দিতে লাগলেন রাতের বেলায়। যুদ্ধপীড়িত মানুষের আশ্রয় ও খাবারেরও ব্যবস্থা করলেন তিনি। মৃত্যুর ঝুঁকি জেনেও তিনি নিবেদিত ছিলেন মানবসেবায়।

মুক্তিযুদ্ধের দ্বিতীয় বৃহত্তম গেরিলা বাহিনী ছিল হেমায়েত বাহিনী। বাহিনীপ্রধান হেমায়েত উদ্দিন বীর বিক্রমকেও চিকিৎসা সেবা দিয়ে বাঁচিয়েছিলেন ফাদার রিগন। হানাদারদের সঙ্গে এক সম্মুখযুদ্ধে হেমায়েত উদ্দিনের মুখম-লে গুলিবিদ্ধ হয়। তার মুখের বাম পাশ দিয়ে গুলি ঢুকে ডান চোয়ালের ১১টি দাঁত পড়ে যায়। জিহ্বার একটা টুকরাও পড়ে যায়। দুঃসাহসিক এই যোদ্ধাকে ফাদার রিগন চিকিৎসা সেবা দিলেন সেই উত্তাল দিনে।

এ প্রসঙ্গে হেমায়েত উদ্দিন বীর বিক্রম ফাদার রিগন সম্পর্কে বলেন, সেই দৃশ্য আজো আমার মনে পড়ে। মুক্তিযুদ্ধে গুরুতর আহত অবস্থায় ফাদার রিগনের কাছ থেকে যদি চিকিৎসাসেবা না পেতাম হয়ত আমি      বাঁচতে নাও পারতাম। আমি না বাঁচলে আমার ৫৫৫৮ জন মুক্তিবাহিনী সঠিক নেতৃত্বহীনতায় বিভ্রান্ত হতো। হেমায়েত বাহিনী একমাত্র বাহিনী যারা ভারতের মাটিতে না গিয়ে বাংলাদেশে থেকেই যুদ্ধ সংঘটিত করে। মুক্তিযুদ্ধে ফাদার রিগনের কথা কখনোই ভুলবার নয়। আমি মনে করি, ফাদার রিগনও একজন মুক্তিযোদ্ধা।

ফাদার রিগন মুক্তিযুদ্ধকালীন নিয়মিতভাবে ডায়েরি লিখতেন। তার মুক্তিযুদ্ধকালীন তার ডায়েরি বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম দলিল। তার ডায়েরিতে সাক্ষী হয়ে রয়েছে পাক হানাদারদের বর্বরতার কথা।

তার ডায়েরি থেকে কিয়ৎ অংশ উদ্ধৃত করছি : ১৯৭১ সালের ১২ জুন সকাল ৮টায় ২৩ জন মিলেটারিবিশিষ্ট দুটি লঞ্চ জলিলপাড়ে ভিড়ল। তাদের সঙ্গে কয়েকজন বাঙালিও ছিল। সৈন্যরা সমস্ত বাজার আগুন দিয়ে পোড়াল । শুধু বাজার নয়, তারা গ্রামে ঢুকে কলিগ্রামের ৫০টি, জলিলপাড়ের ১৮টি এবং বনগ্রামের ২৬টি বাড়ি আগুন দিয়ে পুড়িয়ে দিল। বাজারে একজন ক্যাথলিক খ্রিষ্টানকে দা দিয়ে কুপিয়ে হত্যা করা হলো। কলিগ্রামের পাষাণের ছেলে রবিদাস কোনো মতে জীবন বাঁচাল। তারা কলিগ্রাম অক্সফোর্ড মিশনের স্যামুয়েল বিশ্বাসকেও আঘাত করল। বনগ্রামে মিলিটারিরা ৪ জনকে হত্যা করে। শিশির, তন্ময়, উপেন দাস, বাবু মালাকার, নারায়ণ বাড়ৈ এবং আরো অনেককেই আহত করল। বিকেলে তারা ধ্বংসযজ্ঞ শেষ করে ৬টি খাসি ও অনেক জিনিসপত্র নিয়ে গ্রাম ত্যাগ করল। এই বীভৎস ধ্বংসযজ্ঞের পর আমি ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারগুলোকে দেখতে গেলাম। কী করুণ সে আর্তনাদ! বাঁচার জন্য মানুষের কী আকুতি! ...

২০০৬ সালে মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর আয়োজিত একটি অনুষ্ঠানের মাধ্যমে ফাদার রিগন তার ইতালীয় ভাষায় লিখিত ডায়েরি এবং ডায়েরির ইংরেজি অনুবাদ ও মুক্তিযুদ্ধকালীন তার হাতে তোলা আলোকচিত্র জাদুঘরকে দান করেন।

মুক্তিযুদ্ধবন্ধু ফাদার রিগনের পরিচয় বহুমাত্রিক। তিনি একাধারে অনুবাদক, গবেষক, সমাজসেবক, শিক্ষা উদ্যোক্তা এবং সর্বোপরি অসাধারণ এক সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব। তার জন্ম ১৯২৫ সালের ৫ ফেব্রুয়ারি ইতালির ভেনিসের অদূরে ভিল্লাভেরলা গ্রামে। তিনি কর্মসূত্রে এদেশে আসেন ১৯৫৩ সালে। দেশের নানা জায়গা ঘুরে অবশেষে স্থায়ীভাবে বসবাস করছেন সুন্দরবন ঘেঁষা মংলার শেলাবুনিয়া গ্রামে। ২০০৮ সালে সরকার তার অসাধারণ অবদানের জন্য প্রদান করে বাংলাদেশের সম্মানজনক নাগরিকত্ব।

২০১২ সালে মুক্তিযুদ্ধে অনন্য অবদানের জন্য রাষ্ট্রীয়ভাবে তাকে প্রদান করা হয় মুক্তিযুদ্ধ মৈত্রী সম্মাননা। এছাড়াও দেশে-বিদেশে অসংখ্য পুরস্কার ও সম্মাননায় ভূষিত হয়েছেন তিনি।

ফাদার রিগন একজন খ্রিষ্ট সন্ন্যাসী হলেও তার ধ্যান-জ্ঞান রবীন্দ্রনাথ ও লালনের মতো। তাই তিনি অকপটে বলেছেন, রবীন্দ্রনাথ তার মাথায় আর লালন থাকে তার অন্তরে। এই হলো আমাদের মুক্তিযুদ্ধবন্ধু ফাদার মারিনো রিগন।

রবীন্দ্রনাথের মতো করেই তিনি বলেন, মোর নাম এই বলে খ্যাত হোক, আমি তোমাদেরই লোক।

 

লেখক : ফাদার মারিনো রিগনের প্রিয় বন্ধু পুঁথি শিল্পী কাব্য কামরুল।


** লেখার মতামত লেখকের। একুশে টেলিভিশনের সম্পাদকীয় নীতিমালার সঙ্গে লেখকের মতামতের মিল নাও থাকতে পারে।
Ekushey Television Ltd.










© ২০২৪ সর্বস্বত্ব ® সংরক্ষিত। একুশে-টেলিভিশন | এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি