যে কারণে মনোনয়ন পাননি আজমত
প্রকাশিত : ১৮:৪৩, ১০ এপ্রিল ২০১৮
স্বাধীনতার পর গাজীপুরে আওয়ামী লীগের ইতিহাস আর আজমত উল্লাহ খানের রাজনীতি এক সুতোয় গাঁথা। একটিকে বাদ দিয়ে অন্যটি ভাবা যায় না। গাজীপুরের প্রতিটি অলি-গলি ও রাজপথ ঘুরে সংগঠনকে গড়ে তোলেছেন। দুই দশকেরও বেশি সময় ধরে প্রতিটি আন্দোলন-সংগ্রামে অগ্রভাগে থেকে দলীয় কর্মসূচি বাস্তবায়ন করেছেন।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আইন বিভাগে প্রথম ব্যাচের ছাত্র আজমত উল্লাহ খান। মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিয়েছেন সক্রিয় ভাবে। তরুণ বয়সে টঙ্গী পৌরসভার চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন। পর পর তিনবার ছিলেন এই দায়িত্বে। নিজ হাতে তিলে তিলে গড়ে তুলেছেন গাজীপুরে আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক ভিত। প্রতিটি পাড়া ও অলিগলিতে আছে তার অবাধ বিচরণ। গাজীপুর জেলা আওয়ামী লীগের সাধারন সম্পাদক ছিলেন তিন বার। তখন তার কমিটির সভাপতি ছিলেন বর্তমানে মুক্তিযোদ্ধা বিষয়ক মন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হক।
গত সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনেও আওয়ামী লীগের দলীয় প্রার্থী ছিলেন আজমত উল্লাহ খান। তবে বিপুল ভোটের ব্যবধানে হেরে যান বিএনপি প্রার্থী এমএ মান্নানের কাছে। অবশ্য আজমত উল্লাহ খান নিজে সেজন্য দায়ী করেছিলেন জাতীয় রাজনীতিকে। ওই সময়ে দেশের অন্য সবকটি নির্বাচনেও হেরে গিয়েছিল আওয়ামী লীগের প্রার্থী। আজমত উল্লাহ খানের দাবি, এক শ্রেণীর মৌলবাদী গোষ্ঠী ধর্মীয় উস্কানি তুলে তাকে হারিয়ে দিয়েছে।
আজমত উল্লাহ খান এবারও গাজীপুর সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনে আওয়ামী লীগের শক্ত মনোনয়ন প্রত্যাশী ছিলেন। তবে সব জল্পনা কল্পনার অবসান ঘটিয়ে দল শেষ পর্যন্ত মনোনয়ন দেয় আওয়ামী লীগের আরেক মনোনয়ন প্রত্যাশী জাহাঙ্গীর আলমকে। সেই হিসেবে আগামী ১৫ মে অনুষ্ঠিত হতে যাওয়া সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনে জাহাঙ্গীর আলম হচ্ছেন আওয়ামী লীগের প্রার্থী।
তবে যে যাই বলুক, আজমত উল্লাহ খান মনোনয়ন না পেলেও তার রাজনৈতিক ভবিষ্যত নিয়ে প্রশ্ন তোলার সুযোগ নেই গাজীপুরের রাজনীতিতে। সে কথা স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী ও দলীয় সভানেত্রী শেখ হাসিনাও জানেন।
জানা গেছে, প্রধানমন্ত্রী ও দলীয় সভানেত্রী শেখ হাসিনার সভাপতিত্বে মনোনয়ন বোর্ড আনুষ্ঠানিক বৈঠকে বসার আগে শেখ হাসিনা আজমত উল্লাহ খানকে ডেকে নেন। এ সময় প্রধানমন্ত্রী আজমত উল্লাহ খানকে বলেন, ‘আপনি দলের ত্যাগী নেতা। দলের জন্য সারাজীবন অনেক পরিশ্রম করেছেন। আপনাকে দল মূল্যায়ন করবে। কিন্তু রাজনীতির কিছু কৌশল আছে। কৌশলগত কারণেই এবারের নির্বাচনে আপনাকে মনোনয়ন দেওয়া যাচ্ছে না।’
প্রধানমন্ত্রীর এমন কথার পর আজমত উল্লাহ খান বলেন, ‘আমি বঙ্গবন্ধুর আদর্শের কর্মী। নেত্রী হিসেবে আপনার প্রতি আমার শতভাগ আস্থা আছে। আপনার আদেশ আমার কাছে সবচেয়ে বড়।’
পরে গণমাধ্যমে দেওয়া বক্তব্যেও একই কথার পুণরাবৃত্তি করেন আজমত উল্লাহ খান। একুশে টেলিভিশন অনলাইনকে টেলিফোনে আজমত উল্লাহ খান বলেন, নেত্রীর নির্দেশ আমার কাছে মেয়র পদের চেয়ে অনেক বড়। তিনি যা বলবেন আমি তাই করব। তিনি আমাকে যে ভালোবাসা দিয়েছেন সেজন্য আমি কৃতজ্ঞ।
রাজনীতি করতে করতে চুল পাকানো আজমত উল্লাহ খান কেন ছিটকে পড়লেন নির্বাচনী মনোনয়ন থেকে এমন প্রশ্ন ঘুরপাক খাচ্ছে অনেকের মুখে মুখে। কেউ কেউ বিষয়টি কৌশলে এড়িয়ে গেলেও অনেকে আবার নিজের মতো করেই ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ দাড় করচ্ছেন। তবে দলের দায়িত্বশীল সূত্র জানিয়েছে, গাজীপুরের নির্বাচনকে এ মুহূর্তে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিচ্ছে কেন্দ্রীয় আওয়ামী লীগ। সেজন্য কোনো ধরণের ঝুঁকি নিতে চায় নি। গত নির্বাচনে আজমত উল্লাহ জয়ের ব্যাপারে শতভাগ আশাবাদী ছিলেন। কিন্তু এত বড় ব্যবধানে হেরে যাওয়ার ধাক্কা সহজে নিতে পারেন নি আজমত। এজন্য বেশ কিছুদিন নিজেকে গুটিয়ে রাখেন। এই সুযোগে অপর মনোনয়ন প্রত্যাশী জাহাঙ্গীর আলম মাঠ গুছিয়ে নেন। মহানগরের ৫৭ ওয়ার্ডে আওয়ামী লীগের কমিটি না থাকলে জাহাঙ্গীর আলম নিজের নামে ফাউন্ডেশন করে তাতে প্রতিটি ওয়ার্ডের বিভিন্ন শ্রেণী পেশার মানুষকে যুক্ত করেন। যদিও পরবর্তীতে আজমত সক্রিয় হয়ে উঠেন মনোনয়ন পেতে কিন্তু তৃণমূলের সঙ্গে তার একটা দূরত্ব তৈরি হয়ে যায়। যদিও এসব বিষয়ে মহানগর ও জেলা আওয়ামী লীগের নেতারা স্পষ্ট করে কিছু বলতে চান নি। সবাই দলীয় সিদ্ধান্তের কথা বলেই দায় এড়াতে চাইছেন।
গাজীপুর জেলা আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মতিউর রহমান মতি এ বিষয়ে বলেন, এটা দলীয় সিদ্ধান্ত। স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী মনোনয়ন নির্ধারণ করেছেন। তাই এখানে আর কিছু বলার নেই।
কেন আজমত উল্লাহ খানকে মনোনয়ন না দিয়ে জাহাঙ্গীর আলমকে মনোনয়ন দেওয়া হলো এমন প্রশ্নের জবাবে গাজীপুর জেলা আওয়ামী লীগের সহ সভাপতি ওয়াজ উদ্দিন মিয়া একুশে টেলিভিশন অনলাইনকে বলেন, আওয়ামী লীগের পর্যবেক্ষক টিমের রিপোর্ট অনুযায়ী জনমত জরিপে যিনি এগিয়ে আছেন তাকেই মনোনয়ন দেওয়া হয়েছে। তরুণ ও নতুন ভোটারদের মধ্যে জাহাঙ্গীর আলমের অবস্থান ভালো। সেসব বিবেচনায় নিয়েই জাহাঙ্গীর আলমকে মনোনয়ন দিয়েছে দল। আজমত উল্লাহ খানকে দল এখনো মনোনয়ন না দিলেও তার সহযোগিতা ছাড়া নির্বাচন কঠিন হয়ে হয়ে পড়বে বলে জানালেন ওয়াজ উদ্দিন মিয়া।
তরুণদের আধিক্যে বয়সে প্রবীণ আজমত উল্লাহ খান কিছুটা কোনঠাসা হয়ে পড়েছেন। এমন আভাস পাওয়া যায় আরেক মনোনয়ন প্রত্যাশী নেতা গাজীপুর মহানগর যুবলীগের আহবায়ক কামরুল আহসান সরকার রাসেলের বক্তব্যে। তিনি বলেন, আজমত সাহেব পুরোনো নেতা। তার অভিজ্ঞতা ও অবদানকে কোনোটাই কম নয়। তবে তিনি আমাদের সকলকে ঐক্যবদ্ধ রাখতে ব্যর্থ হয়েছেন।
স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতাদের অভিমত, গাজীপুরে এবারের নির্বাচনে তরুণ ভোটাররা মূল ফ্যাক্টর হয়ে উঠবে। সেটি মাথায় রেখেই তরুণদের কাছে জনপ্রিয় জাহাঙ্গীর আলমকে বেছে নিয়েছে দল। জাহাঙ্গীর গত এক দশক ধরে তরুণ ভোটারদের কাছে টানতে নানা কার্যক্রম চালিয়ে আসছেন। অন্যদিকে আজমত উল্লাহ খানের ফোকাস ছিল প্রবীণ আওয়ামী লীগাররা।
গাজীপুর বারের তরুণ নেতা অ্যাডভোকেট প্রশান্ত কুমার সরকার। তিনি বলেন, জাহাঙ্গীর আলমের জন সম্পৃক্ততা আজমত উল্লাহ খানের চেয়ে অনেক বেশী। তিনি অকাতরে ব্যয় করেন। কেউ কখনো তার কাছ থেকে খালি হাতে ফেরেনা। রাজনীতিবিদ হলেও রাজনীতির বাইরে সাধারণ মানুষের সঙ্গে তার যোগাযোগ ভালো। নারী, তরুণ, মসজিদের ইমাম- সব শ্রেণীতে তার যোগাযোগ আছে। সব মিলিয়ে আজমত উল্লাহ খান এসব ব্যপারে পিছিয়ে পড়েছেন।
আজমত উল্লাহ খান মনোনয়ন না পাওয়ার ক্ষেত্রে তার দোষত্রুটি না দেখে জাহাঙ্গীর আলমের জনসম্পৃক্ততাকেই ক্রেডিট দিচ্ছে তৃণমূল আওয়ামী লীগ।
/ এআর /
আরও পড়ুন