রাজধানীতে অবৈধ গ্যাস-বিদ্যুৎ সংযোগে লেনদেন কয়েক কোটি টাকা
প্রকাশিত : ১৮:২৭, ৩১ আগস্ট ২০১৯ | আপডেট: ২২:০৩, ৩১ আগস্ট ২০১৯
রাজধানীর তিন বস্তিতে অবৈধ গ্যাস ও বিদ্যুৎ সংযোগ দিয়ে ২৪টি সিন্ডিকেট মহল বড় অংকের টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে। অবৈধ সংযোগের ফলে কড়াইল, বাসানটেক এবং চলন্তিকা বস্তিতে বসবাসকারী দেড় লক্ষাধিক মানুষ হুমকির মধ্যে রয়েছে। সাম্প্রতিক এক অনুসন্ধানে এতথ্য ওঠে এসেছে।
অনুসন্ধানে জানা যায়, এই সিন্ডিকেট গ্যাস ও বিদ্যুৎ সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠানের কতিপয় অসাধু কর্মচারীদের মাধ্যমে তাদের অবৈধ কাজ চালিয়ে যাচ্ছে। তারা এই অবৈধ সংযোগ থেকে প্রতি মাসে দুই থেকে তিন কোটি টাকার মতো অর্থ আয় করে। এ অবৈধ আয় চালিয়ে যাওয়ার জন্য প্রশাসনকে মোটা অংকের টাকা দেওয়া হয়।
ওই বস্তিগুলোতে যেভাবে অধিক পরিমাণ লাইন সংযোগ দেওয়া হয়েছে তাতে যেকোনো সময় একটি বড় ধরণের দুর্ঘটনা ঘটতে পারে। সামান্য ঘটনা থেকে বড় আকারের অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা যে কোনো সময় ঘটে যেতে পারে বলে বিশেষজ্ঞরা এ ব্যাপারে মত দিয়েছেন।
ফায়ার সার্ভিস এবং সিভিল ডিফিন্সের সাবেক পরিচালক শেখ নেওয়াজ ভূঁইয়া বলেন, ইতোমধ্যে বেশ কয়েকটি বস্তিতে আগুন লাগার ঘটনা ঘটেছে।
তিনি কড়াইল বস্তিতে আগুন লাগার ঘটনার কথা মনে করিয়ে দিয়ে বলেন, কড়াইল বস্তিতে ২০১৬ সালের ডিসেম্বর এবং ২০১৭ সালের জানুয়ারিতে দু’বার আগুন লাগার ঘটনা ঘটে। প্রথমবার ৫২৬ টি এবং দ্বিতীয় বার ৪ হাজার ৯৯৬ টি ঘর পুড়ে ছাই হয়ে যায়।
ফায়ার সার্ভিসের তথ্যমতে, আগুন লাগার এই দুটি ঘটনায় ফায়ার সার্ভিসের কর্মীরা শুরুর দিকে আগুনের লেলিহান শিখা কমাতে ব্যর্থ হয়। কারণ সেখানে গ্যাসের বিস্ফোরণ ঘটেছিল।
সর্বশেষ ২০১৬ সালের আগস্ট মাসে চলন্তিকা বস্তিতে বড় ধরণের আগুন লাগার ঘটনা ঘটে। এ ঘটনায় প্রায় এক হাজারেরও বেশি কুঁড়েঘর পুড়ে যায় এবং বেশ কয়েকজন মারাত্মকভাবে আহত হয়।
বস্তিগুলোতে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা পর্যবেক্ষণ করে দেখা যায়, আগুন মূলত শর্ট সার্কিট, মশার কয়েল এবং সিগারেটের বাট থেকে সূত্রপাত হয়। তবে ক্ষুদ্র কারণে আগুন লাগলেও তা মূহুর্তেই ছড়িয়ে পড়ে। এর কারণ হলো অবৈধ গ্যাস এবং বিদ্যুতের সংযোগ।
ফায়ার সার্ভিসের সহকারী পরিচালক বলেন, চলন্তিকা বস্তিতে আগুন দ্রুত ছড়িয়ে পড়েছিল। কারণ সেখানের অধিকাংশ গ্যাস লাইন সংযোগ ছিল প্লাস্টিকের পাইপের মাধ্যমে। এ কারণে আগুন নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যায়। এটা মূলত হয়েছিল অবৈধ গ্যাস সংযোগের কারণেই।
ঢাকার বস্তিতে অগ্নিকাণ্ডের কয়েকটি ঘটনার দিকে ইঙ্গিত করে তিনি বলেন, প্লাস্টিকের গ্যাস পাইপ এবং ঘন ঘন সংযোগ দেওয়ার করণে ফায়ার সর্ভিস কর্মীরা আগুন নিয়ন্ত্রণে আনতে পারেননি।
এদিকে চলতি বছরের ২৭ ফ্রেব্রুয়ারি বাসানটেক বস্তিতে দু’জন শিশু নিহত হয়েছেন। বস্তি থেকে অন্যরা পালাতে সক্ষম হলেও তারা পালাতে সক্ষম হয়নি। কারণ তারা বস্তির ভেতর একটি গর্তের ভেতর অবস্থান করছিল।
ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্সের ডেপুটি সহকারী পরিচালক কাজী নাজমুজ্জামান বলেন, অবৈধ গ্যাস সংযোগের কারণেই আগুনের শিখা কয়েক সেকেন্ডের মধ্যেই ছড়িয়ে পড়ে।
এবার আসুন দেখে নেওয়া যাক ৩টি বস্তিতে গ্যাস ও বিদ্যুতের সংযোগ এবং বসবাসকারী লোকের সংখ্যা সম্পর্কে জেনে নেওয়া যাক:
চলন্তিকা বস্তি
এই বস্তিতে প্রায় ১৫ হাজার লোক বসবাস করে। এখানে ঘর রয়েছে ৩ হাজার। জমির পরিমাণ ২০ একর। এতে রয়েয়ে ১৫শ টি গ্যাস এবং ৩ হাজার বিদ্যুতিক লাইন। ২০১৬ সালের আগস্ট মাসের অগ্নিকাণ্ডের আগের পরিসংখ্যান অনুযায়ী।
কড়াইল বস্তি
এ বস্তিতে ১ লাখ ১০ হাজার লোক বসবাস করে। এখানে প্রায় ৩০ হাজার ঘর রয়েছে। জমি আছে প্রায় ৯০ একর। এখানে ১৫ হাজার গ্যাস এবং ২০ হাজার বৈদ্যুতিক লাইন রয়েছে।
বাসানটেক বস্তি
এ বস্তিতে ৩০ হাজার লোক বসবাস করে। ঘর রয়েছে ৪ হাজার ৭৫০টি। জমি রয়েছে ৪০ একর। এখানে প্রায় ১৫শ টি গ্যাস লাইন এবং ৪ হাজার ৭৫০ টি বৈদ্যুতিক লাইন রয়েছে।
এ বস্তিগুলোতে সাধারণত হকার, দোকানদার, রিক্সা ড্রাইভার এবং ভ্যান চালকরা বসবাস করেন। এগুলো সাধারণত তৈরি করা হয় কাঠ, বাঁশ এবং টিনের সাহায্যে।
তারা গড়ে প্রতি মাসে বিদ্যুত বিলের জন্য ৫০০ টাকা এবং গ্যাস লাইনের জন্য ৭০০ টাকা দিয়ে থাকেন।
আর এ বস্তিগুলোতে গ্যাসের লাইন দেওয়া হয়েছে জিআই পাইপ বা প্লাস্টিকের পাইপের মাধ্যমে। যেগুলোতে সহজেই আগুন ধরে যায়।
ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশনের ১৯-এর ওয়ার্ড কাউন্সিল মফিজুর রহমান বলেন, অবৈধ গ্যাস লাইনের কারণেই অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটে। আর এ কাজে তিতাস গ্যাস কোম্পানির কতিপয় অসাধু কর্মচারীও জড়িত রয়েছেন।
সরেজমিনে দেখা যায়, ১০ ফিট বাই ৮ ফিটের একটি রুমে গ্যাসের চুলা ব্যবহার করা হচ্ছে। সেখানে ৪ থেকে ৫ জন লোক বসবাস করে। এসবের অধিকাংশ রুমের কোনো জানালা নেই। গ্যাসের চুলার পাশেই দরজা দেখা গেছে।
দেখা গেছে, কিছু কিছু পাইপ মাথার উপর ঝুলছে এবং কিছু পাইপ এলোমেলোভাবে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে আছে।
চলন্তিকা বস্তির একজন চায়ের দোকানদার বলেন, আমি নিরুপায় হয়ে অবৈধভাবে গ্যাস ব্যবহার করছি। কেননা গ্যাস ছাড়া আমি যদি কেরেসিন ব্যবহার করি তবে আমাকে প্রতিদিন ১৩০ টাকা দিতে হবে।
তিতাস গ্যাস কোম্পানির একটি সূত্র বলছে, তারা ইতিমধ্যে বস্তিগুলোর অবৈধ সংযোগ অপসারণে কাজ করছে।
বাসানটেক বস্তির একটি সূত্র বলছে, গত শনিবার ওই বস্তিতে অবৈধ লাইন অপসারণে কাজ শুরু হয়েছে।
এমএইচ/
আরও পড়ুন