ঢাকা, শনিবার   ২৩ নভেম্বর ২০২৪

রেইড এ্যাট ‘নো ম্যান্স ল্যান্ড’ (পর্ব-২)

নাসিম হোসেন

প্রকাশিত : ১৩:৪৬, ৭ সেপ্টেম্বর ২০২০ | আপডেট: ১৮:০২, ২৬ সেপ্টেম্বর ২০২০

(প্রথম পর্বের পর)

‘শুরু হলো পথ চলা, শুরু হলো কথা বলা’-না, শ্রীকান্ত আচার্য’র গানের মতো ওতো রোমান্টিক হওয়ার সুযোগ নেই। কথা, টর্চের আলো, ম্যায় হাঁচি-কাশি দেওয়াও বারণ করা ছিল। সবাই পথ চলতে লাগলো নিরবে। একহাত দূর দূর ফাকঁ রেখে।

এর চেয়ে বেশি দূরুত্ব হলেই বিচ্ছিন্ন হয়ে যেত সামনের বা পেছনের লোক থেকে। পথের যে কোন বাঁকে একটু থামতে হতো পেছনের মানুষটিকে দেখে নিতে। অন্ধকার, চারপাশের বৃক্ষরাজি, বুক সমান উঁচু ঘন ছনের আস্তরণ আর নিজেদের পোষাকের জংলি ছাপের সম্মিলনে যে ব্যাকগ্রাউন্ড তৈরি হতো তাতে সবাইকে সামনের বা পেছনের মানুষটিকে হারিয়ে ফেলার ভয় সব সময় সবাইকে তটস্থ রাখতো।

একটা অবিচ্ছিন্ন চেইনের মতো সবাইকে পথ চলতে হতো। তাই কেউই এই চেইনের ‘লস্ট লিংক’ হয়ে গালমন্দ খাওয়ার ভয়ে সব সময় দেখে পথ চলতো। পথ চলতে চলতে কিছু সময় পর পর চলতো গণনা ড্রীল :  সামনে থেকে পেছনে- ১,২,৩,,,,,,,,  ২০ আপ। পেছন থেকে সামনে- ২০,১৯,১৮,,,,,,,, ১ আপ। ঠিক, ঠিক, ঠিক। তো সব গুনা গুনতির মধ্যেও সৈনিকরা হারিয়ে যেত মাঝে মাঝেই। 

এতে কমে যেত চলার গতি আর বেড়ে যেত পেট্রোল লিডারের মনের চাপ: টার্গেটে পৌঁছার সময় যাচ্ছে কমে।
প্রদীপ পাড়া থেকে ঘণ্টা মতন পথ চলার পর বিশাল এক শৈল প্রপাতের সামনে দাঁড় করালো উত্তম, স্যার এখন ছড়াতে নামতে হবে, এ ছড়া ধরে আধঘণ্টার মতো চললে অলোক কারবারী পাড়া,,,,।

এভাবেই মাঝে মাঝে উত্তম সম্ভাব্য পথের বর্ণনা দিতো। আমিও ম্যাপ ও কম্পাসের সাথে মিলিয়ে নিতাম নিজের অবস্থানের সাথে টার্গেটের ফারাক কতটুকু তা বুঝে নিতে। এখানে নামার পূর্বে জাহাঙ্গীর সেটে জানালো স্যার একটু বিশ্রাম দেন, সবার অবস্থা টাইট। দশ মিনিটের বিরতি। খুব নিকটের সৈনিকদের ঢক ঢক করে পানি গিলার শব্দ পাচ্ছিলাম। আসলে ওরা এতটাই তৃষ্ণাতুর ছিল যে ওটাকে আর পানি পান বলা যায় না: পানির বোতলকে উঁচু করে ধরে গলার ভিতর ঢালছিল।

রেইড এ্যাট ‘নো ম্যান্স ল্যান্ড’ (পর্ব-১)

একটু দূরেই কিছুটা চাঁপা আওয়াজ শুনে কী হয়েছে জিজ্ঞেস করতেই পাশে থাকা ওয়ারলেস অপারেটর জানালো, ‘স্যার এলএমজি ম্যান এহসানকে জোঁকে ধরেছে’। একটা বিশ্রী গা ঘিন ঘিন করা অনুভূতি পা থেকে মাথা পর্যন্ত বয়ে গেল। -দ্রুতই বেল্ট বরাবর কোমরের নীচ, গলা, হাতের কব্জিসন্ধি চেক দিলাম। না, নেই।

বেচারা এহসানকে তিন তিনটে জোঁক ওর নাভীমূল, পেট আর গলায় কখন যে কামড় বসিয়েছে ও টেরই পায়নি। ওর কিছুটা চুলকানি অনুভূতি হওয়ায় হাত দিতেই আঙ্গুল ফুলে কলা গাছ প্রায় দেড় ইঞ্চি লম্বা ঐ ইতর গুলির দেখা পায়। ম্যাচের কাঠির আগুনে ওরা ঝরে পরে। কিন্তু এহসানের রক্তঝরা বন্ধ হয়নি সারা রাতেও।

অনেকগুলো ‘ইজ্জতের’ রশি একসাথে বেঁধে উপর থেকে নীচে ছড়াতে নামলাম। পাথুরে শিলার উপর খাঁজ কাটা ধাপ যা প্রচণ্ড বেগে ছুটে চলা পানির আঘাতে তৈরি। কত হাজার বছর আগে প্রকৃতি এটা কী জন্য তৈরি করেছিল কে জানে। তবে শিলার উপর হালকা কাদার প্রলেপ আপনার বিবেচনাবোধের সাথে বেঈমানি করলে আপনি ভারসাম্য হারাবেন। শব্দের মাত্রা শুনে বোঝা যাবে আপনি কতটা নীচে পড়েছেন।

পর্বাতোরাহীর মতো একে অন্যের সাহায্যে নীচে নেমে এলো ছড়ার হাটুঁ সমান পানিতে। একটা শীতল অনুভূতি সবাইকে একটু প্রশান্তি দিল। মনে হলো কোন শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত কক্ষে প্রবেশ করেছি। গুনাগুনতির ‘ঠিক, ঠিক, ঠিক’ পর্ব শেষে আবার শুরু হলো পথ চলা। এরই মাঝে সবাই ছড়ার মিনারেল পানিতে শূন্য বোতল ভরে নিল।

এবার পরবর্তী যাত্রা বিন্দু আলোক বিকাশ কারবারী পাড়া।
গহীনছড়ার মধ্য দিয়ে পথ চলার ঝুঁকি জীবন দিয়ে শোধ করতে হয়। পাহাড়ের উপর থেকে যে কোন নেংটী ইদূর বাহিনীও প্রবল প্রতাপশালী আলেকজান্ডারকেও কুপোকাত করতে পারে। একটি গ্রেনেড একটি পুরো পেট্রোলকে বিলীন করে দিতে পারে। 

ছড়ার মধ্য দিয়ে চলতে চলতে নানান আশঙ্কা মনে ভাসছে- ‘উত্তম যদি বিশ্বাসঘাতক হয়ে আমাদের কোন এ্যাম্বুশে ফেলে?’। 
উত্তম আটকের ৪৮ ঘণ্টা পরে যে পরিকল্পনা করে ওদের রেইড করতে যাচ্ছি, তেমন পরিকল্পনা করে ওরাও যদি কোন এ্যাম্বুশ করে এই সব খাড়া পাহাড়ের চূড়া থেকে?
হিল ট্র্যাক্টসে এ্যাম্বুশ একটি ভয়ঙ্কর অভিজ্ঞতা। আশির দশকে মেজর মোহসীনের বিশজনের পুরো দলটিই তো  বিলীন হয়ে গিয়েছিল এ রকম এ্যাম্বুশে পড়ে। 
‘উত্তম, উত্তম। থাম, আর কতক্ষণ লাগবে?’
প্রথম স্কাউটের সাথে ইজ্জতের রশি দিয়ে রাখি বন্ধনে আবদ্ধ উত্তম মাথা চুলকাতে চুলকাতে জবাব দিলো- ‘এই আর আধা ঘণ্টা’। 
মেজাজটা একটু বিগড়ে গেল - ‘শালা, ছড়াতে নেমেই বলেছিস আধা ঘণ্টা, এখনো আধা ঘণ্টা?’-রাগে উৎকণ্ঠায় ওকে আমার স্ত্রী’র ছোটভাই বানিয়ে ফেললাম।
নিজেকেই প্রবোধ দিলাম: যে গহীন ছড়ার মধ্যে ও আমাদের নিয়ে এসেছে এখন তো উত্তমই ‘মোঘল’, ওর পাতেই খানা খেতে হবে।

নিকষ কালো অন্ধকারে ছড়ার মধ্যে পানির গভীরতা বুঝতে না পেরে প্রায়শই কেউ না কেউ পানিতে ডুবে থাকা পাথরে হোচট খেয়ে গা ভেজাচ্ছিল। আমাদের দুর্ভাগ্যকে প্রকট করতেই যেন হঠাৎ মাথার উপর ক্যানোপির মতো থাকা শিরিষ গাছের পাতার উপর ঝম ঝম করে বড় বড় বৃষ্টির ফোঁটার শব্দ শুনতে পেয়ে গেল দু-রাতের হতাশাটা আবার ফেরত এলো- ‘নাহ,  আর বুঝি এগুনো গেল না।’

দ্রুতই ছড়া থেকে উঠতে হবে নতুবা বৃষ্টিজলে ছড়ার পানির উচ্চতা বেড়ে গেলে সবাইকে ভাসিয়ে নিয়ে যাবে।
ছড়ার ডানপাড়ে উঠার সংকেত গেল। কিছুটা সামনে এগুলে জুম চাস করা টিলার খাঁজ কাটা সিঁড়ির দেখা মিললো। কিন্তু এক পশলা বৃষ্টিতে ওটাও পিচ্ছল হয়ে গেছে। বেশ কিছুটা উপরে উঠতেই দুটো মাচাং ঘর দেখতে পেয়ে সচকিত হয়ে উঠলো স্কাউট, চাঁপা কণ্ঠে ডাকলো- ‘স্যার’।
মাটিতে শুয়ে পরে এসএমজি তাক করতে করতে ডান হাতে ফেসবুকের ‘লাইক’ অপশনের মতো সামনে ইশারা করলো।
ওর থেকে ৫/৬ ফিট দূরে হামাগুড়ি দিয়ে উপরে উঠছিলাম। ওর ঐ রকম ভয়ার্ত স্যার ডাক শুনে আমিও ক্রলিং করে ওর পাশাপাশি অবস্থান নিতে নিতে শুনলাম ‘শান্তি বাহিনী’।

সেফটি লিভার নেমে গেল নীচে অটোমেটিক ফায়ার পজিশনে- এই বুঝি বের হলো রাতের নিস্তব্ধতা ভেঙে ভিসুভিয়াসের লাল লাভা।
নিজের বুটের উপর কারো হাত পরেছে তা অনুসরণ করতেই দেখি উওম, ‘ওরা জুমের লোক স্যার’। উত্তেজনায় তা কানে গেল না।
শুক্লা পক্ষের চাদঁ আর মেঘের পালাবদলের খেলা চলছে। দ্রুত অপসৃয়মান কালো মেঘের ছায়ায় ঢাকা পরে গেছিলো টিলার ঢালুতে আমাদের অবস্থান। সবুজ লতাপাতার মধ্যে আমাদের ঘনসবুজ কম্ব্যাট এতোটাই ঢেকে গেছিলো ওরা দেখতে পায়নি আমাদের। 
চাঁদের আলো ফিরে এলে দেখতে পেলাম দুটো তরুণ ছেলে মাচার উপর একজনের কোলে একটা লম্বা বন্দুকের মতো কিছু।  

নির্ঘাত অপমৃত্যুর এক নিখুঁত দৃশ্যপট।
এবার ওরা আমাদের দেখতে পেয়ে দু’দিকে দিলো মরণপণ এক ঝাঁপ। আর ন্যানো সেকেন্ড দেরি হলেই ওরা হয়ে যেত লাশ- সামরিক পরিভাষায় ‘কো-লেটারেল ড্যামেজ’।
উইনিটের ভেটারেন কমান্ডো সিনিয়র অফিসার লিয়াকত প্রায় শূন্যের মধ্যে নেক লক দিয়ে ধরে ফেললো একজনকে। 

কয়েকজন দ্রুত উঠে গেল মাচার উপর। বেরিয়ে এলো আরো দুজনকে নিয়ে। ১৮ থেকে ২০ বৎসরের উদোম গায়ের চার সুঠামদেহী তরুণ। মাচাং ঘরে পাওয়া গেল দুটি গাদা বন্দুক। বন্য শুকুর শিকারে বহুল ব্যবহৃত এক পাহাড়ি ঐতিহ্য। তবে এ রকম বন্দুকের নল থেকেই একসময় পাহাড়ে শুরু হয়েছিল সশস্ত্র বিপ্লব। যার নানা অধ্যায় পার হয়ে যে প্রেক্ষিত তৈরি হয়েছে আজ রাতে আমাদের এ অভিযান তারই  ফলশ্রুতি। 

প্রায় বেঘোরে মরতে মরতে ধরা পরা এই চার তরুণকে নিয়ে কি করি?  
ট্রেনিং ম্যানুয়াল বলে: বেধেঁ নাও সাথে। না হলে অপারেশনের গোপনীয়তা তো থাকবেই না বিপদ হবে।
কপালে দুর্গতি থাকলে যা হয় বন্যশুকুর শিকারে এসে নিজেরাই শিকারে পরিণত হলো শিকারে। আরও চারজন সৈনিক ইজ্জতের রশি ওদের কোমরে পরিয়ে রাখীবন্ধন করে নিয়ে চললো পেট্রলের সাথে।

অনাকাঙ্ক্ষিত এই ঝুটা অভিযান আমাদের মূল অভিযানকে সময়ের রেসে পিছিয়ে দিয়েছে। ভোরের আলো ফুটতে আর মাত্র দু’ঘণ্টা বাকি। মানচিত্র অনুযায়ী আরও চার কিলোমিটার পার হতে হবে। এখনো আলোক বিকাশ কারবারী পাড়ায় পৌঁছাতে বাকি। সেখান থেকে ‘কোনারায় পাড়া’- ‘উঁচু টিলা’ শত্রুর আস্তানা।

পুনরায় সংগঠিত হয়ে আবার যাত্রা শুরু, তবে এবার সাথে চার ‘অধম’। ওদেরকে ক্যাপ্টেন ইমরানের পেট্রলের সাথে ট্যাগ ইন করে ঊর্দ্ধমুখী যাত্রা। ওরা যে আমাদের হাত থেকে বেঁচেছে তাই নয় আমরাও ওদের গাদা বন্দুকের শিশার আঘাত থেকে রক্ষা পেয়েছি। অন্ধকারে গাদা বন্দুকের শীশার আঘাতে ‘মেজর’ আহত এ রকম একটা খবর চাউর হলে কী কেলেঙ্কারিই না হতো, এটা ভাবতেই উপরে উঠার গতি বেড়ে গেল।

কিন্তু শরীর আর টানতে পারছে না। প্রচুর পানি বের হয়ে ডিহাইড্রেশনে যেন না ভুগি সে জন্য সাথে নেওয়া স্যালাইন, কনসেন্ট্রেটেড গ্লুকোজের স্ট্রিপ সবই শেষ। ছড়ার পানির ভেতর জীবাণুনাশক ঔষধ দিয়ে চলছে তৃষ্ণা নিবারণ। প্রতিটি সৈনিকের ইউনিফর্ম ঘামে ভিজে একাকার। ভাদ্রের ভ্যাপসা গরমে পাহাড়ের চড়াই উৎরাই পার হয়ে লক্ষ্যস্থলে পৌঁছানো আমাদের জন্য এক বিরাট চ্যালেঞ্জ হিসাবে দাঁড়িয়ে গেছে।

পেছনে চলা পেট্রোল থেকে ম্যাসেজ পেলাম ‘বিরতি চাই’। কিন্তু এখন বুক সমান উঁচু  নল- খাগড়ার ভেতর দিয়ে যাচ্ছি। রিজ লাইনের উপর না এলে বিরতি করা অনিরাপদ। অতএব ‘মুভ’-এ রকম আদেশ গেল পেছনে।

এলিফ্যান্ট গ্রাসের করাতসম ধারালো পাতার ছোঁয়া হাতে গালে কপালে রেখে যাচ্ছে নানা ট্যাটু। একটু উপরে উঠে পেছনে তাকিয়ে নিজের টহল টীমকে মনে হলো সবুজ নলখাগড়ার মধ্য দিয়ে আঁকাবাঁকা হয়ে এগিয়ে চলছে প্রায় দেড়শ গজ লম্বা এক বিশাল অজগর। 
‘অজগর ঐ আসছে ধেয়ে আমটি আমি খাবো পেড়ে’-ছোট বেলায় পড়া ছড়াটি বারবার মনে হতে লাগলো, আশঙ্কা জাগছে সময় মতো ওখানে পৌঁছাতে পারবো কি পারবো না ভেবে।

কিছুক্ষণ পর আবার বিপত্তি- পথ হারিয়েছে উত্তম। অজগরের চোখ হয়ে ও তো ভালোই চলছিল। কাছে ডাকতেই বললো, ‘স্যার,  আলোক বিকাশ পাড়া যেতে একটা চিকন শিলার রাস্তা আছে ওটা খুঁজে পাচ্ছি না। জঙ্গলে ঢেকে গেছে পথের মুখ। 
বিশ্বাস করবো কি করবো না- পথ হারানোর অভিনয় করে সময়ক্ষেপণ করে ভোর বানিয়ে দিলে তো ৬০ জন লোকের সারা রাতের শ্রম বৃথা যাবে।

সবাইকে দশ মিনিটের বিরতি দিয়ে বিকল্প খুঁজতে লাগলাম। তখনই মনে পরলো আরে ঐ চার ‘অধমকে’ তো ভালো করে জিজ্ঞাসাবাদই করা হয়নি।
চার অধমকে নীচ থেকে উপরে আনা হলো, ‘তোর বাড়ি হুদু’?-প্রশ্ন ছুঁড়ে দিতেই যে উত্তর এলো তাতে শঙ্কার মেঘ কেটে গেল- ‘আলোক বিকাশ কারবারী পাড়া’।
দ্রুতই উত্তম আর অধমদের এক করা হলো হারানো পথ খুঁজতে।
বিশ্রামরত সৈনিকরা কেউ কেউ সাতাইশ রোজার সেহরি সারছে পরিত্যাক্ত জুম থেকে কুড়ানো আধা পাকা পেঁপে বা শসা দিয়ে। সারারাত ধরে পথ চলার ক্লান্তিও ওদের ঈমানের জোর কমাতে পারেনি।

উত্তম আর একজন অধমের যৌথ দল জঙ্গল কেটে পথ দেখাতে থাকলো, আমরা তার পেছনে আর এক ঘণ্টা পর অন্ধকার ফুটে আলো বের হবে।
বহু আকাঙ্ক্ষিত সেই গুহা পথের সামনে এসে আবার ঢোক গিলতে হলো।
জন্মগত ঠোটঁ কাটা শিশুর মতো রিজ লাইনটা। এবার নীচে নামতে হবে তারপর বহুতল ভবনের সানসেটের  মতো থরে থরে সাজানো শেওলা ঢাকা বিশাল সব পাথুরে স্তর। এতোটাই অন্ধকার আলো ছাড়া এপথে এগুনো অসম্ভব।

এলএমজি ম্যান, মর্টার ডিটাচমেন্ট, সিগনাল ম্যানকে ইজ্জতের রশি দিয়ে বেধেঁ আছড়ে পরার বেইজ্জতি থেকে রক্ষা করা হলো। 
এবার উপরে উঠার পালা। এতোটা পিচ্ছিল পথে মনে হয় আগে কখনোই চলিনি। সবুজ শেওলার ঘন আস্তরণ চুইয়ে চুইয়ে পানি পরবর্তী ধাপে পরছে, আর কেমন একটা শীতল অনুভূতি।
প্রায় আধ ঘণ্টা লেগে গেল সুরঙ্গের মতো এই পথটুকু পাড়ি দিতে।
আলোক বিকাশ কারবারী পাড়াকে ডানে রেখে আবার ছড়ার মধ্য দিয়ে উল্টা শ্রোতে চলা। এবার বিশেষ লক্ষ্য রাখতে হলো জলের মধ্যে চলতে গিয়ে যেন জল ভাঙ্গার শব্দ তৈরি না হয়।
টার্গেটের যতই নিকটবর্তী হচ্ছি শিরার মাঝে রক্ত চলার গতিও পাল্লা দিয়ে বাড়ছে।

ছড়ার মাঝে দুপাশের গাছের ফাঁক দিয়ে একটু করে আকাশ দেখা যাচ্ছে, আলো ফুটছে।  
ছড়াটি এবার ডানে মোড় নিবে। তখনই উত্তম থেমে যায়-
‘স্যার’,-ডান হাতে ইশারা করে সেই কাঙ্ক্ষিত ‘নো ম্যান্স ল্যান্ড’র দিকে। ঘন পল্লবে ঢাকা উঁচু এক পাহাড়ের দিকে।
হাতের ইশারায় সবাই নিজেদের আড়াল করলো ছড়ার লতাপাতার মাঝে। সেটে সংকেত পেয়ে জাহাঙ্গীর, ইমরান কাছে বসলো।

এবার চূড়ান্ত পর্ব: ইমরানকে তার মর্টার দল, সাতজন আঘাত পাওয়া সৈনিকের দল আর উওম - অধমের দেখভাল করার দায়িত্ব দিয়ে তার অবস্থান নিতে বললাম। 
ও মর্টার পজিশনে গেলে আমরা ওর সংকেত পেয়ে টার্গেটে চার্জ করার জন্য ‘মুভ’ করবো। মর্টার যদি নিখুঁতভাবে টার্গেটে ফায়ার আনতে পারে তবে ওটাই হবে আমাদের ‘লাইফ সাপোর্ট’। আমাদের দেখে ফেলে ওরা যদি আগেই ‘ওপেন করে’ তবে তার পাল্টা জবাবটা হতে হবে মর্টার ফায়ার দিয়ে। মর্টারের গোলা মাথায় না পরলে উঁচুতে থাকা শত্রুকে দমানো যায় না।

আমরা আমাদের দলকে চারটি গ্রুপে ভাগ করে নেই: আমি প্রথম গ্রুপ, জাহাঙ্গীর দ্বিতীয়, লিয়াকত তৃতীয় এবং সার্জেন্ট এখলাস চতুর্থ।
আমাদের অস্ত্রগুলো চেক করে রুদ্ধশ্বাসে অপেক্ষা করছি ইমরানের সংকেতের। ইমরানের দক্ষতার উপর আজ অনেক কিছুই নির্ভর করছে।
‘মুভ’ ওয়ারলেসে সংকেত পেয়ে সবাই ছড়ার পাড়ের লতা পাতার আড়াল থেকে উঠে চলা শুরু করলাম।
যেখান থেকে ছড়াটি ডানে বাকঁ নিয়েছে তার ডান পাড় থেকে খাড়া উঠে গেছে আমাদের লক্ষবস্তু উঁচু টিলা।

সকালের ছড়ার পানি থেকে  কুণ্ডলী পাকিয়ে উঠা ভাঁপ একটা স্মোক স্ক্রীন বা সাদা ধূয়ার পর্দা তৈরি  করেছে। এরই আড়ালে এগিয়ে চলছি। 
এবার টিলায় আরোহণের মতো প্রাণঘাতী কাজটি করতে হবে। গত কয়েকদিনের তুমুল বৃষ্টিতে পানির তোড়ে টিলাটির নীচের কিছু অংশে ভূমিধসে মাটি গেছে সরে আর উন্মুক্ত করে দিয়েছে গাছের শিকড়। টারজানের মতো এই শিকড় বেয়েই উঠতে হবে আমাকে। আর এ সময় যদি উপর থেকে কেউ দেখে ফেলে তবে ওরা যা ইচ্ছে তাই করতে পারবে আমাদের।
একজনকে অন্তত উপরে উঠে পরেরজনকে কাভার দিতে হবে।

কমান্ডারের কথা মনে পড়লো: ‘ইন দেট কেস ইউ উইল বি দ্যা ফাস্ট ম্যান...’
আমি উপরে এলাম পেছনে জাহাঙ্গীর তারপর অনেকেই। এতোটাই খাড়া দাঁড়ানো যায় না। বুকের উপর ভর করে সাপের মতো গাছ-বাঁশের ফাঁক গলে উপরে উঠছি। 
এখনো সবাই উপরে আসেনি। দৃষ্টি সামনের ঝোঁপ ঝাড়ের ভেতর। কিছুটা সময় পর পোচের ভেতর থেকে আরজেস গ্রেনেডটি বের করে সেইফটি পিনের ছড়ানো পাত দুটোকে একটু চাপিয়ে দ্রুত ছোঁড়া যায় এমন অবস্থায় এনে উঠে দাঁড়ালাম। বাম হাতের তর্জনী এসএমজির টিগারে। ডান হাতে গ্রেনেড।
একটা দু’পায়ে চলার পথ পেলাম, জানি এটাই টিলার টপে নিয়ে যাবে।
এই বুঝি কারো দেখা মিললো-এই...এই...

নিজের বুকের ভেতরের দপ-দপানি স্পষ্ট শুনছিলাম। একটা কাটা গাছের গুড়ি দেখা যাচ্ছে হাত বিশেক দূরে। উত্তমের বর্ণনা অনুযায়ী ওখানেই তো থাকার কথা ওদের প্রহরীর। না, কোন সাড়া শব্দও নেই। তবে কী, তবে কী ভাবতে ভাবতে উঠে দাড়াঁলাম। যে ভীষণ এক প্রাণঘাতী সংঘর্ষের প্রস্তুতি নিচ্ছিলাম তা বিধাতার নির্দেশে ঘটলো না।

ধীরে ধীরে টিলার মাঝ বরাবর এসে পরলাম। পেছনে পেছনে জাহাঙ্গীর। নীল পলিথিনে তৈরি অনেকগুলো অধিবাসী বিহীন ছাউনি। 
‘স্যার, ওরা পালিয়েছে’। উত্তপ্ত কড়াইতে পানি ঢেলে দিলো জাহাঙ্গীর। 
বুক থেকে একটা হতাশার নি:শ্বাস বের হয়ে গেল।
নীল আকাশের নিচে নীল পলিথিনগুলো মনের মধ্যে একটা নীল দুঃখ বোধের জন্ম দিলো।
কিছুক্ষণের মধ্যেই পুরো টীমটি ‘নো ম্যান্স ল্যান্ডের’ উপর স্থাপিত অস্থায়ী আস্তানাটি চারিদিক থেকে ঘিরে সার্চ শুরু করলো। ওদের পলায়নের পথ আর সময় নিয়ে সবাই পর্যালোচনায় ব্যস্ত হয়ে উঠলো।
ব্লকিং পজিশনকে শত ডেকেও সাড়া পেলাম না। অতো সকালে কারই বা ঘুম ভাঙে।

লিয়াকত সাহেব কিছু টুকরো টুকরো করে ছেড়া কাগজ মাটির উপর রেখে কিছু একটা জিগসো পাজেল মিলানোর চেষ্টা করছে। 
স্যার চিঠি পাওয়া গেছে। জোড়া লাগানো ছেঁড়া কাগজের চিঠির সারমর্ম: ‘উওম ধরা পড়েছে’। কেউ ওদের জানিয়েছিল উত্তমের ধরা পড়ার সংবাদটি। 
ওরা এই পথে পালিয়েছে। গতরাতেই ওরা পালিয়েছে, ক্যাম্পের সার্বিক অবস্থা তাই নির্দেশ করে।
চারিদিকে গোল হয়ে বসা সৈনিকরা বহির্মুখী হয়ে সারারাতের চেপে রাখা জল বিয়োগে ব্যস্ত। মনে মনে বলি, সিও’র আদেশ মানছে বোধহয়; আমিও সে আদেশ পালন করলাম।
‘ইফ ইউ ডোন্ট গেট দেম ইন দেয়ার বেড, স্পয়েল দেয়ার বেড।’

আহ! কি প্রশান্তি!

এবার ফেরত যাবার পালা। ভাবছি কী পেলাম এই ‘নো ম্যান্স ল্যান্ড’ জয় করে: বডি কাউন্ট ছাড়া তো  স্বীকৃতি মেলে না।
সৈনিকরা হতাশ নয়; ওরা আমাকেই বরং শান্ত্বনা দিলো আজ পালিয়েছে অন্যদিন সে সুযোগ পাবে না। ওরা যেখানেই যাক ওদের পিছু ছাড়বো না।
মনে হলো আমেরিকার প্রেসিডেন্ট জর্জ বুশ কথা বলছে:
‘ইউ ক্যান রান, বাট ইউ ক্যানট হাইড’।
আপাতত ‘নো ম্যান্স ল্যান্ড’কে অরক্ষিত রেখে নীচে নেমে এলাম। 
দেখা পেলাম ইমরানের। সাথে ‘এক উত্তম আর চার অধম।’

উৎসুক স্থানীয় জনগণের চোখের সামনে দিয়ে ধীরে ধীরে নেমে যাচ্ছে গতরাতে অদেখা ৬০ জনে লম্বা এই বিশাল অজগরটি। অজগর যে আমটি পেড়ে খেতে পায়নি তা এতক্ষণে ওরা বুঝে গেছে।
কিন্তু অজগরের শরীরে এখনো পেঁচিয়ে আছে ওদের এলাকার চার অধম।
স্থানীয় দুজন কারবারীর জিম্মায় ওদের ছেড়ে আমরাও বাঁচি। ওরাও শিকার পায়নি, আমরাও শিকার পায়নি। কী রকম একটা ‘উইন উইন’ সিচুয়েশন।  
দিঘীনালা থেকে ব্রিগেড কর্তৃক পাঠানো কনভয় 
 অপেক্ষা করছে আমাদের নিতে।
গাড়ীতে উঠছি সবাই। বিষণ্ণ মুখে উত্তম।
‘স্যার, আমাকে কি জেলে দিবেন?’-নিজের ভাগ্য নিয়ে উৎকণ্ঠিত উত্তম।

মনে মনে বলি সারারাত তুই যে কষ্ট করেছিস তাতে তো তোর জামাই আদর পাওয়ার কথা। উত্তম আমাদের গাইড ছিল, ওর দলের চোখে তা পরিষ্কার গাদ্দারি। আর গাদ্দারির শাস্তি তো জানাই আছে। 
‘না, তুই রাঙ্গামাটি যাবি’- আমি ওর শঙ্কা দূর করি। 
মনের মধ্যে ঝুমুর গানের কলিটা মনে পড়লো-
‘তুই লাল পাহাড়ির দেশে যা 
রাঙামাটির দেশে যা 
ইখান তুকে মানাইছে নাই রে
ইক্কেবারে মানাইছে নাই রে।’

উত্তম এবার কথা রেখেছিল। পানছড়িতে ওকে আর কখনো দেখা যায়নি। রেইড এ্যাট ‘নো ম্যান্স ল্যান্ড’ ওর জীবনকে বদলে দিয়েছিল। 

লেখক: সাবেক সেনা কর্মকর্তা

এমবি//


** লেখার মতামত লেখকের। একুশে টেলিভিশনের সম্পাদকীয় নীতিমালার সঙ্গে লেখকের মতামতের মিল নাও থাকতে পারে।
Ekushey Television Ltd.










© ২০২৪ সর্বস্বত্ব ® সংরক্ষিত। একুশে-টেলিভিশন | এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি