যে ১০ কারণে খুলনায় মঞ্জুর ভরাডুবি
প্রকাশিত : ১৪:৪৫, ১৭ মে ২০১৮
খুলনা সিটি করপোরেশন (কেসিসি) নির্বাচনে ভরাডুবি হয়েছে বিএনপির মেয়র প্রার্থী কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক সম্পাদক ও নগর কমিটির সভাপতি নজরুল ইসলাম মঞ্জুর। হেভিওয়েট এই প্রার্থীর প্রায় ৬৮ হাজার ভোটের ব্যবধানে পরাজয়ে হতাশ তৃণমূলের নেতাকর্মীরা। এত আশা জাগিয়েও শেষ পর্য্যন্ত মঞ্জু কেন জয় পেলেন না এ নিয়ে চলছে দলটির নেতাকর্মীদের চুলচেরা বিশ্লেষণ।
মঞ্জুর পরাজয়ের নেপথ্যে প্রাথমিকভাবে মোটাদাগে ১০টি কারণ চিহ্নিত করেছেন খুলনার নেতাকর্মীরা। এগুলো হচ্ছে-মেয়র হয়ে গত পাঁচ বছরে উন্নয়ন কাজে মনিরুজ্জামান মনির ব্যর্থতা, বিগত দিনে উন্নয়ন বঞ্চনার প্রচারের যুক্তিসঙ্গত জবাব দিতে না পারা, মনোনয়ন না পেয়ে আচরণবিধির দোহাই দিয়ে দলীয় মেয়র ও নগর বিএনপির সাধারণ সম্পাদক মনিরুজ্জামান মনির নির্লিপ্ততা এবং মঞ্জুর পক্ষে জোরালোভাবে কাজ না করা, দলীয় সংহতি ও ঐক্যমত সৃষ্টি না হওয়া (বিশেষ করে কাউন্সিলর প্রার্থীরা নিজেদের জন্য ব্যস্ত থাকা), দীর্ঘদিনের সাংগঠনিক বিশৃঙ্খলা, মতানৈক্য ও অন্তর্কোন্দল নিরসন না করে চেপে রাখা, মামলা ও সম্ভাব্য গ্রেফতার নিয়ে তৃণমূল কর্মীদের উদ্বেগ ও প্রকাশ্যে স্বাভাবিকভাবে কাজ করতে না পারা, কেন্দ্রীয় নেতারা কথার শক্তির সঙ্গে কাজের শক্তির মিল না থাকা, নির্বাচনে শেষ পর্যন্ত থাকা না থাকা নিয়ে দোলাচল,কোনো কোনো কেন্দ্রে জালভোট ও প্রশাসনের নিরব ভূমিকা।
মঞ্জুর নির্বাচনি কার্যক্রম পর্যালোচনায় দেখা যায়, এবারের নির্বাচনে বিএনপির কাউন্সিলর প্রার্থীরা সংঘবদ্ধ ভোট চাওয়ার চেয়ে একক ভোট পেতে তৎপর ছিলেন। মঞ্জু এলাকায় গেলে ওই সব প্রার্থী সঙ্গে ছিলেন মঞ্জুর দলীয় কাউন্সিলর প্রার্থী হিসেবে প্রচার পেতে। কিন্তু তার অনুপস্থিতিতে যখন তারা ভোটারদের বাড়ি বাড়ি প্রচারণা চালিয়েছেন সেখানে কেবল নিজের জন্যই ভোট চেয়েছেন।
কেন্দ্রীয় বিএনপি গাজীপুর নির্বাচন নিয়ে যতোটা ব্যস্ত ছিল, খুলনা নিয়ে অতটা সিরিয়াস ছিল না। তারা ধরে নিয়েছিল খুলনায় মঞ্জুর জনপ্রিয়তা দিয়েই পার পাওয়া যাবে। তাই কেন্দ্রীয় নেতাদের অনেকেই সেখানে যান নি। যারা গিয়েছেন তারা ভোট চাওয়ার চেয়ে ফটোসেশন এবং ভ্রমণেই বেশি ব্যস্ত ছিলেন। অন্যদিকে কেন্দ্রীয় আওয়ামী লীগ, সহযোগী সংগঠন এবং পেশাজীবী সংগঠন খালেকের পক্ষে ছিলেন মরিয়া।
এছাড়া সাংগঠনিক দুর্বলতাগুলো জানা সত্ত্বেও মিটিয়ে ফেলার চেষ্টা থাকলেও তা সম্ভব হয়নি। নির্বাচনে প্রার্থী হওয়া নিয়ে জেলা বিএনপির সভাপতি শফিকুল আলম মনার সঙ্গে তার দূরত্ব তৈরি হওয়ায় ভারসাম্যহীনতা নষ্ট হয়। পরে অবশ্য মনাকে তার প্রধান নির্বাচনি এজেন্ট করা হয়। একইসঙ্গে বিএনপি নেতা আলী আসগর লবী গ্রুপের নেতা-কর্মীরা মাঠে প্রকাশ্যে না থাকাটাও ছিল চোখে পড়ার মতো।
দলীয় বিরোধে বহিষ্কার হওয়া মহানগর কোষাধ্যক্ষ আরিফুর রহমান মিঠুর নীরবতা পালনও ছিল মঞ্জুর পরাজয়ের কারণগুলোর অন্যতম। তার পক্ষের কর্মীরা এলাকায় মেয়রের পক্ষে সক্রিয় না থাকায় এর নেতিবাচক প্রভাব পড়ে ভোটে।
বর্তমান মেয়র মনিরুজ্জামান মনি বিধি নিষেধের কারণে প্রকাশ্যে মেয়র প্রার্থীও পক্ষে অবস্থান নিতে পারেননি। তিনি দলের মহানগর কমিটির সাধারণ সম্পাদক। কার্যক্রমে তার অনুপস্থিতি তৃণমূলের কর্মী সমর্থক ও সাধারণ জনমনে নেতিবাচক প্রভাব ফেলে। আর নির্বাচিত হওয়া নিয়ে বিএনপি নেতাদের অতিমাত্রায় আত্মবিশ্বাস ছিল উল্লেখ করার মতো। ফলে অনেক কাজই করার কথা তারা চিন্তায় নিতে পারেননি। এছাড়া মনির সমর্থকরা তিনি মনোনয়ন না পাওয়ায় হতাশ হয়েছেন, অনেকে কাজ করেননি, ভোটকেন্দ্রেও যান নি কেউ কেউ।
এছাড়া গত ৫ বছর মেয়র পদে থেকে মনিরুজ্জামান মনি তেমন উন্নয়ন কাজ করতে পারেন নি। আগের মেয়াদে তালুকদার আবদুল খালেক ব্যাপক উন্নয়ন করেছিলেন। মনি সেই ধারাবাহিকতা রক্ষা করতে পারেন নি। তাই উন্নয়ন বঞ্চিত নগরবাসী খালেককেই বেছে নিয়েছেন। তারা ধরে নিয়েছেন যে, মঞ্জু মেয়র হলেও উন্নয়ন বঞ্চনা ঘুচবে না খুলনাবাসীর।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, আওয়ামী লীগের মধ্যে দীর্ঘদিন ধরে কোন্দল ছিল। গত নির্বাচনে তালুকদার আবদুল খালেকের পরাজয়ের পেছনে ওই কোন্দল কাজ করেছিল। এবার নির্বাচনে দলীয় হাইকমান্ডের হস্তক্ষেপে ওই কোন্দলের কিছুটা হলেও অবসান হয়েছে।
প্রকাশ্যে কোনো নেতা তালুকদার আবদুল খালেকের বিরোধিতা করতে সাহস পাননি। বিভিন্ন মাধ্যমে স্থানীয় নেতাদের গতিবিধি পর্যবেক্ষণ করা হয়েছে। তিনি আরও বলেন, এবার নির্বাচনে স্থানীয় উন্নয়নের বিষয়টি তুলে ধরেছে আওয়ামী লীগ। এটি জনগণের মাঝে ব্যাপক সাড়া ফেলেছে। জনগণ বুঝেছে, এ নির্বাচনে সরকার পরিবর্তন হবে না, খালেদা জিয়ার মুক্তিও হবে না। মানুষ বিএনপিকে ভোট দিলে উন্নয়নবঞ্চিত হবে।
এদিকে নিজভোট কেন্দ্রে হেরে গেছেন বিএনপির মেয়র প্রার্থী নজরুল ইসলাম মঞ্জু। নগরীর রহিমা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় কেন্দ্রে মঞ্জু পেয়েছেন ৪১০ ভোট ও তালুকদার আবদুল খালেক পেয়েছেন ৫২৯টি ভোট। এটিকে মঞ্জুর নির্বাচনী দূরদর্শিতার অভাব হিসেবেই দেখছেন খুলনাবাসী।
যদিও নজরুল ইসলাম মঞ্জু বলেছেন, নির্বাচনকে ঘিরে পুলিশের ব্যাপক ধরপাকড় ও বিএনপি কর্মী দমনে সক্রিয় অবস্থানের কারণে বিএনপির কার্যক্রম বাধাগ্রস্ত হয়। বিজিবি ও র্যাব সদস্যরা মাঠে থাকলেও ঘুমন্ত অবস্থায় ছিলেন। নির্বাচন কমিশনে সুনির্দিষ্ট অভিযোগ দেওয়ার পরও কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়নি। নির্বাচনের শুরুতেই বিএনপির ঘাঁটি ২২, ২৯, ৩০, ২৪, ২৫, ২৬, ১৯, ১৬, ১৭ নং ওয়ার্ড, খালিশপুরের সব কেন্দ্র ও দৌলতপুরের কিছু কেন্দ্রে বিএনপির কর্মীরা অবস্থান নিতেই পারেনি, যা নৌকার দখলে চলে যায়। এ নির্বাচনে ধানের শীষ যে ভোট পেয়েছে তা ছিল সকাল ১১টার মধ্যের চিত্র। এরপরই চিত্র পাল্টে যায়। বিএনপির ভোট ব্যাংকে নৌকার আঘাত হয়। বিএনপির কর্মীরা সুসংগঠিত ছিল। তাদেরকে কাজ করতে বাধা দেওয়া হয়েছে।
মহানগর বিএনপির নির্বাচন পরিচালনা কমিটির মিডিয়া উপ কমিটির সদস্য সচিব এহতেশামুল হক শাওন গণমাধ্যমকে বলেন, বিএনপির ভোটাররা ভোট দিতে না পারা এবং ভোট কেটে নেওয়ার কারণে এ অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে। বড় দলে বিভেদ মতৈক্য থাকবেই। ক্ষোভ থাকবেই। ব্যক্তির প্রতি ক্ষোভ থাকবেই। তবে, এ নির্বাচনে ব্যক্তি নয়, প্রার্থী ছিল ধানের শীষ। আর তাই দলের কোনও স্তরেই কোনও প্রকার ক্ষোভ কাজ করেনি। সকলেই ধানের শীষের পক্ষে এক ছিলেন।
খুলনা জেলা বিএনপির সভাপতি ও মেয়র প্রার্থীর প্রধান নির্বাচনী এজেন্ট অ্যাডভোকেট এসএম শফিকুল আলম মনা এ বিষয়ে বলেন, আমাদের নেতাকর্মীদের ধরপাকড় করা হয়েছে। এজেন্টদের কেন্দ্রে যেতে দেয়নি। এ কারণে ভোটের দিন নেতাকর্মী ও সাধারণ জনগণ কেন্দ্রে কম ছিল। ভোট কেন্দ্রে মানুষের উপস্থিতি বেশি হলে ফল এমন হতো না। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, আমাদের দলীয় কোন্দল দেখিনি। আমরা ধানের শীষ প্রতীক দেখেছি।
/ এআর /
আরও পড়ুন