ঢাকা, বৃহস্পতিবার   ১৪ নভেম্বর ২০২৪

রক্তের বিকল্প শুধু রক্তই

একুশে টেলিভিশন

প্রকাশিত : ১৫:৩৭, ১৯ জুলাই ২০২১ | আপডেট: ১৬:৫৯, ৩০ জুলাই ২০২১

মানবদেহের একটি অপরিহার্য উপাদান হচ্ছে রক্ত। চিকিৎসা বিজ্ঞানে আজ পর্যন্ত রক্তের কোন বিকল্প আবিস্কার হয়নি। রক্তের অভাবে যখন কোন মানুষ মৃত্যুর মুখোমুখি দাঁড়ায় তখন অন্য একজন মানুষের দান করা রক্তই তার জীবন বাঁচাতে পারে। কিন্তু ১৬ কোটি মানুষের এদেশে স্বেচ্ছা রক্তদাতার সংখ্যা খুবই কম।

দেশে প্রতিবছর প্রায় সাড়ে ৯ লাখ ব্যাগ নিরাপদ ও সুস্থ রক্তের চাহিদা রয়েছে। এর  বিপরীতে কেবল ৩০ শতাংশ আসে স্বেচ্ছাসেবকদের মাধ্যমে। বাকি ৭০ শতাংশ আসে রক্তগ্রহীতার স্বজন, বন্ধু-বান্ধবসহ পরিচিতজনদের কাছে। সেখানেও ব্যর্থ হলে তারা পেশাদার রক্ত বিক্রেতার স্মরণাপন্ন হয়। এদের রক্ত নিরাপদ নয়। কারণ আত্মীয় ও পরিচিতজনের রক্ত অনেকে প্রয়োজনীয় স্ক্রিনিং ছাড়াই রোগীর শরীরে দিতে চায় যা অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ। এদিকে পেশাদার রক্ত বিক্রেতাদের রক্ত আরো বিপজ্জনক। তাদের রক্ত ব্যবহারের ফলে রোগীর দেহে ঘাতকব্যাধির জীবাণু সংক্রমিত হতে পারে। এজন্য স্বেচ্ছা রক্তদাতার রক্তই সবচেয়ে নিরাপদ।

রক্তদানের উপকারিতা

স্বেচ্ছায় নিজের রক্ত অন্য কারো প্রয়োজনে দান করাই রক্তদান। ১৮ থেকে ৬০ বছর বয়সী যেকোনো শারীরিক ও মানসিকভাবে সুস্থ ও সক্ষম ব্যক্তি রক্ত দিতে পারবেন। প্রতি চার মাস পর পর প্রত্যেক সুস্থ ও প্রাপ্তবয়স্ক নর-নারী নিশ্চিন্তে ও নিরাপদে রক্তদান করতে পারবেন। এতে স্বাস্থ্যে কোনো ধরনের ক্ষতিকর প্রভাব পড়বে না। বরং রক্তদানের মাধ্যমে শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমাতা বৃদ্ধি পায়।

রক্তদানের বহুবিধ উপকারিতা রয়েছে। রক্তদান করার সাথে সাথে আমাদের শরীরের মধ্যে অবস্থিত ‘বোন ম্যারো’ নতুন কণিকা তৈরির জন্য উদ্দীপ্ত হয় এবং দান করার দুই সপ্তাহের মধ্যে নতুন রক্ত কণিকা জন্ম হয়ে এ ঘাটতি পূরণ করে। বছরে তিনবার রক্তদান রক্তদাতার লোহিত কণিকাগুলোর প্রাণবন্ততা বাড়িয়ে দেয় এবং শরীরে আয়রণের ভারসাম্য বজায় থাকে।

ইংল্যান্ডের মেডিকেল পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, নিয়মিত স্বেচ্ছা রক্তদানকারী দুরারোগ্য রোগব্যাধি যেমন, ক্যান্সার, হৃদরোগ ও হার্ট অ্যাটাকের মতো রোগের ঝুঁকি থেকে প্রায়ই মুক্ত থাকেন।

রক্তের কোলেস্টরেল-এর উপস্থিতি কমিয়ে দেহের স্থুলতা কমাতে  সাহায্য করে। শরীরের বিপাকক্রিয়ায় অক্সিজেন ফ্রি রেডিকেল তৈরী হয়। এর জন্য আমরা বয়সের সঙ্গে সঙ্গে বুড়িয়ে যাই। রক্তদানে এ কেমিক্যাল শরীর থেকে বেরিয়ে গিয়ে শরীরকে বিষ মুক্ত করে। ফলে বয়সের চাপ দেরীতে পড়ে। মুমূর্ষু মানুষকে রক্তদান করে মানসিক পরিতৃপ্তি ও প্রশান্তি লাভ করা যায়। সর্বোপরি রক্তদান মানে নিজের ও পরিবারের দুঃসময়ের জন্য রক্ত সঞ্চয় করা।

► প্রতিবার রক্তদানের পর রক্তদাতার অস্থিমজ্জা (Bone marrow) নতুন রক্তকণিকা তৈরির জন্যে উদ্দীপ্ত হয়। ফলে রক্তদানের দুই সপ্তাহের মধ্যে সে ঘাটতি পূরণ হয়ে যায়।

► শরীরের রক্ত কণিকাগুলোর মধ্যে লোহিত রক্তকণিকার আয়ুষ্কাল সর্বোচ্চ ১২০ দিন। তাই চার মাস অর্থাৎ ১২০ দিন পর পর রক্তদানে শরীরের কোনো ক্ষতি নেই।

► রক্তদাতার রক্তে HIV, Hepatitis-B, Hepatitis-C, Syphilis & Malarial Parasite এর উপস্থিতি পরীক্ষা করা হয়। রক্তদাতা রক্তদানের ফলে এ টেস্টগুলো বিনামূল্যে করার সুযোগ পাচ্ছেন।

► রক্তদানের ফলে রক্তে Cholesterol-এর পরিমাণ কমে, ফলে হৃদরোগের সম্ভাবনা ৩৩ ভাগ কমে যায়।

► রক্তদানে শরীরের Free radicals-এর পরিমাণ কমে যায়। তাই বার্ধক্যজনিত জটিলতা দেরিতে আসে।

► স্বেচ্ছায় রক্তদানে মানসিক প্রশান্তি আসে। কারণ প্রতি দুই সেকেন্ডে বিশ্বে এক ব্যাগ রক্তের প্রয়োজন হয়। 
► সম্প্রতি ইংল্যান্ডের এক গবেষণায় দেখা গেছে নিয়মিত রক্তদান ক্যান্সার প্রতিরোধে সহায়ক।

রক্তদান করলে শুধু অন্যজনের উপকার হয় না, আপনি নিজেও উপকার পাবেন। প্রথম হলো মানসিক শান্তি। আপনার রক্তে জীবন ফিরে পেয়েছেন কেউ- ভাবুন এটা কতোটা পরোপকারী কাজ। 

দেহের মোট ওজনের আট ভাগই রক্ত। আর রক্তের ৫৫ ভাগই হলো রক্তরস বা প্লাজমা, যার ৯০ ভাগই আসলে পানি। সুতরাং আপনি যে রক্ত দেন তার ওজন এক পাইন্টের কম হলেও আসলে এর অর্ধেকটাই পানি। এজন্যেই রক্ত দেয়ার আগে এবং পরে চিকিৎসকেরা পর্যাপ্ত পানি খেতে বলেন (অন্তত ৫০০ মিলিলিটার)। তাহলেই রক্ত দেয়ার পর ক্ষয়টা দ্রুত পুষিয়ে যায়।

অপেক্ষা কেন?

একবার রক্ত দেয়ার পর পরবর্তী চার মাস পর আপনি আবার রক্ত দিতে পারবেন। এ সময়ের মধ্যে সাধারণত হিমোগ্লোবিনের মাত্রা আগের অবস্থায় ফিরে যায়। প্রশ্ন হলো, কেন এ সময়টা লাগে? আসলে শ্বেতকণিকা বা অনুচক্রিকার ক্ষয়টা পূরণ হয়ে গেলেও লোহিতকণিকার ক্ষয় পূরণ হতে কিছুটা সময় লাগে। আর লোহিত কণিকার সাথে সুস্থতার একটা সম্পর্ক আছে। কারণ লোহিত কণিকায় থাকে হিমোগ্লোবিন অণু, যার প্রধান কাজই হলো সারাদেহে অক্সিজেন বয়ে নিয়ে যাওয়া। আর হিমোগ্লোবিনে থাকে আয়রন, রক্ত দেয়ার সময় যা কিছুটা হারায়। এটা পূরণ করার জন্যে তখন একদিকে দেহের লৌহভাণ্ডার বেশি বেশি ব্যবহৃত হয়, অন্যদিকে খাবার এবং পানীয় থেকে তৈরি হতে থাকে বেশি বেশি আয়রন।

কখন রক্তদান করা যাবে না-

১. এইচআইভি, হাইপারটেনশন, কার্ডিয়াক অ্যারেস্ট, মৃগীরোগ বা হেপাটাইটিস থাকলে।

২. ম্যালেরিয়ায় আক্রান্ত ব্যক্তির ক্ষেত্রে সুস্থ হওয়ার কমপক্ষে এক বছর না হওয়া পর্যন্ত রক্ত দেয়া যাবে না। কারণ এক বছর পর্যন্ত ম্যালেরিয়ার জীবাণু শরীরে থাকতে পারে।

৩. আপনার দেহে হিমোগ্লোবিনের মাত্রা পর্যাপ্ত না থাকলেও সাময়িক সময়ের জন্যে আপনাকে রক্তদানে বিরত থাকতে হবে। পুরুষদের ক্ষেত্রে এটা ১২.৫ এবং মহিলাদের ক্ষেত্রে এটা ১৩।

৪. আকুপাংচার, কান ফুটো বা ট্যাটু করাবার সাথে সাথেই রক্তদান করা যাবে না। তাছাড়া সে সুঁই দিয়ে করা হয়েছে, তা জীবাণুমুক্ত ছিল কি না- এটা যদি নিশ্চিত জানা না থাকে তাহলে একবছর অপেক্ষা করতে হবে।

৫. ফ্লুতে আক্রান্ত হলে সুস্থ হওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে।

৬. গর্ভবতী এবং সদ্য প্রসব করেছেন এমন মায়েরাও রক্তদান করতে পারবেন না।

৭. ব্লাড ক্যান্সারে আক্রান্ত ব্যক্তি রক্তদান করতে পারবেন না। তবে অন্যান্য ক্যান্সারে আক্রান্ত কেউ তার সর্বশেষ সার্জারি, কেমোথেরাপি বা রেডিয়েশনের পাঁচ বছর অতিক্রম হওয়ার পর রক্তদান করতে পারবেন।

৮. রক্তদানের ২৪ ঘণ্টার পূর্বে যদি কেউ মদ্যপান করে।

৯. নিজের দেহে রক্ত নিলে অন্তত একবছর অপেক্ষা করতে হবে।

১০. বিদেশে গেলে ফিরে আসার পর কিছুদিন অপেক্ষা করতে হবে।

১১. দাঁত বা মুখের কোনো অপারেশন হলে অপেক্ষা করতে হবে।

১২. ধূমপান করার চার ঘণ্টা পর্যন্ত রক্তদান করা যাবে না।

১৩. বড় কোনো সার্জারি হয়ে থাকলে কমপক্ষে ৬ মাস এবং ছোট সার্জারি হলে কমপক্ষে ২ মাস অপেক্ষা করতে হবে।

১৪. এন্ডোস্কোপি করাবার পর কমপক্ষে চার মাস পর্যন্ত রক্তদান করা যাবে না।

এবার জেনে নেই যাক, রক্ত দেয়ার আগে যেসব বিষয় মানতে হয় :

বয়স ১৮

রক্তদাতার বয়স কমপক্ষে ১৮ বছর হতে হবে। আঠারো বছরের নিচের কেউ রক্ত দিতে পারবেন না। এছাড়া ওজনও থাকতে হবে ঠিকঠাক। কমপক্ষে ১১০ পাউন্ড থাকতে হবে।

শারীরিক সুস্থতা

রক্ত দেয়ার প্রথম শর্ত হল রক্তদাতাকে অবশ্যই শারীরিকভাবে সুস্থ থাকতে হবে। কোনো ব্যক্তি যদি সুস্থ না থাকেন তিনি রক্ত দিতে পারবেন না।

নিম্ন রক্তচাপ

যাদের নিম্ন রক্তচাপের সমস্যা রয়েছে, তারা রক্তদান করতে পারবেন না। তাই রক্ত দেওয়ার সময় এই বিষয়টি লক্ষ্য রাখা দরকার। খুব বেশি বা খুব কম কোনটাই রক্তদানের ক্ষেত্রে সহায়ক নয়।

রক্তের হিমোগ্লোবিন

রক্তের হিমোগ্লোবিন ১১-এর নিচে হলে রক্ত দেওয়া ঠিক নয়। এতে করে হার্টবিট বেড়ে যাওয়া, ক্লান্ত লাগা, চোখে ঝাঁপসা দেখা, মাথা ঘোরাসহ অজ্ঞানও হয়ে যেতে পারেন।

অ্যান্টিবায়োটিক সেবন

কোন রোগে অ্যান্টিবায়োটিক সেবনরত অবস্থায় থাকলে সে ক্ষেত্রে রক্তদান করা উচিত নয়। অ্যান্টিবায়োটিক সেবনকারী রোগী রক্তদান করলে তিনি শারীরিকভাবে ক্ষতির সম্মুখীন হবেন।

পিরিয়ড ও গর্ভাবস্থা

মেয়েরা পিরিয়ড চলাকালীন রক্তদান করতে পারবেন না। কারণ এ সময় শরীর থেকে রক্ত প্রবাহিত হয়, শরীর দুর্বল থাকে তাই রক্ত দিলে শরীরে বিভিন্ন সমস্যা দেখা দিতে পারে। এছাড়া গর্ভাবস্থায় রক্তদান করতে পারবেন না।

দুর্ঘটনা বা অস্ত্রোপচার

রক্তদানের কাছাকাছি সময়ে কোন বড় দুর্ঘটনা বা অস্ত্রোপচার হয়ে থাকলে রক্তদান না করা বাঞ্ছনীয় । কারণ এ সময় আপনি শরীরিকভাবে রক্ত দেয়ার জন্য উপযুক্ত নন।

হাঁপানী রোগী

শ্বাস-প্রশ্বাসজনিত রোগ অ্যাজমা বা হাঁপানি আছে এমন কেউ রক্ত দিতে পারবেন না। রক্ত দিলে হাঁপানি বেড়ে যেতে পারে।

রক্তদানে কোন শারীরিক ক্ষতি হয় না। তবে রক্তদানের ফলে অস্থিরতা, মাথা ঘোরানো, দুর্বলতার মতো ক্ষণস্থায়ী সমস্যা দেখা দিতে পারে। তবে দুই গ্লাস পানি বা জুস খেলে এই ভাব দূর হবে। আর পর্যাপ্ত ঘুম এবং খাবারে কলিজা, বিভিন্ন ধরনের কচু, ডিম, দুধ রাখতে হবে।

এসএ/


Ekushey Television Ltd.










© ২০২৪ সর্বস্বত্ব ® সংরক্ষিত। একুশে-টেলিভিশন | এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি