ঢাকা, শুক্রবার   ০১ নভেম্বর ২০২৪

ম্যাজিক দেখিয়ে ২৪২ মিলিয়ন ডলার নিয়ে উধাও প্লেবয়

একুশে টেলিভিশন

প্রকাশিত : ০০:০৯, ১৭ ফেব্রুয়ারি ২০১৮

ব্ল্যাক ম্যাজিকে বিশ্বাস আছে? থাকুক বা না থাকুক এই ব্ল্যাক ম্যাজিক দেখিয়েই ২৪২ মিলিয়নেরও বেশি ডলার হাতিয়ে নেন এক ব্যক্তি। আমুদে জীবনযাপন করা এই ‘প্লেবয়’ ১৯৯৫ সালে ব্ল্যাক ম্যাজিকের ধাপ্পা দিয়ে হাতিয়ে নেন এই বিশাল অংকের টাকা। আজ জানাব বিশ্বে তোলপাড় সৃষ্টি করা এই ‘জাদুকর’ এর কাহিনী।

প্রতারণার নমুনা

১৯৯৫ সালে দুবাই ইসলামিক ব্যাংকের এক ম্যানেজারের সাথে সাক্ষাৎ করেন ফউতাঙ্গা বাবানি সিসসোকো নামের এক ব্যক্তি। গাড়ি কিনবেন বলে ঋণ চাইলেন তিনি। রাজি হলেন ব্যাংক ম্যানেজার মোহাম্মদ আইয়ুব। রাতে নিজ বাসায় ডিনারের আমন্ত্রণ জানালেন বাবানিকে।

ডিনারে গিয়ে বাবানি আইয়ুবকে জানালেন, তিনি ব্ল্যাক ম্যাজিকের মাধ্যমে টাকা দ্বিগুণ করতে পারেন। আইয়ুব চাইলে তার টাকা দ্বিগুণ করে দিতে পারেন। এখানে বলে রাখা ভাল, ইসলাম ধর্মাবলম্বীদের একটি অংশ ‘ব্ল্যাক ম্যাজিক’কে নিষিদ্ধ হিসেবে মেনে থাকে। তবে বাস্তবে ব্ল্যাক ম্যাজিক আছে কী না সে নিয়েও দ্বন্দ্ব আছে বেশ।

তবে বাস্তবে থাকুক বা না থাকুক আর ধর্মের দৃষ্টিতে জায়েজ বা না-জায়েজ যাই হোক না কেন পরের দিন ঠিকই বাবানি’র বাসায় টাকা নিয়ে হাজির হলেন আইয়ুব। বাবানি’র বাড়িতে প্রবেশের সময় ঐ ব্যাংক কর্মকর্তা দেখলেন, বাড়ির ভেতর থেকে হন্তদন্ত হয়ে বের হয়ে আসছেন এক ব্যক্তি। এক জ্বীন তাকে আঘাত করে বলে জানায় ঐ ব্যক্তি। আইয়ুব যেন জ্বীনকে রাগিয়ে না তোলেন সে ব্যাপারে সতর্কও করলেন তিনি। জ্বীন রেগে গেলে টাকা আর দ্বিগুণ হবে না।

বাড়ির ভেতরে একটি ম্যাজিক রুমে গেলেন আইয়ুব। ব্যাগ ভর্তি টাকার ব্যাগ ঐ কক্ষের এক কোণায় রেখে বাইরে রেরিয়ে আসলেন। বাইরে থেকেই ভেতরে দেখলেন অশীরিরি আলো এবং ধোয়া। শুনলেন জ্বীনের আওয়াজও।এরপরেই সব নীরব।

একটু পর দ্বিগুণ টাকা নিয়ে আইয়ুবের সামনে হাজির বাবানি। সেই শুরু।

১৯৯৫ থেকে ১৯৯৮ সাল পর্যন্ত ১৮৩ বার বাবানি’র ব্যাংক অ্যাকাউন্টে টাকা জমা করেন আইয়ুব। আর এ সব টাকাই ছিল দুবাই ইসলামিক ব্যাংকের। টাকার পরিমাণ ২৪২ মিলিয়ন ডলার। এমনকি বিশ্বের বিভিন্ন দেশে ক্রেডিট কার্ডে বাবানির খরচ করা অর্থও দুবাই থেকে পরিশোধ করত আইয়ুব।

এ বিষয়ে ব্যাংকের পক্ষে তদন্ত করা আইনজীবী অ্যালান ফাইন বলেন, “তিনি (আইয়ুব) মনে করেছিলেন যে, ব্ল্যাক ম্যাজিক দিয়েই তার কাছ থেকে এ টাকা হাতিয়ে নেয় বাবানি। প্রথম কয়েক বার দ্বিগুণ টাকা পাওয়াতে মূলত আইয়ুবই অন্ধ বিশ্বাসে এতগুলো টাকা দেয় বাবানিকে”।

১৯৯৮ সালে ব্যাংকটি যখন এই আর্থিক কেলেংকারির বিষয়টি ধরতে পারে ততদিনে স্রেফ লাপাত্তা হয়ে যান এই ‘জাদুকর’। মজার বিষয় হল এই যে, এই বিপুল পরিমাণ অর্থ দুবাই এর বাইরে থেকেই আরামসে পাচ্ছিলেন বাবানি।

অর্থ আত্মসাতের পাশাপাশি নারীর মন জয়েও ওস্তাদ ছিলেন বাবানি। ১৯৯৫ সালেরই কোন একদিন যুক্তরাষ্ট্রের সিটি ব্যাংকে যান বাবানি। এক নারী কর্মকর্তাকে জানান যে ঋণ প্রয়োজন তার। কোন ধরণের সুপারিশ ছাড়াই দেড়শ মিলিয়ন ডলার ঋণ তো পেলেনই; সাথে বিয়ে করলেন সেই নারী কর্মকর্তাকে। রাজত্ব আর রাজকন্যা দুটোই পেলেন বাবানি।

সৌখিন জীবনযাপন

ফউতাঙ্গা বাবানি সিসসোকো ছিল অনেকগুলো স্ত্রী। যুক্তরাষ্ট্র থেকে শুরু করে পুরো আফ্রিকার অনেক জায়গাতেই ঘাটি গেড়েছিলেন বাবানি। নিজ দেশ মালিতেও আছে তার বেশ ক’জন স্ত্রী। প্রতি স্ত্রীকে দিয়েছেন অর্ধ মিলিয়নেরও বেশি পরিমাণ অর্থ বা সম্পদ।

কেনাকাটা বাবদও ব্যাপক খরচ করতেন বাবানি। ব্যাংকের টাকা জালিয়াতি মামলায় বাবানির বিষয়ে তদন্ত করা আইনজীবী ফাইন বিবিসিকে বলেন, “আমি জানতে পারি যে, যুক্তরাষ্ট্রের মিয়ামিতে একটি জুয়েলারি দোকানেই অর্ধ মিলিয়ন ডলারের পাথর কেনেন তিনি। পুরুষদের পোশাক বিক্রি করা এক দোকানে ঢুকেই কিনে ফেলেন দেড় লাখ মার্কিন ডলার মূল্যের পোশাক।

একটি মোটর গাড়ি শো-রুমের ব্যবসায়ী রোনিল ডুফরেন জানান, “সে একবার দোকানে আসলে এক সাথে দুই থেকে চারটি গাড়ি কিনে নিয়ে যেতেন। এক সপ্তাহ পর আবার আসতেন। তিন থেকে চারটি গাড়ি কিনতেন। তার কাছে টাকা যেন ছিল হাতের ময়লার মত”। বাবানির কাছে ছয় মাসে ৩০ থেকে ৩৫ টি বিক্রি করেছেন বলে জানান রোনিল।

আর শুধু মিয়ামিতেই ২৩টি ফ্ল্যাট ছিল তার স্ত্রীদের থাকার জন্য। পাক্কা প্লে-বয়, কী বলেন?

যেভাবে ধরা পড়লেন

ব্যাংকের টাকায় বেশ ভালোই দিন কাটছিল বাবানির। চালু করেছিলেন এয়ার লাইনস প্রতিষ্ঠানও। হকার-সিডেলে ১২৫ এবং দুইটি বোয়িং ৭২৭ ছিল সেই বহরে। তবে কথায় বলে না যে, চোরের দশ দিন তো গিরস্তের এক দিন। সেই একদিনই ফেসে যান বাবানি।

১৯৯৬ সালে ভিয়েতনাম যুদ্ধ ফেরত দুইটি সামরিক হেলিকপ্টার কিনতে আগ্রহী হয়ে ওঠেন তিনি। আর তাতেই আইনশৃংখলা বাহিনীর আগ্রহের কেন্দ্রবিন্দু বনে যান খোদ নিজেই। যুক্তরাষ্ট্রসহ ইন্টারপোলের সার্চ লিস্টে জায়গা হয় বাবানির। কিছুদিন পরে ধরা পরেন জেনেভায়। বলে রাখা ভাল যে, জেনেভায় ব্যাংক অ্যাকাউন্ট খুলতে গিয়েছিলেন তিনি!

জেলে যেমন ছিলেন

জেলে বন্দী থাকলেও মোটেও কষ্টে ছিলেন না তিনি। বরং সবাইকে নিয়ে বেশ আরাম আয়েশে ছিলেন চতুর বাবানি। মিয়ামিতে তার আইনজীবী টম স্পেনসার বলেন, “আমি যখন জেল প্রধানের সাথে কথা বলতে যাই তখন তিনি জিজ্ঞেস করলেন যে, বাবানি কী যুক্তরাষ্ট্রে যাবেন? আমি বললাম, এখনও জানি না। তিনি বললেন, যত বেশিদিন সম্ভব বাবানি যেন তাদের জেলে থাকে। আমি এর কারণ জিজ্ঞেস করলে তিনি বলেন, “তার জন্য প্রতিদিন প্যারিস থেকে আনা মজাদার খাবার খেতে পারছি আমরা”।

যেভাবে মুক্ত হলেন

মিয়ামি থেকে যুক্তরাষ্ট্রে নেয়া হয় বাবানিকে। সেখানে তার বিচার শুরু হলে প্রভাবশালী কয়েকজন ব্যক্তি তার জামিনদার হতে দাঁড়িয়ে গেলেন আদালতে। যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক এক সিনেটরও ছিলেন তাদের মধ্যে। সেসময় রেকর্ড ২০ মিলিয়ন ডলারের বিনিময়ে জামিন পান তিনি।

এখানেই শেষ নয়। বাবানির জামিনের জন্য কাজ করা প্রত্যেক আইনজীবী উপহার হিসেবে পেয়েছেন মার্সিডিজ, জাগুয়ারের মত বিলাসবহুল গাড়ি।

মামলার রায়ে ৪৩ দিন কারাবাস আর আড়াই লাখ ডলার জরিমানা করা হয় বাবানিকে। দুবাই ইসলাইমিক ব্যাংকের কথা মনে আছে? বাবানির এই জরিমানার অর্থও পরিশোধ করে ঐ ব্যাংক। বলাই বাহুল্য যে, এর পিছনে ছিলেন মোহাম্মদ আইয়ুব।

কারা বাসের পর তিনি যখন নিজ জন্মভূমি মালিতে ফিরে গেলেন তখন তিনি দেশটির জন্য রীতিমত এক বীর। ২০০২ থেকে ২০১৪ সাল পর্যন্ত দেশটির আইন প্রণেতা ছিলেন বাবানি।

বর্তমানে যেমন আছেন বাবানি

বর্তমানে মালির দাবিয়া গ্রামে নিজের বাড়িতে থাকেন বাবানি। সাথে থাকে ড্রাইভার এবং অস্ত্র সজ্জিত নিরাপত্তা রক্ষীরা। বিবিসির প্রতিনিধি ব্রিগিট স্কিফারকে এক সাক্ষাৎকার দেন বাবানি।তিনি বলেন, “আমি সিসসোকো ফউতাঙ্গা বাবানি সিসসোকো। আপনি জানেন, যেদিন আমি জন্মেছিলাম সেদিন পুরো গ্রাম জুড়ে আনন্দ উৎসব হয়েছিল। কয়েক দিন ধরে চলে সে উৎসব”।

জীবনের এক পর্যায়ে ৪০০ মিলিয়ন ডলার পর্যন্ত আয় করেছিলেন বলে জানান বাবানি। দুবাই এর ব্যাংকের সেই ২৪২ মিলিয়ন টাকা তিনিই হাতিয়ে নিয়েছিলেন কী না এমন প্রশ্নের জবাবে বেশ ঘুরিয়ে পেচিয়ে তিনি বলেন, “যে ভদ্রলোকই (ব্যাংকের সেই ম্যানেজার আইয়ুব) বলতে পারবে ব্যাংকের টাকা কী হল। একজন ব্যক্তির পক্ষে তো আর ব্যাংকের টাকা বের করে আনা সম্ভব না, তাই না? অনেক লোকের হাত ঘুরে টাকা বের হয়। কাজেই তারাই বলতে পারবে ঐ টাকা কে নিয়েছে।”

আপনি কী আসলেই আইয়ুবকে ব্ল্যাক ম্যাজিক করেছিলেন? সাংবাদিকের এমন প্রশ্নে বাবানি বলেন, “দেখেন কোন ব্যক্তি যদি ব্ল্যাক ম্যাজিক জানে তাহলে সে আর কষ্ট করে কাজ করবে কেন? তাহলে তো সে ঘরে বসেই পৃথিবীর সব ব্যাংক লুট করে ফেলতো”।

তবে এক সময় ‘রাজার হালে’ কাটানো বাবানির এখন আর্থিক অবস্থা মোটেও ভালো হয়। বিষয়টি জানিয়েছেন তিনি নিজেই। তিনি বলেন, “আমি আর আগের মত ধনী নেই। আমি এখন গরীব”।

*বিবিসি প্রতিনিধি ব্রিগিট স্কিফারের লেখা থেকে অনূদিত ও সম্পাদিত

//এস এইচ এস//টিকে


Ekushey Television Ltd.










© ২০২৪ সর্বস্বত্ব ® সংরক্ষিত। একুশে-টেলিভিশন | এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি