মেধার মূল্যায়নে চাই প্রশ্নফাঁস রোধ
প্রকাশিত : ১৮:৫৪, ১৪ ডিসেম্বর ২০১৭ | আপডেট: ১২:৫০, ১৮ ডিসেম্বর ২০১৭
শনিবার। বিকেল ৪টা। রাজধানীর শাহবাগ মোড় এলাকার এক ছোট ভাইয়ের সঙ্গে কথা হচ্ছিল। সব খবর কেমন জানতে চাইলে হতাশ কন্ঠে জানালেন খুব ভালো না। হতাশ জীবন নিয়ে। তিনি জানালেন কোনো চাকরি পাচ্ছেন না। চাকরির জন্য কয়েকটি ভাইভাও ইতোমধ্যে দিয়েছেন। কিন্তু কাজের কাজ চাকরি হয়নি। এদিকে বাড়িতে বৃদ্ধ বাবা-মা ছেলের দিকে চেয়ে আছেন ছেলের একটা চাকরি হবে। ছেলে টাকা পাঠালে ভালোভাবে শেষ সময়টুকু কাটাতে পারবেন এই আশায় পথ চেয়ে বসে আছেন। কিন্তু সে রকম কোনো ফল পাচ্ছেন না। দেশের সেরা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ম্যানেজমেন্ট বিভাগ থেকে পাশ করেছেন। ফলাফলও ভালো কিন্তু পরও হতাশ। তিনি আরও জানালেন পরীক্ষার আগেই পশ্নপত্রফাঁস হয়ে যায়। তাই চাকরি পাব এমন জোরালো আশা করতে সাহসও পাচ্ছেন না উত্তর অঞ্চলের ওই ছেলে। তারা বাবা-মাকেও কোনো খুশির সংবাদ দিতে পারছেন না।
চাকরির পরীক্ষার প্রশ্নফাঁস নতুন কোনো তথ্য না। সব সময়েই কম বেশি প্রশ্নফাঁসের ঘটনা ঘটে থাকে। কিন্তু তার ব্যাপকতা নিয়ে রয়েছে নানা প্রশ্ন। এছাড়াও শোনা যায় বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষার প্রশ্নফাঁস। তাছাড়া এসএসসি, এইচএসসি ও স্নাতকেরও প্রশ্নফাঁসের অভিযোগ প্রায় শোনা যায়। এবার যোগ হয়েছে প্রাথমিক সমাপনী বা পিএসসির প্রশ্নফাঁস। প্রশ্ন হলো এ কোমলমতি শিক্ষার্থীদের হাতে এ ফাঁসকৃত প্রশ্ন কারা তোলে দিচ্ছেন। অভিভাবক পর্যায়ের কেউ। সেটা হতে পারে বাবা-মা বা বড় ভাই বা ভাবি বা বোন। কিন্তু তারা কি সঠিক কাজ করছে। তাদের বিবেক কি একবারের জন্যও বাধে না। এটা অন্যায়। এটা নিজের সন্তানের ক্ষতি করছে। এ ফাঁস করা প্রশ্ন দিয়ে এ প্লাস পেয়ে কোনো কাজে আসবে না। প্রশ্নফাঁস রোধে সরকার বা সংশ্লিষ্টরা নিশ্চয় আন্তরিক। তারা প্রশ্নফাঁস রোধে কার্যকর পদক্ষেপ নিচ্ছে এটা নিয়ে ভিন্ন মত থাকতে পারে।
সম্প্রতি শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদ বলেছেন, প্রশ্নফাঁস রোধে এমন কোনো চাবি নেই যে তা ঘুরালেই বন্ধ হয়ে যাবে। সুতরাং চাবি দিলেই প্রশ্নফাঁস বন্ধ হবে না। তবে আমরা প্রশ্নফাঁস বন্ধে বিভিন্ন পদক্ষেপ নিয়েছি। সচিবালয়ে মাধ্যমিকের পাঠ্যক্রম উন্নতকরণ নিয়ে দেশের বিশিষ্ট শিক্ষাবিদদের সঙ্গে বৈঠক শেষে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে তিনি এসব কথা বলেন। মন্ত্রী অনুষ্ঠানে আরও বলেন, এটা (প্রশ্নফাঁস) একটা অপরাধ। খুন একটা অপরাধ। খুনের সাজা ফাঁসি। ফাঁসি তো অনেক হচ্ছে। কিন্তু খুন তো থেমে থাকেনি। প্রশ্নফাঁসও বন্ধে হচ্ছে না।
অপর এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, প্রশ্নফাঁস কোনো কালেই বন্ধ হয়নি। সব সময়ই প্রশ্নফাঁস হয়েছে। আমার শিক্ষার বয়স ৬০ বছর। তখন থেকেই প্রশ্নফাঁস ছিল। কিন্তু ওই সময় তো আর সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ছিল না। যে কারণে প্রচার কম হয়েছে। কিন্তু এখন প্রচার বেশি হচ্ছে।
শিক্ষামন্ত্রী বলেন, আগে বিজি প্রেস থেকে প্রশ্নফাঁস হতো। কিন্তু এখন আমাদের কিছু অনৈতিক শিক্ষক প্রশ্নফাঁস করছে। এসব বিষয়ে আমরা ব্যবস্থা নিয়েছি।
প্রশ্নফাঁস রোধে আরও কিছু পদক্ষপ নেওয়া দরকার বলেই সংশ্লিষ্টরা মনে করেন। এ জন্য পাঠ্যবইয়ের কারিকুলাম চেঞ্জ করা যেতে পারে। আধুনিক প্রযুক্তিকে কাজে লাগিয়ে গুনগত মান উন্নত করা যেতে পারে। যাতে একজন শিক্ষার্থী বই পড়তে আগ্রহী হয়।
মাধ্যমিক শিক্ষার পাঠ্যবই উন্নত, প্রাঞ্জল ও সুখপাঠ্য করার পরামর্শ দিয়েছেন শিক্ষাবিদরা। সম্প্রতি এক অনুষ্ঠানে বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ অধ্যাপক ড. আবদুল্লাহ আবু সাঈদ বলেন, আমেরিকায় পাঠ্যবই অনেক সুন্দর, সুখপাঠ্য, উপন্যাসের মতো। শিক্ষার্থীরা আনন্দ নিয়ে বই পড়ে। আমি চাই আমাদের বইগুলো সে রকম হোক।
ওই সভায় অন্যদের মধ্যে শিক্ষাবিদ ড. জামিলুর রেজা চৌধুরী, অধ্যাপক ড. কায়কোবাদ, অধ্যাপক ড. এম এম আকাশ প্রমুখ উপস্থিত ছিলেন। তারাও এর প্রয়োজনীতার কথা বলেন।
কয়েকদিন আরেকটি সংবাদ প্রকাশিত হয় মুলধারার সংবাদপত্রগুলোতে ‘প্রশ্নফাঁস করেই কোটিপতি শিক্ষার্থী’ শিরোনামে। ওই প্রতিবেদনে বলা হয়, ওই শিক্ষার্থী প্রশ্নফাঁস করে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার্থী ভর্তি করতেন। বিশেষ করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে তিনি প্রতিবছর জালিয়াতি করে শিক্ষার্থী ভর্তি করাতেন। আর এভাবে সে শিক্ষার্থী থাকা অবস্থায় কোটিপতি হয়ে যান। তাকে গ্রেফতার করার পর এ তথ্য বেরিয়ে আসে।
সবচেয়ে বড় বিষয় হলো এভাবে কতজনকে ধরবেন। কতজনের বিচার করবেন এ প্রশ্ন থেকেই যাচ্ছে। এই অভিশাপ থেকে বেরিয়ে আসার জন্য স্থায়ী সমাধান খুঁজতে হবে এবং সেই আলোকে ব্যবস্থা নিতে হবে। তা না হলে মেধাশূন্য জাতিতে পরিণত হতে হবে আমাদের। যেই কোনো পরীক্ষা আসে সেই শোনা যায় প্রশ্নফাঁস। চলতি বছরের একটি সরকারি ব্যাংকের প্রশ্নফাঁস নিয়ে ব্যাপক সমালোচনা করা হয়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সামাজিক বিজ্ঞানের অধীনে ওই ব্যাংকের পরীক্ষা নেওয়া হয়েছিল। ওই পরীক্ষার আগের রাতে ফেসবুকে পরীক্ষার্থীরা প্রশ্ন দিয়ে বলেছিল এটি ফাঁস হওয়া প্রশ্ন। কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ ও ব্যাংক কর্তৃপক্ষ এটা যৌক্তিহীন বলে উড়িয়ে দিয়েছিল এ অভিযোগ। পরে বেশ কিছু গণমাধ্যমে সংবাদ হওয়ায় পরীক্ষা বাতিল করতে বাধ্য হয়। এভাবে আর কতদিন। এর একটা স্থায়ী সমাধান জাতি আশা করে।
একটি জাতিকে শক্তভিত্তির ওপর দাঁড়াতে অবশ্যই প্রশ্নফাঁস রোধ করতে যথাযথ পদক্ষেপ নিতে হবে। মেধার মূল্যায়নে চাই প্রশ্নফাঁস রোধ। এ দাবি সব মেধাবীদের। তাদের দাবিকে সংশ্লিষ্টরা মূল্যায়ন করবেন এমনটা আশা করা নিশ্চয়ই অন্যায় হবে না। ভবিষ্যতে আর যেন কোনো পরীক্ষার প্রশ্নফাঁস না হয় সংশ্লিষ্টরা সেই পদক্ষেপ নেবেন, এমনটাই প্রত্যাশা থাকল।
লেখক: সাংবাদিক
আর/
** লেখার মতামত লেখকের। একুশে টেলিভিশনের সম্পাদকীয় নীতিমালার সঙ্গে লেখকের মতামতের মিল নাও থাকতে পারে।