ঢাকা, শনিবার   ২৩ নভেম্বর ২০২৪

‘মুক্তিযুদ্ধের প্রেরণা ছিল বঙ্গবন্ধুর ভাষণ’

একুশে টেলিভিশন

প্রকাশিত : ১৯:৩০, ২৯ ডিসেম্বর ২০১৭ | আপডেট: ১৮:৩২, ১৩ জানুয়ারি ২০১৮

মহান স্বাধীনতা যুদ্ধে মুক্তিকামী মানুষের মনে প্রেরণা যুগিয়েছিল জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ৭ই মার্চের ভাষণ। বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণে উদ্বুদ্ধ হয়ে জাতি দলমত বির্বিশেষে এক কাতারে দাঁড়িয়েছিল (স্বাধীনতা বিরোধীরা ছাড়া)। বঙ্গবন্ধু সাড়ে সাত কোটি বাঙালিকে আহবান জানিয়েছিলেন, শত্রুর মোকাবেলায় পাড়ায় পাড়ায় আওয়ামী লীগের নের্তৃত্বে সংগ্রাম পরিষদ গড়ে তুলতে।

এই মন্ত্রে দীক্ষিত বাঙালি জাতি চূড়ান্ত বিজয় অর্জনে তাঁর নের্তৃত্বে একটি স্বপ্ন বাস্তবায়নে সংকল্পবদ্ধ ছিল। তারই অনুপ্রেরণায় যুদ্ধের দিনগুলোতে আমরা হাজারো মায়ের কান্না, শিশুর আর্তনাদ ও বোনের হাহাকারের প্রতিশোধ নিতে শত্রুর মোকাবেলা করেছিলাম।

পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর নিষ্ঠুর বর্বরতা ইতিহাসখ্যাত চিঙ্গিস খানের বর্বরতাকেও হার মানিয়েছিল। যে কারণে মুক্তিযুদ্ধাদের যুদ্ধজয়ের সংকল্প আরও তীব্রতা লাভ করেছিল। গোটা বাংলাদেশই তখন ছিল রণাঙ্গন । আমরা (গেরিলারা) যথন শত্রু নিধনে ছড়িয়ে পড়েছিলাম, তখন পাকিস্তানি ও তাদের দোসরদের নিরীহ বাঙালির উপর চালানো অত্যাচারের চিত্র মুক্তিযোদ্ধাদের শত্রু আক্রমণে আরো বেপরোয়া করে তুলত। আরো শাণিত করত আমাদের যুদ্ধজয়ের চেতনা।

সেদিন আমারা বাংলার মাঠে-ঘাটে, নদীতে, রাস্তার পাশে পড়ে থাকতে দেখেছি নীরিহ বাঙালি কৃষক, শ্রমিক, ছাত্র, নারী-বৃদ্ধ ও শিশুর অগণিত পরিত্যক্ত লাশ। এ ছিল পাকিস্তান হানাদার বাহিনী ও তাদের দোসরদের নির্মম নির্যাতনের এক বেদনাদায়ক চিত্র। দেখেছি স্বজনহারাদের অসহায় আর্তনাদ ও আহাজারি । মা-বোনের চোখে দেখেছি নির্বাক অশ্রু। এর মধ্যেই এরাই মুক্তিযোদ্ধাদের দিয়েছিল খাদ্য-বস্ত্র-আশ্রয় ও সহায়তা। সেদিন মা-বোনেরা জায়নামাজে বসে দু’হাত তুলে দোয়া ও নিভৃত অশ্রু বিসর্জন করেছিলেন। একটা অপারেশন শেষ করার কিছু দিন পর আমরা যখন ওই এলাকায় যেতাম, তখন খবর নিয়ে জানতে পারতাম, পাক হানাদার বাহিনী ও তাদরে এ দেশীয় দোসররা ওই এলাকায় কারো বাড়ি জ্বালিয়ে দিয়েছি, কোথাও মা-বোনদের উপর অত্যাচার চালিয়েছে, কোথাও বা উঠিয়ে নিয়ে গেছে তাদের।

এর পাশাপাশি চালিয়েছিল গণহত্যা। এটা ছিল তখন গোটা বাংলাদেশ তাদের নিত্য-নৈমিত্যিক অত্যাচার ও নিষ্ঠুরতার দৃশ্য। তাই কত বীরের রক্তধারা, কত মায়ের অশ্রু, হাজারও বোনের হাহাকার, শিশুর আর্তনাদ আর এতিমের ঝাপসা দৃষ্টিতে আচ্ছন্ন হয়ে আছেন এই ত্যাগের সংগ্রামী ঐতিহ্য।

প্রতিরোধ যু্দ্ধ কিন্তু ২৫ মার্চ রাত থেকেই শুরু হয়ে গিয়েছিল। সেদিন ইপিআর, পুলিশ, মুজাহিদ, আনাসার ও সশস্ত্র বাহিনীর সদস্যরা, ছাত্র জনতা, কৃষক , শ্রমিক তথা সর্বস্তরের জনগণ একাকার হয়ে কোনো পূর্বপ্রস্তুতি ছাড়াই নিজ নিজ এলাকয় দুর্বার প্রতিরোধ গড়ে তুলেছিল।

৭ মার্চ বঙ্গবন্ধুর ভাষণ ছিল প্রেরণার মূল উৎস। এ প্রতিরোধ যুদ্ধের ধারাবাহিকতায় প্রায় দু’সপ্তাহ সময়কালের মধ্যে একই উদ্দীপনা ও বুক ভরা সাহস ও শপথ নিৃয়ে পদার্পণ করল পরিকল্পিত স্বাধীনতা যুদ্ধের মূল পর্বে।

গেরিলা কায়দায় অ্যামবুশ, রেইড, গ্রেনেড অ্যাকশন, অনেক সময় সম্মুখ আক্রমণ সংঘবদ্ধভাবে বেড়েই চলছিল। আমার নের্তৃত্বে বৃহত্তম নোয়াখালীর (ফেনী, নোয়াখালী, লহ্মীপুর) গেলিলা ও সম্মুখ যুদ্ধের কিছু বিবরণ এ বইয়ের রণাঙ্গনে এক প্রান্তর অধ্যায়ে উল্লেখ রয়েছে।

রণাঙ্গনে সকল শহিদদের আমি এখনও শ্রদ্ধার সাথে স্মরণ করি। শহিদদের স্বপ্নসাধ এখনও বাংলাদেশে পুরো বাস্তাবয়িত হয়নি। আমরা সহযোদ্ধারা এখনও তাদের অর্তনাদ শুনতে পাই। তারা সেদিন আমাদেরকে উদ্দেশ্য করে বলে গিয়েছিল “ আমরা আমাদের বর্তমানকে উৎসর্গ করলাম, তোমাদের ভবিষ্যতের জন্য- ঘরে ঘরে গিয়ে সবাইকে এখথা শুণাবে।” এই শহিদদেরও একটি ভবিষ্যৎ ছিল। তাদেরও পরিবার-পরিজনকে নিয়ে সুখী সমৃদ্ধ জীবন-যাপনে একটি লালিত বাসনা ছিল। তারা দেশকেও ভালোবাসত, নিজের হাতে নিজের দেশকে স্বপ্নের মতো গড়ে তুলবে-এটাই ছিল তাদের তাদরে প্রত্যাশা । মোরা একটি ফুলকে বাঁচাবো বলে যুদ্ধ করি, মোরা একটি মুখের হাসির জন্য অস্ত্র ধরি ”-এই ছিল তাদরে দৃপ্ত শপথ ।

আজ তারা আমাদের মাছে নেই, তাই স্বাভাবিভাবে প্রশ্ন জাগে, আমাদের নিজের বিবেকের কাছে এই শহিদদের অর্পিত দায়িত ও তাদের স্বপ্নসাধ আমরা কতটুকু বাস্তবায়ন করতে পেরেছি।

সামাদ ছিল একজন ছাত্র। তার নের্তৃত্বে প্রশিক্ষিত ৫ জন মুক্তিযোদ্ধার একটি দল অক্টোবর/নভেম্বরের দিকে বিলোনিয়া রণাঙ্গণে আমার নিকট রিপোর্ট করে। আমি তাদরকে ১০ম ইস্ট বেঙ্গলে রেজিমেন্টের সশস্ত্র বাহিনী, পুলিশ, আনসার, ইপিআর, মুজাহিদ মিলে প্রায় ২ হাজার যোদ্ধা ছিল।

আমার অদিনায়কত্বে ১০ম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টে পাইনোওনিয়ার প্লাটুনসহ শত শত গণযোদ্ধা ছিল । সেদিন আমি সামাদকে দেখেছি সব সময় হাসিখুসি থাকতে, তাবে দায়িত্ব পালনে সে ছিল নির্ভীক এক সাহসী দুর্ধর্ষ যোদ্ধা । আমি যখন কোনো শত্রুর অবস্থান রেকির জন্য যেতাম অনেকের মধ্যে আমি সামাদকেও নিয়ে যেতাম। প্রায়ই অবসরে তার সাতে কুশল বিনিময় করতাম। একদিন সে অমাকে বলেছিল- বাড়িতে তার বাবা-মায়ের সাথে এক ছোট বোন ও এক ভাই আছে। বাড়ি তার সেনবাগ।

তার আশা ছিল যুদ্ধ শেষে সে ফিরে যাবে তার বাবা-মা ও আদরের ছোট ছোট বোনের কাছে। যুদ্ধে যোগদানের জন্য মা-বাবার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে আমার সময় তারা তাকে জড়িয়ে ধরে দোয়া করেছিল এবং বাড়ি ছেড়ে আসার প্রাক্কালে তার ছোট ভাই-বোনেরা তাকে হাত নেড়ে বিদায় জানিয়েছিল। রণাঙ্গনে আলাপকালে সেদিন সে অমাকে অগ্রিম দাওয়াত দিয়ে রেখেছিল এবং আবদার করে অনেক আগ্রহ সহকারে বলেছিল, স্যার-যুদ্ধ শেষে আপনি আমাদের বাড়িতে আসবেন।

আমি তাকে কথা দিয়েছিলাম। তার কিছু দিন পরে আমাদের দ্বিতীয় বিলোনিয়া যুদ্ধ শুরু হওয়ার আগ মুহূর্তে কয়েকজন সশস্ত্র বাহিনীর সদস্য ও গণযোদ্ধাদের সাথে সামাদকে পশুরাম ও চিতোলিয়ার শত্রুর অবস্থান রেকি / পরিদর্শন করার জন্য পাঠানো হয়েছিল। শত্রুর অবস্থানের কাছাকাছি পৌঁছার আগেই এ রেকি দলটি শত্রুর পক্ষের অ্যাম্বুসে পড়ে। শুরু হয় চারদিক থেকে গোলাগুলি।

সামাদ তার দলের বাকি সদস্যদেরকে বাঁচানোর জন্য তার নিজের অবস্তান থেকে কাভারিং ফায়ার দিচ্ছিল। অ্যাম্বুস শত্রু পক্ষের অনেকেই হতাহত হয়েছিল। সামাদের অসাধারণ সাহসী ভূমিকায় আমাদের রেকি দলের বাকি সদস্যরা কাভারিং ফায়ারের বদৌলতে সেদিন বেঁচে গিয়েছিল। তখন বাকিরা কিছুটা কৌশলগত অবস্থান পরিবর্তন করে শত্রু পক্ষকে সম্পূর্ণভাবে ঘায়েল করতে সক্ষম হয়েছিল। শত্রু পক্ষের আশাপাশির ঘাঁটি থেকে আগত আরেকটি দলের আক্রমণের মুখে পড়ে।

সামাদ তাদেরকেও প্রতিহত করার জন্য শেষ পর্যন্ত লড়ে গিয়েছিল এবং বীরত্বের সাথে লড়তে লড়তে শেষ বিদায় নিল। সামাদের আর ফিরে যাওয়া হলো না মা-বাবার কোলে, চিরতরের জন্য বঞ্চিত হলো তার ভাই-বোন তার আদর থেকে।

 

এম/আর


** লেখার মতামত লেখকের। একুশে টেলিভিশনের সম্পাদকীয় নীতিমালার সঙ্গে লেখকের মতামতের মিল নাও থাকতে পারে।
Ekushey Television Ltd.










© ২০২৪ সর্বস্বত্ব ® সংরক্ষিত। একুশে-টেলিভিশন | এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি