যাত্রী-চালক সবারই আছে অভিযোগ
রাইড শেয়ারিং প্ল্যাটফর্মগুলো নিয়ে বাড়ছে অসন্তোষ
প্রকাশিত : ১৪:৩০, ১৯ মে ২০১৮ | আপডেট: ১৪:৩১, ১৯ মে ২০১৮
রাইড শেয়ারিং প্ল্যাটফর্ম বর্তমান গতিময় শহরের এক অবিচ্ছেদ্য অংশে পরিণত হয়েছে। যাদের নিজস্ব বাহন নেই তারা তো বটেই, সময় বাঁচিয়ে যারা এক জায়গা থেকে অন্য স্থানে যেতে চান তারা আশির্বাদ মনে করেন এই সেবাকে। উপকৃত হন বাহন মালিকেরাও। কিন্তু নানা কারণে যাত্রী ও চালক সবারই অভিযোগ ও অসন্তোষ দিন দিন বাড়ছে রাইড শেয়ারিং সেবা দেওয়া প্রতিষ্ঠানগুলোর বিরুদ্ধে। ভাড়া বেশি নেওয়ার অভিযোগ যাত্রীদের আর রাইড শেয়ারিং প্রতিষ্ঠানগুলোর বিরুদ্ধে চালকদের মূল অভিযোগ ঠকানোর।
রাইড শেয়ারিং প্ল্যাটফর্ম যেভাবে কাজ করে
রাইড শেয়ারিং প্ল্যাটফর্মে ব্যক্তিগত মালিকানাধীন যানবাহনে যাত্রী পরিবহণ করা হয়। গাড়ি, বাইক বা অন্য কোনো মোটর যানের মালিক বা চালক তাঁর বাহনে যাত্রীদেরকে তাদের গন্তব্যে পৌঁছে দেন। চালক ও যাত্রীর মধ্যকার এই যোগাযোগ বা পুরো প্রক্রিয়াটি হয় একটি প্ল্যাটফর্মের মাধ্যমে। মূলত একটি মোবাইল অ্যাপসের মাধ্যমে। যাত্রীকে এই সেবা নিতে হলে দূরত্ব অনুযায়ী একটি ভাড়া পরিশোধ করতে হবে। চালকের আদায় করা এই ভাড়ার একটি অংশ (বেশিরভাগ ক্ষেত্রে মোট ভাড়ার ২০ শতাংশ) পাবে ওই রাইড শেয়ারিং প্ল্যাটফর্ম।
এখানে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান রাইড শেয়ারিং প্ল্যাটফর্ম হিসেবে কাজ করে যেমন পাঠাও, উবার, সহজ, মুভ ইত্যাদি।
যেভাবে যাত্রা শুরু
বাংলাদেশে রাইড শেয়ারিং ধারণার বিকাশ লাভ করে মোটামুটিভাবে ২০১৬ সালের শেষ দিকে। ‘শেয়ার এ মোটরবাইক’ বা স্যামকে দেশের প্রথম রাইড শেয়ারিং প্ল্যাটফর্ম হিসেবে ধরা হয়। ২০১৭ সালের মাঝামাঝি এসে নগরীর চালক ও যাত্রী দুই শ্রেণীর কাছেই ব্যাপক জনপ্রিয়তা পায় এই সেবা। ভবিষ্যতে বেশ বড় একটি খাত হওয়ার ইঙ্গিত দিতে থাকে রাইড শেয়ারিং প্ল্যাটফর্মগুলো। বিষয়টি এত ব্যাপকতা লাভ করে ছে যে, রাইড শেয়ারিং প্ল্যাটফর্ম নিয়ে আইন তৈরির প্রয়োজনীয়তাও অনুভূত হচ্ছে। বাংলাদেশ সড়ক পরিবহণ কর্তৃপক্ষ (বিআরটিএ) এ সংক্রান্ত একটি খসড়া নীতিমালা ইতোমধ্যে চূড়ান্ত করেছে।
স্যাম দিয়ে শুরু হলেও দেশীয় প্রতিষ্ঠান পাঠাও এবং যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক বহুজাতিক প্রতিষ্ঠান উবার এই খাতে অন্য সবার থেকে দ্রুত জনপ্রিয়তা পায়। প্রতিষ্ঠান দু’টি যথাক্রমে মোটর সাইকেল আর প্রাইভেট গাড়ি দিয়ে শুরু করলেও উভয়েই এখন দুই ধরণের বাহনের সেবা দিয়ে যাচ্ছে।
পাঠাও, উবারের সঙ্গে রাইড শেয়ারিং সেবা দেওয়া প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে অন্যতম অন্যান্য প্ল্যাটফর্ম বা প্রতিষ্ঠানগুলো হলো সহজ রাইডস, মুভ, ওভাই, ইজিয়ার, ডাকো ক্যাপ্টেইন।
বাড়ছে অভিযোগ
রাইড শেয়ারিং বিষয়টির বহু ধরণের ইতিবাচক দিক থাকলেও যাত্রী-চালক-প্রতিষ্ঠানের একে অপরের মধ্যে আছে ত্রিমুখী অভিযোগ। আর এসব অভিযোগের কারণে দিন দিন অসন্তোষ বাড়ছে এই খাত সংশ্লিষ্টদের মধ্যে।
রাইড শেয়ারিং-এ যাত্রীদের অভিযোগগুলোর বেশিরভাগই চালকদের বিরুদ্ধে। তবে প্রতিষ্ঠানগুলো যেহেতু চালকদের নিয়ন্ত্রণ করে থাকে সে কারণে অভিযোগের তীর প্ল্যাটফর্মগুলোর দিকেও যায়।
রাইড শুরুর আগে দেখানো ভাড়ার থেকে রাইড শেষের পর ভাড়া অনেক বেশি আসে বলে অভিযোগ পাঠাও ব্যবহারকারীদের। মিরপুর থেকে যাতায়াতের জন্য নিয়মিত পাঠাও ব্যবহার করেন এমন এক যাত্রী আমিন উদ্দীন অভিযোগ করে বলেন, ‘একদিন পল্লবী থেকে দারুস সালাম যাব বলে পাঠাও-তে কল দেই। রাইড শুরুর আগে ভাড়া দেখানো হয়েছিল প্রায় ১০০ টাকা। তবে রাইড শেষে আমার ভাড়া আসে ১৪০টাকার বেশি। এমনটা কেন হলো জানার জন্য গ্রাহক সেবা কেন্দ্রে ফোন দিলাম। সেখান থেকে বললো যে, আমি নাকি ‘হট জোন’ এলাকায় ছিলাম। এই এলাকায় ভাড়া বেশি আসে। আমার কথা হচ্ছে, আমি যে হট জোনে আছি তা আমাকে কেন জানাবে না? আমার অ্যাপসে কেন সেটা আমি দেখতে পারব না? ভাড়া তো আমি দিই, তাই না?’
ভাড়া বেশি আসার অভিযোগ আছে ‘ওভাই’র বিরুদ্ধেও।
বহুজাতিক প্রতিষ্ঠান উবার ব্যবহার করে নেতিবাচক অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হয়েছেন এক সংবাদ কর্মী। প্রাইভেট একটি চ্যানেলের সাংবাদিক মফিউর রহমান এই প্রতিবেদককে বলেন, ‘একদিন রাতে উবার মটোতে (বাইক) রাইড রিকোয়েস্ট দেই। একজন চালক তা গ্রহণ করেন। কিন্তু তিনি আমাকে না নিয়েই তাঁর মতো করে চলে যান। এতে করে আমি আর নতুন করে রাইড রিকোয়েস্ট দিতে পারছিলাম না। কারণ রাইড রিকোয়েস্ট গ্রহণ করা চালক রাইড বাতিল না করলে যাত্রী নতুন রাইড দিতে পারেন না। আমাকে সেদিন অনেকক্ষণ অপেক্ষা করতে হয়। এতে আমার সময় নষ্ট হয়।’
‘সবচেয়ে আশ্চর্যের বিষয় হচ্ছে যে, উবারের গ্রাহক সেবা কেন্দ্রে যোগাযোগের কোনো উপায় আমি তখন অ্যাপসে পেলাম না। একটি নম্বরে ফোন দিলে অপরপ্রান্ত থেকে বলা হলো যে, সাপোর্ট সেন্টারে শুধু চালকদের সমস্যার সমাধান দেওয়া হয়’-যোগ করেন মফিউর।
চালকদের যত অভিযোগ
রাইড শেয়ারিং প্ল্যাটফর্মে যারা মূল কাজটি করে থাকেন তারা হলেন যানবাহন চালকেরা। প্ল্যাটফর্ম তৈরি করা প্রতিষ্ঠানগুলোর বিষয়ে চালকদের অভিযোগের যেন শেষই নেই।
মোস্তাফিজুর রহমান খান নিয়মিতভাবে রাইড শেয়ার করতেন সহজ রাইডসে। নিজের অভিজ্ঞতা এই প্রতিবেদকের কাছে তুলে ধরেন। তিনি বলেন, ‘একদিন রাইড শেষ করে দেখতে পাই যে, যাত্রীর ডিসকাউন্ট (মূল্য ছাড়) ছিল। তাই তাঁর কোনো ভাড়া আসেনি। আমিও ভাড়া নিইনি। কিন্তু কিছুক্ষণ পরেই সহজ এক ক্ষুদে বার্তায় আমাকে জানায় যে, আমার এই রাইড নিয়ে তাদের সন্দেহ আছে। আমাকে তাদের অফিসে যেতে বলে। নইলে টাকা দেবে না। আমি প্রশ্ন হচ্ছে, আমি কেন তাদের অফিসে যাব? আমি তো আর তাদের কর্মী না, তাই না? আমি সেখানে ফ্রিল্যান্স করি। রেজিস্ট্রেশনের জন্য তাদের লোক পেট্রোল পাম্পে এসেও আমাদের থেকে নিবন্ধন করিয়ে নেয়। আর আমার টাকা দেওয়ার সময় আমাকে অফিসে ডাকবে। এটা তো হয় না।’
পাঠাও-তে রাইড শেয়ার করেন এমন একজন চালক নাহিদুল ইসলাম অভিযোগ করে বলেন, ‘পাঠাও বা সহজ এই প্ল্যাটফর্মগুলো বোনাসের লোভ দেখিয়ে আমাদেরকে দিয়ে বেশি বেশি রাইড শেয়ার করিয়ে থাকে। কিন্তু বোনাস আর তারা দেয় না। এই বোনাস পেতে হলে কল সেন্টারে ফোন দিতে হয়। টাকা পেতে হলে বিকাশ নাম্বার ভেরিফিকেশনের জন্য অফিসে যেতে বলে। অথচ নাম্বার আগে থেকেই ভেরিফাই করা। আর অফিসে গেলে তাদের নানান যুক্তি। আমার রাইড ভুয়া ছিল, আমি একই যাত্রীকে দু’বার রাইড দিয়েছি এসব বলে। কিন্তু আমি যদি কোনো প্রমাণ চাই তখন দিতে পারে না। শুধু বলে, ‘আমাদের সিস্টেমে আছে’। তাদেরই সবকিছু। তাদেরই সিদ্ধান্ত।’
তিনি আরও বলেন, ‘চালকদের জন্য যে মূল্যছাড় প্ল্যাটফর্মগুলো দেয় তা সমন্বয় হয়ে প্রতিষ্ঠান থেকে আমাদের পাওয়ার কথা। কিন্তু সেটাও হয় না। গ্রাহকের মূল্য ছাড়ের পরেও দেখা যায়, প্ল্যাটফর্মটিকে আমারই টাকা দিতে হয়। এটা তো মানা যায় না।’
প্ল্যাটফর্মগুলো যা বলছে
যাত্রী বা চালকদের অভিযোগ অনেকটাই মানতে নারাজ রাইড শেয়ার দেওয়া প্রতিষ্ঠানগুলো। সহজ রাইডস তথা সহজ ডট কমের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মালিহা মালেক কাদের বলেন, ‘রাইড শেয়ারিং এর খাত এখনও নতুন। যাত্রী ও চালক সবাইকেই আমরা ভালো একটি সেবা দেওয়ার চেষ্টা করছি। তবে চালকেরা বোনাস বা ডিসকাউন্ট নিয়ে যে অভিযোগ করেছেন তা সঠিক নয়। চালকদের বোনাসের টাকা আমরা কার্যদিবসের মধ্যেই পাঠিয়ে দিই’।
চালকদের কেন অফিসে ডাকা হয়, এমন প্রশ্নের জবাবে দেশের প্রেক্ষাপটে অন্যতম সফল এই নারী উদ্যোক্তা জানান, দেখেন অনেক সময়ই চালকেরা ভুয়া রাইড দেন। এটা সত্য। আমরা চালকদের অফিসে আসতে বলি যেন তাদের সঙ্গে সরাসরি কথা বলা যায়। সরাসরি কথা বললে অনেক সময় অনেক কিছু পরিষ্কার হয়। কোনো ভুল বোঝাবুঝি থাকলে দূর হয়। এই কারণেই আমরা তাদেরকে অফিসে আসতে বলি।
এমজিএইচ গ্রুপের মালিকানাধীন রাইড শেয়ারিং প্ল্যাটফর্ম ওভাই এর পক্ষ থেকে বলা হয়, বেস ফেয়ার, যাত্রার সময়কাল, কতটুকু দূরত্ব অতিক্রম হচ্ছে এবং ওয়েটিং টাইম- এগুলোর উপর নির্ভর করেই সাধারণত আমাদের ভাড়া নির্ধারণ করা হয়। এক্ষেত্রে কোন কোন সময়ে যাত্রীদের যথাসময়ে নিরাপদভাবে পৌছে দেওয়ার জন্য প্রাথমিকভাবে অনুমিত রুট পরিবর্তন করা হলে সর্বশেষ ভাড়া অনুমিত ভাড়ার তুলনায় কিছুটা কমতে বা বাড়তে পারে। অন্যান্য রাইড শেয়ারিং প্ল্যাটফর্মের তুলনায় ওভাই এখনও নতুন এবং গ্রাহকদের সবচেয়ে নিরাপদ ও উন্নত সেবা দেওয়ার উদ্দেশ্যে আমরা এখনও পরীক্ষামূলকভাবে নিত্য নতুন ধারনা প্রচলন করার চেষ্টা করছি।
এসব বিষয়ে জানতে চাইলে যাত্রী ও চালক উভয়ের স্বার্থ সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে বিবেচনা করা হয় বলে এক লিখিত বিবৃতিতে জানায় উবার। প্রতিষ্ঠানটির বিবৃতিতে বলা হয়, গ্রাহক ও চালকদের বিড়ম্বনাহীন সেবা দেওয়ার জন্য উবার প্রতিজ্ঞাবদ্ধ। ইতোমধ্যে আমরা এই খাতে ব্যাপক উন্নতি দেখতে পাচ্ছি। কোনো রাইড নিয়ে কারও কোনো অভিযোগ থাকলে আমাদের অ্যাপের মাধ্যমেই কিন্তু সেগুলো তারা আমাদের জানাতে পারেন। আমাদের অ্যাপ, ড্রাইভার পার্টনার হেল্পলাইন, গ্রীন লাইট সেন্টার অথবা নির্দিষ্ট রবি ডিলারশিপ কেন্দ্রগুলো থেকে সেবা নিতে পারবেন আমাদের গ্রাহক ও চালকেরা।
তবে বিভিন্ন অভিযোগের বিষয়ে পাঠাওয়ের বক্তব্য জানতে চাওয়া হলেও এই প্রতিবেদন লেখা পর্যন্ত কোনো মন্তব্য আসে নি প্রতিষ্ঠানটির পক্ষ থেকে।
বিআরটিএ যা বলছে
রাইড শেয়ারিং নিয়ে এতসব অভিযোগ থাকলেও সেই অভিযোগ শোনার মতো কেউ নেই। অভিযোগের তদন্ত বা সুষ্ঠু সমাধান কীভাবে হবে তা এখনও নির্ধারিত হয়নি। রাইড শেয়ারিং এর সার্বিক বিষয়টি দেখভাল করা সংস্থা হলো বাংলাদেশ রোড ট্রান্সপোর্ট অথরিটি বিআরটিএ। এই খাতের জন্য নীতিমালার একটি খসড়া ইতোমধ্যে চূড়ান্ত করেছে সংস্থাটি। বিআরটিএ’র পরিচালক (রোড সেফটি) শেখ মোহাম্মদ মাহবুব-ই-রাব্বানী বলেন, রাইড শেয়ারিং নীতিমালা খসড়া পর্যায়ে আছে। সেই খসড়ায় এসব অভিযোগ প্রতিষ্ঠান ও অভিযোগকারীদের মধ্যে সমাধান করে নেওয়ার সুপারিশ করা হয়েছে। সেখানে সমাধান না হলে বিআরটিএ সেটি দেখবে।
তবে তার আগ পর্যন্ত কোনো ধরণের জরুরি পরিস্থিতি বা অভিযোগের বিষয়ে পুলিশের জরুরী সেবা ৯৯৯-এ ফোন করার পরামর্শ দেন এই কর্মকর্তা। এছাড়া সড়ক পরিবহণ ও সেতু মন্ত্রণালয়ের উদ্যোগে সড়ক নিরাপত্তা আইনেও বিষয়টিকে একটি আইনি কাঠামোর মধ্যে নিয়ে আসা হচ্ছে বলে জানান মাহবুব-ই-রাব্বানী।
/ এআর /