যেভাবে তৈমুর লংয়ের হাতে পর্যুদস্ত হয়েছিল ওসমানীয় বায়েজিদ
প্রকাশিত : ১৯:৩২, ২৩ আগস্ট ২০২৩
তুর্কী-মোঙ্গল সেনাধ্যক্ষ তৈমুর লং ছিলেন তিমুরীয় সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠাতা। ১৩৭০ থেকে ১৪০৫ সাল পর্যন্ত পঁয়ত্রিশ বছর ছিলো তার রাজত্ব। আজকের দিনের তুরষ্ক, সিরিয়া, ইরাক, কুয়েত, ইরান থেকে মধ্য এশিয়ার অধিকাংশ অংশ (কাজাখস্তান, আফগানিস্তান, রাশিয়া, তুর্কমেনিস্তান, উজবেকিস্তান, কিরগিজস্তান, পাকিস্তান, ভারত, এমনকি চীনের কাশগর পর্যন্ত) তার সাম্রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত ছিলো।
এই তৈমুর লংয়ের সাথে ওসমানীয় সুলতান বায়েজিদের বিরোধ শুরু হয় সাম্রাজ্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে। শুরুতে পরিস্থিতি অতটা উত্তপ্ত ছিলো না। কিন্তু তৈমুরের এক চিঠির জবাবে বায়েজিদের রাগান্বিত প্রত্যুত্তর আস্তে আস্তে ঘোলাটে করে ফেলে পুরো ব্যাপারটিই। আঙ্কারার যুদ্ধ সম্পর্কে জানতে হলে শুরুতে তাই আমাদের জানতে হবে বিখ্যাত এ দুই বিজেতার মাঝে সম্পর্ক খারাপ কীভাবে হলো সেই ইতিহাস।
আনাতোলিয়া অঞ্চলে নিজের প্রভাব বিস্তৃত করে চলছিলেন ওসমানীয় সাম্রাজ্যের চতুর্থ সুলতান প্রথম বায়েজিদ। একে একে বিভিন্ন অঞ্চলই মেনে নিচ্ছিলো তাদের আনুগত্য। এ সময়েই কিছু আমির পালিয়ে চলে যান সীমান্তবর্তী তিমুরীয় সাম্রাজ্যে। তারা গিয়ে তৈমুর লংয়ের কাছে আশ্রয় প্রার্থনা করলে তিনি তা মঞ্জুর করেন। অন্যদিকে জালায়িরীদ শাসক সুলতান আহমেদ এবং ক্বারা ক্বয়োনলু নামক এক শিয়া অঘুজ তুর্কী গোত্রের প্রধান ক্বারা ইউসুফকে আশ্রয় দিয়েছিলেন সুলতান বায়েজিদ। এ দুজনই আবার ছিলেন তৈমুরের ঘোর প্রতিপক্ষ।
নিজের শত্রুদেরকে পার্শ্ববর্তী সাম্রাজ্যে এভাবে সমাদৃত হতে দেখাটা মোটেই সুখকর ছিলো না তৈমুরের জন্য। তাই তিনি চিঠি লিখলেন বায়েজিদের কাছে, ফেরত চাইলেন বিদ্রোহীদের। এ চিঠিতে তিনি ইউরোপীয়দের বিরুদ্ধে ওসমানীয় বাহিনীর যুদ্ধজয়ের প্রশংসা করেছিলেন বলে জানা যায়। তবে সেই সাথে যারা তার বিরুদ্ধে যায়, তাদের পরিণতিও যে সুখকর হয় না, সেই কথাও তিনি স্মরণ করিয়ে দিয়েছিলেন সুলতানকে।
মাত্র কিছুদিন আগেই নিকোপলিসের যুদ্ধে জয় পেয়েছিলেন সুলতান বায়েজিদ। তৈমুর লংয়ের চিঠিকে তাই আমলেই নিলেন না তিনি। বরং এমন চিঠি পেয়ে ক্রোধান্বিত হয়ে অপমানসূচক ভাষায় কিছু কড়া কথা শুনিয়ে দেন তিনি তৈমুরকে। এ আগুনে ঘিও ঢেলেছিলেন সুলতান নিজেই। ১৩৯৯-১৪০০ সালের শীতে নিজের ছেলে এবং একইসাথে ওসমানীয়দের অনুমিত ভবিষ্যত সুলতান সুলায়মান সেলেবিকে তিনি পাঠান আর্মেনিয়ায়। সেখানে তৈমুরের মিত্র এর্জিনকানের তাহার্তেনকে আক্রমণ করে কামাখ শহর দখল করে নেন তিনি। এমন কিছু মোটেই প্রত্যাশা করেন নি তৈমুর। তবে জবাব দিতেও তিনি বিন্দুমাত্র কার্পন্য করেন নি।
১৪০০ সালের গ্রীষ্মে সিভাসে ঝড়ের বেগে গিয়ে এক তাণ্ডবলীলা চালিয়ে আসেন তিনি। ওসমানীয় সাম্রাজ্যের অধীনে থাকা সেই এলাকার মুসলিমদের অধিকাংশকে মুক্তিপণের বিনিময়ে ছেড়ে দেয়া হলেও আর্মেনীয় খ্রিষ্টানদের অনেককেই হত্যা করা হয়েছিলো বলে জানা যায়। এরপর তৈমুর যাত্রা শুরু করেন মিশরের উদ্দেশ্যে। তবে ততক্ষণে ইতিহাস বিখ্যাত দুই সমরনায়কের মাঝে যুদ্ধের পথ উন্মুক্ত হয়ে গেছে।
ওদিকে সুযোগের অপেক্ষায় ছিলো কনস্টান্টিনোপলও। সুলতান বায়েজিদ তখন নিকোপলিসের যুদ্ধের পর আবারো অবরোধ শুরু করেছেন সেখানে। ফলে অভাব-অনটন আস্তে আস্তে ঘিরে ধরা শুরু করে নগরবাসীকে। তখন বাইজান্টাইনদের সম্রাট ছিলেন ম্যানুয়েল দ্বিতীয় পালাইয়োলগোস। তিনি তার আত্মীয় জনকে কিছুদিনের জন্য রাজপ্রতিভূ হিসেবে নিযুক্ত করে গোপনে গোপনে ১৩৯৯ সালে পাড়ি জমান ইউরোপে। সেখানে বিভিন্ন রাজদরবারে সাহায্যের আশায় ঘুরতে লাগলেন তিনি।
রোম, মিলান, প্যারিসে রাজা ষষ্ঠ চার্লস, এমনকি ইংল্যান্ডে রাজা চতুর্থ হেনরির সাথেও দেখা করে আসেন তিনি। ফ্রান্সের রাজা তাকে কনস্টান্টিনোপল থেকে উদ্ধারের জন্য আগেই নাইটদের দিয়ে সহায়তা করেছিলেন। তাই নতুন করে সাহায্য পাঠাতে নিজের অপারগতা প্রকাশ করেন তিনি। অন্যদিকে নিকোপলিসে পরাজয়ের পর ইউরোপের অন্যান্য পরাশক্তিও নতুন করে ওসমানীয় বাহিনীর সাথে ক্রুসেডে জড়ানোর মতো অবস্থায় ছিলো না। আবার রাজপ্রতিভূর দায়িত্বে থাকা জনও বায়েজিদ বাহিনীর কাছে আত্মসমর্পনের জন্য মানসিক প্রস্তুতি নিচ্ছেন বলে গুজব শোনা যাচ্ছিলো। ফলে সব মিলিয়ে বাইজান্টাইন সাম্রাজ্যের অবস্থা ছিলো টালমাটাল।
ওদিকে তৈমুর আর বায়েজিদের মাঝে উত্তপ্ত চিঠি বিনিময় তখনও চলছিলো। তৈমুর অবশ্য আরেকটি কাজ করেছিলেন। তিনি ‘শত্রুর শত্রু = বন্ধু’ নীতি অবলম্বন করে বায়েজিদের প্রতিপক্ষদের সাথে সম্পর্কোন্নয়নে জোর দেন। যেমন কৃষ্ণ সাগরের উপকূলে অবস্থিত রাজ্য ট্রেবিজন্ডের কথাই বলা যায়, যার রাজা ছিলেন ম্যানুয়েল তৃতীয় কম্নেনস। ওসমানীয় বাহিনীকে পর্যুদস্ত করতে যারা শুরুর দিকে তিমুরীয় বাহিনীর সাথে হাত মিলিয়েছিলো, তিনি ছিলেন তাদের একজন।
১৪০২ সালের শীতকালের কথা। তৈমুর বাহিনীর তৎপরতা দেখেই বোঝা যেতে থাকলো যে, তিনি বোধহয় ওসমানীয় বাহিনীর বিপক্ষে বড় রকমের কোনো অভিযানে নামতে যাচ্ছেন। এ সময় অবশ্য আপত্তি তুলেছিলো তিমুরীয় সাম্রাজ্যের কিছু আমির। তাদের দাবি ছিলো যে, জ্যোতিষীর ভাগ্য গণনায় দেখা গেছে এখন যুদ্ধযাত্রা করা অশুভ। এর জবাবে তৈমুর নিজে একজন জ্যোতিষী নিয়োগ দেন যিনি বরং যুদ্ধের পক্ষেই তার ভবিষ্যদ্বাণী দিয়েছিলেন! এরপর আর তৈমুর দেরি করলেন না, বেরিয়ে পড়লেন আঙ্কারার উদ্দেশ্যে।
তৈমুর অবশ্য একেবারে কোমর বেধেই মাঠে নেমেছিলেন। ওসমানীয় বাহিনীর শক্তি-সামর্থ্য ও পূর্ব ইতিহাস নিয়ে ভালোভাবে জানাশোনা ছিলো বলেই তিনি সমরকন্দে সৈন্য সাহায্য চেয়ে দূত পাঠিয়েছিলেন। পরবর্তীতে এ বাহিনীর নেতৃত্ব দিয়েছিলেন তৈমুরের নাতি মুহাম্মদ সুলতান। উত্তর-পূর্ব প্রান্ত দিয়ে সসৈন্যে আনাতোলিয়ায় প্রবেশ করেন তৈমুর লং। এ বাহিনীরই আরেকটি অংশ এগিয়ে গিয়েছিলো কামাখ শহরে তৈমুরের মিত্র তাহার্তেনের সাহায্যার্থে এবং তারা সফলও হয়।
এরপর আর্জুরুম হয়ে সিভাস নগরীর দিকে অগ্রসর হয় তৈমুরের বাহিনী। পথে সুলতান বায়েজিদের কূটনীতিকদের সাথে দেখা হয়ে যায় তার। তাদের সাদরে গ্রহণ করলেও তৈমুর ফিরিয়ে দিয়েছিলেন তাদের আনা উপহারগুলো। উভয়পক্ষই তাদের পূর্বের দাবিতে অটল থাকে। তৈমুরও তাই আর যুদ্ধের সিদ্ধান্ত থেকে সরলেন না। বরং নিজের বাহিনী সম্পর্কে ধারণা দিতে নিয়ে গেলেন সেই কূটনীতিকদের। চাগাতাই, পারস্য, জর্জিয়া, ভারত এবং আরো অনেক এলাকা থেকে আসা সৈন্যরা একে একে প্যারেড করে যায় তাদের সামনে দিয়ে, বাহিনীর নেতারা আনুগত্য প্রদর্শন করেন তৈমুরের প্রতি। সেখানে অশ্বারোহী তীরন্দাজের সংখ্যাই ছিলো বেশি। এছাড়া ভারী অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত যোদ্ধা যেমন ছিলো, তেমনি ছিলো ভারত থেকে আনা যুদ্ধ হাতিও!
বসে ছিলেন না সুলতান প্রথম বায়েজিদও। নিজের এলাকার পাশাপাশি মিত্র রাজ্যগুলো থেকে সৈন্য সংগ্রহে ব্যস্ত হয়ে পড়েছিলেন তিনি নিজেও। এদের মাঝে অবশ্য আগের মতোই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ছিলো জেনিসারি বাহিনী ও সিপাহীরা। সার্বিয়া থেকে ভারী অস্ত্রে সজ্জিত বিশাল অশ্বারোহী বাহিনী নিয়ে এসেছিলেন বায়েজিদের আত্মীয় ও সার্বিয়ার সামন্তরাজ স্টেফান লাজারেভিচ। ক্রিমিয়া থেকে এসেছিলো একদল কিপচ্যাক তাতার। আবার কারামান ও ইরেৎনা থেকেও এসেছিলো অশ্বারোহী সেনারা।
তৈমুর লং কিংবা সুলতান বায়েজিদ- কার বাহিনীতে ঠিক কত সংখ্যক সেনা ছিলো সেই বিষয়ে বিস্তর দ্বিমত রয়েছে ঐতিহাসিকদের মাঝে। তৈমুর যে বাহিনী নিয়ে যুদ্ধ করতে এসেছিলেন বায়েজিদের সাথে, তাদের সাথে পরবর্তীতে বায়েজিদ বাহিনীর সাথে বিশ্বাঘাতকতা করা অন্যরাও যোগ দিয়েছিলো। সাদারল্যান্ড মেঞ্জিসের মতে উভয় পক্ষেই ছিলো প্রায় দশ লক্ষের মতো সেনা। পিটার ফ্রেডেট অবশ্য তৈমুর ও বায়েজিদ বাহিনীর বেলায় এ সংখ্যা যথাক্রমে ৮,০০,০০০ ও ৪,০০,০০০ বলেই উল্লেখ করেছেন। রবার্ট হেনলোপেন ল্যাবার্টন তৈমুর বাহিনীতে ৬,০০,০০০ এবং বায়েজিদ বাহিনীতে মাত্র ১,২০,০০০ এর মতো সেনা উপস্থিত ছিলো বলে জানিয়েছেন। আধুনিক যুগের ঐতিহাসিকেরা অবশ্য সৈন্য সংখ্যা এত বিশাল বলে মানতে নারাজ। তাদের মতে তৈমুর লং ও সুলতান বায়েজিদের বাহিনীতে যথাক্রমে ১,৪০,০০০ ও ৮৫,০০০ এর মতো সৈন্য ছিলো।
সুলতান বায়েজিদ যখন তার কূটনীতিকদের সাথে তৈমুরের আচরণের কথা জানতে পারলেন, তখন তিনি খুব একটা আশ্চর্য হন নি। বরং কনস্টান্টিনোপলের অবরোধ পরিত্যাগ করে তিনি বাহিনী নিয়ে অগ্রসর হয়ে যান আনাতোলিয়ার পথে। তৈমুরের সাথে হিসাব-নিকাশ এবার পাকাপাকিভাবেই মিটিয়ে নেয়ার পণ করেছিলেন তিনি।
বায়েজিদ বুঝতে পেরেছিলেন যে, যুদ্ধের জন্য তৈমুরের অশ্বারোহী বাহিনী আঙ্কারার সমতল ভূমিকেই বেছে নিবে। তাই তিনি তার বাহিনী নিয়ে সেদিকেই রওয়ানা হয়েছিলেন। দ্রুতবেগে সেখানে পৌঁছে অবশ্য হতাশ হতে হয়েছিলো তাদের। কারণ সেখানে পৌঁছানোর পর তারা জানতে পারে যে, সিভাসের উত্তরে টোকাত অঞ্চলে তখন ধ্বংসযজ্ঞ চালাচ্ছে তিমুরীয় বাহিনী। যখন তারা বায়েজিদ বাহিনীর এখানে আসার কথা শুনতে পেলো, সাথে সাথেই তৈমুর তার বাহিনীকে ঝড়ের বেগে সিভাস থেকে দক্ষিণ-পশ্চিমে যেতে নির্দেশ দিলেন। কিজিলির্মাক নদীর তীর ধরে তারা কায়সেরিতে পৌঁছে। সেখানে অল্প বিশ্রাম ও ঘোড়াগুলোকে খাওয়ানোর পর তারা আবার রওয়ানা হয়ে পড়ে, উদ্দেশ্য তখন যত তাড়াতাড়ি সম্ভব আঙ্কারায় পৌঁছা। আসলে এটা ছিলো তৈমুর লংয়ের চমৎকার এক কৌশল। একদিকে তিনি যেমন ওসমানীয় বাহিনীকে অতিরিক্ত ঘুরিয়ে ভ্রমণক্লান্তিতে জর্জরিত করতে চাচ্ছিলেন, তেমনি যুদ্ধক্ষেত্র নির্বাচনের স্বাধীনতাও পেয়েছিলেন তিনি। এর ফলে সকল সমীকরণই যে একসময় তার পক্ষে যাওয়া শুরু করে তা আমরা একটু পরেই দেখতে পাবো।
টানা আটদিন বিরামহীন যাত্রার পর অবশেষে আঙ্কারায় এসে পৌঁছে ওসমানীয় বাহিনী। একটানা বিরামহীন এ যাত্রার ফলে পিপাসা ও ক্লান্তিতে কাবু হয়ে পড়েছিলো তাদের অধিকাংশ সেনাই। ওদিকে তৈমুর ঠিকই চুবুক শহরের উত্তর-পূর্বদিকে প্রয়োজনীয় প্রতিরক্ষামূলক ব্যবস্থা গ্রহণের মতো যথেষ্ট সময় পেয়েছিলেন। বায়েজিদ সেখানে এসে পৌঁছান ২৭ জুলাই। তার জেনারেলদের অনেকেই তাকে প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা গ্রহণের পরামর্শ দিয়েছিলো। তবে সেই পরামর্শ আমলে না নিয়ে বরং আক্রমণাত্মক রণকৌশলই বেছে নিয়েছিলেন সুলতান।
এবার আসা যাক কোন বাহিনী কীভাবে তাদের সেনাদের সাজিয়েছিলো সেই আলোচনায়। লাল রঙ দিয়ে ওসমানীয় বাহিনী এবং নীল রঙ দিয়ে তিমুরীয় বাহিনীকে বোঝানো হয়েছে।
অনেকটা অর্ধচন্দ্রাকারে সাজানো ওসমানীয় বাহিনীর ডান ভাগের নেতৃত্বে ছিলেন সুলতান বায়েজিদের ছেলে সুলায়মান সেলেবি। রুমেলীয় বাহিনী এবং আনাতোলিয়া থেকে আগত তুর্কি যোদ্ধাদের সমন্বয়ে গঠন করা হয়েছিলো এ বাহিনী। বাম দিকের বাহিনীর নেতৃত্বে ছিলেন সার্বিয়ার সামন্তরাজ স্টেফান লাজারেভিচ। এ বাহিনীতে সার্বিয়া থেকে আগত ভারী অস্ত্রে সজ্জিত নাইটদের পাশাপাশি আনাতোলীয় যোদ্ধারাও ছিলো। মাঝখানের বাহিনীটি সাজানো হয়েছিলো জেনিসারি ও আজাপদের দিয়ে যার নেতৃত্বে ছিলেন সুলতান নিজেই। সেই সাথে ছিলো তার তিন ছেলে- ঈসা, মূসা ও মুস্তফা।
এবার আসা যাক তিমুরীয় বাহিনীর কথায়। ডান ও বাম দিকের বাহিনীর নেতৃত্বে ছিলেন যথাক্রমে তৈমুরের দুই পুত্র শাহরুখ ও মিরান শাহ। সবচেয়ে শক্তিশালী ছিলো তাদের বাহিনীর মধ্যভাগ যার নেতৃত্বে ছিলেন মুহাম্মদ সুলতান। এখানে সমরকন্দ থেকে আসা ভারী অস্ত্র ও বর্মে সজ্জিত অশ্বারোহী বাহিনীর পাশাপাশি ভারত থাকা আনা যুদ্ধ হাতির পালও ছিলো। মধ্যভাগের পেছনে থাকা রিজার্ভ ডিভিশনের নেতৃত্বে ছিলো তৈমুর নিজে।
যুদ্ধ শুরু হয়েছিলো ১৪০২ সালের ২৮ জুলাই সকাল নয়টা, মতান্তরে সকাল দশটায়। যুদ্ধের বর্ণনা দেয়ার আগে এক্ষেত্রে যুদ্ধক্ষেত্র সম্পর্কেও আমাদের জানা দরকার। কারণ এ যুদ্ধে তৈমুর লং যুদ্ধক্ষেত্র নিয়ে যে কৌশলের পরিচয় দিয়েছিলেন তা তার পরবর্তী বিজয়ে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রেখেছিলো।
আঙ্কারার যুদ্ধক্ষেত্রটি ছিলো দুপাশে পাহাড় দিয়ে ঘেরা বিশাল এক সমতল ভূমি। পশ্চিম দিকের পর্বতমালা থেকে নেমে এসেছিলো চুবুক খাঁড়ি। এর পানি এসে প্রথমে জমা হচ্ছিলো একটি জলাশয়ে। পরে সেখান থেকে তা উত্তর ও দক্ষিণের বিভিন্ন অংশে প্রবাহিত হচ্ছিলো। অর্থাৎ যুদ্ধক্ষেত্রের একমাত্র সুপেয় পানির উৎস ছিলো এ খাঁড়ির পানি। যে দল জলাশয়ের নিয়ন্ত্রণ নিতে পারবে, পুরো এলাকার পানির নিয়ন্ত্রণও থাকবে সেই দলের হাতেই। যুদ্ধ করতে গিয়ে ক্লান্ত ও পিপাসার্ত ওসমানীয় বাহিনী খুব বেশি পানি পান করতে পারে নি। কারণ তিমুরীয় বাহিনী একদিকে যেমন আশেপাশের এলাকার সব কুয়া ধ্বংস করে দিয়েছিলো, তেমনি বাঁধ দিয়ে বদলে দিয়েছিলো উপরে উল্লেখ করা সেই পানির উৎসের গতিপথ। শুধুমাত্র পানি নিয়ে খাটানো এ কৌশলই বলা যায় যুদ্ধে তৈমুরের বাহিনীকে বিজয়ের দিকে অনেকখানি এগিয়ে দিয়েছিলো, মানসিকভাবে করে তুলেছিলো অধিক বলীয়ান।
সুলতান বায়েজিদের নির্দেশে তৈমুরের বাহিনীর উদ্দেশ্যে এগিয়ে যায় ওসমানীয় বাহিনীর দুই পাশের সেনারা। কিন্তু তিমুরীয় বাহিনীর বৃষ্টির মতো ছোঁড়া তীর আর ন্যাপথা ফায়ারবলের কাছে টিকতে পারে নি ডানদিকের বাহিনীটি। বাম দিকে থাকা স্টেফানের নাইট বাহিনী অবশ্য বীরত্বের পরিচয় দিয়েছিলো। শুরুতে তাদের তুমুল আক্রমণের ফলে পিছু হটতে বাধ্য হয় তৈমুরের বাহিনী।
অল্প সময়ের মাঝেই বিশ্বাসঘাতকেরা তাদের মুখোশ উন্মোচন করতে শুরু করে। কারামান, আয়দীন ও মেন্তেশ থেকে আগত তুর্কীরা সুযোগ বুঝে যোগ দেয় তিমুরীয় বাহিনীর সাথে। এর পেছনে অবশ্য তৈমুরের সুদুরপ্রসারী চিন্তাকেও কৃতিত্ব দিতে হবে। কারণ যুদ্ধ শুরুর আগে বছরখানেক তিনি আসলে একনিষ্ঠভাবে ঠিক এ কাজগুলোই করে যাচ্ছিলেন, যার সুফল অবশেষে পেলেন যুদ্ধের ময়দানে। হঠাৎ করে এভাবে লোকবল কমে যাওয়ায় বিপদে পড়ে যায় শুরুতে ত্রাসের সঞ্চার করা স্টেফানের বাহিনী। তিমুরীয় বাহিনীর ডানদিকের সাথে কুলিয়ে উঠতে না পেরে পিছু হটতে বাধ্য হয় তারা। অপরদিকে ওসমানীয়দের ডানদিকের বাহিনীর উপর এরপর ঝাঁপিয়ে পড়ে তিমুরীয় সেনারা। আগের তীর আর আগুন বৃষ্টির পর এবার সৈন্যদের হামলা আর সামলাতে পারে নি তারা। তাই ঠিকমতো যুদ্ধ শুরু করার আগেই যুদ্ধে হেরে গেছেন ভেবে স্বীয় বাহিনী নিয়ে পালিয়ে যান সুলায়মান সেলেবী।
ততক্ষণে বিশ্বাসঘাতকদের কারণে বেশ দুর্বল হয়ে পড়েছিলো ওসমানীয় বাহিনী। তবুও যুদ্ধক্ষেত্র ছেড়ে যান নি সুলতান বায়েজিদ, প্রাণপণে লড়ে যাচ্ছিলেন তার সাথে থাকা জেনিসারিদের নিয়ে। একসময় পালিয়ে যেতে শুরু করে পদাতিক বাহিনীও। তবে জেনিসারিদের সাহায্যার্থে রণাঙ্গন ছাড়ে নি অশ্বারোহী বাহিনী। তখনই তাদের দিকে বিশাল সৈন্যসামন্ত নিয়ে অগ্রসর হন তৈমুর লং নিজেই। তিনদিক থেকে ওসমানীয় বাহিনীকে চেপে ধরে তিমুরীয় বাহিনী।
এক পর্যায়ে হার মানতে বাধ্য হয় ওসমানীয়দের অশ্বারোহী বাহিনীও। তখন সুলতান তার জেনিসারি ও সিপাহীদের নিয়ে কাছেই এক পাহাড়ে পিছু হটতে শুরু করেন। মরণপণ যুদ্ধের শপথই যেন সেদিন নিয়েছিলেন তিনি। স্টেফান লাজারেভিচ অনেক অনুরোধ করেছিলেন সুলতানকে পালিয়ে যাবার জন্য। তবে সুলতান সেই কথায় কর্ণপাত না করে যুদ্ধ চালিয়ে যেতে থাকেন। শেষ পর্যন্ত অবশ্য আর পারে নি ওসমানীয় বাহিনী। তারা পরাজিত হয় তৈমুর লংয়ের বহুজাতিক সেই বাহিনীর কাছে, বন্দী হন সুলতান বায়েজিদ স্বয়ং। তার আরেক ছেলে মুস্তফা সেলেবিও সেদিন বন্দী হয়েছিলেন। তাকে ১৪০৫ সাল পর্যন্ত সমরকন্দে আটকে রাখা হয়েছিলো।
ওসমানীয় ও তিমুরীয় বাহিনীর মরণপণ এ যুদ্ধে শেষপর্যন্ত জয়ী হয় তৈমুর লংয়ের বাহিনীই। যুদ্ধে প্রায় ৫০,০০০ এর মতো তুর্কী সেনা মৃত্যুবরণ করেছিলেন বলে জানা যায়। ওদিকে বন্দী সুলতান বায়েজিদকে নিজের সাথেই নিয়ে যান তৈমুর। অবশেষে বন্দী থাকাকালেই পরের বছরের মার্চ মাসে পরলোকগমন করেন তিনি।
ওসমানীয় সাম্রাজ্যের ইতিহাসে আঙ্কারার এ যুদ্ধের ফলাফল ছিল অত্যন্ত সুদুরপ্রসারী। এর ফলে কিছুদিন আগেই পূর্ব আনাতোলিয়ায় জয় করা অঞ্চলগুলো হাতছাড়া হয় ওসমানীয়দের। তৈমুর সেগুলো তাদের পূর্বের শাসকদের হাতেই তুলে দিয়েছিলেন। অপরদিকে ক্ষমতার দ্বন্দ্ব শুরু হয় সুলতানের ছেলেদের মাঝে, শুরু হয় অরাজকতা। প্রায় এক দশক ধরে চলা এ অরাজক সময়ে টলে উঠেছিল পুরো ওসমানীয় সাম্রাজ্যই, হুমকির মুখে পড়ে গিয়েছিলো তাদের অস্তিত্ব। অবশ্য একসময় তা কাটিয়ে উঠতে সক্ষম হয় তারা, ক্ষমতায় আসেন ওসমানীয় সাম্রাজ্যের পঞ্চম সুলতান প্রথম মুহাম্মদ। ধীরে ধীরে আবারো শক্তিশালী হতে শুরু করে ওসমানীয় বাহিনী, ফিরে পেতে থাকে তাদের হারানো গৌরব, সম্প্রসারিত হতে শুরু করে তাদের সীমানা, বাড়তে শুরু করে তাদের প্রভাব-প্রতিপত্তি।
ওসমানীয় সাম্রাজ্যের চতুর্থ সুলতান প্রথম বায়েজিদের জীবনে ঘটে যাওয়া যুদ্ধগুলো নিয়ে বর্ণনা শেষ করছি এখানেই। পরবর্তী পর্বে আমরা জানবো তার মৃত্যুর পর এক দশক ধরে চলা অরাজক কাল নিয়েই। আজকের মতো তাই বিদায় নিচ্ছি এখানেই।
এমএম//