মুক্তিযুদ্ধে বিরোধীতাকারীদের ভাষাসৈনিক বলতে রাজি নই
প্রকাশিত : ২৩:৫১, ৩১ জানুয়ারি ২০১৮ | আপডেট: ১২:৪০, ১ ফেব্রুয়ারি ২০১৮
ভাষা সৈনিকদের স্মৃতি সংরক্ষণ ও ভাষা আন্দোলনের ইতিহাস নিয়ে গবেষণা করছে ‘`ভাষা আন্দোলন গবেষণা কেন্দ্র ও জাদুঘর’। ১৯৫২ সালের রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদের আহবায়ক কাজী গোলাম মাহবুব তার নিজ বাড়িতে (রাজধানীর ধানমন্ডিতে) এটি প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। ভাষা আন্দোলন গবেষণা কেন্দ্র ও জাদুঘরের নির্বাহী পরিচালক হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন এম আর মাহবুব।
সাম্প্রতিক সময়ে ভাষা আন্দোলন নিয়ে যারা গবেষণামূলক কাজ করছেন তাদের মধ্যে অগ্রণী ভূমিকায় রছেন তিনি। এপর্যন্ত ভাষা আন্দোলনের বিভিন্ন দিক নিয়ে তার লেখা ও সম্পাদনায় প্রকাশিত হয়েছে ৫২টি গ্রন্থ। সারাদেশ থেকে খুঁজে খুঁজে প্রায় ২০০জন ভাষা সৈনিকের স্মৃতিচারণমূলক সাক্ষাৎকার নিয়েছেন তিনি।
ভাষা আন্দোলন সংক্রান্ত গবেষণামূলক কাজের বিভিন্ন দিক নিয়ে তার সাক্ষাৎকার নিয়েছেন একুশে টেলিভিশন অনলাইনের প্রতিবেদক আলী আদনান।
একুশে টেলিভিশন অনলাইন: ভাষা সৈনিক কাজী গোলাম মাহবুব প্রতিষ্ঠিত এ প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে কীভাবে যুক্ত হলেন?
এম আর মাহবুব: ভাষা সৈনিক কাজী গোলাম মাহবুবের সঙ্গে আমার পরিচয় প্রায় ত্রিশ বছর আগে। ১৯৮৭ সালে আমি রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন নিয়ে কাজ শুরু করি। তখন ভাষা আন্দোলন পরিষদ ও ভাষা আন্দোলন মিউজিয়াম নামে দুটো প্রতিষ্ঠান কাজ করত। সেই সূত্র ধরে ভাষা সৈনিকদের সঙ্গে পরিচিতি ঘটে। তখন আমার আগ্রহ জাগে ভাষা সৈনিক যারা ছিলেন তাদের সাক্ষাৎকার নিতে হবে। তখন আমি রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদের আহবায়ক ও তমুদ্দিন মজলিশের প্রতিষ্ঠাতা প্রিন্সিপাল আবুল কাশেম, শামসুল আলম, শাহেদ আলী, সানাউল্লাহ নূরীসহ অনেক ভাষা সৈনিকের সাক্ষাৎকার নিয়েছি। আজকে তাদের অনেকেই প্রয়াত। সেই সূত্র ধরেই কাজী গোলাম মাহাবুবের সাক্ষাৎকার নেওয়ার জন্য তার ধানমণ্ডির বাড়িতে আসি। পরবর্তীতে এ প্রতিষ্ঠানে সার্বক্ষণিকভাবে আমি যোগদান করি।
একুশে টেলিভিশন অনলাইন: কাজী গোলাম মাহাবুব কী কী কাজ করতেন?
এম আর মাহবুব: কাজী গোলাম মাহাবুব ১৯৫২ সালে রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদের আহবায়ক ছিলেন। আপনারা জানেন, রাষ্টভাষা সংগ্রাম পরিষদ প্রথম গঠিত হয় ১৯৪৭ সালের ৩০ ডিসেম্বর। এর আহবায়ক ছিলেন ড. নুরুল হক ভুঁইয়া। ১৯৪৮ সালের ২ মার্চ সর্বদলীয় সংগ্রাম পরিষদ গঠিত হয়।
১৯৫২ সালের ৩১ জানুয়ারি সর্বদলীয় সংগ্রাম পরিষদ গঠিত হয়। এর আহবায়ক কাজী গোলাম মাহাবুব। তিনি এর আগে ছাত্রলীগ নেতা ছিলেন।
পরবর্তীতে তিনি কখনো রাজনীতিতে জড়াননি। আইন পেশায় নিজেকে নিয়োজিত রেখেছিলেন। বার কাউন্সিলের সভাপতি ছিলেন। ভাষা আন্দোলনকে বাঁচিয়ে রাখার জন্য, ভাষা আন্দোলনের স্মৃতি রক্ষার জন্য তিনি অত্যন্ত মহৎ একটি উদ্যোগ গ্রহণ করেছিলেন। তার সেই উদ্যোগ `ভাষা আন্দোলন গবেষণা কেন্দ্র ও জাদুঘর`। ২০০৬ সালের ১৯ মার্চ কাজী গোলাম মাহাবুব মারা যান। তার মৃত্যুর পর তার স্ত্রী পিয়ারী মাহাবুব ও সন্তানরা একটি ট্রাস্ট্রের মাধ্যমে প্রতিষ্ঠানটি চালু রাখার ব্যবস্থা করেন। বর্তমানে এটি কাজী গোলাম মাহাবুব ফাউন্ডেশনের মাধ্যমে পরিচালিত হচ্ছে।
একুশে টেলিভিশন অনলাইন: চলার পথে কেমন প্রতিবন্ধকতার মুখোমুখি হয়ে থাকেন?
এম আর মাহবুব: এরকম একটি গবেষণা কেন্দ্র বা জাদুঘর সীমিত সামর্থ্যে চলা সম্ভব নয়। তারপরও অনেক ভাষা সৈনিক, শুভানুধ্যায়ী আমাদেরকে নানা ভাবে সহযোগিতা করে থাকেন।
একুশে টেলিভিশন অনলাইনঃ সাধারণত কোন ধরনের কাজ এখান থেকে করা হয়?
এম আর মাহবুবঃ আমরা মূলত গবেষণামূলক কাজে বেশি গুরুত্ব দিয়ে থাকি। ভাষা আন্দোলনের নানা ধরনের দলিল, ভাষা সৈনিকদের ব্যবহৃত নানা ধরনের স্মৃতিচিহ্ন এসব সংগ্রহমূলক কাজ করা হয় এখান থেকে। সাম্প্রতিক সময়ে ভাষা আন্দোলনে সংবাদপত্রের ভূমিকা শীর্ষক এক হাজার পৃষ্ঠার বড় একটি গ্রন্থ আমরা গ্রন্থণা ও সম্পাদনা করেছি। বইটিতে ১৯৪৭ থেকে ১৯৫৬ সাল পর্যন্ত ভারত ও তৎকালীন পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের প্রথম সারির সংবাদপত্রগুলোর ভূমিকা পেপার কাটিংসহ ছাপানো হয়েছে। এই কাজটি আমার বার বছরের শ্রমের ফসল।
একুশে টেলিভিশন অনলাইন: এ কেন্দ্রে কী কী দুর্লভ সংগ্রহ পাওয়া যায়?
এম আর মাহবুব: ভাষা আন্দোলনের প্রথম যে পুস্তিকা `পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা বাংলা না উর্দু` ১৯৪৭ সালে তমুদ্দুন মজলিস কর্তৃক প্রকাশিত হয়েছিল। এটির মূল কপি আমাদের কাছে আছে। ভাষা আন্দোলনে মুখপত্র সাপ্তাহিক সৈনিক পত্রিকার মূল কপিগুলো আমরা সংগ্রহ করেছি। একুশের সংকলনের প্রথম কপিটি আমরা সংগ্রহ করেছি। একুশের ছবিগুলো আমরা সংগ্রহ করেছি। একুশের ছবি খুঁজতে গিয়ে সাত-আটটি অপ্রকাশিত ছবি পেয়েছি। তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্যারাক। ১২ নং ব্যারাকের সামনে বরকত গুলিবিদ্ধ হয়। এই ব্যারাকের ছবি কোথাও ছিলনা। মূল ছবি না থাকায় তৎকালীন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জিএস শরফুদ্দিন আহমেদ ও ভাষা সৈনিক আহমেদ রফিকসহ সাত-আটজন মিলে একটি ছবি এঁকেছিলেন। আমরা সেই মূল ছবি সংগ্রহ করেছি। প্রথম শহীদ মিনারের ছবি তুলেছিলেন আমেরিকা প্রবাসী ডা: এ হাফিয। তার কাছ থেকে প্রথম শহীদ মিনারের ছবি সংগ্রহ করেছি। ছবিগুলো সংগ্রহের ক্ষেত্রে অধ্যাপক রফিকুল ইসলাম, আমানুল হক, আজম তকিউল্লাহ অনেক সহযোগিতা করেছেন।
একুশে টেলিভিশন অনলাইন: এ পর্যন্ত আপনি কতগুলো প্রকাশনা নিয়ে কাজ করেছেন? কাজের ধরনটা কেমন?
এম আর মাহবুব: আমি ঢাকা ও ঢাকার বাইরে ভাষা সংগ্রামে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করেছিলেন এরকম সাড়ে তিনশ ভাষা সৈনিকের সাক্ষাৎকার নিই। এর মধ্য থেকে বাছাইকৃত দুইশ সতের জনের সাক্ষাৎকার নিয়ে গ্রন্থ প্রকাশ করি।
একুশে টেলিভিশন অনলাইন: এই সাক্ষাৎকার সংগ্রহের কাজে কোনো ধরনের সমস্যার সম্মুখীন হয়েছিলেন কী না?
এম আর মাহবুবঃ সমস্যা তো হয়েছেই। কখনো কখনো কোনো ভাষা সৈনিকের ছবি সংগ্রহের জন্য মাসের পর মাস অপেক্ষা করতে হয়েছে। অনেক ভাষা সৈনিকের পরিবারের সদস্যরা এসব ব্যপারে সচেতন না। সঠিক গোছানো তথ্য দিতে পারেনা।
একুশে টেলিভিশন অনলাইন: মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস বিকৃত হচ্ছে। কিন্তু ভাষা আন্দোলনের ক্ষেত্রে এ অভিযোগ কী তোলা যায়?
এম আর মাহবুবঃ অবশ্যই। আমি সাক্ষাৎকার নিতে গিয়ে একরকমের তথ্য পেয়েছি, এখন দেখা যাচ্ছে ভিন্ন রকমের তথ্য আসছে। এমন উদাহরণ কম নয়। অনেক ক্ষেত্রে দেখা যাচ্ছে, স্বয়ং ভাষা সৈনিকদের বক্তব্যেও গরমিল আছে। আমি কাউকে দোষ দিচ্ছিনা। আমার ধারণা, সময়ের ব্যবধানে ভাষা সৈনিকদের স্মৃতি মুছে যেতে পারে। এটার জন্য বয়স দায়ী।
একুশে টেলিভিশন অনলাইন: আজকের বাংলাদেশে কতজন ভাষা সৈনিক এখনো জীবিত আছেন? আপনার গবেষণার জায়গা থেকে বলুন।
এম আর মাহবুব: অধিকাংশ ভাষা সৈনিক প্রয়াত। ঢাকার বাইরে বিভিন্ন গ্রামে এখনো কতজন ভাষাসৈনিক আছেন এটার সঠিক সংখ্যা আমি বলতে পারব না। তবে ঢাকায় ৫০-৬০ জন ভাষা সৈনিক এখনো জীবিত আছেন বলে ধারণা করছি।
একুশে টেলিভিশন অনলাইন: আমরা মুক্তিযোদ্ধাদের রাষ্ট্রীয়ভাবে দাফন করি। তাদের ভাতা দিই। তাদের বংশধররা চাকরির ক্ষেত্রে সুবিধা পায়। কিন্তু ভাষা সৈনিকদের নিয়ে তেমন কোন মূল্যায়ন করা হয়নি। আপনি সাক্ষাৎকার নিতে গিয়ে তাদের মধ্যে কি কোনো হতাশা দেখেছেন?
এম আর মাহবুব: অবশ্যই। আমাদের রাষ্ট্রীয় স্বত্ত্বার প্রথম বীজ বপন হয় ১৯৫২ সালে ভাষা আন্দোলনের মাধ্যমে। ৫২ এসেছিল বলেই ৭১- এর রাস্তা তৈরি হয়েছে। কিন্তু আমরা ভাষা আন্দোলনের সৈনিকদের কোনো মূল্যায়ন করতে পারিনি। তাদের মধ্যেও নানা অবমূল্যায়নের কারণে হতাশা দেখা গেছে। কখনো গেজেট আকারে তাদের নাম প্রকাশিত হয়নি। ভাষা শহীদদের তালিকা প্রকাশিত হয়নি। রাষ্ট্রীয়ভাবে কখনো সম্মান দেওয়া হয়নি। তবে এত কিছুর মাঝেও কিছু সুখবর আছে। মাতৃভাষাপ্রেমী প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বাংলা ভাষাকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা করার ব্যাপারে উদ্যোগ নিয়েছিলেন। তার আমলে তার উদ্যোগেই বাংলা জাতিসংঘে দাপ্তরিক ভাষা করার প্রক্রিয়া চলছে। ২০০০ সালে পাঁচজন ভাষাসৈনিককে একুশে পদক দিয়েছেন। যা আর কেউ করেননি।
একুশে টেলিভিশন অনলাইন: স্বাধীনতার বীজ বপন করা হয় ১৯৫২ সালে। কিন্তু পরবর্তীতে মুক্তিযুদ্ধকালীন সময়ে এসে মুক্তিযুদ্ধের বিরোধীতা করেছেন এমন ভাষাসৈনিক পাওয়া যায়। এ ব্যাপারে কী বলবেন?
এম আর মাহবুব: আমাদের মূল বিষয় স্বাধীনতা। আমাদের আলাদা অস্তিত্ব, আলাদা জাতিস্বত্ত্বার স্বীকৃতি পাই মহান মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে। তাই যেসব ভাষাসৈনিকরা মুক্তিযুদ্ধে বিরোধীতা করেছেন তাদেরকে আমি ভাষাসৈনিক বলতে রাজি নই।
টিকে