রাজনৈতিক বৈধতার সংকটে বিএনপি
প্রকাশিত : ২২:১৭, ১৩ অক্টোবর ২০১৮ | আপডেট: ১২:৫১, ১৬ অক্টোবর ২০১৮
বাংলাদেশের সর্ববৃহৎ রাজনৈতিক দল এবং যে দলের নেতৃত্বে বাংলাদেশ স্বাধীনতা লাভ করে সেই দলের প্রধান শেখ হাসিনাসহ সব সিনিয়র নেতাদের ওপর বর্বরোচিত গ্রেনেড হামলা চালানো হয় প্রকাশ্য দিবালোকে; রাজধানীর গুলিস্তান এ্যাভিনিউতে ২০০৪ সালের ২১ আগস্ট। দীর্ঘ ১৪ বছর প্রতীক্ষার পর গত ১০ অক্টোবর বিচারিক আদালত এতদসংক্রান্ত মামলার রায় প্রদান করেছে। এই পৈশাচিক হত্যাকাণ্ডের রায়ের প্রসঙ্গটি ছিল ১০ অক্টোবর বুধবারের টক অব দ্যা কান্ট্রি।
রাস্তা-ঘাটে, অলিতে-গলিতে, দোকানে-বাসে, ট্রেনে, মানুষের মুখে ছিল আদালতের রায়। একটাই কমন কথা ছিল সবার মুখে, যে দল রাষ্ট্র ক্ষমতায় বসে রাষ্ট্রযন্ত্রকে ব্যবহার করে এমন পৈশাচিক, নির্মম, নৃশংস হত্যাকাণ্ড চালাতে পারে তারা কি করে আগামী দিনে বাংলাদেশে রাজনীতি করবে? আলোচ্য রায়ে ১৯ জনের ফাঁসি, ১৯ জনের যাবজ্জীবন এবং ১১ জনের বিভিন্ন মেয়াদী সাজা হয়েছে। এই রায়ের বহুবিধ দিক ও তাত্পর্য রয়েছে। তবে অধিকতর গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলোর ওপর দৃষ্টি দেওয়া প্রয়োজন। যেমন, এক. তত্কালীন বিএনপি সরকারের স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী লুত্ফুজ্জামান বাবর, আরেক উপ-মন্ত্রী আবদুস ছালাম পিন্টু ফাঁসির দণ্ডে দণ্ডিত হয়েছেন। যাবজ্জীবন সাজা হয়েছে বিএনপির বর্তমান ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান পলাতক আসামি তারেক রহমান ও হারিছ চৌধুরীর। দুই. রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ গোয়েন্দা সংস্থার তত্কালীন প্রধানের ফাঁসি হয়েছে। গুরুদণ্ডসহ অন্যান্য দণ্ড পেয়েছেন গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর কয়েকজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা এবং পুলিশ বাহিনীর তিনজন আইজিপিসহ আরো কর্মকর্তাগণ। তিন. হত্যাকাণ্ডের মূল পরিকল্পনা হয় বিএনপির রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডের মূল কেন্দ্র হাওয়া ভবনে এবং সেই পরিকল্পনার প্রধান ব্যক্তি হলেন হাওয়া ভবনের কর্ণধার নামে পরিচিত বিএনপির বর্তমান ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান। উপরোক্ত কথাগুলো সবই আদালতের রায় ও পর্যবেক্ষণের মধ্যে আছে। বড় প্রশ্ন উঠেছে ২০০৪ সালের ২১ আগস্টের পর বিএনপি তখন আরো আড়াই বছর ক্ষমতায় ছিল।
এই মামলাকে কেন্দ্র করে দুই-আড়াই বছর বিএনপি যে সব কলঙ্কজনক প্রহসনমূলক কর্মকাণ্ড করেছে তাতে স্পষ্টতই প্রমাণিত হয় বিএনপি ওই সব খুনিদের রক্ষা করার জন্য একের পর এক নির্লজ্জ মিথ্যাচার করেছে এবং এখনো করে যাচ্ছে। কেন প্রহসনের জজ মিয়া নাটক সাজানো হলো, কেন আদালতের অনুমতি ব্যতিরেকে অপরাধের সমস্ত আলামত ধুয়ে-মুছে পরিষ্কার ও নষ্ট করে ফেলা হলো তার কোনো উত্তর গত ১৪ বছর বিএনপি দিতে পারেনি।
স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী, গোয়েন্দা সংস্থার প্রধান, পুলিশের প্রধান যাদের হাতে রাষ্ট্র ও জনগণের নিরাপত্তা সম্পূর্ণভাবে ন্যস্ত তারা সরাসরি এই হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত। ভাবা যায় না। বিশ্বের ইতিহাসে এমন ঘটনা দ্বিতীয়টি নেই। বিএনপি কেন এটা করেছে তা বুঝতে চাইলে বিএনপির জন্মের পর থেকে ৪০ বছরের রাজনৈতিক লেগেসির ওপর নজর দিতে হবে।
বিএনপি আনুষ্ঠানিকভাবে জন্ম লাভ করে ১৯৭৮ সালের ১লা সেপ্টেম্বর। রাষ্ট্রের সমস্ত ক্ষমতা তখন এক ব্যক্তির হাতে তিনি বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা জেনারেল জিয়াউর রহমান। তিনি একাধারে রাষ্ট্রপতি, প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক, সেনাবাহিনী প্রধান এবং বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান। তারপর জিয়াউর রহমান কী করলেন একবার ভেবে দেখুন। দীর্ঘ সংগ্রাম ও মুক্তিযুদ্ধের ফসল বাহাত্তরের সংবিধান থেকে সামরিক আদেশ বলে সংবিধানের মৌলিক নীতিসহ মুক্তিযুদ্ধের আদর্শ সম্বলিত সমস্ত শব্দ, বাক্য এবং অনুচ্ছেদ বাতিল করে দিলেন। কিন্তু কেন? কোনো রকম জনগণ, পার্লামেন্ট কোনো কিছুর তোয়াক্কা না করে সামরিক আদেশ বলে তাত্ক্ষণিকভাবে সংবিধানের মৌলিক নীতিসহ মুক্তিযুদ্ধের আদর্শের সব কিছু কোন ক্ষমতাবলে কোন অধিকারে কার নির্দেশে জিয়াউর রহমান বাতিল করে দিলেন তার কোনো উত্তর ৪০ বছরে বিএনপি দেয়নি। তারপর জিয়াউর রহমান রাজাকার শিরোমনি শাহ আজিজকে প্রধানমন্ত্রী বানালেন। চিহ্নিত যুদ্ধাপরাধী, গণহত্যাকারী জয়পুরহাটের আবদুল আলিম ও মাওলানা মান্নানকে মন্ত্রী বানালেন। শাহ আজিজের ওই মন্ত্রিসভা মুক্তিযুদ্ধের আদর্শকে লালন পালন করেছে, নাকি বিলুপ্ত করেছে তা বোধ হয় যুক্তি দিয়ে বোঝাবার প্রয়োজন হয় না। শুধু তাই নয়, জামায়াতের মতো ভয়ঙ্কর বাংলাদেশ বিরোধী ধর্মান্ধ গোষ্ঠীকে পুনরায় রাজনীতি করার সুযোগ করে দিলেন। উপরোক্ত সব কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে মুক্তিযুদ্ধের বাংলাদেশ বলতে যা বোঝায় সেটি কি বলি হয়ে গেল না? এর মাধ্যমে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে দীর্ঘ সংগ্রাম ও একাত্তরে ৩০ লাখ মানুষের জীবন দান কি বৃথা হয়ে গেল না? এটা তো সকলে স্বীকার করবেন শুধুমাত্র ভৌগোলিক স্বাধীনতা অর্জন করার জন্য এতো ত্যাগ ও সংগ্রাম করা হয়নি।
পাকিস্তানি আদলের রাষ্ট্র বাংলাদেশের মানুষের জন্য অভিশাপ, যার থেকে মুক্ত হওয়ার জন্যই দীর্ঘ সংগ্রাম এবং মুক্তিযুদ্ধ। কিন্তু জিয়াউর রহমানের উপরোক্ত কাজগুলোর মাধ্যমে কি পাকিস্তানি আদলের রাষ্ট্র ফিরে এলো না? আলোচ্য লেগেসির পরিপ্রেক্ষিতে ২০০৪ সালের ২১ আগস্টের হত্যাকাণ্ড এবং তার রায়ের সূত্র ধরে নতুন করে প্রশ্ন ওঠেছে বিএনপির এই রাজনীতি কি বাংলাদেশে চলতে পারে? কারণ, বিএনপি জন্মের শুরু থেকে যে রাজনীতি করছে তার প্রধান লক্ষ্য মুক্তিযুদ্ধের আদর্শ সম্বলিত রাজনীতিকে বাংলাদেশ থেকে বিদায় করা এবং এটা তো এখন দিনের মতো পরিষ্কার ২০০৪ সালের ২১ আগস্টে শেখ হাসিনাসহ সিনিয়র নেতারা নিহত হলে আগামী ৫০ বছরে মুক্তিযুদ্ধের আদর্শের রাজনীতি আর কোমর সোজা করে দাঁড়াতে পারত না। কান টানলে সব সময় মাথা আসে। একাত্তরের স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রকে অমান্য করা, জাতির পিতাকে অস্বীকার করা, এই রাজনীতি বাংলাদেশে চলছে এমন কথা শুনলে বিদেশি রাজনৈতিক বিশ্লেষকগণ অবাক ও হতভম্ব হয়ে যান। তারা বিস্ময়ের সঙ্গে জিজ্ঞাসা করেন, এটাও কি সম্ভব। এমন প্রশ্নে প্রতিটি বাঙালি ও বাংলাদেশের নাগরিকের লজ্জায় মাথা নত হয়ে যাওয়ার কথা।
১৯৭৫ সালে বঙ্গবন্ধুর হত্যাকাণ্ডের সময় বিএনপির জন্ম হয়নি। তাহলে স্বঘোষিত হত্যাকারীদের বিচার করা যাবে না এই মর্মে জিয়াউর রহমান আইন করলেন কেন এবং খুনিদের পুরস্কৃত করে দূতাবাসে চাকরি দিলেন কেন? এ প্রশ্নের উত্তরও ৪০ বছরে বিএনপি দিতে পারেনি। কিন্তু একটু আগেই বলেছি কান টানলে মাথা আসে। দেশি-বিদেশি গবেষণায় এটি এখন প্রমাণিত হয়েছে ওই ঘৃণ্য হত্যাকাণ্ডের উদ্দেশ্য ছিল কোনো ব্যক্তি বা ব্যক্তিবর্গকে হত্যা করা নয়, এর উদ্দেশ্য ছিল মুক্তিযুদ্ধের আদর্শ, দর্শন, ইতিহাস ও ঐতিহ্যকে চিরদিনের জন্য ধ্বংস করে দেওয়া। সুতরাং ওই খুনিদের শাস্তি মওকুফ করে দিয়ে এবং পুরস্কৃত করে জিয়াউর রহমান কি ওই খুনিদের কাজকে সমর্থন দিলেন না? তাহলে ২১ আগস্টের হত্যাকাণ্ডের ওপর আদালত যে রায় দিয়েছে তা বিএনপি খণ্ডন করবে কি করে? বলার জন্য অনেক কথাই বলা যায়। কিন্তু তাতে যদি তথ্য সমৃদ্ধ যুক্তি না থাকে এবং ঐতিহাসিক সূত্রের যোগসূত্র না থাকে তাহলে সেটা প্রতিষ্ঠিত হয় না। বিএনপির লেগেসি হলো শুরু থেকেই তারা মানুষ হত্যাকারীদের প্রোটেকশন দিয়ে আসছে। বঙ্গবন্ধুর খুনিদের কথা তো বললামই।
তারপর ২০০২ সালে অপারেশন ক্লিন হার্টের সময় প্রায় ৪০ জন মানুষ হেফাজত অবস্থায় মারা যায়। তখন বিএনপি সরকার আইন করল। এই মৃত্যু নিয়ে কোনো প্রশ্ন তোলা যাবে না এবং কেউ দায়ী হলে তাদের বিচারের আওতায় আনা যাবে না। তারপর চিহ্নিত যুদ্ধাপরাধীদের বাঁচাবার জন্য এহেন কাজ নেই যা বিএনপি করেনি। আইনী লড়াই, বিদেশে লবিস্ট নিয়োগ এবং আন্দোলনসহ সব কিছুই করেছে। ২০১১ সালের ১৯ অক্টোবর একটি পত্রিকায় প্রকাশ পায় চাঁপাইনবাবগঞ্জের এক জনসভায় বিএনপি প্রধান বেগম খালেদা জিয়া বলেন, নিজামী, মুজাহিদ, সাঈদী স্বাধীনতা বিরোধী নয় এদেরকে মুক্তি দিতে হবে। সুতরাং ২০০৪ সালের ২১ আগস্টের গ্রেনেড হামলার রায় প্রসঙ্গে বিএনপি যা বলছে তা মানুষের কাছে গ্রহণযোগ্য ও বিশ্বাসযোগ্য হওয়ার মতো ভিত্তি নেই এবং বিএনপির তেমন ক্রেডেনশিয়ালও নেই। খুনিদের পক্ষ নেওয়ার লেগেসি এবং মুক্তিযুদ্ধের আদর্শের বাংলাদেশকে নিঃশেষ করার রাজনৈতিক জায়গা থেকেই বিএনপি এসব বলছে। সুতরাং সাংবিধানিক, আইনী, নৈতিক এবং মুক্তিযুদ্ধের মৌলিক আদর্শের জায়গা থেকে আজ প্রশ্ন ওঠেছে বিএনপির আলোচ্য রাজনীতি বাংলাদেশে আদৌ চলতে পারে কি-না? এই রাজনৈতিক বৈধতার সংকট বিএনপি কী করে কাটিয়ে উঠবে সেটাই আগামীতে দেখার বিষয়।
লেখক : কলাম লেখক ও নিরাপত্তা বিশ্লেষক
sikder52@gmail.com
** লেখার মতামত লেখকের। একুশে টেলিভিশনের সম্পাদকীয় নীতিমালার সঙ্গে লেখকের মতামতের মিল নাও থাকতে পারে।