ঢাকা, সোমবার   ২৩ ডিসেম্বর ২০২৪

মুজিববর্ষ হোক সামাজিক ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার বছর

মো. তাজুল ইসলাম

প্রকাশিত : ১২:৫৬, ১২ জানুয়ারি ২০২০ | আপডেট: ১৮:৩৯, ১২ জানুয়ারি ২০২০

বর্তমানে বাংলাদেশ জুডিসিয়াল সার্ভিস‘র বিচারক। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আইনে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর ডিগ্রি অর্জন করেছেন। তিনি আইন বিষয়ে গবেষণা করছেন এবং বিভিন্ন জাতীয় দৈনিক ও অনলাইন পত্রিকায় আইন ও বিচার সম্পর্কে নিয়মিত কলাম লেখেন।

কিউবার তৎকালিন প্রেসিডেন্ট ফিদেল কাস্ট্রোর একটি উক্তি দিয়ে শুরু করতে চাই। তিনি বলেছিলেন ‘আমি হিমালয় দেখি নাই বঙ্গবন্ধুকে দেখেছি।’

পাহাড়সম ব্যক্তিত্ব হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙ্গালী জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবার্ষিকীর ক্ষণগণনা ইতোমধ্যে শুরু হয়েছে। বাংলাদেশ সরকারের বিভিন্ন মন্ত্রণালয়, নানা বিভাগ ও অধিদপ্তর এই দিনটিকে পালন করছে নানা আয়োজনে, নানা স্লোগানে। 

পুলিশ বলছে- ‘মুজিব বর্ষের অঙ্গীকার, পুলিশ হবে জনতার।’

আইন ও বিচার বিভাগ দিবসটিকে ঘিরে নানা কর্ম পরিকল্পনা হাতে নিয়েছে। সে ক্ষেত্রে বিচার বিভাগের স্লোগান এ রকম হতে পারে- ‘মুজিব বর্ষের অঙ্গীকার, সামাজিক ন্যায় বিচার।’

সামাজিক ন্যায় বিচার কি এবং জাতির পিতা কিভাবে সামাজিক ন্যায় বিচার প্রতিষ্ঠা করতে চেয়েছিলেন? তা এই লেখার মধ্যে সবিস্তারে না হলেও মূল বক্তব্য তুলে ধরা হবে। বর্তমান পৃথিবীতে শান্তি ও নিরাপত্তার জন্য সামাজিক ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করা অত্যন্ত প্রয়োজন। ‘সামাজিক ন্যায়বিচার’র মূল লক্ষ্য হলো- প্রত্যেককে তার হক বা প্রাপ্য অংশ পরিপূর্ণভাবে দিয়ে দেয়া। এ ক্ষেত্রে ধনী-গরিব, উঁচু-নিঁচু, সাদা-কালো আরব-অনারব, সংখ্যালঘু-সংখ্যাগুরু, দল-মত নির্বিশেষে কেউ কোন রকম অন্যায়-অবিচার ও জুলুম-নির্যাতনের স্বীকার ও শিকার হবে না।

বঙ্গবন্ধু অনেকগুলো নীতি বাস্তবায়নে জোরালো পদক্ষেপ নিয়েছিলেন। তার মধ্যে সমাজতন্ত্র তথা সামাজিক ন্যায়বিচার ছিল চতুর্থ নীতি। বঙ্গবন্ধুর জীবদ্দশায় বিশ্বের দুটি সমাজ বিপ্লব সফল হয়েছিল। একটা মাও সেতুং’র নেতৃত্বে গণচীন ও অপরটা লেলিন’র নেতৃত্বে সোভিয়েত ইউনিয়ন প্রতিষ্ঠা।

সমাজতন্ত্রে মার্কসবাদী দর্শনের ভিত্তিতে আর্থ-সামাজিক ও রাজনৈতিক আজকের সেই সমাজতন্ত্রের পরিণতি দেখে বঙ্গবন্ধুর সময়ের বিদ্যমান বাস্তবতার তুলনা করা সমীচীন নয়।

সমাজবিজ্ঞানীরা মনে করেন, বঙ্গবন্ধু মার্কসবাদী দর্শনের দ্বারা প্রভাবিত হয়েছিলেন। তা না হলে শোষণমুক্ত সমাজের কথা তিনি উদাত্ত কণ্ঠে বলতেন না। তবে ষাট ও সত্তরের দশকে বঙ্গবন্ধু উপলদ্ধি করেছিলেন- ব্যক্তি মানুষ স্বার্থ, রাষ্ট্র ও সমাজে বিলিন হওয়া উচিত নয়। বঙ্গবন্ধু কোনো গন্ডির, দেশের বা বিশেষ দর্শনের নীতিতে বিশ্বাস করতেন না। তিনি ভাবতেন, নিজ দেশের জনগণের প্রয়োজন ও প্রত্যাশা অনুযায়ী অর্থনৈতিক কর্মসূচি গ্রহণ করতে হবে। সেই দর্শনে থাকবে শোষিত-বঞ্চিত, অবহেলিত ও সাধারণ মানুষের মুক্তির কথা। বঙ্গবন্ধু সেই পথ বাঙালিকে দেখিয়ে গিয়েছেন। প্রয়োজনে দৃঢ়তার সাথে বিদ্যমান প্রতিকূল অবস্থাকে মোকাবেলা করে বাস্তবতার সাথে সামজ্ঞস্যপূর্ণ আর্থ-সামাজিক পরিকল্পনা গ্রহণ ও বাস্তবায়ন। এই কাজটি শেখ হাসিনা শুরু করেছিলেন।

সারা জাতির উচিত তার নেতৃত্বে বিশ্বাসী হয়ে ঐক্যবদ্ধভাবে দেশ ও জাতি গঠনে কাজ করে যাওয়া। শেখ হাসিনা তার পিতার কর্মসূচি থেকে বিন্দুমাত্র সরে যাননি। বিশ্ব বাস্তবতার কারণে হয়তো কোনো সময়ে কৌশল অবলম্বন করতে হয়েছে মাত্র। বঙ্গবন্ধুর নির্দেশিত পথেই শেখ হাসিনা এগিয়ে চলেছেন এবং সামনের দিনগুলোতে চালাবেন। বঙ্গবন্ধুর সামাজিক ন্যায় বিচার এর চিন্তা চেতনার মধ্যে শোষণ মুক্ত সমাজ ব্যবস্থা ইসলামের ইতিহাসের সামাজিক ন্যায় বিচারের কনসেপ্ট এর সাথে মিলে যায় যা এখানে আলোকপাত করা জরুরি বলে মনে করি।

সেখানে দেখা গেছে আল্লাহর নির্দেশ মোতাবেক রাসূলুল্লাহ (সাঃ) সামাজিক ন্যায়বিচারের এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত স্থাপন করেন। আল্লাহর সার্বভৌমত্ব প্রতিষ্ঠা, সম্পদের সুষম বণ্টন, জীবন, সম্পদ ও সম্মানের নিরাপত্তা নিশ্চিতকরণ, পারস্পরিক ভালোবাসা ও ভ্রাতৃত্ব প্রতিষ্ঠা, সমাজের সকলের মাঝে প্রতিষ্ঠা প্রভৃতি কার্যাবলীর মাধ্যমে তিনি এক শান্তিময় সমাজ প্রতিষ্ঠা করেন। এর জন্য তিনি শরীয়তের বিধান যেমন কার্যকর করেন, তেমনি সকলকে আখিরাতমূখী চিন্তায় উদ্বুদ্ধ করেন। আখিরাতের কঠিন জবাবদিহিতার ব্যাপারে সকলকে সতর্ক করেন। এভাবে সামাজিক ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে তিনি এমন এক শান্তিময় সমাজ প্রতিষ্ঠা করেন, যার দৃষ্টান্ত পৃথিবীর ইতিহাসে বিরল। আধুনিক বিশ্বে শান্তি প্রতিষ্ঠা করতে চাইলে আমাদের অবশ্যই রাসূলুল্লাহ স.-এর সামাজিক ন্যায়বিচারের দিকে লক্ষ্য করতে হবে এবং এর থেকে শিক্ষা নিয়ে তা বাস্তবায়ন করতে হবে। বাংলাদেশে সামাজিক ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠায় বিচার বিভাগকে পুরোপরি স্বাধীন প্রতিষ্ঠান হিসাবে কাজ করার সুযোগ দিতে হবে। কেননা ন্যায় বিচার প্রতিষ্ঠায় বিচার বিভাগকেই এগিয়ে আসতে হয়।
 
দেশ ও জাতিকে সঠিকভাবে পরিচালনা করতে সরকারের তিনটি অঙ্গ শাসন বিভাগ, আইন বিভাগ ও বিচার বিভাগের মধ্যে সমন্বয় সাধন করা অতীব জরুরি এবং সেটি করে দেশকে এগিয়ে নিতে হয়। শাসন বিভাগের আধিপত্য ব্রিটিশ আমল থেকে সুস্পষ্ট। যেটি সুশাসন প্রতিষ্ঠায় কোনদিনই কাম্য নয়। বিচার বিভাগের স্বাধীনতা খর্ব করে নয় বরং জাতির পিতার মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে তিলে তিলে গড়া স্বাধীন বাংলাদেশের স্বাধীন বিচার ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠায় মনোযোগী হওয়া। তাহলে সামাজিক ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা সহজসাধ্য হয়।
 

তাজুল ইসলাম- ফাইল ছবি

গণতন্ত্রকে শক্তিশালী করতে হলে নেতা নির্বাচনে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে গণতান্ত্রিক চর্চা সুসংহত করতে হবে, রাজনৈতিক দলগুলোর নেতাদের আরও বেশি জবাবদিহিতার আওতায় নিয়ে আসতে হবে। আধিপত্যে বিস্তার রোধে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী যে শুদ্ধি অভিযানের সূচনা করেছেন তাতে সকলের সমর্থন যোগানো উচিত। শুদ্ধি অভিযান যাতে আরও দীর্ঘায়িত হয় সে ব্যাপারে বঙ্গবন্ধুর আদর্শের সৈনিকদের সর্বাত্নক একাত্মতা ঘোষণা করাও জরুরি। জাতির পিতার গড়া আওয়ামী লীগকে জাতির সামনে একটি গণ কল্যাণমুখি রাজনৈতিক দল হিসাবে উপস্থাপন করতে হবে। শুধু নিজের আখের গোছানোর রাজনীতি না করে সত্যিকারের রাজনীতিবিদ হতে হবে। রাজনৈতিক দলগুলো তাদের আধিপত্য বিস্তার করা নিয়ে সময় ব্যয় না করে বরং বঙ্গবন্ধুর সামাজিক ন্যায় বিচার প্রতিষ্ঠায় মনোযোগী হলে দেশ উপকৃত হয়। তাহলে রাজনীতি, রাজনীতিবিদ, রাজনৈতিক দল তাদের পুরানো ঐতিহ্য ফিরাতে সক্ষম হবে। 

দেশের সামগ্রিক প্রশাসন বিভাগ, পুলিশ, আইনজীবী, ভূমি অফিস, ডাক্তার, বিচারক, কোর্ট স্টাফ, বিচারপ্রার্থী জনগণ তথা সরকার শুধু দিবস পালন করে ক্ষান্ত থাকলে হবে না। চিন্তা করার সময় এসেছে পুলিশ বিভাগের দীর্ঘকালীন প্রশ্নবিদ্ধ তদন্ত ব্যবস্থা, প্রশ্নবিদ্ধ মেডিকেল রিপোর্ট, জবাবদিহিহীন ওকালতি মোটাদাগে প্রশ্নবিদ্ধ প্রসিকিউশন, দুর্নীতিযুক্ত ভূমি প্রশাসন, আদালতের কর্মচারীদের যোগ্যতার ঘাটতি অর্থাৎ অযোগ্য লোককে নিয়োগ, মামলার সংখ্যা অনুপাতে বিচারকস্বল্পতা এবং স্বার্থপর ও আত্মকেন্দ্রিক সুবিধাবাদী জনগণ দিয়ে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা কোনোভাবেই সম্ভব নয়। সর্বক্ষেত্রে দুর্নীতি, অসততা, অসাধুতা, অনৈতিকতা, লোক ঠকানো, অসময়ানুবর্তিতা ও আইনের অপপ্রয়োগ দিয়েও ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব নয়। ১৭ কোটি জনগণের জন্য মাত্র ১ হাজার ৭০০ জন বিচারক দিয়ে সামাজিক ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করতে হলে দেশের বিদ্যমান আইন, দেওয়ানি ও ফৌজদারি বিচারপদ্ধতি ও বিচারের সঙ্গে জড়িত সব অংশীজনের (স্টেকহোল্ডার) মানসিক পরিবর্তন অতিব জরুরি।

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবার্ষিকী হোক বদলে যাওয়ার উপযুক্ত সময় এবং অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক ও সামাজিক ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার বছর।

বঙ্গবন্ধু যে সামাজিক ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার স্বপ্ন দেখতেন বা ভাবতেন, তা ক্যাসিনোতে সময় নষ্ট করে, টেন্ডারবাজিতে মনোযোগ দিয়ে, শিক্ষাঙ্গনে হত্যার রাজনীতি করে, কাউকে ‘বড় ভাই’ বলে তৈলমর্দন করে বাস্তবায়ন হবে না। সত্যিকার অর্থে বঙ্গবন্ধুর আদর্শের রাজনীতি ধারণ ও পালন করতে হবে। তাহলে জাতির পিতার কন্যা জননেত্রী শেখ হাসিনার ভিশন-২০২১ ও ২০৪১ এবং ইলেকশনের সময় ঘোষিত ইশতেহার বাস্তবায়ন হবে, এক কথায় দেশের উন্নয়ন ত্বরান্বিত হবে।

আরও বিশ্বাস করি, মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বিশ্বাসী রাজনীতিবিদদের হাত ধরেই গণতন্ত্র, উন্নয়ন ও সামাজিক ন্যায়বিচার শতভাগ নিশ্চিত হবে। ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠায় বঙ্গবন্ধু সব সময় সোচ্চার ছিলেন। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ন্যায়বিচারের কথা বলতে গিয়ে উল্লেখ করেন, ‘যদি কেউ ন্যায্য কথা বলে, আমরা সংখ্যায় বেশি হলেও সে একজনও যদি হয়, তার ন্যায্য কথা আমরা মেনে নেব।’

তাই ন্যায়বিচার নিশ্চিত করার জন্য সবাইকে যার যার অবস্থান থেকে কাজ করতে হবে। প্রতিটি রাষ্ট্রেরই ন্যায়বিচার নিশ্চিত করতে দায়-দায়িত্ব রয়েছে। তেমনি জনগণের আস্থার প্রতিও। মামলা-মোকদ্দমা দ্রুত নিষ্পত্তি করে বিচারকে আরও গতিশীল ও জনবান্ধব করতে বিচার বিভাগের দায়ভার রয়েছে। তাহলে বঙ্গবন্ধুর সামাজিক ন্যায় বিচার সুপ্রতিষ্ঠিত হবে।

লেখক: মো. তাজুল ইসলাম, বিচারক, বাংলাদেশ জুডিশিয়াল সার্ভিস
 


** লেখার মতামত লেখকের। একুশে টেলিভিশনের সম্পাদকীয় নীতিমালার সঙ্গে লেখকের মতামতের মিল নাও থাকতে পারে।
Ekushey Television Ltd.










© ২০২৪ সর্বস্বত্ব ® সংরক্ষিত। একুশে-টেলিভিশন | এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি