শিল্পঋণে ‘সিঙ্গেল ডিজিট’ সুদহার অনুমোদন
প্রকাশিত : ১১:১১, ২৫ ডিসেম্বর ২০১৯ | আপডেট: ১১:১৩, ২৫ ডিসেম্বর ২০১৯
উৎপাদনশীল খাতের ব্যাংক ঋণে সিঙ্গেল ডিজিট বা এক অংকের সুদহার অনুমোদন করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। এটি ১ জানুয়ারি থেকে কার্যকর হবে। শিল্পখাতের মেয়াদি এবং তলবি ঋণের গ্রাহকরা এই সুবিধা পাবেন।
মঙ্গলবার সন্ধ্যায় বাংলাদেশ ব্যাংকের বিশেষ পর্ষদ সভায় এটি অনুমোদন দেয়া হয়। সভাটি বিকাল ৪টায় শুরু হওয়ার কথা থাকলেও কোরাম সংকটের কারণে ৫টায় শুরু হয়ে চলে সন্ধ্যা সাড়ে ৭টা পর্যন্ত।
গভর্নর ফজলে কবিরের সভাপতিত্বে রুদ্ধদ্বার এ সভায় উপস্থিত ছিলেন জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের চেয়ারম্যান মোশাররফ হোসেন ভূঁইয়া, বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিচালক ও অর্থ মন্ত্রণালয়ের আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের সিনিয়র সচিব মো. আসাদুল ইসলাম, অর্থ সচিব আবদুর রউফ তালুকদার, ডেপুটি গভর্নর এসএম মনিরুজ্জামান, বাংলাদেশ ব্যাংক পর্ষদের পরিচালক মাহবুব আহমেদ ও একেএম আফতাব উল ইসলাম এফসিএ এবং বোর্ড সচিব কাজী ছাইদুর রহমান।
জানতে চাইলে বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র মো. সিরাজুল ইসলাম বলেন, শিল্প খাতে এক অঙ্কের সুদহার অনুমোদন করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক পর্ষদ। মেয়াদি ও তলবি ঋণগ্রহীতারা এ সুবিধা পাবেন। শিগগির প্রজ্ঞাপন জারি করা হবে। এটি কার্যকর হবে ১ জানুয়ারি থেকে।
জানা গেছে, উল্লিখিত সুযোগ-সুবিধাসহ বেশকিছু সুপারিশ চূড়ান্ত করে বাংলাদেশ ব্যাংকের এ সংক্রান্ত গঠিত কমিটি। কমিটির চূড়ান্ত প্রতিবেদন জমা দেয়ার কথা ছিল গত ১০ ডিসেম্বর, কিন্তু ভাষাগত কিছু জটিলতার কারণে প্রতিবেদনটি জমা দেয়ার সময় দু’দিন পেছানো হয়। ফলে সুদহার কমানোর সুপারিশসংবলিত প্রতিবেদনটি গত ১২ ডিসেম্বর অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামালের কাছে হস্তান্তর করা হয়।
এরপর বাংলাদেশ ব্যাংককে প্রয়োজনীয় নির্দেশনা দেন তিনি। এর আগে ১ ডিসেম্বর রাতে ডেপুটি গভর্নর এসএম মনিরুজ্জামানকে প্রধান করে সাত সদস্যবিশিষ্ট একটি কমিটি গঠন করে বাংলাদেশ ব্যাংক। একইদিন দুপুরে এ কমিটি গঠনের ঘোষণা দেন অর্থমন্ত্রী। কমিটিকে কীভাবে ব্যাংক ঋণের সুদহার এক অঙ্কে নামিয়ে আনা যায়, সে বিষয়ে একটি সুপারিশ উপস্থাপনের নির্দেশনা দেয়া হয়।
সম্প্রতি এক বৈঠকে অর্থমন্ত্রী বলেছেন, ‘নয়-ছয় ফর্মুলা’ ভুলে যান। এখন থেকে ব্যাংকিং খাতে আমানতে ৬ এবং ঋণে ৯ শতাংশ সুদহার ফর্মুলা থাকবে না। নতুন পদ্ধতিতে সুদের হার কমানো হবে। তবে এখানে ব্যবসা করতে হলে শিল্পঋণে সুদের হার ৯ শতাংশের বেশি এক পয়সাও নেয়া যাবে না।
বাংলাদেশ ব্যাংক সূত্র জানায়, শুধু শিল্পঋণে ৯ শতাংশ সুদ কার্যকরের বিষয়ে শিগগির প্রজ্ঞাপন জারি করবে বাংলাদেশ ব্যাংক। এর মধ্যে চলতি মূলধন ঋণ, প্রজেক্ট লোনসহ শিল্প খাতের বড় ঋণগুলো থাকবে। তবে ভোক্তাঋণ এর আওতায় পড়বে না।
জানা গেছে, ঋণের সুদের হার ৯ শতাংশের মধ্যে বা সিঙ্গেল ডিজিটে নামিয়ে আনতে প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশ এখনও মানছেন না বেসরকারি ব্যাংকগুলোর মালিকরা। এ বিষয়ে প্রধানমন্ত্রী ৭ বার এবং বর্তমান ও সাবেক অর্থমন্ত্রী ১১ বার নির্দেশনা দিয়েছেন।
সূত্রমতে, সুদের হার এক অঙ্কে নামিয়ে আনার জন্য বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকসের (বিএবি) দাবির পরিপ্রেক্ষিতে গত দেড় বছরে সরকার ও বাংলাদেশ ব্যাংক দফায় দফায় ৯টি সুবিধা দিয়েছে। কিন্তু সরকারি ব্যাংক এবং কয়েকটি বেসরকারি ব্যাংক ছাড়া বাকিগুলো ঋণে সুদহার এক অঙ্কে নামায়নি। সুদহার এক অঙ্কে না এলেও ৯টি সুবিধার চারটিতেই ব্যাংকগুলো প্রায় ২৫ হাজার ৫০০ কোটি টাকা পেয়েছে।
ব্যাংকগুলোর দাবির পরিপ্রেক্ষিতে গত বছরের ১৫ এপ্রিল থেকে নগদ জমা সংরক্ষণ হার (সিআরআর) কমিয়ে দ্বি-সাপ্তাহিক গড় ভিত্তিতে ৫.৫ শতাংশ এবং দৈনিক ভিত্তিতে ন্যূনতম ৫ শতাংশ নির্ধারণ করা হয়েছে। গত বছরের এপ্রিল থেকে চলতি বছরের জুন পর্যন্ত হিসাবে ব্যাংকগুলো এ ক্ষেত্রে ১১ হাজার ১১২ কোটি টাকার সুবিধা পেয়েছে।
গত ২০১৮-১৯ অর্থবছরে ব্যাংকের কর্পোরেট করহার ৪২.৫ শতাংশ থেকে কমিয়ে ৪০ শতাংশ নির্ধারণ করা হয়। এতে ব্যাংকগুলো ২.৫ শতাংশ ট্যাক্স সুবিধা পায়। এর ফলে ১৩ হাজার ৫৫৮ কোটি টাকার সুবিধা পেয়েছেন ব্যাংকের উদ্যোক্তা পরিচালকরা।
ব্যাংক সংগঠনের দাবির পরিপ্রেক্ষিতে কৃষি খাতে প্রদত্ত ঋণের বিপরীতে রক্ষিতব্য সাধারণ প্রভিশন সংরক্ষণের হার ২.৫ শতাংশ থেকে কমিয়ে ১ শতাংশ নির্ধারণ করা হয়। চলতি বছরের জুন পর্যন্ত ব্যাংকগুলো ৫৩৪ কোটি টাকা সুবিধা ভোগ করেছে।
একইভাবে গৃহায়ন খাতে রক্ষিতব্য সাধারণ প্রভিশন সংরক্ষণ হারেও সুবিধা দেয়া হয়। গৃহায়ন খাতে সাধারণ প্রভিশন সংরক্ষণের হার ২ শতাংশ থেকে ১ শতাংশে নামিয়ে আনা হয়। এতে চলতি বছরের জুন পর্যন্ত ব্যাংকগুলো ২৫৫ কোটি টাকা সুবিধা পায়।
সব মিলিয়ে শুধু এ সুবিধাগুলো থেকে ব্যাংকগুলোর লাভ হয়েছে প্রায় সাড়ে ২৫ হাজার কোটি টাকা। এ ছাড়া বেসরকারি ব্যাংকগুলোতে সরকারি তহবিল জমার হার বৃদ্ধি, পরিচালক পদে অধিষ্ঠিত থাকার মেয়াদ ও একক পরিবারের সদস্য সংখ্যা বৃদ্ধি, ২ শতাংশ ডাউন পেমেন্টে ১০ বছর মেয়াদে পুনঃতফসিল এবং ঋণশ্রেণীকরণ নীতিমালা শিথিলকরণ সুবিধা দেয়া হয়েছে।
তবে কাজের কাজ কিছুই হয়নি। দেড় বছরেও বাস্তবায়ন হয়নি এক অঙ্কের সুদহার। অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল একপ্রকার বাধ্য হয়েই সুদহার এক অঙ্কে নামিয়ে আনতে কমিটি গঠন করে দিয়েছেন। সে কমিটির সুপারিশের ভিত্তিতেই প্রজ্ঞাপন জারি করতে যাচ্ছে বাংলাদেশ ব্যাংক।
আরও পড়ুন