ঢাকা, রবিবার   ২৪ নভেম্বর ২০২৪

‘যেন কিছু মনে করো না’

বাপ্পী রহমান

প্রকাশিত : ১২:০০, ৬ এপ্রিল ২০২১ | আপডেট: ১২:৪৭, ৬ এপ্রিল ২০২১

দ্রুত বাড়ছে করোনার সংক্রমণ। তাই বছরখানেক বাদে আবারও দেশে লকডাউন এসেছে। ২০২০ সালের ২৩শে জানুয়ারি চীনের হুবেই প্রদেশের উহান শহর প্রথম লকডাউন করা হয়। ধারণা করা হয়, এই শহর থেকেই প্রথম করোনাভাইরাস মহামারীর রূপ নেয়। করোনা সংক্রমণ ঠেকাতে সেই প্রথম লকডাউন জারি হয়েছিল বিশ্বে। 

যুক্তরাজ্য থেকে প্রকাশিত ইংরেজি অভিধান কলিনস ডিকশনারির হিসেবে, ২০২০ সালের বর্ষসেরা শব্দ ‘লকডাউন’। লকডাউনের আভিধানিক অর্থ হলো, ‘ভ্রমণ, সামাজিক সম্পৃক্ততা এবং জনসমাগমস্থলে যাতায়াতের ক্ষেত্রে কঠোর বিধিনিষেধ আরোপ’। 

কারও কারও মতে, লকডাউনের চূড়ান্ত উদ্দেশ্য হচ্ছে- সামাজিক দূরত্ব নিশ্চিত করা। তবে ‘সামাজিক দূরত্ব’ বললে কেমন যেন একটা দূরে সরিয়ে দেওয়ার ভাব স্পষ্ট হয়। কেউ কেউ ভাবছেন এটা সোশ্যাল ডিসট্যান্স না বলে ফিজিক্যাল ডিসট্যান্স বা শারীরিক দূরত্ব বলা যায় কিনা। সে যাই হোক, করোনা ভাইরাসের সংক্রমণ কমিয়ে আনার জন্য বিভিন্ন দেশের সরকার যেসব পদক্ষেপ নিয়েছে, ‘লকডাউন’ তার প্রতিশব্দে পরিণত হয়েছে। 

শুরু থেকেই লকডাউন নিয়ে প্রশ্ন উঠছে, ওঠাও স্বাভাবিক। ব্যক্তি স্বাধীনতা নাকি জননিরাপত্তা? কেউ ভাবছেন সর্বাগ্রে নিরাপত্তা। কারও মতে লকডাউন চরম মাত্রার, কঠোর, আক্রমণাত্মক কিংবা ব্যক্তি স্বাধীনতায় চূড়ান্ত হস্তক্ষেপ। এই বিতর্ক অবশ্য পুরনো। আদতে কথা হচ্ছে- ব্যক্তি স্বাধীনতা এবং জননিরাপত্তার যে পাল্লাটি রয়েছে, তার ভারসাম্য একটি পরিবর্তনশীল সমীকরণের মধ্য দিয়ে পথ চলছে। 

ইতং... বিতং... শেষতক ইরিন পেজ (২০০৭) তার গবেষণায় জানান দিচ্ছেন, ‘সংক্রমণ যখন মড়কের মোড়কে আবির্ভূত হয়, তখন সরকার অসহায় হয়ে পড়ে। মানুষের জীবন বাঁচানো তখন সরকারের মুখ্য কাজ হয়ে দাঁড়ায়। ফলত: গৌণ হয়ে যায় ব্যক্তির স্বাধীনতা সুরক্ষা করা’। মানছি সে কথা। তবে মৌলিক চাহিদার সুরক্ষা ও জীবিকার প্রবেশগম্যতা যদি সহজলভ্য না হয় তাহলে কী দাঁড়াবে?

নোবেলজয়ী অর্থনীতিবিদ অমর্ত্য সেন তাঁর বলছেন, ‘কেউ যখন ভাবছেন কী করে করোনা ভাইরাসের সংক্রমণ থেকে বাঁচা যাবে, কেউ তখন ভাবছেন, কোথায় দুটো ভাত পাওয়া যাবে! কাজেই তার ব্যবস্থা করতে হবে’। 

একইভাবে ভাবছেন তাঁর উত্তরসূরি অভিজিৎ ব্যানার্জি- ‘লোকে যদি ভাতের খোঁজে রাস্তায় বেরোতে বাধ্য হয়, তা হলে লকডাউনের সুফল পাওয়া যাবে না’। 

যদি লকডাউন সফল করতেই হয়, তাহলে গরিব মানুষের হাতে টাকা তুলে দিতে হবে। তা নাহলে মানুষ শুধু খাবারের খোঁজে রাস্তায় রাস্তায় ঘুরে বেড়াবে! শুধু রেশন বা বিনামূল্যে খাবার দিলেই হবে না। তাঁদের আরও কিছু চাহিদা থাকে। সেগুলোও যাতে তাঁরা পূরণ করতে পারেন, তার পরিসর তৈরি করে দিতে হবে। তাঁদের হাতে এমন কিছু তুলে দিতে হবে যাতে তাঁরা এই লকডাউনের সময়ে প্রশাসনের সঙ্গে সহযোগিতা করে। 

মণিরামপুরের সহকারী কমিশনার গত বছর এইসব সাত-সতেরো ভাবেননি, বিশেষ সময়ও ছিলো না। তাই দুই বয়স্ক ভ্যানচালককে কানধরে উঠবস করালেন। কেবল তা করেই ক্ষান্ত হননি। ছবিও তুলেছেন। অথচ এই দুর্যোগে কানধরে উঠবস করা উচিত আমাদের, যারা তিন বেলা পেটপুরে খেতে পারছি। 

রোজকার জীবনে আমরা যে সততা দেখাচ্ছি, তার খানিকটাও যদি বিশ্বাস করতাম তাহলে সম্ভবত ভোলগার জল গঙ্গা পর্যন্ত গড়াতো না। হায় কপাল! প্রতিনিয়ত নিজের সঙ্গে প্রতারণা করতে করতে ভুলে গেছি আমরাও প্রতারক।

লেখক- সহযোগী অধ্যাপক, লোক প্রশাসন বিভাগ, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়।

এনএস/


** লেখার মতামত লেখকের। একুশে টেলিভিশনের সম্পাদকীয় নীতিমালার সঙ্গে লেখকের মতামতের মিল নাও থাকতে পারে।
Ekushey Television Ltd.










© ২০২৪ সর্বস্বত্ব ® সংরক্ষিত। একুশে-টেলিভিশন | এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি