ঢাকা, রবিবার   ২০ এপ্রিল ২০২৫

Ekushey Television Ltd.

মুক্তিযুদ্ধে এক শহীদের মা

মৃত্যুর আগে প্রধানমন্ত্রীর দেখা চাই

আলী আদনান

প্রকাশিত : ১৬:১৮, ১ ডিসেম্বর ২০১৭ | আপডেট: ১৩:৪৫, ২ ডিসেম্বর ২০১৭

Ekushey Television Ltd.

মালিবাগ সংলগ্ন গুলবাগে স্বামীর রেখে যাওয়া বাড়ীতেই সময় কাটে তার। খাওয়া-ঘুম বা খুব প্রয়োজনীয় কাজ ছাড়া হাত থেকে তসবিহ রাখেন না। ছেলে, ছেলের বৌ, মেয়ে, মেয়ের জামাতা, নাতি- নাতনী সবাই তাকে ঘিরে আছে। তবু কোথায় যেন শুন্যতা। কী যেন নেই। রক্তাক্ত সময় এখনো তাড়া করে তাকে। তিনি সব সময় চুপচাপ থাকেন।

বয়স ঠিক গুনে গুনে বলা না গেলেও অনুমান করা হয় ৯০ পার হয়েছে বেশ কয়েক বছর আগে। চেহারায় সারল্য ও এক কঠিন ব্যক্তিত্বের মিশ্রন তার সর্বাঙ্গে। তিনি একজন মা। তবে তাঁর আসল পরিচয়, তিনি একজন শহীদের মা। মুক্তিযুদ্ধের শহীদ ফারুক ইকবাল তার সন্তান। মুখ ফুটে তিনি হয়ত চিৎকার করেন না বা করবেন না। তবে তার বলার সুযোগ আছে, ”তিনি মুক্তিযুদ্ধে প্রথম শহীদের মা”।

বিয়ের পর স্বামীর চাকরীর কারনে নানা জায়গায় ঘুরতে হয়েছে তাকে। তবে মালিবাগের বাড়ীটাতে তার ঠিকানা হয়েছে মুক্তিযুদ্ধের অনেক আগেই। এই বাড়ীতেই তিনি স্বামী হারিয়েছেন। আর হারিয়েছেন, নাড়ী ছেঁড়া ধন- সন্তান। আজীবন একটি আক্ষেপ তাড়া করেছে তাকে। আজো তাড়া করে। এই রোগা শরীরেও তিনি দুধ খাননা। দুধ তাঁর দুচোখের বিষ!

আজ পৃথিবীর কাছে তার খুব বেশী কিছু চাওয়ার নেই। তিনি শুধু একটিবার, শুধু একটিবার দেশের প্রধানমন্ত্রীকে ছুঁয়ে দেখতে চান। যে বঙ্গবন্ধুর ডাকে ছেলে এক ভোরে কিছু না খেয়ে ঘর ছেড়েছিল, সেই বঙ্গবন্ধুর রক্ত আছে আজকের প্রধামন্ত্রীর শরীরে। সেই রক্তের ডাক তিনি তার ভিতরে শুনতে পান। একটিবার, শুধু একটিবার তিনি প্রধানমন্ত্রীকে ছুঁয়ে দেখতে চান।

গুলবাগের একটি মধ্যবিত্ত পরিবার ও বেপরোয়া সময়

রাজধানী ঢাকার মালিবাগ সংলগ্ন গুলবাগ এলাকায় স্ত্রী- পুত্র নিয়ে বসবাস করতেন আফছার উদ্দিন আহমেদ। আফছার উদ্দিন সাহেব কাষ্টমস এ চাকরী করেন। সাদাসিধে মানুষ। পাঁচ ছেলে তিন মেযে নিয়ে সুখেই বাস করেন। তাঁর দ্বিতীয সন্তান ফারুক ইকবাল। সাহসী ও ডানপিঠে। ছাত্রলীগ করেন। আবুজর গিফারি কলেজ চাত্র সংসদের জিএস। বযস সবসাকুল্যে আঠার। অন্য সব তরুণের মত সেও বিশ্বাস করে পাকিস্থানীদের সাথে আমাদের আর হবেনা। দেশস্বাধীন করাই এখন আমাদের একমাত্র পথ। শুধু বঙ্গবন্ধুর নির্দেশের অপেক্ষা। ফারুক ইকবালের গড়ন ছোট খাট। নাকের নিচে সদ্য উঠা মোচের রেখা দেখা যায়। সাংগঠনিক দক্ষতা খুব ভাল। কলেজে যেমন জনপ্রিয়, তেমনি মৌচাক, মালিবাগ, মগবাজার, খিলগাঁও, শান্তিবাগ এলাকায় তার প্রচুর বন্ধুবান্ধব। ফারুক ইকবালের দিন রাতের বড় সময়টি বন্ধুদের সাথেই কাটে। দলে নতুন নতুন ছেলে ভিড়ানো ও তাদের কানে স্বাধীনতার মন্ত্র ঢেলে দেওয়া সদ্য কৈশোর পার হওয়া এই তরুনের কাজ।  ঢাকার পাকিস্থানী প্রশাসন যেসব তরুণকে কালো তালিকায় রেখেছে বা যাদেরকে শত্রু মনে করে তাদের মধ্যে অন্যতম এই তরুণ।

৩র্মাচ, ১৯৭১

আফছার সাহেবের বাড়ীতে একটি কালো কুকুর ছিল। কুকুরটির দেখাশুনা করত আফছার সাহেবের মেজ ছেলে ফারুক ইকবাল। কয়েকদিন ধরে কুকুরটি কাঁদছে। গালে অশ্রুর দাগ। সেদিকে ফারুক ইকবালের মনোযোগ দেওয়ার সময় নেই। ১মার্চ ইয়াহিয়া সংসদ অধিবেশন বাতিল করেছে । তার মানে তারা বাঙ্গালীদের ক্ষমতায় যাওয়ার বৈধ দাবিকে মেনে নিচ্ছেনা। বাঙ্গালী ছাত্র সমাজের আন্দোলনের আগুণে যেন ঘি ঢেলে দিয়েছে কেউ। ফারুক ইকবালের মত অসংখ্য তরুণ এখন রাজপথে। ২তারিখ রাতে ফারুক ইকবাল যখন ঘরে ফিরেছে তখন মধ্যরাত। মায়ের বকুনির ভয়ে খাবার ঘরে গিয়ে আলো না জ্বেলে অন্ধকারে হাতড়ে হাতড়ে ভাত খান তিনি।

পরের দিন খুব ভোরে ঘর থেকে বের হওয়ার সময় মা বলেন, নাস্তা করে যেতে। ফারুক জানায় হাতে সময় নেই। এলাকার ছেলেপিলেরা অপেক্ষা করছে। মিছিল নিয়ে পল্টন ময়দানে যেতে হবে। আজ সেখানে বঙ্গবন্ধু ভাষণ দিবেন। বড় বড় সব ছাত্রনেতা থাকবেন। মা তখন বলেন তাহলে এক গ্লাস দুধ খেয়ে যা। ফারুক জানায় ফিরে এসে খাব।

বেলা বাড়তে থাকে। সেই সাথে পাল্লা দিয়ে বাড়ে রোদ। তার চাইতে বেশী উত্তপ্ত ঢাকার রাজপথ। মৌচাক, মালিবাগ, খিলগাঁও, রামপুরা, বাড্ডা, শান্তিবাগ, মগবাজার- এসব এলাকার মিছিলগুলো একে একে এসে একত্রিত হতে থাকে। এলাকাগুলোর মধ্যে ঘুরে ঘুরেন চলতে থাকে মিছিল। বিশাল বড় মিছিলে নিয়ে পল্টনে যাওযা হবে, এটাই ফারুক ইকবালের পরিকল্পনা।

বেলা বারোটার দিকে মিছিলটি এসে দাঁড়ায় রামপুরা বাংলাদেশ টেলিভিশন ভবনের মেইন গেইটে। পথরোধ করে দাঁড়ায় পাকিস্তানী মিলিটারী। সবার হাতে উদ্যত মেশিনগান। তাতে কী। মিছিলের উত্তেজনার কাছে মিলিটারী অসহায়। মিলিটারী জানতে চায় মিছিলের নেতৃত্ব কে দিচ্ছে? জানতে পারে ফারুক ইকবাল নামের এক সদ্য কৈশোর পার হওয়া তরুণ। আবুজর গিফারী কলেজের জিএস। মিলিটারী হয়তো খুশীই হয়। না চাইতে হাতের কাছে শিকার। এই ছেলে এতদিন অনেক ভুগিয়েছে। শত শত ছেলেকে স্বাধীনতার কথা বলে রাস্তায় নামিয়েছে।

মিলিটারী ফারুককে ডেকে পাঠায়। তাদের মধ্যে কী কথা হয় জানা যায়না। ফারুক ইকবালকে মিছিলে ফিরে যেতে বলা হয়। ফারুক ফিরে যাচ্ছে। এমন সময় পিছন থেকে গুলী করা হয়। জানা যায়, এখন যেখানে বাংলাদেশ টেলিভিশনের মেইন গেইট, ঠিক সেখানেই আইল্যাণ্ডের উপর মুখ থুবড়ে পড়েন তিনি। পিছন থেকে করা গুলী ডান পাঁজরের নিচ দিয়ে নাড়ীভুঁড়ি নিয়ে বের হয়। ধারণা করা হয়, সাথে সাথেই মারা যান তিনি। নয় মাসের মুক্তিযুদ্ধে প্রথম শহীদ।

এরপর ঢাকা মেডিকেলে তাকে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল। কিন্তু কোন লাভ হয়নি। না, ফারুক ইকবালের রক্ত বৃথা যায়না। ক্ষোভে, উত্তেজনায় ফেটে পড়ে ছাত্র জনতা। তাকে দেখতে ছুটে আসেন তখনকার ছাত্রনেতা আসম আব্দুর রব। তিনি ঘোষণা করেন মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে ফারুক ইকবাল প্রথম শহীদ। তাকে দিয়েই শুরু হয় নতুন রক্তক্ষয়ী সঙগ্রাম।

 

প্রতিবেদকের বক্তব্য:

দেশ স্বাধীন হয়। বর্তমান হয় অতীত। রাজনীতি পরিণত হয় ক্ষমতার দ্বন্দ্বে। ফারুক ইকবালকে ভুলে যায় সবাই।  শুধু নির্বাচন আসলে প্রার্থীরা ভোট চাইতে তার বাড়ী যায়। ফারুক ইকবাল শুয়ে আছেন মৌচাক – মালীবাগ মোড়ে। সিটি কর্পোরেশন তার কবরের উপরে একটি মিনার তৈরী করেছে।

এই প্রতিবেদক তার মায়ের সাথে দেখা করতে গেলে দেখা যায় তিনি জীবনের শেষ সময়ের জন্য অপেক্ষা করছেন। তার একটাই ইচ্ছা। তিনি প্রধানমন্ত্রীর সাথে দেখা করতে চান। একাট বার, শুধু একটিবার তিনি প্রধানমন্ত্রীকে আবেগে ছুয়ে দেখতে চান।

প্রধানমন্ত্রী ব্যস্ত থাকেন। দেখা হওয়া কী সম্ভব? এমন কথার জবাবে এই মা বলেন, সম্ভব। প্রধান মন্ত্রীর কাছে আমার ডাক পৌছালে তিনি অবশ্যই আসবেন। এক স্বজনহারা অন্য স্বজনহারার ডাক অস্বীকার করতে পারেন না।

মাননীয় প্রধানমন্ত্রী কী এই ডাক কখনো শুনতে পাবেন?        

 


Ekushey Television Ltd.

© ২০২৫ সর্বস্বত্ব ® সংরক্ষিত। একুশে-টেলিভিশন | এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি