মৃত্যুর পর জানা গেল ইভানার অসুখী জীবনের কথা
প্রকাশিত : ১১:৩২, ২৫ সেপ্টেম্বর ২০২১
সবাই জানতেন তারা খুব সুখী, কিন্তু ভেতরে ভেতরে যে ‘দাম্পত্য অসুখ’ দানা বেঁধে ছিল তা জানা গেল ইভানা লায়লা চৌধুরীর আকস্মিক মৃত্যুর পর।
ইভানার মৃত্যুর পর অভিযোগের তীর এখন তার স্বামী ব্যারিস্টার আব্দুল্লাহ হাসান মাহমুদ ওরফে রুম্মানের দিকে।
মেয়ের মৃত্যুর জন্য জামাতা রুম্মানকে দায়ী করে শুক্রবার (২৪ সেপ্টেম্বর) শাহবাগ থানায় লিখিত অভিযোগও দিয়েছেন ইভানার বাবা। যেখানে এক নারী আইনজীবীসহ আরও দুইজনের নাম রয়েছে।
অভিযোগের বরাত দিয়ে শাহবাগ থানার ওসি মওদুদ হাওলাদার একুশে টেলিভিশন অনলাইনকে জানিয়েছেন, রুম্মান বিয়ের পর থেকেই ইভানাকে শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন করতেন। ওই নারী আইনজীবীর সঙ্গে যে রুম্মান সম্পর্কে জড়িয়েছিলেন সেটাও জেনেছিলেন ইভানা।
গত ১৫ সেপ্টেম্বর রাজধানীর শাহবাগের পরীবাগে বহুতল দুই ভবনের মাঝ থেকে ইভানার (৩২) মৃতদেহ উদ্ধার করা হয়। এ ঘটনায় আগেই একটি অপমৃত্যুর মামলা হয়েছে।
এছাড়া ইভানার মৃত্যুর ঘটনার সুষ্ঠু তদন্তের দাবিতে শাহবাগ থানায় একটি আবেদন জমা দিয়েছিলেন কয়েকজন আইনজীবী।
ইভানা ছিলেন ঢাকার স্কলাস্টিকা স্কুলের ক্যরিয়ার গাইডেন্স কাউন্সেলর। ২০১০ সালে ব্যারিস্টার আব্দুল্লাহ হাসান মাহমুদ রুম্মানের সঙ্গে তার বিয়ে হয়। তাদের দুই ছেলের একজনের বয়স আট ও অন্যজনের ছয় বছর। ছোট ছেলেটি বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন।
ইভানার মৃত্যুর পর স্বামীর অবহেলা, মানসিক যন্ত্রণা এবং পরকীয়া নিয়ে মুখ খুলতে শুরু করেছেন তার আত্মীয়-বন্ধু-শিক্ষক-সহপাঠীরা। সাংসারিক অশান্তির নানা বিষয় বিভিন্ন সময় ইভানা জানাতেন বলে জানিয়েছেন তারা।
ইভানার একজন সহপাঠী একুশে টেলিভিশন অনলাইনকে বলেন, “ইভানার বিয়ের এক থেকে দেড় বছর পর থেকেই তার স্বামীর সঙ্গে ঝামেলা শুরু হয়। নানা বিষয় নিয়েই ঝগড়া হতো। বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন বাচ্চাটির জন্যও তাকে দায়ী করা হয়।”
“ইভানা চাকরি করুক এটা চাইতেন না তার স্বামী। তাকে বার বার বাধা এবং তালাকের হুমকি দেন। ইভানা তালাকের কথা শুনে মুষড়ে পড়ে। সে আত্মসম্মানকে খুব ভয় পেত। নিজের মা-বাবাকে কখনো তার অসুখী জীবনের কথা জানতে দেয়নি।”
তিনি আরও বলেন, “সর্বশেষ স্বামীর পরকীয়ার বিষয়টি তার কাছে ধরা পড়ে যায়। সে বিষয়টি আমাদের একজন শিক্ষকের সঙ্গে শেয়ার করে। সে একেবারেই ভেঙ্গে পড়ে। রুম্মান তালাকের বিষয়টি জানিয়ে দেয়, যা মেনে নেয়া তার পক্ষে হয়ত সম্ভব ছিল না।”
ইভানার আরেক সহপাঠী ব্যারিস্টার সিফাত মাহমুদ শুভ বলেন, “ইভানা কলাবাগানে অবস্থিত লন্ডন কলেজ অফ লিগ্যাল স্টাডিজে আমার সহাপাঠী ছিল। আমরা অনেকে লন্ডনে বার অ্যাট ল করতে গেলেও ইভানা যেতে পারেনি। বিয়ের পর থেকে সে সবার সঙ্গে যোগাযোগ কমিয়ে দেয়। পরে শুনেছি সে পারিবারিক ঝামেলায় আছে। এমন প্রাণবন্ত একজন মানুষ আত্মহত্যা করবে এটা বিশ্বাস করা যায় না।”
যেদিন ইভানার লাশ পাওয়া যায়, সেদিন গণমাধ্যমকে দেওয়া তার শ্বশুরের ভাষ্যেও ছেলের দাম্পত্য কলহের বিষয়টি উঠে আসে।
ইভানার শ্বশুর বলেছিলেন, ঘটনার দিন ইভানার ও তার ছেলের মধ্যে খুব ঝগড়া হয়। পরে রুম্মান বাসা থেকে বের হয়ে যায়। একটু পর ইভানাও দরজা খুলে বের হয়। দুপুরের দিকে ভবনের নিচে ইভানার লাশ পওয়া যায়।
তবে ইভানার সাংসারিক অশান্তির কথা কখনও জানতে পারেননি বলে জানিয়েছেন তার বোন ফারহানা চৌধুরী তিথি।
তিনি বলেন, “যদি জানতাম তাহলে এ ঘটনা ঘটত না। আমরা পদক্ষেপ নিতাম। সে সবকিছু আমাদের কাছে লুকিয়েছে। বাবা-মাও কিছু জানত না। আমরা চিন্তায় ছিলাম তার অটিস্টিক বাচ্চটাকে নিয়ে। এখন তার বন্ধুরা আমাদের অনেক কিছু বলেছে। সে তার শিক্ষকের সঙ্গেও যোগাযোগ করেছিল।”
ইভানা যে প্রতিষ্ঠান থেকে এলএলবি সম্পন্ন করেছিলেন সেই লন্ডন কলেজ অফ লিগ্যাল স্টাডিজের শিক্ষক ও সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী আসিফ বিন আনোয়ারের সঙ্গেও একাধিকবার নিজের সমস্যা নিয়ে কথা বলেছিলেন। পারিবারিক অশান্তি ও তালাকের বিষয়ে তার কাছে পরামর্শও চেয়েছিলেন।
এই আইনজীবী বলেন, “মেয়েটি আমার সঙ্গে তার পারিবারিক সমস্যা নিয়ে কয়েকবার যোগাযোগ করেছিল। সর্বপ্রথম ২০১৩ সালে সে একবার আমার সঙ্গে যোগাযোগ করে। সময় নিয়েও পরে আসেনি। এরপর ২০১৬ সালে আবার যোগাযোগ করে। জানায় সে খুব সমস্যায় আছে। তাকে তালাকের হুমকি দিচ্ছে। এরপর আবার বিরতি।
“সর্বশেষ মৃত্যুর দুইদিন আগে সে মেসেজ করে জানায়, তার স্বামী অন্য মেয়ের সঙ্গে সম্পর্কে জড়িয়েছে। এ কারণে সে হাত কেটে আত্মহত্যার চেষ্টা চালায়। সেই ছবিও আমাকে পাঠায়। আমি তাকে বোঝানোর চেষ্টা করি, দ্রুত দেখা করতে বলি।”
ওই নারীর সঙ্গে স্বামী রুম্মানের হোয়াটসঅ্যাপে আলাপচারিতার স্ক্রিনশটও ইভানা পাঠিয়েছিলেন বলে জানান ব্যারিস্টার আসিফ।
তিনি বলেন, “ইভানাকে তার স্বামী পরিকল্পিতভাবে ঘুমের ওষুধ খাওয়াত। ইভানা মেসেজে জানিয়েছে, সে প্রথম বুঝতে পারেনি যে ওই নারীর সঙ্গে দীর্ঘ সময় ধরে কথা বলার জন্যই তাকে ঘুম পাড়িয়ে রাখা হতো।”
এ বিষয়ে কথা বলার জন্য ইভানার স্বামী আব্দুল্লাহ হাসান মাহমুদ রুম্মানের মোবাইল ফোনে একাধিকবার কল করা হলেও তিনি ধরেননি।
ইভানার মৃত্যুর পর ঘটনার সুষ্ঠু তদন্তের দাবিতে আইজীবীদের পক্ষে শাহবাগ থানায় একটি আবেদন করেছিলেন ব্যারিস্টার আসিফ বিন আনওয়ারের পক্ষে।
ইভানা যে মানসিকভাবে বিপর্যস্ত ছিলেন এবং শ্বশুরবাড়ির পক্ষ থেকে তাকে মৃত্যুর দিকে ঠেলে দেওয়া হয়েছে, এ সম্পর্কিত কিছু তথ্য প্রমাণও তারা আবেদনের সঙ্গে জমা দেন বলে জানিয়েছেন শাহবাগ থানার ওসি মওদুদ হওলাদার।
ওসি বলেন, “আত্মহত্যার প্ররোচনা বিষয়ে ইভানার শিক্ষক আসিফ বিন আনোয়ার কিছু তথ্য আমাদের দিয়েছেন। আমরা এখন সবকিছু তদন্ত করে দেখছি।”
এছাড়া মামলার পাশাপাশি পরিবারের পক্ষ থেকে করা অভিযোগও তদন্ত করা হবে জানান তিনি।
এসি/এএইচএস