ঢাকা, রবিবার   ২০ এপ্রিল ২০২৫

Ekushey Television Ltd.

‘রাষ্ট্রভাষা বাংলা তবে আদালতের ভাষা নয় কেন’

একুশে টেলিভিশন

প্রকাশিত : ১৮:২১, ১৮ ফেব্রুয়ারি ২০১৮ | আপডেট: ২১:০৫, ২০ ফেব্রুয়ারি ২০১৮

ব্যারিষ্টার তুরিন আফরোজ

ব্যারিষ্টার তুরিন আফরোজ

Ekushey Television Ltd.

আমাদের রাষ্ট্রভাষা বাংলা। এর পেছনে রয়েছে এক গৌরবোজ্জ্বল সংগ্রামের ইতিহাস, যা কারো অজানা নয়। মায়ের ভাষায় কথা বলার অধিকার আদায়ে বুকের তাজা রক্ত দিয়েছে বাঙালি। পৃথিবীর ইতিহাসে কোনো জাতি মাতৃভাষার অধিকার আদায়ে এমনটি করে নি।

রক্তের বিনিয়মে রাষ্ট্রভাষা বাংলা প্রতিষ্ঠা হলেও আজও সরকারি-বেসরকারী বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান তাদের গুরুত্বপূর্ণ কাজগুলো দেদারসে করে যাচ্ছে ইংরেজি ভাষা ব্যবহার করে। রাষ্ট্রের তিনটি বিভাগের অন্যতম বিচার বিভাগের ভাষাও ইংরেজি। আদালতের রায় লিখা হয় ইংরেজিতে।

স্বাধীন বাংলাদেশের স্থপতি জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান দেশের সর্বস্তরে বাংলাভাষা চালু করার ওপর জোর দিয়েছিলেন। বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও আদালতে বাংলাভাষা ব্যবহার না হওয়ায় দু:খ প্রকাশ করেছেন। দেশের মানুষের যোগাযোগের মাধ্যম বাংলা। এতসব বাস্তবতা সত্ত্বেও আদালতে বাংলা ভাষায় রায় দেওয়া হচ্ছে না। দেশের সব মানুষের ভাব আদান প্রদানের একমাত্র মাধ্যম বাংলাভাষাকে এভাবে কৌশলে উপেক্ষা করাটা বহু প্রশ্নের জন্ম দেয়। এমনটিই মনে করেন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের প্রসিকিউটর বিশিষ্ট আইনজীবী ব্যারিষ্টার তুরিন আফরোজ। তার প্রশ্ন রাষ্ট্রভাষা বাংলা হলে আদালতের ভাষা নয় কেন?

তুরিন আফরোজ মনে করেন, আদালতের ভাষা বাংলা হলে তা একদিকে যেমন সাধারণ মানুষের বোধগম্য হবে তেমনি রাষ্ট্রীয় ও সাংবাবিধানিক বিভিন্ন বিষয় মানুষ অনুধাবন করতে পারবেন সহজেই। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন আলী আদনান

একুশে টেলিভিশন অনলাইনঃ উচ্চ আদালতের রায়ে ভাষা বাংলা করার বিষয়ে বহু দিন ধরে আলোচনা শোনা যাচ্ছে, কিন্তু বাস্তবায়ন হচ্ছে না। একজন আইনজীবী হিসেবে বিষয়টিকে আপনি কিভাবে দেখছেন?

ব্যারিষ্টার তুরিন আফরোজঃ ‘উচ্চ আদালতের ভাষা বাংলা’ করার বিষয়ে যে দাবিটি উঠেছে সেটি অত্যন্ত যৌক্তিক এবং সমর্থন-যোগ্য। কারণ, বাংলাদেশের প্রায় ৯৫ শতাংশ রায় লেখা হয় দেশের মানুষের জন্য। এসব রায় ইংরেজিতে লেখার দরকার কি? তবে বাকি যে ৫ শতাংশ রায় আন্তর্জাতিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে হবে, শুধু সেসব রায় ইংরেজিতে অনুবাদ করে নেওয়া যেতে পারে। এর ফলে মায়ের ভাষায় আমরা আমাদের আদালতের রায়ও পাব, আবার অন্যদিকে আন্তর্জাতিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ রায়গুলোর স্বকীয়তাও ঠিক থাকবে। এ দাবীর প্রেক্ষিতে যে বিষয়টি উল্লেখ না করলেই নয় তা হলো, ১৯৪৭ সালের সেপ্টেম্বর মাসের ৭ তারিখে বাংলাদেশের স্থপতি সেদিনের যুবক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান দৃপ্তকণ্ঠে ঘোষণা দিয়েছিলেন, ‘বাংলা ভাষাকে পূর্ব পাকিস্তানের শিক্ষার বাহন ও আইন আদালতের ভাষা করা হউক’ । এর পরে বাংলা একাডেমির একুশের অনুষ্ঠানে উদ্বোধনী ভাষণে ১৯৭১ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি জাতির জনক বলেছিলেন, ‘আমি ঘোষণা করছি, আমাদের হাতে যেদিন ক্ষমতা আসবে, সেদিন থেকেই দেশের সর্বস্তরে বাংলা ভাষা চালু হবে। বাংলা ভাষার পণ্ডিতরা পরিভাষা তৈরি করবেন, তারপর বাংলা ভাষা চালু হবে, সে হবে না। পরিভাষাবিদরা যত খুশি গবেষণা করুন, আমরা ক্ষমতা হাতে নেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে বাংলা ভাষা চালু করে দেব, সেই বাংলা যদি ভুল হয়, তবে ভুলই চালু হবে, পরে তা সংশোধন করা হবে।’

পরবর্তীকালে বঙ্গবন্ধুর সুযোগ্য কন্যা মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ১৯৯৮ সালের ১ মার্চ ঢাকায় বিচার প্রশাসন প্রশিক্ষণ ইনস্টিটিউটের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে দৃঢ়কণ্ঠে বলেছিলেন, ‘দেশের আদালতে... দেশের জনগণের ভাষা ব্যবহৃত হচ্ছে না, সে তো এক লজ্জাকর ব্যাপার। এ দুর্গতি যত তাড়াতাড়ি দূর হয়, তার জন্য সর্বতোভাবে আমাদের চেষ্টা করতে হবে।’ অতএব একটি বিষয় সহজেই অনুমেয় যে, রাজনৈতিক নেতৃত্বের সম্পূর্ণ স্বদিচ্ছা এবং সমর্থন রয়েছে দাবিটির প্রতি। যেহেতু আমাদের বিচার বিভাগ নিরপেক্ষ এবং স্বাধীন তাই এই বিষয়ে (আদালতের ভাষা বাংলা) শেষ কথা বিচার বিভাগকেই বলতে হবে।

একুশে টেলিভিশন অনলাইনঃ উচ্চ আদালতে ভাষা বাংলা করার কী কী যুক্তি থাকতে পারে?

ব্যারিষ্টার তুরিন আফরোজঃ বিচারের রায় লেখা হয় দেশের মানুষের জন্য। তারাই যদি আদালতের রায় সঠিকভাবে বুঝতে না পারে তবে রায় লেখার অর্থ কী? ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠিত হয়েছে কিনা এটা বুঝবে কী করে মানুষ? তাই মহামান্য আদালতের রায়গুলো বাংলা ভাষাতেই লেখাটা প্রত্যাশিত।

দ্বিতীয়ত, সাবেক প্রধান উপদেষ্টা ও বাংলাদেশের সাবেক প্রধান বিচারপতি মুহাম্মদ হাবিবুর রহমান লিখেছেন, ‘অনেকের ধারণা, বাংলায় লেখা হলে আমাদের রায় কেউ পড়বে না। আমাদের রায় পড়ার জন্য যেন সারা বিশ্ব রাত জেগে বসে আছে! যেসব দেশের সঙ্গে আমাদের স্বার্থ জড়িত ও বাণিজ্যের সম্পর্ক, সেসব দেশের বেশ কিছু লাইব্রেরিতে গিয়ে আমি দেখেছি, সেখানে বাংলাদেশের ল জার্নাল বা বই নেই বললেই চলে।’ অতএব, যেহেতু আমাদের আদালতে বিচারপ্রার্থীরা বাঙালি, আইনজীবীরা বাঙালি, মাননীয় বিচারপতিবৃন্দও বাঙালি, সেহেতু আদালতের রায়ের ভাষা বাংলা কেন নয়?

তৃতীয়ত, অন্য ভাষায় আইনচর্চার ফলে আমরা আইনশাস্ত্রে স্বাভাবিক সহজতা লাভ করতে পারিনি, পারিনি তেমন কোনো মৌলিক অবদান রাখতেও। বাংলায় ভালো মানের আইনের বই পাওয়া দুস্কর। আবার ইংরেজিতে আইনের ওপর লেখা দেশি লেখকের বইয়ের সংখ্যা অপ্রতুল। তাহলে আমাদের আইনের শিক্ষার্থীদের আমরা প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তরে অন্ধ বানিয়ে রেখেছি। বাংলা ভাষায় আইনের ওপর গবেষণাপত্র আমরা হেসে উপেক্ষা করে উড়িয়ে দিই। বড় বড় চোখ করে এই আমাদের মতো আইনের শিক্ষকরাই শিক্ষার্থীদের উপহাস করে বলি, ‘ইংরেজি জানো না, তবে আইন পড়তে এসেছ কেন?’ কী করছি আমরা? কোমলমতি আইনের শিক্ষার্থীদের ইংরেজি বলা রোবটে পরিণত করতে পারলেই ভাবছি আমাদের শিক্ষক জীবন স্বার্থক। এটা নেহায়েত অন্যায়। আদালতের ভাষা বাংলা হলে শিক্ষার্থীরা তাদের মাতৃভাষায় আইন শিক্ষাদানের মাধ্যমে তাদের জ্ঞানের বিস্তার সাধন করতে পারবে। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বলেছেন, ‘কোনো শিক্ষাকে স্থায়ী করিতে গেলে, গভীর করিতে হইলে, ব্যাপক করিতে হইলে তাহাকে চির পরিচিত মাতৃভাষায় বিগলিত করিয়া দিতে হয়। যে ভাষা দেশের সর্বত্র সমীরিত, যাতে সব জাতির মানসিক নিঃশ্বাস-প্রশ্বাস নিষ্পন্ন হইতেছে, শিক্ষাকে সেই ভাষার মধ্যে মিশ্রিত করিলে তবে সমস্ত জাতির রক্তকে বিশুদ্ধ করিতে পারে, সমস্ত জাতির জীবনক্রিয়ার সহিত তাহার যোগসাধন হয়।’

চতুর্থত, এমন কিছু মামলা রয়েছে যা জাতির জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এসব মামলার রায় বাংলাতে হওয়াই বাঞ্ছনীয়, যাতে দেশের সব মানুষ তা বুঝতে পারে অতি সহজেই। এ বিষয়ে ষোড়শ সংশোধনী মামলার হাইকোর্ট বিভাগের রায়ে মহামান্য বিচারপতি মো. আশরাফুল কামাল লিখেছেন, ‘স্বভাবতই সংবিধানসংক্রান্ত মামলা জাতির জন্য অতি গুরুত্বপূর্ণ। কারণ এসব মামলার রায় থেকে জনগণ তাদের পবিত্র সংবিধানকে আরো বেশি গভীরভাবে জানতে ও বুঝতে পারে। পূর্বতন চারটি সংবিধান সংশোধন মামলাই বিচার বিভাগের ইতিহাসে গুরুত্বপূর্ণ। ঐতিহাসিক মামলাগুলো ভবিষ্যৎ সব সাংবিধানিক সংকটে আমাদের পথ দেখাবে। এ ধরনের মামলা জাতির আলোকবর্তিকা হিসেবে কাজ করে। সে কারণে এ ধরনের গুরুত্বপূর্ণ মামলাগুলোর রায় পড়ার জন্য প্রতিটি নাগরিকের অসীম আগ্রহ। সে প্রেক্ষিতে আমি মনে করি, এই ধরনের জনগুরুত্বপূর্ণ মামলাগুলো, বিশেষ করে সংবিধান সংশোধনসংক্রান্ত মামলাগুলো ও যেসব মামলায় সংবিধানের গুরুত্বপূর্ণ ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ করা হয় সেসব মামলার রায় অবশ্যই বাংলায় প্রদান করা ন্যায়সংগত।’

পঞ্চমত, বাংলা ভাষায় রচিত পৃথিবীর একমাত্র সংবিধান হলো গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের সংবিধান। সংবিধানের অনুচ্ছেদ ৩-এ লেখা আছে, ‘প্রজাতন্ত্রের রাষ্ট্রভাষা বাংলা’। তাহলে স্বভাবতই প্রশ্ন জাগে যদি রাষ্ট্রের ভাষা বাংলা হয় তবে আদালতে কেন নয় ? তাই আমি মনে করি আদালতের ভাষা বাংলা হওয়া উচিত।

একুশে টেলিভিশন অনলাইনঃ পৃথিবীর কোন কোন দেশে উচ্চ আদালতে মাতৃভাষার ব্যবহার হয়?

ব্যারিষ্টার তুরিন আফরোজঃ বিশ্বের অনেক দেশ রয়েছে যেখানে মাতৃভাষাতেই আদালতের রায় লেখা হয়। উদাহরণ হিসেবে আমরা জার্মানি, জাপান অথবা চীনের কথা বলতে পারি। এসব দেশের আদালত নিজেদের মাতৃভাষাতেই রায় লিখে থাকেন। তবে যেসব রায় সংশ্লিষ্ট রাষ্ট্র মনে করে যে, আন্তর্জাতিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ, সেগুলো তারা অন্য ভাষায় অনুবাদ করে থাকে। আমরাও একই পদ্ধতি অনুসরণ করতে পারি।

একুশে টেলিভিশন অনলাইনঃ উচ্চ আদালতে বাংলা ভাষা ব্যবহারের বিষয়ে কি কি পদক্ষেপ নেওয়া জরুরি বলে আপনি মনে করেন?

ব্যারিষ্টার তুরিন আফরোজঃ উচ্চ আদালতে বাংলাভাষা ব্যবহারের ক্ষেত্রে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ মাননীয় বিচারপতিবৃন্দকেই নিতে হবে। তারা যখন বাংলায় রায় দেওয়া শুরু করবেন এবং আদালতের অন্যান্য কাজও বাংলায় সম্পাদন করাকে সমর্থন জানাবেন তখন স্বয়ংক্রিয় ভাবেই বাংলা ভাষাকে কেন্দ্র করে আদালতে একটি বিচার বিভাগীয় পদ্ধতি ও সংস্কৃতি গড়ে উঠবে। যেখানে আদালতের সব কার্যাবলী বাংলায় সম্পন্ন হবে। এমনকি আইনের বইগুলোও বাংলায় রচিত হবে।

আমি আশাবাদী এই কারণে যে, বর্তমানে উচ্চ আদালতের মাননীয় বিচারপতিগনের মধ্যে অনেকেই বিষয়টিকে সমর্থন করে রায় প্রদান করা শুরু করেছেন। তবে এই বিষয়ে একজনের নাম বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। তিনি হচ্ছেন মাননীয় বিচারপতি আশরাফুল কামাল। তিনি তার ষোড়শ সংশোধনী মামলার হাইকোর্ট বিভাগের রায়ে বাংলায় রায় লেখার ওপর বিশেষ গুরুত্ব আরোপ করেছেন। তাই সময় এসেছে দেশের আদালতে দেশের জনগণের ভাষা ব্যবহার করবার। মায়ের ভাষায় আদালতের রায় লিখতে হবে। ইংরেজি ভাষার নিগড় ভেঙে বাংলা ভাষাকে মুক্তি দিতে হবে, কারণ জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের মতো আজ তাঁর সন্তানরাও দিগ্বিদিক হুংকারে ঘোষণা করুক—‘আমি বাঙালি, বাংলা আমার দেশ, বাংলা আমার ভাষা।’

একুশে টেলিভিশন অনলাইনঃ আমাদের সময় দেওয়ার জন্য আপনাকে অনেক ধন্যবাদ।

ব্যারিষ্টার তুরিন আফরোজঃ একুশে পরিবারের প্রতি শুভ কামনা।

 

/ এআর /


Ekushey Television Ltd.

© ২০২৫ সর্বস্বত্ব ® সংরক্ষিত। একুশে-টেলিভিশন | এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি