ঢাকা, মঙ্গলবার   ০৩ ডিসেম্বর ২০২৪

শাপলা-শালুক কুড়ানোর দিনগুলো

একুশে টেলিভিশন

প্রকাশিত : ১৪:৪৬, ২৮ ডিসেম্বর ২০২০

শাপলা আমাদের জাতীয় ফুল। জলের ওপর ফুটে থাকা শাপলা ফুলের দৃষ্টিকাড়া সৌন্দর্য্য সত্যিই  যে কোনো মানুষকে মুগ্ধ করে। আমাদের প্রিয় জন্মভূমির নৈস্বর্গিক রূপটাই এমন অপরূপ। সারা দেশে খাল-বিল, নদী-নালা, হাওর-বাওড় ও রাস্তার ধারের জলাভূমিতে যেসব উদ্ভিদ জন্মে তার মধ্যে সবার প্রিয় জলজ উদ্ভিদ শাপলা ও শালুক। এক সময় বর্ষা মৌসুমে দেশের বিভিন্ন জলাশয়ে ব্যাপকভাবে শাপলা ফুলের মনোরম দৃশ্য দেখা যেত। এই ফুলের সমারোহ ছিল চোখে পড়ার মতো। বর্ষা থেকে শরতের শেষ পর্যন্ত জলাশয়ে এমনিতেই জন্মাত প্রচুর শাপলা-শালুক। এসব রঙ-বেরঙের শাপলার বাহারি রূপ দেখে মুগ্ধ হতো সবাই।

শাপলা-শালুকের নাম শোনেননি এমন বাঙালি মনে হয় খুব কমই আছে। সেই ছোটকাল থেকেই গ্রামের পুকুর, বিল ও ঝিলে শাপলা-শালুক দেখে দেখে বড় হয়েছি। শাপলা এবং শালুক খাবার হিসেবে গ্রাম বাংলায় প্রচলিত ছিলো। স্মৃতির মুকুরে ভেসে উঠে দুরন্ত সেই শৈশবে বন্ধুরা মিলে শাপলা-শালুক কুড়ানো, সঙ্গে ফাও হিসেবে শাপলার ফল ভেট বাঢ্যাপ তুলে খাওয়ার দিনগুলোর কথা।

শাপলা-শালুক ছাড়াও পানি ফল বা সিংড়া ও ভেট বা ঢ্যাপ সেটিও এখন আর গ্রামবাংলার জলাভূমিতে চোখে পড়ে না। 

শাপলা-শালুক, ভেট বা ঢ্যাপ ও পানিফল
আমাদের দেশের সুস্বাদু পানির জলাশয়ের অতি গুরুত্বপূর্ণ কয়েকটি জলজ উদ্ভিদের মধ্যে প্রধান হল শাপলা-শালুক, সিংড়া বা পানিফল ইত্যাদি। শাপলা ফুল ফোটার দুই-তিন মাস বয়স হলেই ফুলের পাঁপড়ি ঝরে যায়। ঝড়ে গিয়ে মাথায় এক প্রকার ফলের মতো গুছি তৈরি হয়, যা গ্রামবাংলায় ভেট বা ঢ্যাপ নামে পরিচিত। এই ভ্যাট বা ঢ্যাপের মধ্যে অসংখ্য বীজদানা থাকে। এসব বীজদানা রোদে শুকিয়ে চাল তৈরি করা হয়। ভেট বা ঢ্যাপের পুষ্টিকর চাল থেকে তৈরি করা খৈ আর নাড়ুর মজাই আলাদা। কাঁচা ঢ্যাপের দানা কেউ কেউ খালি খেতেও পছন্দ করেন।

শাপলার কন্দকে বলে শালুক। শুষ্ক মৌসুমে জলাশয়ের পানি শুকিয়ে গেলেও এই গাছের কন্দ দীর্ঘকাল টিকে থাকতে পারে। বর্ষাকালে পানি ফিরে আসলে কন্দ থেকে গাছ, পাতা ও ফুল বের হয়। শাপলা গাছ বা ডাটা পানির গভীরতায় ৫ থেকে ২০ ফিট পর্যন্ত লম্বা হয়।

শাপলার পাতা বড়, গোলাকার, ভাসমান এবং ফুল দৃষ্টিনন্দন। শাপলা প্রজাতির সংখ্যা প্রায় ৫০টির মত। জন্মে বিশ্বের নানা দেশে। বাংলাদেশে হয় দুটি সাদা রঙের ও লাল রঙের রক্তকমল।

আরেকটি বিখ্যত জলজ উদ্ভিদ হলো সিংড়া বা পানিফল। সিংড়া নাম হয়েছে- এই ফল সুস্বাদু এবং সিংগাড়ার মত দেখতে তাই। পানিতে জন্মে বলে এর আরেক নাম পানি ফল। আমরা এখন যে সিংড়া খাই তা আমাদের দেশী জাতের না। আমাদের দেশী যাতের সিংড়া ফল হয় একটু ছোট আকারের এবং রঙ কালচে সবুজ এবং ধারালো কাটাযুক্ত।

জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের কবিতায় শাপলা-পদ্ম
যেদিন আমি হারিয়ে যাব,
বুঝবে সেদিন বুঝবে,
অস্তপারের সন্ধ্যা তারায়
আমার খবর পুছবে–
ভোরে ঝিলের জলে
শালুক পদ্ম তোলে
কে ভ্রমর-কুন্তলা কিশোরী।
ফুল দেখে বেভুল সিনান্ বিসরি।।
একি নূতন লীলা আঁখিতে দেখি ভুল
কমল ফুল যেন তোলে কমল ফুল
ভাসায়ে আকাশ গাঙে অরুণ-গাগরি।।
ঝিলের নিথর জলে আবেশে ঢল ঢল
গ’লে পড়ে শত সে তরঙ্গে,
শারদ আকাশে দলে দলে আসে
মেঘ, বলাকার খেলিতে সঙ্গে।

কবি নজরুল ইসলামের শালুক-পদ্ম ফুলসহ অন্যান্য জলজ উদ্ভিদগুলো যেন হারিয়ে যাচ্ছে। বলতে গেলে চোখেই পড়ে না! নদীনালা, খালবিল, জলাশয় এবং নিচু জমিতে এমনিতেই প্রাকৃতিকভাবে জন্মাতো প্রচুর শাপলা-শালুক, ভেট ও সিংড়া। তখন অনেকেই এসব পানিফলকে রেখেছিল খাদ্য তালিকায়ও। পানিফলের গাছগুলো যেন মাথা উঁচু করে জানান দিত, ‘আমি শাপলা, শালুক, ভেট, সিংড়া।’ ছোট ছোট ছেলেমেয়েরা তো বটেই, সব বয়সী মানুষই, রঙ-বেরঙের শাপলার বাহারি রূপ দেখে ব্যাকুল হয়ে যেত। যেন প্রাণটা জুড়িয়ে যেত চিরচেনা শাপলা ফুল দেখে। 

ভেষজ গুণাগুন
প্রবীণদের মতে শাপলার-শালুকের ভেষজ গুণ অনেক। শালুক খেলে হজম শক্তি বাড়ে, দ্রুত ক্ষুধা নিবারণ করে এবং শরীরে পর্যাপ্ত শক্তিও জোগায়। শাপলা-শালুক স্নিগ্ধকারক, শীতলকারক, পিত্ত প্রশান্তিদায়ক, হৃদযন্ত্রের শক্তিদায়ক, পিপাসা নিবারক, প্রস্রাবে জ্বালাপোড়া নিবারক, আমাশয় ও পেট ফাঁপায় উপকারী। শাপলা-শালুক দিয়ে যেসব রোগের চিকিৎসা সম্ভব তার মধ্যে রয়েছে পিত্তজ্বালায় (পিত্তাধিক্যে) কাঁচা শাপলা বেটে রস করে আধাকাপ করে সকাল-সন্ধ্যা পান করলে দুই থেকে পাঁচ দিনের মধ্যেই উপকার পাওয়া যাবে। যাদের প্রস্রাবে জ্বালাপোড়া করে, তারা কাঁচা শাপলার আধাকাপ রস দিনে ৩-৪ বার অথবা শুকনো ৫ গ্রাম শাপলা ২ কাপ পানিতে ১২ ঘণ্টা ভিজিয়ে রেখে সকাল-বিকাল পান করলে উপকার পাবেন। গলব্লাডার অপারেশন-পরবর্তী পিত্তের সমস্যায় শাপলা ভেজানো পানি পান বেশ উপকারী।

শালুক আগুনে পুড়িয়ে কিংবা সেদ্ধ করেও খাওয়া যায়। শালুক পোড়া এখনও সেই শৈশবকালের কথা মনে করিয়ে দেয়। পোড়া শালুক খেতে সেদ্ধ কাঁঠাল বিচির মত। পানিফলেও রয়েছে প্রচুর ভেষজ গুণাগুণ। তাইতো এখনও অনেকে খুঁজে ফেরে।

আজ থেকে মাত্র ১০-১৫ বছর আগেও বিলের বুকজুড়ে শাপলা ফুলের দৃষ্টিনন্দন সৌন্দর্য্য ছিল চোখে পড়ার মতো। সে সময় শরৎকাল যেন বিলের প্রকৃতিই অন্যরকম সাজে সজ্জিত হয়ে উঠত। শাপলা ফুল, পানিফল ও অন্যান্য উদ্ভিদ যে শুধু পরিবেশ ও প্রকৃতির সৌন্দর্যই বৃদ্ধি করতো তা কিন্তু নয়, এসবের রয়েছে প্রচুর পুষ্টিগুণ। সবগুলোই মুখরোচক পুষ্টিসমৃদ্ধ খাদ্য উপাদানে ভরপুর। 

কৃষিভিত্তিক অর্থনীতিতে গ্রামবাংলার শালুক হতে পারে একটি অর্থকরী ফসল। এর পুষ্টিগুণ আলুর মতো। কাদা মাটিতে বিনা চাষে উৎপন্ন শালুক আহরণ করে খাদ্য হিসেবে ব্যবহার করার পাশাপাশি বাজারজাত করা ও রফতানির উদ্যোগ নেওয়া প্রয়োজন। 

বিশেষজ্ঞদের মতে, জলবায়ুর ব্যাপক পরিবর্তনের ফলে এখন আর আগের মতো সময় মতো বন্যা হচ্ছে না। বন্যার পানি যতটুকু হওয়ার দরকার তাও হচ্ছে না। এ ছাড়া আবাদি জমিতে অতিমাত্রায় কীটনাশক ও রাসায়নিক সার প্রয়োগের ফলে মাটির নিচে লুকিয়ে থাকা শালুক বিনষ্ট হয়ে যাচ্ছে। নতুন করে আর শাপলা-শালুক, পানিফলসহ অন্যান্য জলজ জন্মাচ্ছে না। ফলে এসব উদ্ভিদ বিলুপ্তির পথে। এখন আর তা আগের মত চোখে পড়ে না। মনে হচ্ছে শাপলা শালুক কুড়ানো দিনগুলো যেন স্মৃতি হয়েই থাকবে।

এএইচ/


Ekushey Television Ltd.










© ২০২৪ সর্বস্বত্ব ® সংরক্ষিত। একুশে-টেলিভিশন | এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি