শখের অ্যাকুরিয়াম: পর্ব-৩
প্রকাশিত : ১১:০৫, ১৩ জুন ২০২১
আমাদের শহর কেন্দ্রিক জীবনধারায় ড্রইংরুমে একটি অ্যাকুরিয়াম সৌন্দর্য্য বাড়িয়ে তোলে নিঃসন্দেহে। কিন্তু এই সৌখিনতার পাশাপাশি চলে আসে সেই জিনিসটার প্রতি যত্ন এবং রক্ষণাবেক্ষণ। প্রথম ও দ্বিতীয় পর্বে আমরা জেনেছিলাম কীভাবে এই অ্যাকুরিয়াম তৈরি করতে হয় এবং সৌখিন মাছ প্রেমিদের কিছু কমন প্রশ্ন ও উত্তর সম্পর্কে। আজ আমরা জানবো- অ্যাকুরিয়ামে মাছের কমন রোগ ও তার প্রতিকার সম্পর্কে। আসুন, তাহলে জেনে নেয়া যাক-
মাছের কমন রোগ ও তার প্রতিকার সমূহ
সৌখিন মাছের রোগ হলেই কেবল ঔষধ-এর প্রয়োজন পড়বে। কোনও কারণ ছাড়া অ্যাকুরিয়ামের পানিতে কোনও প্রকার ঔষধ প্রয়োগ করা যাবে না। সাধারণত এই সৌখিন মাছ কেনার সময় দোকানী কিছু লাল নীল হলুদ- বিভিন্ন রকমের বোতল দিয়ে থাকে। আর বলে দেন- এইগুলো পানিতে নিয়মিত দিলে মাছের কোনও রোগ হবে না বরং পানি পরিষ্কার থাকবে। তারা আরও বলে দেন, এই অ্যাকুরিয়্যাম লবন নেন, এই টেবলেট নেন, এই ক্যাপসুল নেন। আমার জানামতে, এগুলো ব্যবহারে অ্যাকুরিয়ামের মাছের কোনও উপকার তো হয়-ই না, উল্টো ক্ষতি হতে পারে।
মাছের রোগ নির্ভর করে যে স্থানে অ্যাকুরিয়াম রাখা হয় বা তার আবহাওয়ার ওপর। আবার আপনি অ্যাকুরিয়্যামে যে পানি ব্যবহার করেন তার ওপরও নির্ভর করে মাছের রোগ। মাছের রোগ প্রতিরোধের জন্য প্রয়োজন হচ্ছে আপনার অ্যাকুরিয়্যামের পানি ও তার আশেপাশের আবহাওয়া ঠিক রাখা। অনেক সময় দেখা যায় যে, ছোট অ্যাকুরিয়্যাম অথচ মাছের পরিমাণ অনেক বেশী, তখন মাছের রোগ বেশী দেখা যায়। আপনার অ্যাকুরিয়্যামকে এমনভাবে সাজাতে হবে, যাতে মাছ তার চলাফেরায় স্বস্তি পায়।
অ্যাকুরিয়্যামে মাছের কি রোগ হয়েছে সেটা আগে বের করতে হবে। কারণ মাছের রোগ ঠিকভাবে বুঝতে না পারলে ঔষধ প্রয়োগ ঠিকভাবে করা যাবে না। আমরা মাছের রোগ প্রতিরোধ করার জন্য এমন কিছু ঔষধ প্রয়োগ করব যা সাধারণত স্থানীয় ফার্মেসীতে পাওয়া যায়। এবার আসুন, মাছের কি কি রোগ হয় ও তার প্রতিকার নিয়ে আলোচনা করি-
আমরা আজ এমন ঔষধ নিয়ে আলোচনা করব, যা সাধারণত মানুষ তার বিভিন্ন রোগে ব্যবহার করে থাকে এবং দামও কম। অ্যাকুরিয়ামে মাছের বিভিন্ন রোগসমূহের ক্ষেত্রে আমরা তিন রকম ঔষধ প্রয়োগ করব। যেমন-
১. টেট্রাসাইক্লিন বা অক্সিটেট্রাসাইক্লিন
২. মেট্রোনিডাজল এবং
৩. অন্যান্য মেডিসিন
মূলত ব্যাকটেরিয়ার কারণেই মাছের অনেকগুলো রোগ হয়ে থাকে। এবার আসুন, কোন রোগের জন্য আমরা কোন ঔষধ ব্যবহার করব তা জেনে নিই।
১. ফিন/টেইল রট:
অ্যাকুরিয়ামে মাছের এই রোগটি হলে দেখবেন যে, আপনার মাছের পাখনা বা লেজ খয়ে খয়ে যাচ্ছে বা পঁচে যাচ্ছে।
২. গিল রোগ:
মাছের ফুলকায় এই রোগটি দেখা যাবে। এই রোগটি হলে পানিতে মাছের শ্বাস নিতে সমস্যা হবে। ফলে বাতাস থেকে শ্বাস নেয়ার চেষ্টা করে সে।
৩. কটন মাউথ রোগ:
এই রোগটা মাছের মুখের উপরে দেখা যাবে। মাছের মুখের উপরে তুলোর মতো জমতে দেখা যাবে।
৪. বডি স্লাইম রোগ:
এই রোগ হলে মাছের শরীরে বিভিন্ন দাগ দেখা যাবে। ফলে মাছ এই দাগ তোলার জন্য অ্যাকুরিয়্যামে ঘষা দিতে পারে।
৫. পপ আই রোগ:
এই রোগটা মাছের চোখে হয়ে থাকে। ফলে মাছের চোখগুলো একটু বড় বড় হয়ে যায় বা ঝাপসা ঝাপসা হয়ে পড়ে।
৬. ওপেন বডি সোর:
এই রোগটা মাছের শরীরে ক্ষত তৈরী করে থাকে।
উপরে মাছের যতগুলো রোগ আছে, তার প্রতিকার হবে টেট্রাসাইক্লিন বা অক্সিটেট্রাসাইক্লিন মেডিসিন এর ব্যবহারে। আসুন, জেনে নিই সঠিকভাবে ঔষধ ব্যবহার সম্পর্কে।
এই ঔষধটা এন্টিবায়োটিক, যা পজেটিভ বা নেগেটিভ দুই ধরনের ব্যাকটেরিয়ার বিপক্ষেই কাজ করে। এই ঔষধ দেশের সব ফার্মেসীতে পাওয়া যায়। প্রতি ১০ গ্যালন পানিতে ২৫০ মিলি ঔষধ ব্যবহার করা যেতে পারে। এখন ঔষধ যদি ট্যাবলেট হয়, তবে তা গুড়া করে একটা বাটিতে ভিজিয়ে রাখতে হবে। আর যদি ক্যাপসুল হয় তবে তো ঔষধ গুড়া করা থাকেই। ফলে ঔষধ ভালোভাবে বাটির পানিতে ভিজিয়ে নেড়ে অ্যাকুরিয়্যামের পানিতে ঢেলে দিবেন।
তবে মনে রাখতে হবে যে, প্রত্যেকদিন আপনার অ্যাকুরিয়্যামের অর্ধেক পানি নতুনভাবে পরিবর্তন করে ঔষধ দিতে হবে। এভাবে অন্তত ৭ দিন ঔষধ প্রয়োগ করতে হবে। যদি ৫ দিনের মধ্যে কোনও উন্নতি না দেখা যায় তবে ঔষধ প্রয়োগ বন্ধ করতে হবে।
এবার কথা হবে মেট্রোনিডাজল মেডিসিন নিয়ে। যা মানুষের পেট খারাপ হলে আমরা ব্যবহার করি। মাছের আরও কিছু রোগ আছে, যা এই মেডিসিন ব্যবহারে সাফল্য পাওয়া যায়।
১. ইণ্টারনাল প্যারাসাইড:
এই রোগে মাছগুলোর পেট চিকন হয়ে যায়। খাওয়া অরুচি দেখা যায়। সাধারনত এইরোগে মাছের পুপ গুলো সাদা রংয়ের হয়ে থাকে।
২. হোল ইন দ্য হেড:
এই রোগে মাছের মাথায় ক্ষত সৃষ্টি হয়। খাবারে অরুচি দেখা দেয়।
৩. ব্লট বা ড্রপসি:
এই রোগে মাছের পেট সবসময় ফুলে থাকে। দেখে মনে হবে পেটে ডিম আছে। কিন্তু না, সে রোগে ভুগছে। সাধারণত এই রোগে মাছের পুপগুলো সাদা রংয়ের হতে পারে।
উপরে মাছের যতগুলো রোগ আছে, তার প্রতিকার হবে মেট্রোনিডাজল মেডিসিন-এর ব্যবহারে। আসুন, এবার জেনে নিই সঠিকভাবে ঔষধ ব্যবহার।
এই ঔষধটাও দেশের সব ফার্মেসীতে পাওয়া যায়। প্রতি ১০ গ্যালন পানিতে ২৫০ এমজি ঔষধ ব্যবহার করা যেতে পারে। এটাও আগের মতোই একইভাবে প্রয়োগ করতে হবে, পানি পরিবর্তন করে করে এভাবে অন্তত ৭ দিন ঔষধ প্রয়োগ করতে হবে। যদি ৫ দিনের মধ্যে কোনও উন্নতি না দেখা যায়, তবে ঔষধ প্রয়োগ বন্ধ করতে হবে।
বিবিধ রোগ:
১. ওরম প্রবলেম:
মাছেরও কৃমিজনিত রোগ হয়। এই রোগ হলে নিচের এই ঔষধটা দিতে হবে। Levamisole গ্রুপের Etrax (tab) 40mg বা Neotrax (tab) 40mg বা Helmisole (tab) 40mg বা Levosol (tab) 40mg।
এটার ডোজ হচ্ছে- প্রতি ১০ গ্যালন পানিতে ৯০ মিলি ব্যবহার করতে হবে। আপনার অ্যাকুরিয়্যামের পানি ৮০ ভাগ পরিবর্তন করতে হবে। এরপর ট্যাবলেট নিয়ে গুড়া করে একটা বাটিতে সামান্য পানি মিশিয়ে তারপর অ্যাকুরিয়্যামে ঢেলে দিতে হবে। এক্ষেত্রে আপনার অ্যাকুরিয়্যামের লাইট বন্ধ রাখতে ২৪ ঘণ্টার জন্য। তারপর ৮০ ভাগ পানি পরিবর্তন করতে হবে ও লাইট ব্যবহার করতে পারেন।
২. ফাঙ্গাস রোগ:
মাছে এই রোগ দেখা দিলে, মাছের বিভিন্ন যায়গায় একসাথে জমে থাকা তুলার মতো দেখাবে। এক্ষেত্রে Fluconazole গ্রুপের Flugal (cap) 150/200mg ব্যবহার করতে পারেন।
এটার ডোজ হচ্ছে- ১০ গ্যালন পানিতে ২০০ মিলি। প্রতিদিন আপনার অ্যাকুরিয়্যামের অর্ধেক পানি নতুনভাবে পরিবর্তন করে ঔষধ দিতে হবে। এভাবে অন্তত ৭ দিন ঔষধ প্রয়োগ করতে হবে। যদি ৫ দিনের মধ্যে কোন উন্নতি না দেখা যায়, তবে ঔষধ প্রয়োগ বন্ধ করতে হবে।
ইসক রোগ:
মাছের এই রোগ হলে, সারা শরীরজুড়ে অনেকাংশে খুশকীর মতো দেখা যাবে। এরজন্য আলাদাভাবে কোনও ঔষধ দিতে হবে না। পানিকে একটু হালকা গরম ও মোটা লবন ব্যবহারে এই রোগ নিরাময় হয়ে থাকে। প্রতি ১০ গ্যালন পানির জন্য ১ টেবিল চামচ লবন দিতে হবে। প্রতিদিন অর্ধেক পানি পরিবর্তন করে এই লবন দিতে হবে। এইভাবে ৭ দিন লবন দিতে হবে।
মাছের যে কোনও সমস্যা হলে, সবচেয়ে ভালো কাজ হলো- যে মাছটি অসুস্থ সেই মাছটি আলাদা করে ঔষধ প্রয়োগ করা। ফলে যে মাছের অসুস্থ হয়নি তার জন্য ঔষধ প্রয়োগের দরকার নেই। এতে করে আপনার ঔষধও কম লাগবে এবং সব মাছ সুস্থ থাকবে আশাকরি। এজন্য আপনি আলাদাভাবে একটা অ্যাকুরিয়্যামের ব্যবস্থা করবেন, যেখানে সব অসুস্থ মাছের জন্য ঔষধ প্রয়োগ করা হবে।
এনএস/