পর্ব-২
রাইড শেয়ারিং-এ মানা হচ্ছে না নীতিমালা
প্রকাশিত : ১৮:৫১, ১৩ অক্টোবর ২০১৮ | আপডেট: ১৯:১৪, ১৪ অক্টোবর ২০১৮
২০১৬ সালের শেষ দিকে বাংলাদেশে কার্যক্রম শুরু হয় রাইড শেয়ারিং প্ল্যাটফর্মগুলোর। এরপরের বছর থেকে দ্রুত জনপ্রিয়তা বাড়তে এই খাতের। পাল্লা দিয়ে বাড়তে থাকে অব্যবস্থাপনা ও বিশৃংখলাও।
পুরো প্রক্রিয়াকে শৃংখলার মাঝে নিয়ে আসতে প্রণয়ন করা হয় ‘রাইড শেয়ারিং সার্ভিস নীতিমালা,২০১৭’। এই নীতিমালার মেয়াদ আট মাস পেরিয়ে গেলেও মানা হচ্ছে না সেসব নিয়ম। আর তাই কোনোভাবেই শৃংখলা ফিরে আসছে না এই খাতে। সুনির্দিষ্ট অভিযোগের পরেও প্ল্যাটফর্মগুলোর উদাসীনতাকেও দায়ী বলে মনে করছেন অনেকেই।
কেস স্টাডি
রাজধানীতে নিয়মিত রাইড শেয়ারিং সেবা নেন এমন বিভিন্ন বয়সের ও বিভিন্ন পেশায় কর্মরত যাত্রীদের সঙ্গে কথা হয় এই প্রতিবেদকের। মনির হোসেন নামের এক যাত্রী পাঠাও-তে রাইড নিয়ে বেশি ভাড়া দিতে হয়েছে বলে অভিযোগ করেন। একুশে টিভি অনলাইনকে তিনি বলেন, কিছুদিন আগে রাজধানীর যমুনা ফিউচার পার্ক থেকে মানিকনগরের জন্য রাইড নেই। রাইডের আগে ভাড়া দেখায় ১৪৬ টাকা। রাইড শেষে ভাড়া আসে ২৪৩ টাকা। অর্থ্যাৎ প্রায় ৯৭ টাকা বেশি। এটা তো মানা যায় না। এমনটা আমার সঙ্গে আরও একবার হয়েছে।
রাইড শেয়ার নিয়ে অসন্তুষ্ট হয়ে জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরে অভিযোগ দায়ের করেছেন মনির। একই সঙ্গে বন্ধ করেন পাঠাও-তে রাইড নেওয়া।
দেশের একটি বেসরকারি টিভি চ্যানেলের উচ্চ পদস্থ কর্মকর্তাও শিকার হন বিড়ম্বনার। বাসাবোর বাসা থেকে কাওরান বাজার আসার জন্য একটি প্ল্যাটফর্মে রাইড অনুরোধ করেন তিনি। একজন বাইকার সেটি গ্রহণও করেন। মুঠোফোনে অপেক্ষা করতে বলা হয় এই যাত্রীকে।
পর্ব-১ঃ রাইড শেয়ারিং-এ হ-য-ব-র-ল
প্রায় ১৫ মিনিট অপেক্ষা করার পর চালক যাত্রীর কাছে তার গন্তব্যস্থল জানতে চান। সম্ভাব্য যাত্রী তার গন্তব্যস্থল জানালে সেখানে আসতে অসম্মতি জানিয়ে রাইডের অনুরোধ বাতিল করে দেন তিনি। একুশে টিভি অনলাইনকে নিজের অভিজ্ঞতা জানিয়ে ওই যাত্রী বলেন, বাইকার তো আমার সম্ভাব্য গন্তব্যস্থল দেখেই রাইডের অনুরোধ গ্রহণ করেছিলেন। তাহলে আমার কাছে কেন জিজ্ঞেস করবে যে, আমি কোথায় যাব? আর এত সময় পর যে আমার রাইড বাতিল করলো এই সময়ের মূল্য কে দেবে?’
শৃংখলা আনতে উদাসীন প্ল্যাটফর্মগুলো
যাত্রী এবং চালকদের মাঝে থাকা বিভিন্ন অসন্তোষ এবং অভিযোগের প্রতি রাইড শেয়ার দেওয়া প্ল্যাটফর্মগুলো অনেকটাই উদাসীন বলে অভিযোগ এ খাত সংশ্লিষ্টদের। বিভিন্ন বিষয়ে সুনির্দিষ্ট অভিযোগ পাওয়ার পরেও কার্যত টনক নড়তে দেখা যায়নি প্রতিষ্ঠানগুলোর।
চালক ও যাত্রীদের বিভিন্ন অভিযোগ ও অসন্তোষ নিয়ে প্রতিক্রিয়া জানতে চাওয়া হলে কোন মন্তব্য পাওয়া যায়নি পাঠাও, সহজ এবং উবারের মতো নেতৃত্বস্থানীয় প্ল্যাটফর্মগুলোর তরফ থেকে।
গত সেপ্টেম্বরের শেষদিকে রাজধানীতে এক সাংবাদিক সম্মেলনে সহজ ডট কমের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা মালিহা কাদিরকে চালকদের প্রতি দায়বদ্ধতা নিয়ে প্রশ্ন করা হলে তিনি বলেন, যারা রাইডস শেয়ার করছেন তারা সহজের কেউ না। তারা নিজেদের বাহন নিয়ে আমাদের প্ল্যাটফর্মে এসে নিজেদের মতো একটা ব্যবসা করছেন। চালকদের প্রতি সেই অর্থে দায়বদ্ধতা নেই বলে সাফ জানিয়েছিলেন এই নারী উদ্যোক্তা। একই সাথে রাজধানীতে বাহনের সংখ্যা বৃদ্ধি এবং নানান অব্যবস্থাপনা নিয়ে প্রশ্ন করা হলেও কৌশলে তা এড়িয়ে যান মালিহা কাদির।
মানা হচ্ছে না রাইড শেয়ারিং নীতিমালা
উদীয়মান এই খাতকে একটি আইনী কাঠামোর মধ্যে নিয়ে আসতে প্রণয়ন করা হয় ‘রাইডশেয়ারিং সার্ভিস নীতিমালা,২০১৭’। এমনকি দেশের প্রেক্ষাপটে এমন কার্যক্রমের বৈধতা নিয়েও প্রশ্ন ওঠে। পরবর্তীতে রাইড শেয়ারিং-কে বৈধতা দেওয়া হয়। ১১টি শর্তে এই সেবাকে অনুমোদন দেয় মন্ত্রীসভা।
পরিপ্রেক্ষিতে চলতি বছরের ২২ ফেব্রুয়ারিতে জারি করা হয় প্রজ্ঞাপন। প্রজ্ঞাপন অনুযায়ী, বিগত ৮ মার্চ থেকে কার্যকর করা হয় এই নীতিমালা।
এনলিস্টমেন্ট সার্টিফিকেট নেই কারো
দিনপঞ্জিকার হিসেবে এই নীতিমালা কার্যকর হওয়ার ৮ মাস পেরিয়ে গেলেও বাস্তবে পালিত হচ্ছে না এই নীতিমালার বিধিগুলো। এমনকি নীতিমালার অনুচ্ছেদ ‘ক’ এর বিধি-১ অনুযায়ী রাইড শেয়ারিং প্ল্যাটফর্মগুলোকে বাংলাদেশ রোড ট্রান্সপোর্ট অথরিটি (বিআরটিএ) কর্তৃক ‘এনলিস্টমেন্ট সার্টিফিকেট’ নিতে হবে। কিন্তু এখন পর্যন্ত এই সার্টিফিকেট নেয়নি দেশে কার্যক্রম পরিচালনা করা কোন রাইড শেয়ারিং প্ল্যাটফর্মই।
একই অনুচ্ছেদের ৮ থেকে ১১ এবং ১২ নম্বর বিধিতে যথাক্রমে নির্ধারিত স্থান ব্যতীত অন্যান্য স্থানে মোটরযান পার্কিং না করতে, একজন ব্যক্তির মালিকানায় থাকা একটি মাত্র মোটরযান দিয়ে রাইড শেয়ারিং দেওয়া, ব্যক্তিগত মোটরযানের রেজিস্ট্রেশন পাওয়ার কমপক্ষে এক বছর পর রাইড শেয়ারিং সেবায় নিবন্ধিত হওয়া এবং রাইডশেয়ারিং এ ব্যবহৃত মোটরযানের দৃশ্যমান স্থানে জাতীয় জররী হেল্পডেস্কের নম্বর ৯৯৯ সংযোজনের কথা বলা হয়েছে। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে এসব নীতিমালার মধ্যে মানা হচ্ছে না একটিও।
যাত্রী-চালকের নিরাপত্তায় উদাসীনতা
পাশাপাশি যাত্রী ও চালকের নিরাপত্তা নিশ্চিতে নীতিমালায় থাকা বিধিগুলোও অনুসরণ করছে না প্ল্যাটফর্মগুলো। নীতিমালার অনুচ্ছেদ ‘খ’ এর বিধি-১ এ বলা হয়েছে, রাইড শেয়ারিং অ্যাপসে এমন একটি এসওএস (SOS) বোতামের ব্যবস্থা রাখতে হবে যা স্পর্শের সাথে সাথে রাইড সংশ্লিষ্ট যাবতীয় তথ্যাদি স্বয়ংক্রিয়ভাবে ৯৯৯-এ চলে যাবে। এই অনুচ্ছেদের বিধি-১২ এ বলা আছে, যাত্রী ও চালকের নিরাপত্তা নিশ্চিতকল্পে পুলিশ কন্ট্রোল রুমকে জরুরি বার্তা বা সংকেত প্রেরণের একটি উপযুক্ত ব্যবস্থা অ্যাপসে থাকতে হবে। কিন্তু কার্যত এসব বিধিনিষেধের কোন বাস্তবায়নই দেখা যায় না রাইড শেয়ারিং সেবা দেওয়া প্রতিষ্ঠানগুলোর প্ল্যাটফর্মে।
প্রয়োজনের মুহুর্তে নিরুপায় যাত্রী
রাইড শেয়ারিং সেবা নেওয়ার সময় কোন অপ্রীতিকর অবস্থা তৈরি হলে প্ল্যাটফর্মগুলোর কাছ থেকে তাৎক্ষণিক কোন সেবা পান না যাত্রী ও গ্রাহকেরা। রাইড শেয়ারিং সার্ভিস নীতিমালা,২০১৭ অনুযায়ী, যাত্রীদের অভিযোগ এবং প্রয়োজনীয় মুহুর্তে প্ল্যাটফর্মের সাথে যোগাযোগের বিধান রাখা হলেও সেগুলোর বাস্তবায়ন এখনও নেই।
নীতিমালার অনুচ্ছেদ ‘খ’ এর বিধি-৪ অনুযায়ী, যাত্রার যাবতীয় তথ্যাদি এসএমএস, ইমেইল এবং অন্য পদ্ধতির মাধ্যমে যাত্রীকে জানানোর বিধান রাখা হয়েছে। একই সাথে এসব তথ্য কমপক্ষে তিন মাস সংরক্ষণের কথাও বলা আছে বিধিতে। কিন্তু এসব তথ্য সীমিত পরিসরেই পরবর্তীতে দেখতে পারেন গ্রাহকেরা। বিধি-৫ অনুযায়ী, রাইডশেয়ারিং প্ল্যাটফর্মগুলোতে গ্রাহকদের অভিযোগ সুনির্দিষ্ট আকারে দায়েরের সুযোগ রাখতে নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। একই সাথে দায়েরকৃত অভিযোগের হালনাগাদ তথ্য অভিযোগকারী যেন জানতে পারেন সে বিষয়েও ব্যবস্থা রাখতে বলা হয়েছে। কিন্তু এসবের কোন সুবিধাই যাত্রীদের জন্য নেই প্ল্যাটফর্মগুলোতে।
রাইড শেয়ারিং নীতিমালার সবথেকে গুরতর যে ব্যত্যয় প্ল্যাটফর্মগুলো করে আসছেন তা হলো অনুচ্ছেদ ‘চ’ এর বিধি-৮ এর লংঘন। এই বিধি অনুযায়ী, রাইডশেয়ারিং সেবা দেওয়া প্রতিষ্ঠানগুলোকে প্রতিদিন ২৪ ঘন্টা কল সেন্টার চালু রাখার নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে নীতিমালায়। অথচ পাঠাও, উবার বা সহজের মতো শীর্ষস্থানীয় প্ল্যাটফর্মগুলো এখনও নেই এই সুবিধা।
অথচ সরেজমিনে দেখা যায়, পাঠাও এর কলসেন্টার খোলা থাকে সকাল ৮টা থেকে রাত ১০টা পর্যন্ত। উবারের কল সেন্টার খোলা থাকে সকাল ৮টা থেকে রাত ৮টা থেকে। উবারের কল সেন্টার থেকে আবার সেবা দেওয়া হয় শুধু উবার পার্টনারদের অর্থ্যাত রাইড শেয়ারিং সেবা দেওয়া চালকদের। কল সেন্টার সরাসরি সেবা পাওয়ার কোন সুযোগ নেই গ্রাহকদের জন্য। আরেক রাইড শেয়ারিং প্ল্যাটফর্ম সহজের কলসেন্টার ১৬৩৭৪ এ ফোন করলে সেই ফোন কেটে যায় স্বয়ংক্রিয়ভাবে।
সমস্যা দেখার যেন কেউ নেই
রাইড শেয়ারিং সংক্রান্ত উদ্ভুত সমস্যার জন্য সেবা দেওয়া প্রতিষ্ঠানগুলোকেই নির্দেশনা দেওয়া আছে নীতিমালার অনুচ্ছেদ ‘ছ’ এর বিধি-৪ এ। রাইড শেয়ারিং প্ল্যাটফর্মগুলো থেকে কাংখিত সমাধান পাওয়া না গেলে বিআরটিএ আপীল কর্তৃপক্ষ হিসেবে কাজ করবে। বাস্তব ক্ষেত্রে প্ল্যাটফর্মগুলো থেকে সমস্যার সমাধান বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই পান না যাত্রী ও গ্রাহকেরা। আবার অভিযোগকারীদের জন্য কোন সমাধান দিতে পারছে না বিআরটিএ। এ বিষয়ে অনেকটাই ‘হাত গুটানো’ অবস্থায় রয়েছে সরকারি এই নিয়ন্ত্রক সংস্থাটি।
বিআরটিএ এর পরিচালক (রোড সেফটি) শেখ মোহাম্মদ মাহবুব-ই-রাব্বানী বলেন, “বিআরটিএ এর এতো জনবল নেই যে, প্রত্যেকের অভিযোগ নিয়ে প্ল্যাটফর্মগুলোর সাথে দেনদরবার করবো আমরা। যাদের একান্ত সমস্যা থাকবে রাইড শেয়ারিং নিয়ে তারা এই সেবার সাথে পরবর্তীতে আর যুক্ত না হলেই তো হয়”। তবুও কারও কোন অভিযোগ থাকলে বিআরটিএ চেয়ারম্যান বরাবর লিখিত আবেদন করার পরামর্শ দেন এই কর্মকর্তা। তবে সেটি থেকে আসা ফলাফলও যে দীর্ঘ সূত্রিতার ব্যাপার তাও অকপটে মেনে নেন শেখ মোহাম্মদ মাহবুব-ই-রাব্বানী।
এদিকে রাজধানীর কাওরান বাজারে জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের প্রধান কার্যালয় থেকে পাওয়া তথ্যমতে, শুধু সেপ্টেম্বর মাসেই রাইড শেয়ারিং প্ল্যাটফর্মগুলোর বিরুদ্ধে যাত্রী ও চালকদের অভিযোগ এসেছে অন্তত ১৭টি। এদের মধ্যে পাঠাও এর বিরুদ্ধে অভিযোগ দায়ের হয়েছে ৯টি, উবারের বিরুদ্ধে ৭টি এবং সহজের বিরুদ্ধে ১টি। এদের মধ্যে ভাড়া সম্পর্কিত অভিযোগই সবথেকে বেশি বলে জানান অধিদপ্তরের সহকারী পরিচালক (তদন্ত) মাসুম আরেফিন।
তবে আইনগত সীমাবদ্ধতার কারণে এসব অভিযোগের প্রেক্ষিতে অনেক সময়ই কোন ব্যবস্থা নেওয়া যায় না বলে মন্তব্য করেন অধিদপ্তরের আরেক সহকারী পরিচালক জান্নাতুল ফেরদাউস। তিনি বলেন, ‘বিগত জুন মাসের ২৫ তারিখ পাঠাও এর বিরুদ্ধে আসা একটি অভিযোগে প্রতিষ্ঠানটিকে ১০ হাজার টাকা জরিমানা করি আমি।
রাইড শেয়ারিং প্ল্যাটফর্মগুলোর বিরুদ্ধে আসা অভিযোগের মধ্যে এই একটি ক্ষেত্রেই আমি জরিমানা করতে পেরেছি। কিন্তু অনেক সময়ই পরিস্থিতি বুঝেও অভিযোগ নিষ্পত্তি করতে পারি না আমরা। কারণ কোন নীতিমালা বা আইনে এধরণের অভিযোগ নিষ্পত্তির কোন এখতিয়ার আমাদের নেই। একেবারেই যেগুলো গ্রাহকের সার্থ হানি করে, সেগুলোর কিছু কিছু আমরা আমলে নিয়ে কার্যক্রম পরিচালনা করতে পারি’।
/ এআর /