ঢাকা, শনিবার   ২১ ডিসেম্বর ২০২৪

শান্তির বার্তাবাহক পোপ ফ্রান্সিস

একুশে টেলিভিশন

প্রকাশিত : ১৮:১৫, ২ ডিসেম্বর ২০১৭

বিশ্বজুড়ে শান্তির বার্তাবহক হিসেবে কাজ করছেন রোমান ক্যাথলিকদের প্রধান ধর্মগুরু পোপ ফ্রান্সিস পুরো নাম জর্জ মারিও বেরগোগলিও ২০১৩ সাল থেকে তিনি ক্যাথলিক গির্জার ২৬৬তম পোপ হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন পাশাপাশি তিনি পৃথিবীর ক্ষুদ্রতম রাষ্ট্র ভ্যাটিকান সিটির রাষ্ট্রপ্রধান তিনি আর্জেন্টিনা তথা সমগ্র আমেরিকা থেকে নির্বাচিত প্রথম পোপ অসাধারণ ব্যক্তিত্বের অধিকারী শ্বেতশুভ্র মানুষটি প্রভু যিশুর প্রতিনিধি হিসেবে খ্রিস্ট ধর্মে বিশ্বাসী তথা সবার মাঝে আবির্ভূত হয়েছেন তারই ধারাবাহিকতায় শান্তি সম্প্রীতির বাণী নিয়ে ৩০ নভেম্বর বৃহস্পতিবার তিন দিনের সফরে ঢাকায় এসেছেন তার সম্পর্কে বিস্তারিত তথ্যাদি নিম্নে তুলে ধরা হলো

১৯৩৬ সালের ১৭ ডিসেম্বর আর্জেন্টিনায় জন্মগ্রহণ করেন জর্জ মারিও বেরগোগলিও (পোপ ফ্রান্সিস)। তার পিতার নাম হোসে মারিও বেরগোগলিও (১৯০৮-১৯৫৯)। মাতার নাম রেজিনা মারিয়া সিভোরি (১৯১১-১৯৮১)। তার পূর্ব বংশধর ১৯২৯ সালে ইতালির পিয়েমন্ত থেকে আর্জেন্টিনায় চলে যায়। তার মায়ের পূর্বপুরুষ উত্তর ইতালির অধিবাসী ছিলেন। উভয়ের পরিবারই মুসোলিনির ফ্যাসিবাদ নীতি থেকে রক্ষার জন্য আর্জেন্টিনায় অভিবাসী হয়েছিলেন। পাঁচ ভাই-বোনের মধ্যে ফ্রান্সিস ছিলেন সবার বড়। তিনি উইলফ্রেড ব্যারন দ্য লস সানটোস অ্যাঞ্জেলেস স্কুলে ষষ্ঠ শ্রেণিতে পড়াশোনা করেন। তিনি ইসকুয়েলা ট্যাকনিকা নাসিওনাল দ্য এডুকেসিয়ন হিপোলিটো হিগুয়েন থেকে কেমিক্যাল টেকনিশিয়ান বিষয়ে হাই স্কুল ডিপ্লোমা লাভ করেন। এর পর তিনি কয়েক বছর একটি ল্যাবরেটরির খাদ্য বিভাগে কেমিক্যাল টেকনিশিয়ান হিসেবে কাজ করেন। তিনি সঙ্গীত, ফুটবল এবং টানগো খেলা পছন্দ করেন। ধর্মগুরু পোপ ফ্রান্সিসের আজকের দরিদ্রপ্রেম ও ধর্মাদর্শ পরিবার থেকেই লাভ করেছেন।

মাত্র ১৯ বছর বয়সে (১৯৫৫ সাল) তিনি যাজক হওয়ার ইচ্ছা প্রকাশ করে সেমিনারিতে প্রবেশ করেন। ১৯৫৮ সালে তিনি যিশু সংঘের (জেজুইট) নব্যালয়ে প্রবেশ করেন। ১৯৬০ সালে যিশু সংঘে দরিদ্রতা, কৌমার্য ও বাধ্যতার সন্ন্যাসব্রত গ্রহণ করেন। একই বছর তিনি আর্জেন্টিনার সান মিগেলে অবস্থিত কলেজিও ম্যাক্সিমো দ্য সান হোসে কলেজে ভর্তি হন। ১৯৬৩ সালে দর্শনশাস্ত্রে লাইসেনসিয়েট ডিগ্রি লাভ করেন। ১৯৬৪-৬৬ সাল পর্যন্ত একটি কলেজে সাহিত্য ও মনোবিজ্ঞান বিষয়ে শিক্ষকতা করেন। শিক্ষকতার পাশাপাশি তিনি ঐশীতত্ত্ব অধ্যয়ন করেন। ১৯৬৭ সালে সান হোসে কলেজ থেকে ঐশীতত্ত্বে ডিগ্রি লাভ করেন। এরপর ১৯৬৯ সালে মাত্র ৩৩ বছর বয়সে আর্চবিশপ জোস ক্যাস্টিলিয়ানো দ্বারা যাজক হিসেবে অভিষিক্ত হন। ১৯৭০ সালে তিনি যিশু সংঘে চিরব্রত (পোপের প্রতি বাধ্যতা) গ্রহণ করেন। এর কয়েক মাস পরই ১৯৭৩ সালের ৩১ জুলাই তিনি যিশু সংঘের আর্জেন্টিনা প্রদেশের প্রদেশপাল (প্রভিন্সিয়াল সুপিরিয়র) নির্বাচিত হন। ১৯৮০ সালে সান মিগেলে অবস্থিত দর্শনশাস্ত্র ও ঐশীতত্ত্বের সেমিনারির পরিচালক নিযুক্ত হন। ১৯৮৬ সাল পর্যন্ত পরিচালক ও অধ্যাপক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৮৬ সালে তিনি জার্মানির ফ্রাংকফুর্টে যান এবং ঐশীতত্ত্বে পিএইচডি ডিগ্রি লাভ করেন। যাজক হওয়ার পর থেকেই তিনি অক্লান্তভাবে দরিদ্র মানুষের সেবা করেন। তা ছাড়া তিনি বিভিন্ন জাতি, গোষ্ঠী, ধর্ম, গোত্র ও সমস্যাগ্রস্ত মানুষের মধ্যে একতা ও শান্তি স্থাপনের জন্য সর্বদা কথা বলেছেন।

১৯৯২ সালে তিনি আউকা ধর্মপ্রদেশের টিটুলার বিশপ হিসেবে অভিষিক্ত হন। পরে বুয়েনস এইরেস ধর্মপ্রদেশের অক্সিলারি বিশপ হিসেবে মনোনীত হন। ১৯৯৭ সালে তিনি বুয়েনস এইরেস ধর্মপ্রদেশের কো-অডজিটর আর্চবিশপ হিসেবে মনোনীত হন এবং আর্চবিশপ কার্ডিনাল আন্তনিও কোয়ারোসিনোর মৃত্যুর পর ১৯৯৮ সালে ওই ধর্মপ্রদেশের আর্চবিশপ হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করেন। আর্চবিশপ হয়ে তিনি প্রশাসনিক ব্যবস্থা নতুনভাবে ঢেলে সাজান। তিনি বস্তিবাসী, দরিদ্র, সুবিধাবঞ্চিত ও প্রান্তিক জনগণের মধ্যে খ্রিস্টের উপস্থিতি শক্তিশালী করে তোলেন। দরিদ্র ও বস্তিবাসীদের মধ্যে পালকীয় সেবাকাজের জন্য তিনি যাজকদের সংখ্যা দ্বিগুণ বৃদ্ধি করে নিয়োগ দেন। ফলে তার নাম হয়ে ওঠে ‘বস্তির বিশপ’। এমনকি তিনি পুণ্য বৃহস্পতিবারের পা ধোয়ার অনুষ্ঠানটি জেলখানায়, হাসপাতালে, বয়স্ক হোমে, বস্তিতে, বাসায় (রোগী) ও কারাবন্দিদের জন্য পালন করার প্রচলন শুরু করেন। আর্চবিশপ হওয়ার তিন বছর পরই ২০০১ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি পোপ দ্বিতীয় জনপল তাকে আর্জেন্টিনার কার্ডিনাল নিযুক্ত করেন। কার্ডিনাল হিসেবেও তিনি খুবই সাধারণ জীবন-যাপন করতেন। তিনি জাগতিক সুখ-সুবিধা বা আরাম-আয়েশের সুবিধা গ্রহণ করতেন না। তিনি একটি ছোট অ্যাপার্টমেন্টে বাস করতেন। তিনি গণপরিবহনে যাতায়াত করতেন এবং নিজের রান্না নিজেই করতেন। তার খোলামন, উদারতা, মানবতা, নম্রতা, সরলতা, ক্যাথলিক ধর্মের মৌলিক শিক্ষা ও সামাজিক ন্যায্যতা প্রতিষ্ঠার জন্য অনেক সুনাম ও খ্যাতি ছিল। কার্ডিনাল হিসেবে তিনি রোমের পাঁচটি দপ্তরের প্রশাসনিক দায়িত্ব পালন করেন। তিনি ২০০৫ সালের ৮ নভেম্বর আর্জেন্টিনার বিশপ সম্মিলনীর প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন। বিশপ সম্মিলনীর প্রেসিডেন্ট থাকাকালে তিনি বিভিন্ন কমিশনের চেয়ারম্যান ও মেম্বার হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। বিশেষভাবে তিনি পন্টিফিক্যাল ক্যাথলিক বিশ্ববিদ্যালয় অব আর্জেন্টিনার প্রেসিডেন্ট ছিলেন।

পোপ ষোড়শ বেনেডিক্ট মানসিক ও বার্ধক্যজনিত কারণে ২০১৩ সালের ২৮ ফেব্রুয়ারি পদত্যাগ করেন। এর পর নতুন পোপ পেতে শুরু হয় নির্বাচন। ১২ ও ১৩ মার্চ দুই দিন লেগেছে পোপ নির্বাচনে। ভ্যাটিকানের সেন্ট পিটার্স চার্চে এ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। প্রথম দিন বিকেলে নির্বাচনে বসেন ৪৮ দেশের ১১৫ ধর্মযাজক। কিন্তু পরপর চারবার ভোট দিয়েও তারা পোপ নির্বাচনে ব্যর্থ হন। ফলে ব্যালট পুড়িয়ে সিস্টিন চ্যাপেলের চিমনিতে কালো ধোঁয়া তৈরি করা হয় যেন অপেক্ষমান ধার্মিকরা বুঝতে পারে, পোপ নির্বাচন তখনও সম্ভব হয়নি। অবশেষে ১৩ মার্চ বিকেলে চিমনির চূড়ায় দেখা গেল সাদা ধোঁয়া। সেই সাদা ধোঁয়া দেখে সেন্ট পিটার্স স্কয়ারে অপেক্ষমাণ জনতা উল্লসিত হয়ে ওঠেন। সেন্ট পিটার্স ব্যাসিলিকার ঘণ্টাটিও বেজে ওঠে। এর এক ঘণ্টা পর নতুন পোপ হিসেবে জর্জ মারিও বেরগোগলিওর (ফ্রান্সিস) নাম ঘোষণা করা হয়।

খুব সাধারণভাবে জীবন-যাপন করেন পোপ ফ্রান্সিস । পোপ নির্বাচনের পরে একবার ব্রাজিলের কার্ডিনাল রসিকতা করে বলেছিলেন, পোপ হয়ে গরিব মানুষদের ভুলে যেয়ো না। এ জন্যই মনে হয় তিনি দারিদ্র্য, বিনয়, সহজ-সরল জীবন ও ক্যাথলিক চার্চের সংস্কারের প্রতীক হয়ে থাকা সেন্ট ফ্রান্সিস অব আসিসির আদর্শ স্মরণে ‘ফ্রান্সিস’ নামটি ধারণ করেছেন। তিনিই প্রথম, যিনি ফ্রান্সিস নাম গ্রহণ করেন অর্থাৎ তিনি পোপ প্রথম ফ্রান্সিস।

পোপ নির্বাচিত হওয়ার পর প্রাথমিক যে আনুষ্ঠানিকতাগুলো ছিল, সেখানে তিনি সেই দরিদ্রতাকেই প্রাধান্য দেন। শুধু কথায় নয়, বরং তার শিক্ষা ও কথাকে তিনি নিজের জীবনেও প্রয়োগ করেছেন। তিনি অভিজাত জীবনযাপন ত্যাগ করে সাধারণ জীবনযাপনকে বেছে নেন। তিনি পোপ প্রাসাদের বাইরে থাকেন যেন প্রতিনিয়ত মানুষের সঙ্গে দেখা করতে, কথা বলতে ও সভা করতে পারেন। পোপ ফ্রান্সিস এইচআইভি, এইডস, সিঙ্গেল মাদারস, অভিবাসী, শরণার্থী ও অনাথদের কাছে অত্যন্ত প্রিয় একটি নাম।

জাতিসংঘের তৎকালীন মহাসচিব বান কি মুন পোপ ফ্রান্সিসকে একজন শান্তির মানুষ বলে অভিহিত করেছেন। তিনি একবার পোপের সঙ্গে সাক্ষাৎ করে সবাইকে বলেন, পোপ ফ্রান্সিস হলেন নির্বাকদের কণ্ঠস্বর। তিনি আরও বলেন, পোপ ফ্রান্সিস বিভিন্ন ধর্মাবলম্বীদের সঙ্গে মিশতে পারেন। তিনি সেতুবন্ধকারী। তিনি পোপের দরিদ্রদের প্রতি ভালোবাসারও প্রশংসা করেছেন।

টাইম ম্যাগাজিন ২০১৩ সালে তাকে বছরের সেরা ব্যক্তিত্বের মর্যাদা দেয়। দরিদ্র, সুবিধাবঞ্চিত ও প্রান্তিক জনগণের প্রতি তার দরদ, সহানুভূতি ও ভালোবাসার জন্য এবং তাদের পক্ষে কথা ও কাজ করার জন্য তাকে এই সম্মানজনক খ্যাতি দেওয়া হয়। সাপ্তাহিক ম্যাগাজিন ভ্যানেটি ফেয়ারের ২০১৩ সালের ১৭ জুলাইয়ের ২৮তম সংখ্যার প্রচ্ছদে পোপ ফ্রান্সিসের ছবি ছাপানো হয়েছে। প্রচ্ছদের শিরোনাম দেওয়া হয়েছে ‘সাহসী পোপ ফ্রান্সিস’। ভ্যানেটি ফেয়ার আরো লিখেছে, পোপ ফ্রান্সিসকে বিশ্বনেতৃত্বের জন্য আগাম ‘বর্ষসেরা’ ঘোষণা করা হলো।

এ যুগের প্রবক্তা, বিপ্লবী ও সমাজ সংস্কারক পোপ ফ্রান্সিস। যিশু তার জীবনে তৎকালীন ধর্মীয় ও সামাজিক নেতাদের নানা অত্যাচার, শোষণ, নির্যাতন ও মানবতাবিরোধী কর্মকাণ্ডের বিরুদ্ধে তীব্র সমালোচনা, প্রতিবাদ ও ধিক্কার জানিয়েছিলেন। ফলে যিশুকে কঠিন চ্যালেঞ্জ, এমনকি পৈশাচিক মৃত্যুদণ্ডের শিকার হতে হয়েছে। তবু যিশু আপস করেননি। তিনি মানুষের মানবিক ও মৌলিক অধিকার আদায়ে জনগণের পাশে দাঁড়িয়েছেন। তাদের ন্যায়, সত্য ও সুন্দরের পথ দেখিয়েছেন। পোপ ফ্রান্সিস যিশুর দেখানো আদর্শ ও শিক্ষা বিনীতভাবে জগদ্বাসীর কাছে তুলে ধরা এবং জীবনযাপনের চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন।

 

/ডিডি/ এআর


Ekushey Television Ltd.










© ২০২৪ সর্বস্বত্ব ® সংরক্ষিত। একুশে-টেলিভিশন | এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি