রক্তদানে সচেতনতা বাড়লেও মেটেনি প্রয়োজন
প্রকাশিত : ২১:২৯, ১ ফেব্রুয়ারি ২০২১ | আপডেট: ২১:৩৭, ১ ফেব্রুয়ারি ২০২১
স্বেচ্ছায় রক্তদান করছেন একজন নারী
রক্তদান নিয়ে সচেতনতা আগের তুলনায় অনেকটা বাড়লেও এখনো নিরাপদ রক্তদান প্রয়োজনের তুলনায় অপ্রতুল। ফলে পরোক্ষভাবে রক্তের অভাবে মারা যাচ্ছেন অনেক থ্যালাসেমিয়া রোগী। এছাড়াও সচেতনতার অভাবে স্বেচ্ছায় রক্তদাতাদের আধিক্য না থাকায় প্রয়োজনের সময় রক্তের ব্যবস্থা করতে হিমসিম খেতে হচ্ছে রোগীর স্বজনদের। এই সুযোগে আবার গড়ে ওঠেছে অনুমতিহীন অবৈধ ব্লাড ব্যাংকের রমরমা ব্যবসা।
নিরাপদ রক্ত পরিসঞ্চালন কর্মসূচির দপ্তর থেকে প্রাপ্ত তথ্যে জানা যায়, রক্তের প্রকৃত চাহিদার কোনো সুনির্দিষ্ট তথ্য না থাকলেও, দেশে ২০১৯ সালে আনুমানিক ১২ লাখ ইউনিট রক্তের প্রয়োজন ছিল। অন্যদিকে রক্তের যোগ ছিল প্রায় সাড়ে ৮ লাখ ইউনিট। এর ৬০ শতাংশের বেশি রক্তের ব্যবস্থা রোগীর স্বজনরা নিজম্ব মাধ্যমে করে থাকেন। আর ৩০-৩৫ শতাংশ রক্ত আসে স্বেচ্ছায় রক্তদাতাদের কাছ থেকে। অবশিষ্ট রক্ত সংগ্রহ করা হয় পেশাদার রক্ত বিক্রেতাদের কাছ থেকে।
বিশিষ্ট রক্তরোগ বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ডা. এবিএম ইউনুস এ প্রসঙ্গে বলেন, ঘাটতি রক্তের বেশিরভাগই আসে পেশাদার রক্ত বিক্রেতাদের কাছ থেকে। আর এদের রক্ত খুবই ঝুঁকিপূর্ণ, কারণ এরা অনেকেই আবার নেশাগ্রস্ত। এই ঘাটতি মেটাতে সচেতনতার কোনো বিকল্প নেই। তরুণদের সচেতন করে স্বেচ্ছায় রক্তদানে উদ্বুদ্ধ করতে পারলে বিশুদ্ধ রক্তের ঘাটতি মেটানো যাবে।
সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, বাংলাদেশে চাহিদা অনুযায়ী সরাসরি রক্তের যোগান রোগীর স্বজনরা বিভিন্নভাবে পূরণ করে থাকেন। কিন্তু থ্যালাসেমিয়া রোগীরা নিয়মিত রক্ত যোগান দিতে না পেরে একপর্যায়ে মারা যায়। যা প্রকৃত হিসাবে আসে না।
বাংলাদেশ সরকারের স্বাস্থ্য অধিদফতরের (ডিজিএইচএস) তথ্য অনুযায়ী, সারাদেশের বিভিন্ন হাসপাতাল ও স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনের মাধ্যমে মূলত রক্ত সংগ্রহ করা হয়। এরমধ্যে স্বেচ্ছাসেবী সংস্থাগুলো মোট চাহিদার প্রায় ৩০ শতাংশ সরবরাহ করে এবং বাকিগুলো সরাসরি রোগীর স্বজনদের অনুদান থেকে আসে। তবে ক্রয় করা রক্তের সরাসরি কোনো হিসেব নেই।
রক্তদান নিয়ে কাজ করে বাংলাদেশ রেড ক্রিসেন্ট সোসাইটি (বিআরসিএস), কোয়ান্টাম ফাউন্ডেশন, সন্ধানী, বাঁধন এবং পুলিশ ব্লাড ব্যাংকসহ আরও অনেক সংগঠন। বর্তমানে দেশে সরকারি ৩৯০টি এবং লাইসেন্স নিয়ে বেসরকারিভাবে ১০২টি ব্লাড ব্যাংক রক্ত সংগ্রহ ও বিতরণ করছে। এসব কেন্দ্রে হেপাপাইটিস বি-সি, সিফিলিস, ম্যালেরিয়া এবং এইডসের স্ক্রিনিং ব্যবস্থা চালু রয়েছে।
চিকিৎসকরা জানান, সাধারণত বড় অপারেশনে, বড় দুর্ঘটনায় বেশি রক্তক্ষরণ হলে, সিজারিয়ান অপারেশন, প্রসূতির রক্তক্ষরণে, নবজাতকের রক্তরোগের চিকিৎসায়, হিমোফিলিয়া, ক্যান্সার রোগীর চিকিৎসার সহায়তায়, অগ্নিদগ্ধ রোগীর চিকিৎসায়, রক্তস্বল্পতা রোগের চিকিৎসায় রক্ত পরিসঞ্চালনের প্রয়োজন হয়। তবে থ্যালাসেমিয়া ও কিডনী ডায়ালাইসিসে নির্দিষ্ট বিরতিতে নিয়মিত রক্তের প্রয়োজন হয়। এদের শরীরে প্রতিমাসে এক বা একাধিকবার রক্ত সঞ্চালনের প্রয়োজন হয়।
রক্ত দেওয়া নিয়েও সমাজে রয়েছে অনেক ভয়ভীতি। রক্ত দিলে শরীরে ক্ষতি হয় কি না? এমন অনেক প্রশ্ন রয়েছে সাধারণ মানুষের মধ্যে। এক ব্যাগ রক্ত দিতে সময় লাগে মাত্র ১০ থেকে ১২ মিনিট। এই অল্প সময়ে চাইলেই একজনের প্রাণ বাঁচানো সম্ভব।
এপ্রসঙ্গে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের কার্ডিয়াক সার্জারি বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ডাঃ মোঃ আসলাম হোসেন বলেন, আমাদের দেশের সুস্থ শরীরের সচেতন মানুষরা যদি নিয়মিত চার মাস পর পর রক্ত দেন, তাহলে অনেক রোগী উপকৃত হতে পারে। কিন্তু কিছু সংশয় ও ভয়ের কারণে অনেকেই রক্তদান থেকে বিরত থাকেন। যেমন, সুচের খোঁচায় অনেক ব্যথা পাবে কিনা, ইনফেকশন হবে কিনা বা রক্ত দিলে তার রক্তস্বল্পতা হবে কিনা?
তিনি বলেন, আসলে রক্ত দিলে রক্তস্বল্পতা হওয়ার সুযোগ নেই। কারণ আমাদের শরীরের যে লোহিত রক্তকণিকা সেটা প্রতি চার মাস পর পর আপনাআপনি ভেঙে যায় এবং নতুন রক্ত তৈরি হতে থাকে। আর রক্ত গ্রহণের পূর্বে ইচ্ছুক ব্যক্তি রক্তদানের জন্যে যথাযথ সুস্থ কিনা তাও যাচাই করে দেখা হয়। কাজেই রক্ত দিলে কোনো ক্ষতি নেই। কিন্তু দানের দিক থেকে, সেবার দিক থেকে অন্য দশটা সেবার চেয়ে এটা অনেক বড়। সুতরাং আমি মনে করি, যাদের পেশা স্বাভাবিক, কোনো শারীরিক সমস্যা নেই অর্থাৎ সুস্থ মানুষ, তারা প্রত্যেকেই চার মাস পর পর রক্ত দিতে পারেন।
রক্তের ঘাটতি পূরণে প্রয়োজন সচেতনতাঃ
পরিসংখ্যানে দেখা যায়, ২০১৩ সালে রক্তের প্রয়োজন ছিল ৪ লাখ ইউনিট, ২০১৯ সালে যা বেড়ে দাড়িয়েছে ১১-১২ লাখ ইউনিটে। অর্থাৎ এই অর্ধ যুগে চাহিদা বেড়েছে ৩ গুণ। তবে স্বেচ্ছায় রক্তদাতার সংখ্যা সেই তুলনায় বাড়েনি। এজন্য সচেতনতার অভাবকেই দায়ি করছেন বিশেষজ্ঞরা।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, আমাদের জনসংখ্যার এক শতাংশ যদি স্বেচ্ছায় রক্তদান করে তবে রক্ত উদ্বৃত্ত থাকবে। কিন্তু সচেতনতার অভাবে তা হচ্ছে না। এজন্য প্রয়োজন রক্তদান সম্পর্কে তরুণদের সচেতন করা। তবে আশার কথা হচ্ছে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের ব্যবহারকারীদের মধ্যে রক্তদান সম্পর্কে সচেতনতা আগের তুলনায় অনেক বৃদ্ধি পেয়েছে। সেখানে বিভিন্ন গ্রুপ গড়ে ওঠেছে যারা রক্তদানের সচেতনতা নিয়ে কাজ করছে। স্বেচ্ছায় রক্তদাতা ও রোগীর স্বজনদের মধ্যে যোগাযোগ ঘটিয়ে দিচ্ছে।
কোয়ান্টাম রক্তদান কর্মসূচীর সমন্বয়ক ডা. মনিরুজ্জামান বলেন, সচেতনতা তৈরির মাধ্যমেই রক্তের এই ঘাটতি পূরণ করা সম্ভব। আমরা তরুণদের রক্তদানে উদ্বুদ্ধ করার জন্য অজেয়-১৯ নামে একটি কর্মসূছী হাতে নিয়েছি। যেখানে একজন তরুণ ১৯তম জন্মদিন উৎযাপন করবে রক্তদানের মাধ্যমে। তিনি যার যার অবস্থান থেকে রক্তদান বিষয়ে সচেতনতা সৃষ্টির জন্য সবার প্রতি আহ্বান জানান।
স্যার সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজের শিশু বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ডা. অলিয়া শারমিন জানান, আমাদের দেশে থ্যালাসেমিয়া এবং লিউকেমিয়ায় ভোগা শিশুরা যে রক্তের অভাবে কী ভুক্তভোগী- এটা যদি আমরা আরো ব্যাপকভাবে প্রচার করতে পারি, যদি পত্রিকা বা টিভি মিডিয়ায় এ সংক্রান্ত বিভিন্ন প্রামাণ্যচিত্র দেখাতে পারি, যদি স্কুলে স্কুলে প্রোগ্রাম করা যায়, তাহলে তরুণরা রক্তদানে উৎসাহিত হবে। পাশাপাশি পরিবারগুলোতে মা-বাবার উচিত সন্তানদের এইসব দুস্থ বাচ্চাদের কষ্ট সম্পর্কে বলা এবং রক্তদানের মতো ভালো কাজে উৎসাহিত করা। আর এই তরুণরা যদি তাদের বন্ধুদের উদ্বুদ্ধ করে তাহলে একটা বড় গোষ্ঠী ছোটবেলা থেকেই গড়ে উঠবে রক্তদানের জন্যে।
অবৈধ ব্লাড ব্যাংকের জমজমাট ব্যবসাঃ
এদিকে প্রয়োজনীয় রক্তের ঘাটতি থাকায় অবৈধভাবে অনেক ব্লাড ব্যাংক গড়ে ওঠেছে। যাদের কাজ হচ্ছে রোগীর স্বজনদের সঙ্গে প্রতারণা। অভিযোগ রয়েছে, সরকারের অনুমোদনের বাইরেও অবৈধভাবে গড়ে ওঠা এই ব্লাড ব্যাংকগুলো রক্তের অবৈধ বাণিজ্য করে থাকে, দূষিত রক্ত সরবরাহ করে থাকে। এদের থেকে রক্ত নিয়ে অনেকসময় বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত হন রোগী।
এব্যাপারে মাতুয়াইল মা ও শিশু হাসপাতালের গাইনী বিশেষজ্ঞ ডা. কাওছার পারভীন জলি বলেন, অবৈধ ব্লাড ব্যাংক থেকে অনেক সময় আমরা দেখি অনেক পুরনো রক্তও দিয়ে দেয়। রোগীকে বাঁচানোর জন্যে রোগীরা নিয়ে আসে। কিন্তু দেখা যায় ওগুলো দিতে গেলে অনেক সমস্যা হয়ে যায়। এগুলোর প্রতি ইউনিটের দাম দেড় হাজার থেকে ৫ হাজার টাকা পর্যন্ত রাখা হয়। কিন্তু রক্তগুলো ভালো হয় না।
রক্তদানে উপকারিতাঃ
রক্ত দান করলে যে শুধু রোগীর উপকার হয় তা নয়, নিজের শরীরও বিভিন্ন ধরনের রোগে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি কমে যায়। নিয়মিত রক্তদাতাদের ক্যানসারে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি কম থাকে। নিয়মিত রক্ত দিলে শরীরে নতুন লোহিত কণিকা তৈরির হার বেড়ে যায়। এতে অস্থিমজ্জা সক্রিয় থাকে। ফলে শরীরে কখনো রক্ত স্বল্পতা দেখা দিলে তা দ্রুত পূরণ হয়। রক্তদান করলে রক্তে কোলেস্টরেলের মাত্রা কমে যায়, এতে রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে থাকে। ফলে হৃদরোগ ও হার্ট অ্যাটাকের ঝুঁকি অনেকটাই কমে যায়। রক্ত দিলে যে ক্যালোরি খরচ হয়, তা ওজন কমানোর ক্ষেত্রেও ভূমিকা রাখে। এছাড়াও রক্ত দেওয়ার সময়ে যে পরীক্ষা করা হয়, তার মাধ্যমে বিনা খরচে শরীরে হেপাটাইটিস-বি, হেপাটাইটিস-সি, জন্ডিস, ম্যালেরিয়া, সিফিলিস, এইচআইভি বা এইডসের মতো বড় কোনো রোগ আছে কি-না তা জানা যায়। সর্বোপরি, এতে একজন মানুষের জীবন বাঁচানো সম্ভব।