রাজনীতিতে সন্দেহ ষড়যন্ত্রের আঁধার
প্রকাশিত : ১৭:২৯, ২৯ অক্টোবর ২০১৮
রাষ্ট্র, রাজনীতি, ক্ষমতা ও সম্পদকে ঘিরে সন্দেহ, অবিশ্বাস, ষড়যন্ত্র এবং হানাহানি প্রাগৈতিহাসিক যুগ থেকে চলে আসছে। সন্তান পিতাকে, ভাই ভাইকে এবং বন্ধু বন্ধুকে হত্যা করতে পর্যন্ত দ্বিধা করেনি। সম্রাট আওরঙ্গজেব নিজের তিন ভাইকে হত্যা ও বিতাড়ন এবং আগ্রার দুর্গে আমৃত্যু পিতা শাহজানকে বন্দী করে ক্ষমতা দখল ও ভোগ করেছেন।
ইতিহাসে এ রকম উদাহরণের শেষ নেই। বহু উত্থান-পতন, যুদ্ধ-বিগ্রহ এবং রক্তপাতের মধ্য দিয়ে এই সময়ে এসে বিশ্বের বহু দেশেই স্বচ্ছ রাজনীতি প্রাতিষ্ঠানিক রূপ পেয়েছে। কিন্তু আমাদের মতো উন্নয়নশীল দেশ তা থেকে এখনো অনেক দূরে। আমাদের মতো দেশে অস্বচ্ছতা এবং ষড়যন্ত্র নিত্যনৈতিক ব্যাপার। তবে ইতিহাস অকাট্য প্রমাণ দেয় রাজনৈতিক ষড়যন্ত্র কখনো কোনো দেশের জন্য সুফল দেয়নি। তার সুফল ভোগ করেছে মুষ্টিমেয় কয়েকজন ষড়যন্ত্রকারী, তাও স্বল্প সময়ের জন্য।
মীর জাফরের পরিণতি সবাই জানেন। বাংলাদেশের রাজনীতিতে ষড়যন্ত্রের ইতিহাসটা অত্যন্ত বেদনাদায়ক-ট্র্যাজেডি। জাতির পিতা, যার অবদান ব্যতিরেকে বাংলাদেশ কখনোই স্বাধীন হতো না, তাকেই হত্যা করা হয় স্বাধীনতা অর্জনের মাত্র সাড়ে তিন বছরের মাথায়।
ষড়যন্ত্রটা শুধু ব্যক্তি মুজিবকে হত্যার মধ্যে থেমে থাকেনি। ওই ষড়যন্ত্রের মাধ্যমে বাংলাদেশ রাষ্ট্রটিকেই হত্যা করা হয় এবং বাংলাদেশ নামের খোলসে সেই পাকিস্তানকেই ফিরিয়ে আনা হয়, যার বিরুদ্ধে আমরা ২৩ বছর সংগ্রাম করেছি এবং একাত্তরে ৩০ লাখ মানুষের জীবন দিয়েছি। এই ষড়যন্ত্রের ফলে বাংলাদেশের মানুষ কী পেয়েছে। কিছুই পায়নি, বরং হত্যা, ষড়যন্ত্র, সংঘাত, সংঘর্ষ এবং মৌলিক প্রশ্নে জাতিগত বিভাজনের যে শিকার আমরা হলাম তার পরিণতি এখনো পোহাতে হচ্ছে। কিন্তু দেখুন ষড়যন্ত্রের কী নির্মমতা।
একটি ষড়যন্ত্র আরেকটি ষড়যন্ত্রের জম্ম দেয়। অথচ মোহগ্রস্ত ষড়যন্ত্রকারীরা শুরুতে সেটা বুঝতে অক্ষম হয়, টের পায় না। যখন বুঝতে পারে তখন আর ফিরে তাকানোর সময় থাকে না। পঁচাত্তরের পর যার হাত ধরে মুক্তি সংগ্রামের মাধ্যমে অর্জিত রাষ্ট্রটির মৌলিক চরিত্রের কবর রচিত হলো তিনিও নির্মম ষড়যন্ত্রের শিকার হয়ে নিহত হলেন ১৯৮১ সালে, ক্ষমতা দখলের মাত্র ছয় বছরের মাথায়।
ডাল বেয়ে সেই ষড়যন্ত্রের আরও বিস্তৃতি ঘটে। জিয়াউর রহমান ষড়যন্ত্রের কবলে পড়ে নিহত হলেন। অথচ এই ষড়যন্ত্রকারীদের বিচারের আওতায় আনার চেষ্টাই হলো না, যদিও তার গড়া দল এবং তার পরিবারের সদস্যরা প্রবল প্রতাপের সঙ্গে দীর্ঘদিন ক্ষমতায় ছিলেন। সুতরাং কখন, কে কোথায় ষড়ন্ত্রে লিপ্ত তা খালি চোখে দেখা-বোঝা আমাদের মতো সাধারণের সীমার বাইরে। তবে অবস্থা এখন আর আগের মতো নেই।
তথ্য প্রযুক্তির অভূতপূর্ব বিপ্লব, তার সঙ্গে মানুষের বিচার বিশ্লেøষণের ক্ষমতা আগের তুলনায় অনেক বৃদ্ধি পেয়েছে। মানুষ যখন দেখে কোনো ব্যক্তি বা গোষ্ঠীর কথাবার্তা, কর্মকা-, হুমকি-ধমকি, ভবিষ্যদ্বাণী ইত্যাদির সঙ্গে বাস্তবতার কোনো মিল নেই তখন মানুষের মনে সন্দেহের সৃষ্টি হয়। মনে হয় এর মধ্যে আবার কোনো ষড়যন্ত্র আছে কিনা। এরকম সন্দেহজনক কিছু কর্মকান্ড এখন বাংলাদেশের রাজনৈতিক অঙ্গনে দেখা যাচ্ছে। বাংলাদেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম রাজনৈতিক দল বিএনপি।
তারা দীর্ঘ সময় ক্ষমতায়ও ছিল। ধারণা করা হয় শতকরা ২৫-৩০ ভাগ রিজার্ভ ভোট রয়েছে বিএনপির। এই বিএনপি এখন তাদের জোট নেতা হিসেবে মেনে নিচ্ছে ড. কামাল হোসেনকে, যার নিজের দল ও নিজের না আছে কোনো সাংগঠনিক ক্ষমতা, না আছে জনসংযোগ ও জনসমর্থন। তাছাড়া ড. কামাল হোসেনের রাজনৈতিক লেগেসিও রহস্যে ভরা। ২৭-২৮ বছর ধরে গণফোরাম করে কিছুই করতে পারেননি। এরকম একজন রাজনৈতিক ক্রেডেনশিয়ালহীন ব্যক্তির নেতৃত্ব যখন বিএনপির মতো একটা বড় দল মেনে নেয় তখন মানুষের মনে সঙ্গত কারণেই সন্দেহের সৃষ্টি হবে।
এর পেছনে আসল কারণ কী থাকতে পারে। সবাই জানে ড. কামাল হোসেন বাহাত্তরের সংবিধান প্রণেতা। তিনি ইচ্ছামতো সংবিধানের ব্যাখ্যা দিতে পারেন। ওয়ান-ইলেভেনের সময় (২০০৭-২০০৮) বলেছিলেন, দুই বছর জরুরি আইন বহাল রাখা সংবিধান সম্মত, কোনো অসুবিধা নেই। বিএনপি ওয়ান-ইলেভেনের শিকার হয়েছিল। এত তাড়াতাড়ি সবকিছু বিস্মৃতির অতল গহ্বরে চলে গেল। এই ভুলে যাওয়াটা কতখানি বিশ্বাসযোগ্য। ওয়ান-ইলেভেনের কুশীলবদের এখন আবার অনেক তেজ দেখা যাচ্ছে। তাদের কেউ কেউ মানুষকে এখন মানুষ মনে করছে না। প্রকাশ্যে টেলিভিশন টকশোতে যা ইচ্ছা তাই বলছেন।
অন্যদিকে ড. কামাল হোসেনের বিএনপির সঙ্গে একাত্ম হয়ে যাওয়াটা কি খুব স্বাভাবিক ঘটনা বলে মনে হতে পারে। তা না হলে কী আছে এর মধ্যে। কথাটি বলছি এ কারণে যে, ড. কামাল হোসেন মুখে সব সময় বঙ্গবন্ধুর কথা বলেন এবং সম্মান দেখান। শুধু তাই নয়, তিনি অহরহ মুক্তিযুদ্ধের আদর্শের কথা বলেন। সেই কামাল হোসেন কী করে বিএনপির মতো একটা দলের ভিতরে নিজেকে বিলীন করে দিতে পারেন, যে বিএনপি বঙ্গবন্ধুর প্রতি সামান্যতম আনুষ্ঠানিক সম্মান দেখায় না এবং জাতির পিতা হিসেবে স্বীকার করে না।
ড. কামাল হোসেনের রাজনৈতিক সক্ষমতা শূন্য। বিএনপি এখন বেকায়দায় পড়ে কামাল হোসেনের সঙ্গে শুধু বন্ধুত্ব নয়, তার নেতৃত্বও মাথা পেতে নিচ্ছে। এটা একেবারেই অস্বাভাবিক ঘটনা। নবাব সিরাজউদ্দৌলাকে দুর্বল করার জন্য ইংরেজ বাহিনী মীর জাফরকে সিংহাসনের লোভ দেখিয়েছিল।
এর পরিণতি সবাই জানেন। ড. কামাল হোসেনের সক্ষমতা বুঝতাম যদি বেগম খালেদা জিয়ার মুক্তিসহ বিএনপির সেই পুরনো কাহিনী সাত দফা দাবির প্রতি একাত্মতা প্রকাশের আগে তিনি বিএনপির কাছ থেকে প্রকাশ্যে আনুষ্ঠানিক অঙ্গীকার নিতে পারতেন যে, এখন থেকে বিএনপি একাত্তরের স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রসহ জাতির পিতাকে স্বীকার ও সম্মান দেখাবেন।
এ সম্পর্কে বিএনপির সঙ্গে ড. কামাল হোসেনের বার্গেইনিং কিছু হয়েছে কিনা তাও জানা যায়নি। অর্থাৎ ড. কামাল হোসেন মুখে যা বলেন তার সবকিছু বিসর্জন দিয়ে বিএনপির সঙ্গে মিলে গেছেন। ড. কামাল হোসেন বিএনপির মাধ্যমে সুশাসন, গণতন্ত্র ও দুর্নীতিমুক্ত রাষ্ট্র কায়েম করবেন এ কথা বোধ হয় পাগল এবং শিশুও বিশ্বাস করবে না। বরং তার খোলস উম্মোাচিত হলো, জামায়াতের সঙ্গে এক কাতারে দাঁড়িয়ে গেলেন। একাত্তরে তার ভূমিকা গোপন থাকলেও ২০১৮ সালে এসে তা প্রকাশ হয়ে গেল। কতদিন আর সত্যকে চেপে রাখা যায়। সুতরাং এতবড় অসঙ্গতি, অসামঞ্জস্যতা এবং অস্পষ্টতা নিয়ে যখন তারা একে অপরের সঙ্গে মিলে যায় তখন তাদের সত্যিকার উদ্দেশ্য মানুষের কাছে অদৃশ্য থেকে যায়।
সঙ্গত কারণে ভাবনায় আসে সেই অদৃশ্যের অতলে কী রয়েছে। কথায় আছে, যাহা কিছু অদৃশ্য তাহাই নমস্য, আর নয়তো সর্বনাশ্যও। এত সময়ে যাদের কথা বললাম তাদের জন্য নমস্যের কিছু কি আছে। আগের রেকর্ড কী বলে। বাংলাদেশ, রাষ্ট্র, রাজনীতিতে বারবার ষড়যন্ত্র আঘাত হেনেছে। ওয়ান-ইলেভেনের (২০০৭-২০০৮) কথা তো একেবারে ফ্রেশ।
সে ঘটনার প্রধান ব্রেন ছিলেন ড. কামাল হোসেন, এরকম কথা তো ব্যাপকভাবে আলোচিত। ঐক্যফ্রন্টের মঞ্চে ওয়ান-ইলেভেনের প্রধান প্রধান কুশীলবের এখন সরব উপস্থিতি। সুতরাং ষড়যন্ত্রের আশঙ্কাকে উড়িয়ে দেব কী করে। দ্বিতীয়ত, আরেকটি ঘটনা নিয়ে অনেক আলোচনা হচ্ছে। সেটি হলো, এ সময়ের সবচেয়ে তেজোদীপ্ত এবং বিএনপির উচ্চকণ্ঠ ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরীর সম্পূর্ণ একটা অসত্য কথা ও উক্তি, যা তিনি করেছেন বর্তমান সেনাবাহিনী প্রধান জেনারেল আজিজ আহমদ সম্পর্কে। ডা. চৌধুরী এতদসংক্রান্ত বিষয়ে যা কিছু বলেছেন তার একটি কথার মধ্যেও সামান্যতম সত্যতা নেই। আমি চাকরিতে থাকা অবস্থায় যখন ব্রিগেড কমান্ডার ছিলাম তখন জেনারেল আজিজ আমার সঙ্গে কমান্ডিং অফিসার ছিলেন। তাই তার সম্পর্কে ব্যক্তিগতভাবে জানি বলেই বলছি।
জেনারেল আজিজের মতো একজন দক্ষ, সৎ, স্বচ্ছ পেশায় উৎকৃষ্ট এবং ক্লিন ইমেজের সেনাপ্রধান সম্পর্কে যখন কেউ মর্যাদাহানিকর সম্পূর্ণ অসত্য কথা বলেন, তখন সেটির পেছনে এবং অদৃশ্যে কী আছে তা নিয়ে যথেষ্ট সন্দেহ হওয়াটা অত্যন্ত স্বাভাবিক।
তারপর সেই কথাগুলো যখন ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী বলেন, তখন তার রহস্যের মাত্রা আরও বেড়ে যায়। বাইরে অনেকে বলাবলি করেন, তিনি এখন নাকি বিএনপির অলিখিত বড় নেতা। সেনাবাহিনীকে জড়িয়ে শুরু হয় বিএনপির রাজনীতি সেই ১৯৭৮ সালে। ওই সময়ে সেনাবাহিনীকে রাজনীতিতে জড়িত করার কারণে রাষ্ট্র ও রাজনীতির কত বড় সর্বনাশ হয়েছে সে কথা কম বেশি আমরা সবাই জানি। সেই লেগেসি থেকে রাষ্ট্র ও রাজনীতি কোনোটাই এখনো বের হতে পারেনি। ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী নিজের ভুল স্বীকার করে যা বলেছেন তা কারও কাছেই গ্রহণযোগ্য হয়নি।
সেখানেও তিনি অর্ধসত্য বলেছেন। ভুলবশত, অসাবধানতাবশত বা শব্দচয়নে ভুল ইত্যাদি আসলে কোনো কথা নয়। অনেকের ধারণা, সেদিন টকশোতে আসার আগে অত্যন্ত পরিকল্পিতভাবে প্রস্তুতি নিয়েই এসব কথা তিনি বলেছেন। তা না হলে একেবারে সম্পূর্ণ অসত্য উদ্ভট কথা তো কারও মাথায় আসার কথা নয়। ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরীর মতো মেধাবী লোকের তো নয়ই।
সুতরাং এ বিষয়টি হালকাভাবে দেখার কোনো সুযোগ নেই। জাতীয় নির্বাচনকে সামনে রেখে জামায়াত এবং তাদের থেকে উৎপত্তি হওয়া জঙ্গি গোষ্ঠী কী করবে সেটাও একটা বড় সন্দেহের জায়গা। ২০১৪ সালে তারা বিএনপিকে নির্বাচনে অংশগ্রহণ করতে দেয়নি।
কথিত জাতীয় ঐক্যফ্রন্টে জামায়াতকে সঙ্গে রেখেই বিএনপি প্রবেশ করেছে। কয়েকদিন আগে কলকাতার একটা বড় পত্রিকার বরাতে ঢাকার পত্রিকায় খবর বেরিয়েছিল, ঢাকাস্থ পাকিস্তানের দূতাবাসের ভিতরে বসে গোয়েন্দা সংস্থা আইএসআই বাংলাদেশের নির্বাচনকে সামনে রেখে নাকি বহু ধরনের ছক কষছে। পাকিস্তানের গোয়েন্দা সংস্থা আইএসআই যখন ঢাকায় বসে ছক কষে তখন সন্দেহ ও ষড়যন্ত্রের আঁধার সম্পর্কে সবার সতর্ক হওয়া উচিত।
লেখক : কলামিস্ট ও নিরাপত্তা বিশ্লেষক।
sikder52@gmail.com
** লেখার মতামত লেখকের। একুশে টেলিভিশনের সম্পাদকীয় নীতিমালার সঙ্গে লেখকের মতামতের মিল নাও থাকতে পারে।