রেগে গেলেন, হেরে গেলেন
প্রকাশিত : ১৬:০৭, ৯ জুলাই ২০২১ | আপডেট: ১৫:৩৯, ২০ জুলাই ২০২১
রেগে গেলে মানুষ কীভাবে হেরে যায় তার একটি চমৎকার আমেরিকান গল্প আছে। এক মার্কিন ধনকুবেরের একমাত্র সুন্দরী কন্যা। কন্যার ছেলে-বন্ধুর কোনো অভাব নেই। অভাব থাকার কথাও নয়। একে তো সুন্দরী! তারপর ধনকুবেরের মেয়ে।
মেয়ের যখন বিয়ের বয়স হলো বাবা তাকে বললেন, এখন তো তোমাকে সিদ্ধান্ত নিতে হবে। বলো তোমার কাকে পছন্দ। যাকে পছন্দ তার সাথেই তোমার বিয়ের ব্যবস্থা করব।
মেয়ে পছন্দ প্রকাশে অপারগতার কথা জানাল। বলল, আমি কোনো সিদ্ধান্ত নিতে পারছি না। কারণ সবাই বলে তারা আমাকে ভালবাসে। আমার জন্যে প্রয়োজনে জান দিয়ে দেবে।
বাবা চিন্তায় পড়ে গেলেন। কী করা যায় ভাবতে ভাবতে বুদ্ধি বেরিয়ে এল। মেয়ের সাথে আলাপ করে বাবা সিদ্ধান্ত ঘোষণা করলেন-প্রতিযোগিতা হবে। প্রতিযোগিতায় যে প্রথম হবে তাকেই মেয়ে বিয়ে করবে।
প্রতিযোগিতার দিন দেখা গেল শতাধিক যুবক সুন্দর পোশাকে পরিপাটি অবস্থায় ধনকুবেরের বাড়িতে এসে উপস্থিত। ধনকুবের সবাইকে বাড়ির সুইমিং পুলে নিয়ে গেলেন। সুইমিংপুলের পাশে সবাইকে দাঁড় করিয়ে বললেন, দেখ, প্রতিযোগিতা খুব সহজ। সাঁতার প্রতিযোগিতা হবে। সাঁতারে যে প্রথম হবে তার সাথেই আমার মেয়ের বিয়ে দেবো । তবে সুইমিং পুলে ঝাঁপ দেয়ার আগে ভালো করে খেয়াল করো। পানির নিচে বহু কুমির অপেক্ষা করছে। আর এই কুমিরগুলোকে একমাস ধরে কোনো খাবার দেয়া হয় নি।
ধনকুবেরের কথা শেষ হতে না হতেই দেখা গেল যে, এক যুবক পানিতে পড়ে চোখ বন্ধ করে দুই হাত-পা নাড়ছে। কুমিররা কিছু বুঝে ওঠার আগেই সেই যুবক ভাগ্যক্রমে কিছুক্ষণের মধ্যেই সুইমিংপুলের ওপারে গিয়ে উঠেছে।
ঘটনার আকস্মিকতায় সবাই হতবাক। বিস্ময়ের ঘোর কাটতেই ধনকুবেরের মেয়ে দৌড়ে গিয়ে জড়িয়ে ধরল যুবককে। বিস্ময়াবিষ্ট কণ্ঠে বলল, তোমার মতো বীরকেই আমি চাচ্ছিলাম। তুমিই আমার স্বামী হওয়ার একমাত্র উপযুক্ত।
এদিকে যুবকের রাগ তখনো থামে নি। উত্তেজনায় হাত-পা কাঁপছে। এক ঝটকায় মেয়েটিকে দূরে ঠেলে দিয়ে যুবক চিৎকার করে উঠল, 'কোন... জাদা আমাকে ধাক্কা দিয়ে পানিতে ফেলে দিয়েছিল, তাকে আগে দেখে নিই।'
সুন্দরী স্ত্রী ও ধনকুবেরের সম্পদ ওই যুবকের হাতের মুঠোয় চলে এসেছিল। ধাক্কা যে-ই দিক, সে সুইমিং পুল অতিক্রম করে সবার চোখে বিজয়ী বীর বলে গণ্য হয়েছিল। কিন্তু শুধুমাত্র রাগকে নিয়ন্ত্রণ করতে না পারায় সৌভাগ্য এসেও তা হাতের নাগালের বাইরে চলে গেল। অথচ রাগ দমন করতে পারলে, ঠান্ডা মাথায় পরিস্থিতি অনুসারে সিদ্ধান্ত নিতে পারলে সে অনায়াসে মুচকি হেসে বলতে পারত, 'পুরুষ তো আমি একাই, ওরা আবার পুরুষ নাকি!'
নিজের জীবন অনুসন্ধান করলেও আপনি হয়তো দেখতে পাবেন অনেক সুযোগ নষ্টের পেছনে রয়েছে আপনার রাগ, ক্ষোভ ও অভিমান। তাই সবসময় স্মরণ রাখুন 'রেগে গেলেন, হেরে গেলেন'।
জীবনে জয়ী হওয়ার জন্যে তাই আপনাকে প্রো-অ্যাকটিভ হতে হবে। ব্যক্তিগত জীবনে প্রো-অ্যাকটিভ হওয়ার সুফল আপনি অল্প কয়েকদিনের মধ্যেই বুঝতে পারবেন। আপনি হয়তো বলবেন, সবসময় কি প্রো-অ্যাকটিভ থাকা যায়? একজন অহেতুক গালিগালাজ করল, মা-বাবা তুলে গালি দিল, তখনো কি প্রো-অ্যাকটিভ থাকা যায়? অনায়াসে থাকা যায়। মহামতি বুদ্ধের জীবনের একটি ঘটনা এক্ষেত্রে আমাদের জন্যে এক অনুসরণীয় দৃষ্টান্ত।
মহামতি বুদ্ধ তখন বৃদ্ধ। এক চালবাজ লোক জুটে গেল। সে ভাবল বুদ্ধ আর বেশিদিন বাঁচবেন না। এখন তার সাথে কিছুদিন থেকে যদি কিছু কায়দা-কানুন টেকনিক শিখে নেয়া যায় তাহলে বুদ্ধ মারা যাওয়ার সাথে সাথে নিজেকে বুদ্ধের অবতার ঘোষণা করে দেবো । তখন আর পরিশ্রম করতে হবে না। বসে বসে দান-দক্ষিণা গ্রহণ করেই জীবনটা সুখে কাটিয়ে দেয়া যাবে। যেই ভাবা সেই কাজ। ভণ্ড একেবারে নিবেদিতপ্রাণ শিষ্যের মতো ভান করে বুদ্ধের সেবা-যত্ন করতে লাগল। মহামতি বুদ্ধ তার মতলব বুঝলেও কিছুই বললেন না। বছর দুই পার হওয়ার পর ভণ্ড শিষ্য বুঝতে পারল যে, সে ধ্যানের ক্ষমতা বা আধ্যাত্মিক শক্তি কিছুই লাভ করে নি। কারণ নিয়ত পরিষ্কার না থাকলে ধ্যানের ক্ষমতা বা আধ্যাত্মিক শক্তি লাভ করা যায় না। ভণ্ড শিষ্য এর ফলে ভীষণ ক্ষুব্ধ হয়ে উঠল। মনে মনে ঠিক করল এর উপযুক্ত প্রতিশোধ সে নেবে।
একদিন ভোরবেলা মহামতি বুদ্ধ একা বসে আছেন। ভণ্ড ভাবল এই সুযোগ। সে কাছে গিয়ে বুদ্ধকে অশ্রাব্য গালিগালাজ করতে লাগল। বুদ্ধ চুপচাপ শুনছেন। কিছুই বলছেন না।
অনেকক্ষণ গালিগালাজ করার পর ভণ্ড শিষ্য যখন একটু থামল বুদ্ধ তখন মুখ খুললেন। শান্তভাবে জিজ্ঞেস করলেন, আমি কি তোমাকে কোনো প্রশ্ন করতে পারি? ভণ্ড শিষ্যের মেজাজ তখনো ঠান্ডা হয় নি। সে ঝাঁঝাল স্বরে বলল, জিজ্ঞেস করেন, কী জিজ্ঞেস করবেন? বুদ্ধ বললেন, ধরো তোমার কিছু জিনিস তুমি কাউকে দিতে চাচ্ছ। কিন্তু সে যদি তা না নেয়, তাহলে জিনিসগুলো কার কাছে থাকবে? উত্তেজিত শিষ্য জবাব দিল, 'এ তো সহজ বিষয়। এটাও আপনি বোঝেন না? আমার জিনিস আমি যাকে দিতে চাচ্ছি সে যদি না নেয় তাহলে আমারই থাকবে।
বুদ্ধ আবার জিজ্ঞেস করলেন, 'তোমার জিনিস তুমি যাকে দিতে চাচ্ছ সে না নিলে তোমার থাকবে?' ভণ্ড শিষ্যের উত্তর, 'হাঁ আমার থাকবে।' এবার মহামতি বুদ্ধ বললেন, তাহলে এতক্ষণ তুমি আমাকে যা (গালিগালাজ) উপহার দিলে, আমি তার কিছুই নিলাম না।'
আপনিও আপনার জীবনে ব্যক্তিগত গালিগালাজ ও অপমানসূচক কথাবার্তার জবাবে মহামতি বুদ্ধের এই কৌশল অবলম্বন করতে পারেন। আসলে একজন মানুষ যখন অযৌক্তিক আচরণ করে, গালিগালাজ করে, মা-বাবা তুলে গাল দেয় তখন এর জবাবে আপনিও তার মা-বাবা তুলে গাল দিতে পারেন। কিন্তু তার মা-বাবাকে গালি দিয়ে আপনি নিজেকেই অপমানিত করলেন। সে গালিগালাজ করে আপনার শান্তি নষ্ট করতে এসেছিল, আপনি গালির জবাব দেয়ার অর্থই হচ্ছে তার উদ্দেশ্যকে সফল করা। তার চেয়ে কিছুক্ষণ তার গালিগালাজ শোনার পরে আপনি যদি বিনয়ের সাথে বলেন, 'ভাই/আপা আপনি অনেক মেহেরবান। অনেক কিছু আমাকে দিলেন। কিন্তু এগুলো রাখার কোনো জায়গা আমার কাছে নেই। আমি কিছুই নিলাম না। এগুলো আপনারই থাক।' এ কথা বলার পর দেখবেন, অপরপক্ষ দাঁত কামড়ে চলে যাচ্ছে। তার গালিগালাজ যে আপনার ওপর কোনো প্রভাব বিস্তার করতে পারল না, এটাই তার পরাজয়। আর এ পরাজয়ের যন্ত্রণা হয়তো অনেক দিন সে বয়ে বেড়াবে। সে এসেছিল আপনার শান্তি নষ্ট করতে, কিন্তু শান্ত থেকে আপনি তাকে পরাভূত করলেন।
আপনি আপনার চারপাশে তাকালে দেখবেন, যে ক্ষেপে তাকেই ক্ষেপানো হয়। ভাই-বোন, বন্ধু-বান্ধব এদের দিকে লক্ষ্য করলে দেখবেন, যে একটু বেশি সংবেদনশীল, সহজেই ক্ষেপে যায়, অন্যরা তাকে ইচ্ছাকৃতভাবে খোঁচা দিয়ে, কটাক্ষ করে, মন্তব্য করে, উপাধি দিয়ে, ক্ষেপিয়ে এক ধরনের বিকৃত আনন্দ পায়। এ ধরনের পরিস্থিতি এড়ানোর একটাই পথ, শান্ত থাকা। কোনো ধরনের প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত না করা।
বরং তাদের এই কটাক্ষকে আপনি যে কোনো পরোয়া করছেন না, সেজন্যে অবস্থাভেদে একটু মুচকি মুচকি হাসুন। দেখবেন অপরপক্ষ রণেভঙ্গ দেবে। আপনি যদি ক্রমাগত কিছুদিন না ক্ষেপে থাকতে পারেন, দেখবেন এরপর কেউ আপনাকে ক্ষেপাতে আসছে না।
আপনি হয়তো প্রশ্ন করবেন, পারিবারিক জীবনে কি সব পরিস্থিতিতে প্রো-অ্যাকটিভ থাকা সম্ভব? অবশ্যই সম্ভব। যত প্রো-অ্যাকটিভ থাকবেন তত পারিবারিক প্রশান্তি বাড়বে। গ্রিক দার্শনিক ডায়াজোনাসের জীবন দেখুন। একদিনের ঘটনা।
তত্ত্ব আলোচনায় ডায়াজোনাস এত মশগুল ছিলেন যে, রাত পার হয়ে গেল কিন্তু বাড়ির কথা তার মনে পড়ল না। পরদিন সন্ধ্যায় তার খেয়াল হলো, গতকাল তিনি বাসায় যান নি। মনে মনে অনুশোচনা করলেন। সিদ্ধান্ত নিলেন বাসায় গিয়ে তিনি একদম প্রো-অ্যাকটিভ থাকবেন। এদিকে ডায়াজোনাসের স্ত্রী টেনশন ও দুশ্চিন্তায় অস্থির। স্বামী রাতে বাসায় ফেরেন নি, স্বামীর কোনো খবরই পান নি। অতএব স্ত্রী হিসেবে তার টেনশন সহজেই বোঝা যায়। পরদিন সন্ধ্যায় ডায়াজোনাস যখন বাসায় ফিরলেন স্ত্রী তাকে দেখে প্রথমে নিশ্চিত হলেন-যাক স্বামী সুস্থ আছেন, ভালো আছেন। তারপরই রাগ ও ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ ঘটল। এমন কোনো কথা বা বাক্য নেই যা তিনি উচ্চারণ করেন নি। কারণ ক্ষোভের সময় মানুষ অনেক কটু কথাই বলে, যার জন্যে পরে সে নিজেই অনুতপ্ত হয়। স্ত্রী এক নাগাড়ে বলেই চলছেন, কিন্তু ডায়াজোনাস শুধু চুপচাপ শুনছেন। একটি কথারও জবাব দিচ্ছেন না।
একা আসলে ঝগড়া করা যায় না। স্ত্রী কোনো কথারই জবাব না পেয়ে আরো ক্ষুব্ধ হয়ে উঠলেন। কী! একেবারে মৌনি সাধু! আমার একটা প্রশ্নেরও জবাব নেই! ঠিক আছে মজা দেখাচ্ছি! এই বলে সেই ডিসেম্বরের শীতের সন্ধ্যায় বালতিতে রাখা ঠান্ডা পানি এনে পুরোটাই ডায়াজোনাস-এর মাথায় ঢেলে দিলেন। এবার ডায়াজোনাস একটু মুচকি হাসলেন। বললেন, 'এত তর্জন-গর্জন। তারপর একটু বর্ষণ না হলে তো তর্জন গর্জন একেবারে বৃথাই যেত।'
শীতের রাতে এত ঠান্ডা পানি মাথায় পড়ার পরও যদি কোনো স্বামী মাথা ঠান্ডা রাখতে পারেন, তাহলে কোন স্ত্রীর পক্ষে রাগ করে থাকা সম্ভব? স্ত্রীও হেসে ফেললেন। মুহূর্তে মিটমাট হয়ে গেল সব।
পারিবারিক জীবনে যে-কোনো ঝগড়া, ক্ষোভ, রাগারাগি নিরসনে এই প্রো-অ্যাকটিভ দৃষ্টিভঙ্গিকে প্রয়োগ করতে পারেন। আপনার স্ত্রী উত্তেজিত হয়ে উঠেছেন। অযৌক্তিক কথা বলছেন। আপনি চুপচাপ থাকুন। আপনার স্ত্রী আপনাকে বলছে। অন্যের স্ত্রী তো আপনাকে বলছে না। আপনি একটু চুপ থাকুন। মনে মনে হাসুন। মনে মনে বলুন, চিৎকার করছ, করো। সময় মতোই জবাব দেবো। কয়েক ঘণ্টা বা কয়েকদিন পর দেখবেন স্ত্রীই তার আচরণের জন্যে আপনার কাছে দুঃখ বা অনুশোচনা প্রকাশ করছেন। আপনার স্বামী রেগে গেছেন, যা তা বলছেন। বলতে দিন। আপনার স্বামী আপনাকে বকছে, অন্যের স্বামী তো আর আপনাকে বকছে না। আপনি চুপচাপ থাকুন।
মনে মনে বলুন, লাফাচ্ছ! লাফাও! সময় আসুক তারপর মজা বোঝাব! কয়েক ঘণ্টা বা কয়েকদিনের মধ্যে দেখবেন তিনিই আপনার কাছে দুঃখ প্রকাশ করছেন। প্রো-অ্যাকটিভ না হয়ে যদি রি-অ্যাকটিভ হন তাহলে কী হবে? তিনি একটা কথা বলবেন। আপনি কথার পিঠে কথা চাপাবেন। তিল জমে জমে তাল হয়ে যাবে।
মনোকষ্ট ও মনোমালিন্য বাড়তেই থাকবে। এমনকি তা বিচ্ছেদের পথে চলে যেতে পারে। অপরদিকে প্রো-অ্যাকটিভ দৃষ্টিভঙ্গি কার্যত পরিবারের ওপর আপনার প্রভাব ও নিয়ন্ত্রণকেই প্রতিষ্ঠিত করবে।
প্রো-অ্যাকটিভ মানুষই অন্যকে প্রভাবিত করে, পরিস্থিতিকে নিয়ন্ত্রণ করে নিজের পক্ষে নিয়ে আসতে পারে। এই জন্যেই মহামানবরা সবসময় প্রো-অ্যাকটিভ ছিলেন। নবীজীর (স) জীবন দেখুন। তিনি সবসময় প্রো-অ্যাকটিভ ছিলেন। দৃষ্টান্ত হিসেবে আমরা দুয়েকটি ঘটনা আলোচনা করতে পারি।
১. বৃদ্ধার সাথে আচরণ : ঘটনাটি আমরা সবাই জানি। এক বৃদ্ধা প্রতিদিন নবীজীর পথে কাঁটা বিছিয়ে রাখত। উদ্দেশ্য নবীজীকে কষ্ট দেয়া। নবীজী প্রতিদিন কাঁটা সরিয়ে পথ চলতেন। যাতে অন্যের পায়ে কাঁটা না বেঁধে।
একদিন পথে কাঁটা নেই। দ্বিতীয় দিনও পথে কাঁটা নেই। নবীজী ভাবলেন, একদিন হয়তো ভুল করে বৃদ্ধা কাঁটা বিছায় নি। দুই দিন তো ভুল হতে পারে না। নিশ্চয় বৃদ্ধা অসুস্থ। তিনি খোঁজ নিলেন।
বৃদ্ধা ঠিকই গুরুতর অসুস্থ। আমরা হলে হয়তো বলতাম, 'বেটি বুড়ি আমার পথে কাঁটা বিছিয়েছিস! আল্লাহ তোকে উপযুক্ত শাস্তি দিয়েছে।' কিন্তু নবীজী বৃদ্ধার প্রতি সমবেদনা প্রকাশ করলেন। তার চিকিৎসা ও সেবা শুশ্রূষার ব্যবস্থা করলেন।
বৃদ্ধা সুস্থ হয়ে উঠলেন। সুস্থ হওয়ার পর বৃদ্ধার মনে প্রশ্ন জাগল, যাদের কথায় নবীর পথে কাঁটা বিছিয়েছি তারা তো কেউ আমাকে দেখতে আসে নি। বরং যাকে কষ্ট দেয়ার জন্যে কাঁটা বিছিয়েছি তিনিই আমার সেবা শুশ্রূষার ব্যবস্থা করলেন। মানুষ হিসেবে নবীজীই ভালো মানুষ। বৃদ্ধা নবীজীর ধর্ম গ্রহণ করলেন। নবীজী প্রো-অ্যাকটিভ ছিলেন বলেই বৃদ্ধাকে প্রভাবিত করতে পেরেছিলেন। বৃদ্ধা যা-ই করুক না কেন, বৃদ্ধার আচরণ দ্বারা নবীজী প্রভাবিত হন নি। নবীজী বৃদ্ধার সাথে সেই আচরণই করেছেন, যা তিনি সঙ্গত মনে করেছেন। সে কারণেই বিরুদ্ধাচরণকারী বৃদ্ধা নবী অনুরাগীতে রূপান্তরিত হলো।
২. ইহুদির সাথে আচরণ : এটিও আমাদের জানা ঘটনা। এক সন্ধ্যায় এক ইহুদি এসে নবীজীর আতিথ্য গ্রহণ করল। নবীজী তাকে ভালোভাবে খাওয়া-দাওয়ার ব্যবস্থা করলেন। খাওয়া-দাওয়ার পর রাতে ঘুমানোর জন্যে সবচেয়ে ভালো কম্বলটি তাকে দিলেন। কিন্তু ইহুদির মতলব ছিল খারাপ।
সবাই যখন গভীর নিদ্রায় নিমগ্ন তখন ইহুদি কম্বলে পায়খানা করে ভোর হওয়ার আগেই পালিয়ে গেল। কিন্তু তাড়াহুড়ো করে পালানোর সময় ভুলে তলোয়ার ফেলে রেখে গেল।
নবীজী ফজরের সময় উঠে অবস্থা দেখে সবই বুঝলেন। কিন্তু কাউকেই কিছু না বলে কম্বল পরিষ্কার করার ব্যবস্থা করলেন। ইহুদির তলোয়ারটা ভালোভাবে রেখে দিলেন।
এদিকে বহু দূর যাওয়ার পর ইহুদীর খেয়াল হলো সে তলোয়ার ভুল করে ফেলে রেখে গেছে। তখনকার দিনে আরবে একজন মানুষের সবচেয়ে দামী সম্পদ ছিল তার তলোয়ার। ইহুদি অনেকক্ষণ চিন্তা করল। তারপর সিদ্ধান্ত নিল তলোয়ার ফেরত পাওয়ার জন্যে সে নবীজীর কাছে যাবে।
ইহুদি দুরু দুরু বক্ষে নবীজীর কাছে হাজির হলো। আমরা হলে হয়তো বলতাম, 'ব্যাটা ইহুদি! তোকে রাতে যত্ন করে খাওয়ালাম-দাওয়ালাম। সবচেয়ে ভালো কম্বলটি গায়ে দেয়ার জন্যে দিলাম। আর তুই পায়খানা করে কম্বল নষ্ট করে এর প্রতিদান দিলি!
আর এখন এসেছিস তলোয়ার ফেরত নিতে! আয় এই তলোয়ার দিয়ে তোর গলাটা কেটে ফেলি, না হয় একটা হাত-পা কেটে দেই।' কিন্তু নবীজী প্রো-অ্যাকটিভ।
ইহুদির প্রতি সমবেদনা প্রকাশ করে বললেন, ‘আহা! রাতে তোমার কত না কষ্ট হয়েছে। কত কষ্ট হলে একজন মানুষ কম্বল নষ্ট করতে পারে। আর সেই লজ্জায় তুমি অন্ধকার থাকতেই চলে গেছ। আর যাওয়ার সময় ভুল করে তোমার তলোয়ারটা ফেলে রেখে গেছ। এই নাও তোমার তলোয়ার।’
নবীজীর ব্যবহারে ইহুদি মুগ্ধ হলো। অনুশোচনা এলো তার মাঝে।
ইহুদি নবীজীর ধর্ম গ্রহণ করল। ইহুদির আচরণ দ্বারা নবীজী প্রভাবিত হন নি বলেই নবীজী ইহুদিকে প্রভাবিত করতে পেরেছিলেন।
ইতিহাসের দিকে তাকালে আমরা দেখব, যুগে যুগে প্রো-অ্যাকটিভ মানুষরাই অন্যকে প্রভাবিত করেছেন, নিয়ন্ত্রণ করেছেন, সকল প্রতিকূলতাকে জয় করেছেন।
প্রো-অ্যাকটিভ দৃষ্টিভঙ্গি কীভাবে সাফল্য ও বিজয়ের বুনিয়াদে রূপান্তরিত হতে পারে, সে আলোচনা আমরা শেষ করতে পারি ইতিহাসের আরেকটি দৃষ্টান্ত দিয়ে।
পবিত্র বাইবেল ও কোরআন শরীফে এই কাহিনী বিস্তারিতভাবে আলোচিত হয়েছে। কাহিনীটি হযরত ইউসুফের। আমরা খুব সংক্ষেপে এটি আলোচনা করব।
ঘটনার শুরু আমরা ধরতে পারি একটি স্বপ্ন দিয়ে। কিশোর ইউসুফ স্বপ্ন দেখলেন, 'সুর্য, চন্দ্র ও ১১টি নক্ষত্র ধীরে ধীরে এসে অবনত হচ্ছে তার সামনে।'
ঘুম ভেঙে গেল তার। দৌঁড়ে গেলেন বাবা হযরত ইয়াকুবের কাছে। বাবা স্বপ্নের অর্থ পরিষ্কার বুঝতে পারলেন। বুঝলেন, পুত্র তার স্মরণীয়-বরণীয় হবে, অসাধারণ মর্যাদার অধিকারী হবে।
তিনি পুত্রকে নিষেধ করলেন, তোমার ভাইদের এ স্বপ্নের কথা কখনোই বলো না। তাহলে তারা ঈর্ষাপরায়ণ হয়ে তোমার ক্ষতি করবে।
ইউসুফের আপন ভাই বেনিয়ামিন ছাড়াও বৈমাত্রেয় ভাই ছিল দশ জন। বৈমাত্রেয় ভাইরা ছিল ইউসুফের বড়।
ইউসুফ বড় হতে লাগল। সৎগুণাবলিও বিকশিত হতে লাগল। বাবার খুবই প্রিয়পাত্র হয়ে গেলেন তিনি। আর বৈমাত্রীয় ভাইদের ঈর্ষাও বাড়তে লাগল।
তারা ইউসুফকে পথের কাঁটা মনে করে সরানোর চক্রান্ত করল। বাবা ইউসুফকে আগলে আগলে রাখলেও কৌশলে তারা একদিন তাকে বাবার কাছ থেকে দূরে নিয়ে গিয়ে জঙ্গলে কুয়ায় নিক্ষেপ করল।
ইউসুফ কুয়ার মাঝে এক প্রস্তর খণ্ডের ওপর বসে ধৈর্য ও সাহসের সাথে অপেক্ষা করতে লাগলেন। ব্যবসায়ীদের এক কাফেলা ভুল পথে এসে কুয়োর কাছে উপস্থিত হয়। তারা পানি তোলার জন্যে কুয়োয় বালতি ফেলার পর ইউসুফ সেই বালতি ধরে ফেলেন। ব্যবসায়ীরা প্রথম বুঝতে না পারলেও বালতি খুব ভারী লাগায় উঁকি দিয়ে দেখতে পায় একটি লোক রশি ধরে আছে। কয়েকজন মিলে টেনে ইউসুফকে ওপরে তোলে। ব্যবসায়ীর দল উল্লসিত হয়ে ওঠে ইউসুফকে দেখে। তারা বুঝতে পারে এই সুপুরুষ যুবককে মিসরে ক্রীতদাস হিসেবে ভালো দামে বিক্রি করা যাবে।
মিশরের অত্যন্ত ধনাঢ্য ও ক্ষমতাবান ব্যবসায়ী আজিজ তাকে দাস বাজার থেকে উচ্চ মূল্যে কিনে আনলেন। নিজের ব্যক্তিগত দাস হিসেবে নিয়োগ করলেন। বিনয়ী ও মেধাদীপ্ত আচরণ ও কর্তব্যপরায়ণতার কারণে কিছুদিনের মধ্যেই তিনি কার্যত আজিজ পরিবারের সদস্যে রূপান্তরিত হলেন।
ইউসুফ যেমন মেধাবী ও বুদ্ধিমান ছিলেন, তেমনি ছিলেন সুপুরুষ। গৃহস্বামী আজিজের স্ত্রী জুলেখা তার প্রেমে পড়ে গেল। কিন্তু ইউসুফ তাতে সাড়া না দিয়ে কৌশলে তাকে এড়িয়ে যেতে লাগলেন। এতে ক্ষুব্ধ হয়ে জুলেখা মিথ্যা কলঙ্ক আরোপ করার চেষ্টা করল। আজিজ চক্রান্তের মাধ্যমে ইউসুফকে মিশরের রাজার কারাগারে নিক্ষেপ করার ব্যবস্থা করলেন। ধনকুবের আজিজের বাড়িকে তিনি যেমন সহজভাবে গ্রহণ করেছিলেন, তেমনি কারাগারের জীবনকেও সহজভাবে গ্রহণ করলেন। সাধনার নতুন পর্যায় শুরু হলো। তিনি স্বপ্ন ব্যাখ্যায় পারদর্শিতা অর্জন করলেন।
কারাগারে নিজের আত্মিক শক্তিকে সংহত করতে থাকলেন ইউসুফ। এর মধ্যে কারাগারে দুই নতুন কয়েদি এলো। একজন রাজ-পরিচারক অপরজন রাজ-বাবুর্চি। এ দুজন একটু আলাপ করেই বুঝতে পারল যে ইউসুফ কোনো সাধারণ অপরাধী নয়। ইউসুফের সাথে ঘনিষ্ট হয়ে উঠল দুজন। এক রাতে দুজনই খুব স্পষ্ট স্বপ্ন দেখল। আর স্বপ্ন তাদের বিচলিত করে তুলল।
রাজ-বাবুর্চি স্বপ্ন দেখল যে, সে এক জায়গায় দাঁড়িয়ে আছে। মাথায় রুটি। দুটি পাখি ঠুকরে ঠুকরে রুটি খেয়ে ফেলছে। রাজ-পরিচারক স্বপ্ন দেখল যে, সে রাজাকে মদ পরিবেশন করছে। দুজনই হযরত ইউসুফের কাছে এসে স্বপ্নের ব্যাখ্যা জানতে চাইল। তিনি স্বপ্নের ব্যাখ্যা করে বললেন, বাবুর্চি মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত হবে। আর রাজ-পরিচারক তার চাকরি ফিরে পাবে।
হযরত ইউসুফ রাজ-পরিচারককে বললেন, সে চাকরি ফিরে পেলে যেন রাজাকে জানায় ইউসুফ নামে এক নিরপরাধ ব্যক্তি কারাগারে শাস্তি পাচ্ছে। হযরত ইউসুফের স্বপ্ন ব্যাখ্যা সত্য হলো। বাবুর্চি মৃতুদণ্ডে দণ্ডিত হলো। রাজ-পরিচারক তার কাজে যোগদান করল। রাজ-পরিচারক চাকরিতে পুনর্বহাল হওয়ার পর ইউসুফের কথা রাজাকে বলতে ভুলে গেল। ফলে ইউসুফ আরো কয়েক বছর কারাগারেই রয়ে গেলেন। নীরবে ধৈর্যের সাথে নিজেকে গড়তে লাগলেন ভবিষ্যতের জন্যে।
এদিকে মিশরের রাজা এক রাতে স্বপ্ন দেখলেন, তিনি নীলনদের তীরে হাঁটছেন। তার চোখের সামনেই নীলনদের পানি শুকিয়ে যেতে লাগল। সামনে শুধু কর্দমাক্ত মাটি। বহু মাছ কাদা মাটিতে লাফাচ্ছে। নদীর তলদেশ থেকে সাতটি মোটাসোটা গাভী উঠে এলো। তাদের পেছনে পেছনে এলো সাতটি কঙ্কালসার গরু। কঙ্কালসার গরুগুলো খেয়ে ফেলল মোটাসোটা গাভীগুলোকে।
রাজা ঘটনা দেখে আতঙ্কিত হলেন। তারপর দেখলেন নদীর তীরে পরিপুষ্ট সাতটি গমের শীষ জেগে উঠল। তা আবার হারিয়ে গেল কাদামাটিতে। সে জায়গায় দেখা গেল সাতটি শুকনো শস্যহীন গমের শীষ।
মিশরের রাজা ধড়ফড় করে ঘুম থেকে উঠলেন। আতঙ্কিত, বিষণ্ন। স্বপ্নের অর্থ তার কাছে দুর্বোধ্য। পরদিন সভাসদ, জ্যোতিষী, পুরোহিত, মন্ত্রী সবার কাছে স্বপ্নের অর্থ জানতে চাইলেন। কিন্তু কারো উত্তরই রাজার পছন্দ হলো না। স্বপ্নের এই বিষয়টি রাজ-পরিচারকের কানে গেল। হঠাৎ তার মনে পড়ল কারাগারে থাকাকালে তার স্বপ্ন ও ইউসুফের ব্যাখ্যার কথা। মনে পড়ল সে ওয়াদা করেছিল, রাজার কাছে তার কথা বলবে। কিন্তু বেমালুম ভুলে গিয়েছিল।
পরিচারক রাজার কাছে এবার ইউসুফের কথা বলল। রাজা পরিচারককে পাঠালেন ইউসুফের কাছে স্বপ্নের ব্যাখ্যার জন্যে।
হযরত ইউসুফ স্বপ্নের ব্যাখ্যায় বললেন, 'আগামী সাত বছর প্রচুর ফসল হবে। ঠিকভাবে চাষাবাদ করা হলে লোকজনের প্রয়োজনের অতিরিক্ত ফসল হবে। অতিরিক্ত ফসল জমা করে রাখতে হবে। এরপর সাত বছর অনাবাদী ও দুর্ভিক্ষাবস্থা সৃষ্টি হবে। এই সময়ে অতিরিক্ত জমানো শস্য ব্যবহার করা যাবে।'
পরবর্তী সময়ে বীজ হিসেবে ব্যবহার করার জন্যে কিছু শস্যদানা জমিয়ে রাখার পরামর্শ দিলেন তিনি।
স্বপ্নের ব্যাখ্যা ও পরামর্শে রাজা বিস্মিত হলেন। তিনি কারাগার থেকে মুক্ত করে তার সামনে ইউসুফকে আনার জন্যে আদেশ দিলেন। রাজ কর্মচারী ইউসুফকে আনার জন্যে দ্রুত কারাগারে গেল।
কিন্তু হযরত ইউসুফ তাকে নির্দোষ ঘোষণা করা ছাড়া কারাগার থেকে বেরুতে অস্বীকৃতি জানালেন। রাজা বুঝলেন, অন্যায়ভাবে অভিযুক্ত করা না হলে ইউসুফ এ ধরনের কথা বলতেন না।
সকল ঘটনা তদন্ত করে দেখলেন যে, ইউসুফ নির্দোষ। তাকে নির্দোষ ঘোষণা করা হলো। ইউসুফ রাজার দরবারে এলেন। রাজা তার সাথে কথা বলে তার পাণ্ডিত্য ও পরিশীলিত আচরণ দেখে মুগ্ধ হলেন।
হযরত ইউসুফ রাজাকে পরামর্শ দিলেন কীভাবে ভবিষ্যৎ দুর্ভিক্ষাবস্থা থেকে দেশকে রক্ষা করা যাবে। তিনি বললেন, দুর্ভিক্ষ শুধু মিশর নয় আশেপাশের দেশকেও প্রভাবিত করবে।
মিশরের রাজা হযরত ইউসুফকে খাদ্যমন্ত্রী নিয়োগ করলেন। সময় এখন তার অনুকূলে। তিনি সাধারণ মানুষকে দুর্ভিক্ষের হাত থেকে রক্ষা করার জন্যে দূরদৃষ্টিসম্পন্ন পরিকল্পনা ও কার্যক্রম গ্রহণ করলেন।
সাত বছর পর দুর্ভিক্ষ শুরু হলেও মিশরবাসীর ওপর এর কোনো আঁচ পড়ল না। বরং উদ্বৃত্ত শস্য ন্যায্যমূল্যে বিক্রি করার ব্যবস্থা করে প্রতিবেশী দেশগুলোর দুর্ভিক্ষপীড়িত মানুষকেও বাঁচানোর ব্যবস্থা করলেন।
এতে রাজার আন্তর্জাতিক মর্যাদা বেড়ে গেল। রাজা হযরত ইউসুফকে প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব অর্পণ করলেন। তিনি সেবা ও ন্যায়পরায়ণতার উজ্জ্বল আদর্শ স্থাপন করলেন। সম্মানিত হলেন সর্বত্র।
পবিত্র বাইবেল ও কোরআন শরীফে হযরত ইউসুফের কাহিনী বিস্তারিতভাবে বর্ণিত হয়েছে।
আমরা এই কাহিনীর প্রতিটি ঘটনা বিশ্লেষণ করলে দেখি যে, একজন সফল মানুষের জীবনে যে দৃষ্টিভঙ্গি থাকা প্রয়োজন আগাগোড়াই তা তাঁর ছিল।
কিশোর ইউসুফকে সূর্য, চাঁদ ও এগারোটি নক্ষত্রের সেজদা করতে দেখার স্বপ্নকে অনায়াসে আমরা তার জীবনের রূপক মনছবি হিসেবে ব্যাখ্যা করতে পারি। তার জীবনের লক্ষ্য ও প্রাপ্তি এই স্বপ্নেই ধরা দেয় রূপকভাবে।
আর এই লক্ষ্যের জন্যে সবসময়ই তিনি প্রো-অ্যাকটিভভাবে গতিশীল পদক্ষেপ নিয়েছেন। সকল অবস্থায় পরিস্থিতির সর্বোত্তম ব্যবহার করেছেন। তার ভাইয়েরা যখন তাকে কুয়ায় নিক্ষেপ করল, তখন তিনি আহাজারী হা-হুতাশ না করে, হতাশায় ভেঙে না পড়ে পাথরের চাঁই ধরে বসে প্রত্যয়ের সাথে, সবরের সাথে অপেক্ষা করতে লাগলেন। বণিকরা যখন তাকে কুয়া থেকে তুলে ক্রীতদাসের মতো বেঁধে নিয়ে চলল, তখনো তিনি কোনো প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেন নি।
ধনাঢ্য আজিজ যখন তাকে দাস হিসেবে বাসায় নিয়ে গেল, তখন তিনি বিশ্বস্ততা, যোগ্যতা ও ব্যবহারের সর্বোত্তম প্রয়োগ করে গৃহকর্তার মন জয় করলেন। তিনি তার পরিবারের সদস্যের মতো মর্যাদার অধিকারী হলেন।
গৃহকর্তার স্ত্রী জুলেখা যখন প্রেম নিবেদন করলেন, তখনো যুবক ইউসুফ গৃহস্বামীর প্রতি বিশ্বস্ত থাকলেন। যখন জুলেখা জোর করে ইউসুফের সাথে মিলিত হতে চাইল, ইউসুফ নিজেকে সে পাপ থেকে মুক্ত রাখার জন্যে দৌড়ে পালাতে গিয়ে গৃহস্বামীর সামনে পড়লেন। আর জুলেখা পুরো ব্যাপারটিকেই উল্টো ইউসুফের ওপর চাপাতে চাইল।
তখন তিনি রি-অ্যাকটিভ না হয়ে পুরো ঘটনা পর্যালোচনার দায়িত্ব গৃহস্বামীর ওপর অর্পণ করেন। ফলে গৃহস্বামী পুরো ঘটনা পর্যালোচনা করে বুঝতে পারেন ইউসুফ নির্দোষ। কিন্তু কেলেঙ্কারি ও মর্যাদাহানির ভয়ে ষড়যন্ত্রের মাধ্যমে আজিজ ইউসুফকে কারাগারে নিক্ষেপ করেন।
তখনো হযরত ইউসুফ কোনো রি-অ্যাকটিভ আচরণ করেন নি। প্রাক্তন মনিব আজিজের বিরুদ্ধে কোনো কথা বলেন নি। বরং কারাগারে নিজের অন্তর্নিহিত শক্তিকে জাগ্রত করার সাধনায় নিজেকে নিয়োগ করেন। বন্দি জীবনকে তিনি ধ্যানের মাধ্যমে আত্মশক্তিতে বিকশিত করার সুযোগ হিসেবে গ্রহণ করেন।
স্বপ্ন ব্যাখ্যা সফল হয়ে রাজ-পরিচারক কারাগার থেকে মুক্তি পাওয়ার পর রাজার কাছে ইউসুফের কথা বলতে ভুলে গেলেও তিনি কোনো ক্ষোভ প্রকাশ করেন নি।
স্বপ্নের ব্যাখ্যা শোনার পর রাজা ইউসুফকে দরবারে আসতে বলার পর তিনি দরবারে গিয়ে প্রাক্তন মনিব আজিজের বিরুদ্ধে নালিশ করতে পারতেন। কিন্তু তখনো তিনি মনিবের বিশ্বাসকে লঙ্ঘন করেন নি। মনিবের বিরুদ্ধে কিছু বলেন নি। শুধু তিনি যে নির্দোষ এই তদন্তের দায়িত্ব রাজা যাতে নিজে গ্রহণ করেন কার্যত সেই দাবি জানিয়েছিলেন।
মিশরের প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পরও তিনি তার বিরুদ্ধে চক্রান্তকারীদের ব্যক্তিগতভাবে প্রতিশোধ নেয়ার কোনো সুযোগ গ্রহণ করেন নি। এমনকি তার বৈমাত্রেয় ভাইদের কব্জার মধ্যে পেয়েও প্রতিশোধ না নিয়ে ক্ষমা করে দিয়েছেন। জীবনের প্রতিটি সমস্যা ও দুর্যোগ তিনি মোকাবেলা করেছেন প্রো-অ্যাকটিভ দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে, সবর করে।
সবসময় নিজ বিশ্বাসে অটল থেকেছেন আর মেধাকে কাজে লাগিয়েছেন সৃষ্টির সেবায়। ফলে কৈশোরে দেখা স্বপ্ন বা মনছবি বাস্তবায়িত হয়েছে তার জীবনে।
তাই আমরা নিঃসংশয়ে বলতে পারি-'দৃষ্টিভঙ্গি বদলান জীবন বদলে যাবে'। প্রো-অ্যাকটিভ দৃষ্টিভঙ্গি আপনাকে পৌঁছে দেবে মহিমান্বিত জীবনে।
লেখাটি কোয়ান্টাম মেথডের প্রবক্তা মহাজাতক এর মেডিটেশন বই থেকে সংগ্রহ।
এসএ/
আরও পড়ুন