‘রাজনীতি রাজনৈতিক কর্মীদের হাতে থাকা দেশের জন্য ভালো’
প্রকাশিত : ১৬:৫৩, ১৬ জানুয়ারি ২০১৮ | আপডেট: ১৮:১৭, ১৭ জানুয়ারি ২০১৮
ইসহাক আলী খান পান্না
ইসহাক আলী খান পান্না ১৯৯৪ থেকে ১৯৯৮ পর্যন্ত কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেছেন। মাঠ থেকে উঠে আসা এই রাজনীতিবিদ দীর্ঘদিন ছাত্র রাজনীতি কাছ থেকে পর্যবেক্ষণ করেছেন। একুশে টিভি অনলাইনের সঙ্গে আলাপচারিতায় তুলে ধরেছেন নিজের জীবনের অভিজ্ঞতা। সাক্ষাৎকারটি নিয়েছেন আলী আদনান।
একুশে টেলিভিশন অনলাইন: ছাত্ররাজনীতির হাতেখড়ি কিভাবে হল?
ইসহাক আলী খান পান্না: ছোটবেলায় আমি ভাল ফুটবল খেলতাম। সেই সুবাদে এলাকার আবাহনী ক্রীড়া চক্রের খেলোয়াড় ছিলাম আমি। না বললেই নয়, তখন প্রকাশ্যে বঙ্গবন্ধু, আওয়ামী লীগের কথা বলা নিষিদ্ধ ছিল। তাই মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শক্তি বা বঙ্গবন্ধুর আদর্শে যারা বিশ্বাস করতেন তারা আবাহনী ক্রীড়া চক্রে মিলিত হতেন। এরকম কিছু সভায় আমি সিনিয়র ভাইদের সঙ্গে যেতাম। ক্লাস টেনে পড়া অবস্থায় স্থানীয় স্কুলে ছাত্রলীগের কমিটি করা হলে আমাকে সভাপতির দায়িত্ব দেওয়া হয়। এটা আমার জীবনে প্রথম আনুষ্ঠানিকভাবে ছাত্রলীগের দায়িত্ব নেওয়া।
একুশে টেলিভিশন অনলাইন: পিরোজপুর থেকে এসে কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক হলেন। এ যাত্রা কেমন ছিল?
ইসহাক আলী খান পান্না: ১৯৮২ সাথে ছাত্রলীগ দু`ভাগে বিভক্ত হয়ে যায়। একটি অংশ আলাদা হয়ে `জাতীয় ছাত্রলীগ` নামে আত্মপ্রকাশ করে। তখন আমাকে পিরোজপুর জেলা ছাত্রলীগের আহবায়ক করা হয়। তখন আমি মাত্র ইন্টারমিডিয়েটের ছাত্র। সে সময় কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগের সভাপতি ছিলেন মোস্তফা জালাল মহিউদ্দিন। আর সাধারণ সম্পাদক ছিলেন খ ম জাহাঙ্গীর। এটা মূলত ছাত্রলীগ ( জা জা) নামে পরিচিত ছিল। আমরা তাদের নেতৃত্বেই ছাত্রলীগ করতাম। আর জাতীয় ছাত্রলীগের নেতৃত্বে ছিলেন ফজলুর - বাহালুল মজনুন চুন্নু।
একুশে টেলিভিশন অনলাইন: অনেকে বলে থাকেন, জাতীয় ছাত্রলীগে বাছাই করা মেধাবী ছাত্রগুলো গিয়েছিল। আপনার কী অভিমত?
ইসহাক আলী খান পান্না: আমি একথার সঙ্গে একমত না। বরং এটা বলা যায়, জাতীয় ছাত্রলীগ যারা করত, তারা সংখ্যায় কম ছিল। ফলে সহজে নেতৃত্বে আসত ও সবাই চিনত। কিন্তু বাংলাদেশ ছাত্রলীগে কর্মী বেশি ছিল। প্রতিযোগিতা ছিল। তাই নেতৃত্বে আসাটাও কঠিন ছিল। ঐ সময়ে পিরোজপুরে জেলা ছাত্রলীগের সম্মেলনে আমি সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হই। বাংলাদেশ ছাত্রলীগ নিয়ে দিন রাত পরিশ্রম করে পিরোজপুরের প্রতিটা উপজেলায় সংগঠনকে শক্তিশালী করেছিলাম। এরশাদ বিরোধী আন্দোলন তখন তুঙ্গে। প্রতিটি আন্দোলন সংগ্রামে নেতৃত্ব দিত বাংলাদেশ ছাত্রলীগ। পিরোজপুর কলেজ ছাত্র সংসদে বাংলাদেশ ছাত্রলীগ পূর্ণ প্যানেলে বিজয়ী হয়েছিল। জাতীয় ছাত্রলীগ আমাদের সামনে টিকতেও পারেনি। পিরোজপুর সোহরাওয়ার্দী সরকারি কলেজে আমি একবার সম্পাদক নির্বাচিত হয়েছিলাম।
একুশে টেলিভিশন অনলাইন: কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগে সাধারণ সম্পাদক হওয়ার আগে কী দায়িত্বে ছিলেন?
ইসহাক আলী খান পান্না: ১৯৮৬ সালে জেলা ছাত্রলীগের সম্মেলনের পর নেত্রীর নির্দেশে ঢাকায় আসি। তখন আমি কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগের সদস্য নির্বাচিত হই।
একুশে টেলিভিশন আনলাইনঃ তখন সভাপতি কী সুলতান মোহাম্মদ মনসুর আহাম্মেদ?
ইসহাক আলী খান পান্না: হ্যাঁ। আর সাধারণ সম্পাদক আব্দুর রহমান। আব্দুর রহমান বর্তমানে কেন্দ্রীয় আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক। পরবর্তী কমিটি অর্থাৎ হাবীবুর রহমান হাবীব ও অসীম কুমার উকিলের কমিটিতেও আমি সদস্য ছিলাম। এর পরের কমিটি অর্থাৎ মাইনুদ্দীন হাসান চৌধুরী ও ইকবালুর রহিমের কমিটিতে আমি ছিলাম যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক। এর পরের বার এনামুল হক শামীমকে সভাপতি ও আমাকে সাধারণ সম্পাদক করে কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগের কমিটি করা হয়েছিল।
একুশে টেলিভিশন অনলাইন: আপনি ভাল খেলোয়াড় ছিলেন। পড়াশোনার পাশাপাশি বয়স্কাউটিং, নাট্যচর্চা করেছেন। এতকিছু একসঙ্গে কীভাবে করেছেন?
ইসহাক আলী খান পান্না: ( হেসে) আমি কিছুদিন সাংবাদিকতাও করেছি। একটা পত্রিকার জয়েন এডিটর ছিলাম। বাংলার বাণীতেও আমি কিছুদিন কাজ করেছি। আসলে একাগ্রতা একটা বড় ব্যাপার। যখন যে কাজটা করব সেই কাজটা ভালভাবে করার মানসিকতা থাকতে হবে। পুলিশের সঙ্গে ধাওয়া পাল্টা ধাওয়া ছিল নিত্যনৈমিত্তিক ব্যাপার। কিন্তু ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আবার ক্লাসও করতে হয়েছে।
একুশে টেলিভিশন অনলাইন: রাজপথে আপনার দীর্ঘ অভিজ্ঞতা। ঐ জায়গা থেকে বর্তমান ছাত্রলীগকে মূল্যায়ন করুন।
ইসহাক আলী খান পান্না: বাংলাদেশের ইতিহাস আর ছাত্রলীগের ইতিহাস একই। স্বাধীনতার আগে থেকেই সময়ের পরিক্রমায় ছাত্রলীগকে সঠিক সময়ে সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে হয়েছে। ৬৯ বা ৭১- এ ছাত্রলীগ যে সিদ্ধান্ত নিয়েছে তা কিন্তু ৭১ পরবর্তী সময়ে নেয়নি। ঠিক ৮০ দশকে ছাত্রলীগ যেসব সিদ্ধান্ত নিয়েছে তা আজকে নিলে হবেনা। আমাদেরকে সামরিক শাসনের বিরুদ্ধে, স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে লড়াই করতে হয়েছিল। তখন ক্যাম্পাসগুলোতে শিবিরের দাপট ছিল। তাদের বিরুদ্ধে রীতিমত যুদ্ধ করতে হয়েছিল।
এখন সময় পাল্টেছে। এখন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বাংলাদেশকে অর্থনৈতিকভাবে, সামাজিকভাবে, রাজনৈতিকভাবে বিনির্মাণ করছেন। ছাত্রলীগ হবে এই বিনির্মাণের অংশীদার। ছাত্রলীগকে এখন লড়াই করতে হবে মৌলবাদ- জঙ্গীবাদের বিরুদ্ধে। মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস এদেশে দলিত মথিত হয়েছে। সেই ইতিহাস পুনরুদ্ধার করে সঠিকভাবে চর্চা করতে হবে। সেই দায়িত্বটাও ছাত্রলীগ নিতে পারে।
একুশে টেলিভিশন অনলাইন: অনেকে অভিযোগ করে থাকেন বর্তমান ছাত্রলীগ লেজুড়বৃত্তি করছে। আপনার কী মনে হয়?
ইসহাক আলী খান পান্না: এবিষয়ে আমি পুরোপুরি একমত নই। ছাত্রলীগের গঠনতন্ত্র আলাদা। ঘোষণাপত্র আলাদা। ছাত্রলীগ আওয়ামী লীগের অঙ্গ সংগঠন নয়। সহযোগী সংগঠন। গঠনতন্ত্র অনুযায়ী নির্দিষ্ট সময় পরপর ছাত্রলীগে সম্মেলন হয়। সেই সম্মেলনে সাবজেক্ট কমিটি বসে। প্রথমে প্রার্থীদের মধ্যে সমঝোতা করার চেষ্টা করে। সমঝোতা না হলে সরাসরি ভোটে চলে যায়। তাই এখানে লেজুড়বৃত্তি করার সুযোগ নেই বললেই চলে। তবে কোনো নেতা বা কর্মী যদি লেজুড়বৃত্তি করে থাকে সেটা তার ব্যক্তিগত দায়ভার। এটা ছাত্রলীগের কাঁধে চাপানো ঠিক হবে না।
একুশে টেলিভিশন অনলাইন: কিন্তু দীর্ঘদিন যাবত নির্দিষ্ট সময়ে ছাত্রলীগের সম্মেলন হচ্ছে না। এবিষয়ে আপনার কী মত?
ইসহাক আলী খান পান্না: এবিষয়ে আমার দ্বিমত নেই। পরিস্থিতির কারণেই নির্দিষ্ট সময়ে সম্মেলন করা হয়ে উঠে না। স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে পরিস্থিতি ছিল কঠিন। স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে আমাদের প্রতিনিয়ত লড়াই করতে হত। ৯০ পরবর্তী সময়ের সম্মেলনগুলোতেও বিএনপি- জামাতের বিরুদ্ধে লড়তে হত। সম্মেলন করার জন্য যে সার্বিক পরিবেশ দরকার তা ছিলনা। তারপরেও জেলা পর্যায়ে কিন্তু নির্দিষ্ট সময়ে সম্মেলন হয়ে যায়।
একুশে টেলিভিশন অনলাইন: নেত্রীর নির্দেশনা অনুযায়ী অবিবাহিত হওয়া, বয়স ২৯ এর মধ্যে থাকা বা ছাত্রত্ব থাকার কথা থাকলেও তাও কিন্তু লঙ্ঘন করা হচ্ছে বলে শোনা যায়।
ইসহাক আলী খান পান্না: এরকমটা হয়ে থাকলে, তা মূল নেতৃত্বের অগোচরে হচ্ছে। জেনে শুনে এরকম হওয়ার সুযোগ নেই। আরেকটি বিষয় হল, যখন নেতা বানানো হয় তখন কিন্তু সে অবিবাহিত থাকে। তার ছাত্রত্বও থাকে। বয়সও নির্দিষ্ট সীমারেখায় থাকে। কিন্তু সম্মেলনের পর সময়ের ব্যবধানে তার ছাত্রত্ব শেষ হয়। অর্থাৎ ব্যাপারটি ইচ্ছাকৃত না।
একুশে টেলিভিশন অনলাইন: হল দখল, সিট দখলসহ নানা দুর্বৃত্তায়নের অভিযোগ ছাত্রসংগঠনের নেতাদের বিরুদ্ধে পাওয়া যায়। এর জন্য কে দায়ী বলে মনে করেন?
ইসহাক আলী খান পান্না: যে সংগঠনের নেতা- কর্মী জড়িত সেই সংগঠন দায়ী। যেহেতু প্রশ্নটি আমাকে করলেন, আমি ছাত্রলীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক সেহেতু আমি ছাত্রলীগের জায়গা থেকে বলি। যে বঙ্গবন্ধুর আদর্শে বিশ্বাস করে, ছাত্রলীগের নীতি আদর্শে বিশ্বাস করে তার পক্ষে এসব দুর্বৃত্তায়ন সম্ভব না। এসব তাদের পক্ষেই সম্ভব, যারা সব সময় সুবিধাবাদী অবস্থানে থাকে, যখন যে সংগঠনের সুসময় তখন সে সংগঠনের সঙ্গে যায়- তারাই এসব করে থাকে। ছাত্রলীগ একটি বড় সংগঠন- কেন্দ্র থেকে তৃণমূল ইউনিয়ন বা ওয়ার্ড পর্যন্ত বিস্তৃত। তাই অনেক সময় অনেক কিছু কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের নজরে আসেনা। তবে যখন যেটা নজরে আসে তখন সেটার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হয়।
একুশে টেলিভিশন অনলাইন: ছাত্রলীগের রাজনীতিতে তারকা ছিলেন, কিন্তু পরবর্তীতে আওয়ামী রাজনীতিতে আলোচনায় আসতে পারেননি বা টিকে থাকতে পারেননি এমন উদাহরণ কম নয়। ছাত্রনেতাদের ক্ষেত্রে এমন হয় কেনো?
ইসহাক আলী খান পান্না: দেখুন, খেলার টিমে একজন ক্যাপ্টেন থাকেন। খেলার মাঠে তার সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত। তেমনি রাজনীতিতেও একজন নেতা থাকেন। যিনি সিদ্ধান্ত দিবেন কে কোন জায়গা থেকে কাজ করবে, কী কাজ করবে। সেই বিবেচনায় আমাদের নেতা বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনা। তিনি ভাল বুঝেন আমাদের কাকে কোথায় রাখবেন বা কোথায় রাখা দরকার। তার প্রতি আমাদের সে আস্থা আছে। দ্বিতীয়ত, রাজনীতিতে টিকে থাকতে পারেননি কথাটা ঠিক নয়। রাজনৈতিক কর্মীরা কখনো হারিয়ে যায়না। রাজনীতি শুধু মাত্র আপনাকে ঢাকায় বসে করতে হবে কেন? নিজের এলাকায় যান। সাধারণ মানুষের সঙ্গে মেলামেশা করুন। মূল্যায়ন আসবেই।
তবে ব্যক্তিগতভাবে আমি মনে করি রাজনৈতিক কর্মীদের দিয়েই রাজনীতি করানো দরকার। রাজনীতিটা রাজনৈতিক কর্মীদের হাতে রাখা দরকার। সেটা দেশের জন্যও ভাল। রাজনৈতিক নেতা কর্মীদের জন্য ভাল।
একুশে টেলিভিশন অনলাইন: আপনাকে অনেক ধন্যবাদ ব্যস্ততার মাঝেও সময় দেওয়ার জন্য।
ইসহাক আলী খান পান্না: আপনাকেও ধন্যবাদ। একুশে টেলিভিশন অনলাইনের জন্য শুভ কামনা।
আরও পড়ুন