শংকরীদের জীবনযুদ্ধ শেষ হয়না কোনদিন
প্রকাশিত : ১৮:৩৯, ১৯ এপ্রিল ২০২৪
মহান মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে আমরা পেয়েছি প্রিয় মাতৃভূমি। কিন্তু এই স্বাধীনতা অর্জনের পেছনে কত শহীদের রক্ত আর কত মানুষের কত আত্মত্যাগ রয়েছে সেটি অজানাই থেকে যাচ্ছে।
মহান মুক্তিযুদ্ধে ত্যাগ স্বীকার করা তেমন একজন নারী শংকরী শীল। বাড়ি রাজবাড়ীর সদর উপজেলার উজান খানখানাপুর গ্রামে। স্বামী জগদীশ শীল কৃষি কাজের পাশাপাশি গ্রামে কবিরাজি করতেন। দুই মেয়ে নিয়ে চার জনের সংসারে ভালোই ছিলেন শংকরী। শুরু হয় মুক্তিযুদ্ধ। যুদ্ধ শুরু হলে হিন্দু সম্প্রদায়ের মানুষ ভারতে আশ্রয় নিলেও উজান খানখানপুর গ্রামে বসবাস করা হিন্দু সম্প্রদায়ের কেউ ভারতে যায়নি। ১৯৭১ সালের মে মাস। তখন শংকরী পাঁচ মাসের অন্তস্বত্ত। রাজবাড়ী রেল কলোনিতে বসবাস করা বিহারীরা এই সময়ে রাজবাড়ীর বিভিন্ন গ্রামে গ্রামে গিয়ে হিন্দু সম্প্রদায়ের বাড়িঘর খুঁজে বের করে লুটপাট, অগ্নিসংযোগ ও হত্যাকান্ড চালানো শুরু করেছে। এছাড়া খানখানাপুর ইউনিয়নের রসুলপুর গ্রামে ২৫-৩০টি বিহারী পরিবারের বসবাস ছিল। মুক্তিযুদ্ধ শুরুর পর থেকে রাজবাড়ী শহরের বসবাস করা বিহারীদের সাথে এক হয়ে তারাও লুটপাট ও হত্যাকান্ড করে বেড়াতো।
১৯৭১ সালের ৯ মে বাংলা ২৬ বৈশাখ। শংকরীর স্বামী জগদীশ শীল সকালে ঘুম থেকে উঠে বাড়ির কাজ করছিল। শংকরী রান্না শেষে করে খাবারের আয়োজন করছিল। জগদীশ হাত-মুখ পরিস্কার করে খাবার খেতে রান্না ঘরে আসবে এমন সময় স্থানীয় বিহারীদের সাথে রাজবাড়ী থেকে আসা একদল বিহারী জগদীশ শীলকে ধরে নিয়ে যায়। একই সাথে প্রতিবেশি নগেন শীল, লোকনাথ সাহা, অনিল সাহা ও হরিপদ সাহাকে বাড়ি থেকে ধরে নিয়ে আসে। সবাইকে দাঁড় করিয়ে লোকনাথ সাহার বাঁশ বাগানের মধ্যে একসাথে গুলি করে। গুলি শেষে ধারালো অস্ত্র দিয়ে এলাপাথারি কুপিয়ে মৃত্যু নিশ্চিত করে। তবে এদের মধ্যে নগেন শীল জল জল করে চিৎকার করলে আবার তাকে কুপিয়ে দেহ থেকে মাথা আলাদা করে মৃত্যু নিশ্চিত করে। হত্যাকান্ড শেষে সেখানে বাস করা হিন্দু বাড়িগুলোতে লুটপাট চালায়। ভয়ে আর আতঙ্কে ওই গ্রামের হিন্দু সম্প্রদায়ের মানুষ বিভিন্ন স্থানে পালিয়ে যায়। এছাড়া খানখানাপুর ইউনিয়নের বিভিন্ন গ্রামে গণহত্যা চালায় বিহারীরা। পরিবারগুলো পালিয়ে যাবার কারণে হত্যাকান্ডের দুইদিন পর্যন্ত মরদেহ গুলো লোকনাথ সাহার বাঁশ বাগানের মধ্যে পড়ে ছিল। দুর্গন্ধ ছড়ালে স্থানীয় মানুষ ধর্মীয় বিধি-বিধান ছাড়া একসাথে মরদেহগুলো ঐ বাগানের মধ্যেই মাটিচাপা দেয়।
স্বামী মারা মারা যাবার পর অন্তসত্ত্বা শংকরী দুই মেয়েকে নিয়ে বালিয়াকান্দি উপজেলায় বাবার বাড়িতে আশ্রয় নেন। বাবার বাড়িতে শংকরীর ছেলে সন্তানের জন্ম হয়। ছেলের নাম রাখেন জয়দেব শীল। দেশ স্বাধীন হলে স্বামীর ভিটেতে ফিরে আসেন শংকরী। দুই মেয়ে আর এক ছেলেকে নিয়ে শুরু হয় বেঁচে থাকার নতুন সংগ্রাম শংকরীর। তবে শংকরীর জন্য পৃথিবীটা মোটেই সুখের ছিলনা। মুক্তিযুদ্ধের কয়েক বছর পর একে একে মারা যায় শংকরীর দুটি মেয়ে। একটু বড় হয়ে ছেলে জয়দেব রোজগার শুরু করেন। স্থানীয় বাজারে ক্ষৌরকার্য করেই চলছিল মা-ছেলের সংসার। জয়দেব বিয়ে করেন। ঘরে নতুন বৌ আসে। ছেলে, ছেলের বৌকে নিয়ে ভালোই চলছিল শংকরীর সংসার। দুই মেয়ে আর স্বামীকে হারানোর বেদনা ভুলে ছেলে আর ছেলের বৌকে নিয়ে আনন্দেই যাচ্ছিল তাদের দিন। কিন্তু একদিন সন্ধ্যায় বাজার থেকে ফিরে জয়দেব রক্ত বমি করতে থাকে। রাজবাড়ী থেকে ফরিদপুরে নিয়ে যায় জয়দেবকে। অসুস্থ আরো বেশি হতে থাকে। পরে চিকিৎসকের পরামর্শে বাড়ীর জমি বিক্রি করে উন্নত চিকিৎসার জন্য জয়দেবকে নিয়ে যাওয়া হয় ভারতে। সেখানে গিয়ে ধরা পড়ে জয়দেবের পাকস্থলীতে ক্যান্সার হয়েছে। বাড়িতে আনার কিছুদিন পরেই জয়দেব মারা যায়। শংকরী এখন একলা। ছেলের বৌকে সাথে নিয়েই তার বসবাস। ভিটের উপর ছোট একটি ভাঙ্গা ঘরে ছেলের বৌকে নিয়ে থাকে শংকরী। সরকার দেয়া বয়স্ক ভাতার টাকা পায় শংকরী। আর শংকরীর ছেলের বৌ একটি বেসরকারি স্কুলে ১২০০ টাকা বেতনে আয়ার কাজ করে। এই দিয়েই দুই বিধবা নারীর সংসার চলে। এছাড়া প্রতি বছর ডিসেম্বর মাসে খানখানাপুরে গণহত্যার স্মরণে সভা অনুষ্ঠিত হয়। সেখান শহীদ পরিবারগুলোর মাঝে কম্বল বিতরণ করা হয়। এক বছর আমি নিজেও সেখানে উপস্থিত ছিলাম। এছাড়া রাষ্ট্রের পক্ষ হতে শংকরীরা কিছুই পায় না। শংকরীদের ত্যাগের কথাও কোথাও লেখা থাকবে না হয়তো। শংকরী শীল যখন এই মুক্তিযুদ্ধের সময়কার তার জীবনের গল্প বলছিল তখন তিনি সব সময় বলছিলেন ‘গন্ডগলের বছর’। একবারের জন্যই মুক্তিযুদ্ধ বা স্বাধীনতা যুদ্ধ শব্দটি বলেনি। আমার মনে প্রশ্ন জাগে তবে কি মুক্তিযুদ্ধের সুফল শংকরীরা পায়নি। যার জন্য তাদের কাছে মুক্তিযুদ্ধ আজও গন্ডগলের বছরই রয়ে গেল।
আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধে এমন গল্প খুঁজলে হয়তো আরো অসংখ্য পাওয়া যাবে। কিন্তু আমাদের মুক্তিযদ্ধে এই পরিবার গুলোর অবদান আমরা কি মনে রাখবো?
(লেখক-সাংবাদিক সুমন বিশ্বাস, চ্যানেল ২৪ এর স্টাফ রিপোর্টার)
আরও পড়ুন