শুরু হলো ঘর গোছানোর কাজ
প্রকাশিত : ১৬:১১, ১৮ মে ২০২০ | আপডেট: ১৬:২০, ১৮ মে ২০২০
পবিত্র কোরআন-এ আল্লাহ রব্বুল আলামীন সূরা আহজাব-এর ২১ নং আয়াতে বলেন, ‘(হে মানুষ!) নিশ্চয়ই তোমাদের জন্যে নবীজীবন সর্বোত্তম আদর্শ।’ নবীজীবন কোরআনের ফলিত রূপ। কোরআন বুঝতে হলে, কোরআনের গভীরে ডুব দিতে হলে নবীজীবনকে জানতে হবে। নবীজীবনকে যত গভীরভাবে অধ্যয়ন করা যায়, নবীপ্রেমে নিজের অন্তরকে যত প্লাবিত করা যায়, ততোই কোরআনের বাস্তব ও পরাবাস্তব জ্ঞানের ছটায় উপকৃত হওয়া যায়। কোরআনে ব্যক্ত ও সুপ্ত সব কথারই মর্মমূলে প্রবেশ করার ফলে; বিশ্বাসের স্তর থেকে উত্তরণ ঘটবে জানার স্তরে।
প্রথম পর্বে আপনারা জেনেছেন নবী আগমনের পটভূমি। আইয়ামে জাহেলিয়াত। মক্কার বিবর্তন। কাবার নিয়ন্ত্রক বেনিয়া পুরোহিত চক্রের শোষণ ও ভোগবাদী সমাজে নৈতিক ও মানবিক মূল্যবোধের চরম বিপর্যয়ের বিবরণ। দ্বিতীয় পর্বে জেনেছেন শূন্য থেকে জীবন শুরু। অনিশ্চয়তার পর অনিশ্চয়তা। নিজ শ্রম ও মেধায় ৩৫ বছর বয়সে আসীন হলেন মক্কার সমাজে উচ্চ মর্যাদায়। তৃতীয় পর্বে আপনারা জেনেছেন জীবনের বাঁকবদল। জাহেলিয়াত থেকে উত্তরণের সূত্র লাভ। আল্লাহ এক, তিনি ছাড়া কোনো উপাস্য নেই। সকল মানুষ সমান। শুরু করলেন সত্যের প্রচার। প্রথমে গোপনে। তারপর প্রকাশ্যে।
চতুর্থ পর্বে আপনারা জেনেছেন নির্মম নির্যাতন ও উৎপীড়নের মুখে স্বল্পসংখ্যক সঙ্ঘবদ্ধ মানুষের বিশ্বাস ও অহিংসায় অটল থেকে আত্মিক তূরীয় আনন্দে অবগাহনের বিবরণ। পঞ্চম পর্বে জেনেছেন হিজরত- চরম অনিশ্চয়তার মুখে সোনালি সকালের পথে যাত্রার বিবরণ। এবার ষষ্ঠ পর্বে জানবেন মদিনায় আগমনের পর সামাজিক রাজনৈতিক প্রতিকূলতার মধ্যে ধাপে ধাপে তার ঘর গোছানোর কাহিনী।
নবীজী মদিনায় পৌঁছলেন ১২ রবিউল আউয়াল, ২৭ সেপ্টেম্বর ৬২২ খ্রিষ্টাব্দে। মুসলমান আবালবৃদ্ধবনিতা গান গেয়ে স্বাগত জানাল নবীজীকে। ৫০০ কিলোমিটার যাত্রার সমাপ্তি ঘটল। খাজরাজ ও আসের প্রত্যেক গোত্রপতিই তাঁকে তাদের অতিথি হিসেবে পাওয়ার জন্যে ব্যাকুল হয়ে উঠল। নবীজী তাঁর উটের রশি ছেড়ে দিলেন। উট স্বাধীনভাবে মদিনার অলিগলি ঘুরে আবু আইয়ুবের ঘরের সামনে গিয়ে বসে পড়ল। নবীজী আবু আইয়ুবের ঘরে উঠলেন। দোতলা খুব সাধারণ ঘরের নিচতলাকে আবাস হিসেবে গ্রহণ করলেন। আবু আইয়ুব পরিবার তাঁকে দোতলায় থাকার জন্যে অনেক অনুনয় করার পরও তিনি নিচতলাই বেছে নিলেন।
নবীজীকে অতিথি হিসেবে পেয়ে আবু আইয়ুব আনসারীর আনন্দের কোনো সীমা ছিল না। উম্মে আইয়ুব নবীজীর খাবার তৈরি করতেন। নবীজী খাওয়ার পর তারা খেতে বসতেন। নবীজীর থালায় অবশিষ্ট কিছু থাকলে সেটাকে বরকত হিসেবে তৃপ্তির সাথে খেতেন। আবু আইয়ুব ধনী ছিলেন না। কিন্তু অতিথিপরায়ণ ছিলেন। নবীজীর স্বাচ্ছন্দ্য নিশ্চিত করার ক্ষেত্রে তার প্রচেষ্টার কোনো কমতি ছিল না। মমত্ববোধ কতটা ছিল, একটা ছোট্ট ঘটনা থেকে তা বোঝা যায়। এক রাতে তাদের পানির কলস ভেঙে গেল। পানি যাতে দোতলার মাচা চুইয়ে নিচে নবীজীর শরীরে না পড়ে সেজন্যে তারা তাদের কম্বল দিয়ে পানি শুষে নেয়ার ব্যবস্থা করলেন। যেহেতু আর কোনো কম্বল ছিল না, সারারাত তারা জবুথবু হয়ে বসে কাটালেন। আসলে নবীজীর যত্ন নেয়ার ব্যাপারে প্রত্যেক অনুসারীই ছিলেন আন্তরিক।
দুঃসহ জুলুম নির্যাতন থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্যে নবীজী ও বিশ্বাসীরা মক্কা ছেড়ে এলেও অপশক্তি তাদের পিছু ছাড়ে নি। বিশ্বাসীরা ধনসম্পদ সব ফেলে রিক্ত হাতে হিজরত করেছে। ভেবেছে এখন অতীত ভুলে গিয়ে মদিনায় শান্তিতে আল্লাহতে সমর্পিত জীবনাচার পালন করা যাবে, আল্লাহর নৈকট্য লাভে ধাপে ধাপে নিজেকে পরিশুদ্ধ করা যাবে। কিন্তু সে আশার গুড়ে বালি। কোরাইশরা যখন খবর পেল যে, তাদের হিংস্র থাবা থেকে বেরিয়ে মুহাম্মদ মদিনায় পৌঁছে গেছেন, তারা ক্রোধে ক্ষিপ্ত হয়ে উঠল।
মদিনার নেতৃস্থানীয় গোত্রপতি আবদুল্লাহ ইবনে উবাই ইবনে সলুলকে খোলা চিঠি দিল তাদের শত্রু মুহাম্মদকে শহর থেকে বের করে দিতে হবে অথবা তাকে হত্যা করতে হবে। অন্যথায় এ লক্ষ্যে যথোপযুক্ত ব্যবস্থা নেয়া হবে। কোরাইশরা মুসলমানদেরও মদিনায় এসে নির্মূল ও ধ্বংস করার চরমপত্র দিল। নবীজীর সামনে চ্যালেঞ্জ ছিল অনেক। সারা আরবের ন্যায় মদিনার গোত্রীয় সমাজ কাঠামোয় বহিরাগতরা বিবেচিত হতো অপাঙ্ক্তেয়-অচ্ছুত হিসেবে। গোত্রীয় সংস্কৃতি কোথাও বহিরাগতদের কখনো নিজেদের মানুষ হিসেবে গ্রহণ করে না। তারপরেও শরণার্থীসহ মদিনায় মুসলমানরা জনসংখ্যার মাত্র ১৫ শতাংশ। নবীজী কার্যত শরণার্থীদের নেতা।
খাজরাজ, আউস গোত্রের নিজস্ব নেতা রয়েছে। তারা নবীজীকে তাদের বিরোধ মীমাংসায় সালিশ হিসেবে এবং ধর্মীয়ভাবে নবী হিসেবে গ্রহণ করে ‘সুরক্ষা’ দিয়েছে মাত্র। খাজরাজদের এক বড় অংশের নেতা আবার আবদুল্লাহ ইবনে উবাই ইবনে সলুল। ধনাঢ্য ইবনে উবাই-এর সাথে মক্কার অভিজাতদের স্বার্থের সখ্যতা দীর্ঘদিনের। দৃশ্যত মুসলমান হলেও কার্যত তার ভূমিকা ছিল মুনাফেকের। যে-কোনো সময় পেছন থেকে আঘাত হানতে পারে। নবীজীর প্রতি ইবনে উবাই-এর আক্রোশ ছিল পুরোটাই ব্যক্তিগত। তাকে ‘মদিনার রাজা’ হিসেবে মুকুট পরানোর পুরো প্রস্তুতি সম্পন্ন হয়েছিল। কিন্তু নবীজী মদিনায় এসে পড়ায় সব ভন্ডুল হয়ে যায়।
জনসংখ্যার বাকি ৪৫ শতাংশ পৌত্তলিক, ৪০ শতাংশ ইহুদি। এরা আবার বিভিন্ন গোত্রে বিভক্ত। পরিস্থিতি পুরোটাই নড়বড়ে। তবে যিনি মায়ের কোল থেকেই সংগ্রাম করে আসছেন, তাঁর ধৈর্য ও প্রজ্ঞার কাছে সকল সমস্যা কালস্রোতে ভেসে যেতে বাধ্য। নবীজী (স) পরিস্থিতি বিশ্লেষণ করে বুঝলেন- এখন নতুন ঘর একদিকে যেমন গোছাতে হবে, অন্যদিকে ঘর সুরক্ষার পুরো প্রস্তুতি নিতে হবে। সুরক্ষা প্রস্ত্ততিতে কোনো ঘাটতি থাকলে প্রতিহিংসাপরায়ণ কোরাইশরা সবকিছু তছনছ করে দেবে। তাই আত্মিক বিকাশের পাশাপাশি আত্মরক্ষার শক্তিকে সংহত করে অবস্থানকে করতে হবে সবদিক দিয়ে সুরক্ষিত।
এতদিন ধরে সবকিছুই ছিল ভাসমান। অনুসারীদের আত্মিক মুক্তির জন্যে কোনোকিছু গুছিয়ে করার সুযোগ ছিল না। এখন সুযোগ এসেছে। আর কাজও অনেক।
মানবিক সমাজের মূল শক্তি আলোকিত সঙ্ঘবদ্ধ মানুষ, যাদের মনে কোনো হিংসা-বিদ্বেষ থাকবে না। যারা মিথ্যা বলবে না। গীবত করবে না। চুরি করবে না। ব্যভিচার করবে না। অন্যের ওপর জুলুম করবে না। নারীর প্রতি অবিচার করবে না। যারা হবে সবার প্রতি সমমর্মী। এতিম-অসহায়দের ভরসাস্থল। যারা সবকিছু করবে শুধু স্রষ্টার সন্তুষ্টির জন্যে। যারা দিনভর কাজ করবে মানুষের কল্যাণে। আর রাতের একটা সময় কাটাবে আল্লাহর ধ্যানে, তাঁর জিকিরে, তাঁর ইবাদতে। যারা প্রতিটি সেজদায় অনুভব করবে স্রষ্টা-দর্শনের তূরীয় আনন্দ। যাদের দেখলেই মানুষের মনে হবে আল্লাহর কথা। যারা হবে ন্যায় সত্য ও স্রষ্টাপ্রেমের জীবন্ত উদাহরণ।
এজন্যে প্রয়োজন একটি সামাজিক মিলনকেন্দ্র, নারী-পুরুষ নির্বিশেষে যেখানে তারা নিয়মিত মিলিত হতে পারবে, আত্মিক প্রশিক্ষণ নিতে পারবে, অনুশীলন করতে পারবে। মত ও ভাব বিনিময় করতে পারবে। যেভাবে ভাবলেন কাজ শুরু করলেন সেভাবেই। মদিনায় প্রথম হিজরির প্রথম মাসে সামাজিক মিলনকেন্দ্র হিসেবে মসজিদ নির্মাণের কাজ শুরু হলো। মাটির দেয়াল। বালুর মেঝে। খেজুর গাছের খুঁটি। খেজুর পাতার ছাউনি। পুরো নির্মাণ কাজ পরিচালনার দায়িত্ব দেয়া হলো আম্মার ইবনে ইয়াসিরকে, যার মা ছিলেন ইসলামের প্রথম শহিদ সুমাইয়া। ১২ দিনে মসজিদের নির্মাণকাজ সমাপ্ত হলো।
একচালা ২১০০ বর্গহাতের এই সাধারণ অবকাঠামোর মসজিদটি পরিণত হলো নবীজীর সচিবালয়, বিচারালয়, রণকৌশল নির্ধারণ কক্ষ, রাষ্ট্রীয় পরামর্শ কক্ষ, সামাজিক যোগাযোগ আর ধর্মীয় শিক্ষা ও অনুশীলন কেন্দ্র। যেখানে বসে সমাজের নেতৃস্থানীয় ব্যক্তি থেকে শুরু করে একজন সাধারণ গৃহবধূও নিঃসংকোচে বলতে পারত তার মনের কথা, পেশ করতে পারত তার আর্জি। সেখান থেকে পরিচালিত সরকার পরবর্তী একযুগের মধ্যেই নিশ্চিহ্ন করল তখনকার দুই পরাশক্তি বাইজেন্টাইন ও পারস্য সাম্রাজ্যের শোষণের পুরো অবকাঠামো।
মাটির দেয়াল ঘেরা মসজিদ প্রাঙ্গণ হয়ে উঠল কল্যাণ ও আশ্রয় কেন্দ্র। এখানে-
১. যারা ঘরবাড়ির ব্যবস্থা করতে পারত না তারা এসে থাকত।
২. শরণার্থী মহিলাদের থাকার ব্যবস্থাও ছিল।
৩. ইসলাম ও মুসলমানদের ব্যঙ্গ করে রচিত কবিতার জবাবে কবিতা রচনা ও পাঠ করার আসর বসত।
৪. যুদ্ধাহতদের চিকিৎসা ও সেবাযত্নের ক্যাম্প স্থাপন করা হতো।
৫. যুদ্ধবন্দিদেরও রাখা হতো, যাতে তারা ইসলামি জীবনাচার সম্পর্কে চাক্ষুস জ্ঞান লাভের সুযোগ পায়।
৬. ভিনদেশ থেকে আগত প্রতিনিধি দলের থাকার তাঁবুও লাগান হতো।
৭. এই প্রাঙ্গণ থেকেই পতাকা প্রদান করা হতো অভিযানে প্রেরিত জনযোদ্ধা দলকে।
৮. বিয়ের অনুষ্ঠানও হতো এই প্রাঙ্গণে।
অর্থাৎ সমাজ হিতকর সকল কাজেই ব্যবহৃত হতো মসজিদ ও মসজিদ প্রাঙ্গণ।
মসজিদে এত ধরনের কর্মতৎপরতা পরিচালনার জন্যেও নবীজীর নিজের কোনো থাকার ঘর বা মসজিদে কোনো আলাদা কক্ষ ছিল না। কিন্তু সকল কর্ম পরিচালনায় তাঁর শৃঙ্খলার বিষয়টি দেখলে বিস্মিত হতে হয়। মসজিদের তিনটি খুঁটির বিশেষ নাম দিয়েছিলেন তিনি। যেমন-
১. উসতোয়ানাত আল-হালাক।
২. উসতোয়ানাত আল-হারাস।
৩. উসতোয়ানাত আল-তাহাজ্জুদ।
নামাজ শেষ করে নবীজী (স) মেহরাবের প্রথম খুঁটির সামনে বসতেন বা দাঁড়াতেন। সেখানে যে-কেউ তার নিজের যত রকম কথা আছে তার কাছে গিয়ে বলতে পারত। আর যখন কোনো বিশেষ বৈঠক বা গোত্রপতিদের সভা হতো তখন তিনি উসতোয়ানাত আল-হারাস খুঁটির কাছে বসতেন। সেখানে শুধু নির্ধারিত ব্যক্তিরাই যেতে পারতেন। সাধারণ দর্শনার্থীরাও বুঝত এখন নবীজীর (স) সাথে দেখা করা যাবে না।
আর যখন তিনি নীরবে ধ্যানে বা ভাবনায় মগ্ন থাকতে চাইতেন তখন উসতোয়ানাত আল-তাহাজ্জুদ খুঁটির কাছে বসতেন। তখন কেউই তার কাছে যেত না, কেউ কোনোভাবেই বিরক্ত করত না। একাই তিনি নিজের ভুবনে ডুবে যেতেন।
মসজিদ প্রাঙ্গণের একপাশে একই কায়দায় নির্মিত হল মাটির ছোট ছোট একচালা ঘর। ওপরে খেজুর পাতার ছাউনি। নবীজীর পরিবারের সদস্যদের জন্যে। কিছুদিনের মধ্যেই সেখানে মক্কা থেকে এসে উঠলেন দ্বিতীয় স্ত্রী সওদা, কন্যা ফাতেমা ও উম্মে কুলসুম। তার কয়েকদিন পরেই ঘরে উঠলেন তৃতীয় স্ত্রী আয়েশা।
মসজিদকে কেন্দ্র করেই শুরু হলো আলোকিত মানুষ নির্মাণের কাজ। একটি উচ্ছৃঙ্খল অসহিষ্ণু স্বার্থান্ধ বর্বর জনগোষ্ঠীকে সুশৃঙ্খল সঙ্ঘবদ্ধ বিনয়ী সমমর্মী মানুষে রূপান্তরের কাজ। অপরিচ্ছন্ন-অজ্ঞদের পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন পরিশীলিত জ্ঞানী মানুষে উত্তরণের প্রক্রিয়া। মসজিদ প্রাঙ্গণে গড়ে উঠল একটু উঁচু একটি চত্বর। মোহাজির আনসারসহ আরবের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে আগত কৌতূহলী তরুণেরা দল বেঁধে অবস্থান করতে শুরু করল সেখানে। ঘরবাড়ি পরিবার থেকে বিচ্ছিন্ন, ব্যবসা বাণিজ্য ও দুনিয়ার সকল ধান্ধার ব্যাপারে নির্লিপ্ত এই তরুণদের ছিল একটাই লক্ষ্য-কীভাবে রসুলের জ্ঞানে জ্ঞানী হওয়া যায়।
এরা পরবর্তীকালে পরিচিতি লাভ করলেন আসহাবে সুফফা বা আহলে সুফফা নামে। কোরআন-হাদীসের দেমাগী ও ক্বালবি জ্ঞানে এরা হয়ে উঠলেন প্রাজ্ঞ। মোহাজিররা যখন বাজারে ব্যবসা নিয়ে ব্যস্ত থাকতেন, আনসাররা যখন ব্যস্ত থাকতেন কৃষিজ বাগান নিয়ে, তখনও এরা থাকতেন নবীজীর কাছে। তাঁর প্রতিটি বাণীকে আত্মস্থ করতেন পরম যত্নে। জ্ঞান অর্জনে নিজেদের পুরোপুরি নিবেদিত করায় এদের কোনো স্থায়ী আয় ছিল না। ক্ষুধার তীব্রতা সহ্য করতে না পেরে কেউ কেউ কাঠ কেটে বা পানি বহন করে খাবারের জন্যে কিছু উপার্জন করতেন।
অনেকে ক্ষুৎপিপাসায় কাতর হলেও চত্বর ছেড়ে যেতেন না, নবীজীর কোনো কথা শোনা থেকে বঞ্চিত হওয়ার আশঙ্কায়। আত্মসম্মানবোধের কারণে তারা কখনো কারো কাছে সাহায্য চাইতেনও না। নবীজী এদের ভরণপোষণের চেষ্টা করতেন উপহার হিসেবে প্রাপ্ত উপকরণ বা বায়তুল মাল থেকে, যা প্রথমদিকে ছিল একেবারেই অপ্রতুল। সাহাবীরাও অনেক সময় এদেরকে মেহমান হিসেবে বাসায় নিয়ে যেতেন খাওয়ানোর জন্যে। কোরআন হিফজ করার পাশাপাশি হাদীসের জ্ঞানে এরা গভীর পান্ডিত্য অর্জন করলেন।
আরবের বিভিন্ন প্রান্তে এদেরকেই পাঠানো হতো মানুষকে ধর্মীয় জ্ঞানে শিক্ষিত করার জন্যে। এরা বহু জায়গায় জ্ঞান বিতরণ করতে গিয়ে প্রতিপক্ষের হাতে শহিদ হয়েছেন। সুফফা হচ্ছে- রসুলের হাতে গড়া প্রথম জ্ঞানচর্চা প্রতিষ্ঠান। ইসলামী জ্ঞানের সংরক্ষণ ও তা ক্রমপ্রবহমান হওয়ার পেছনে আহলে সুফফারা পালন করেন অতুলনীয় ভূমিকা। এদের সংখ্যা সবসময়ই ওঠানামা করেছে। অনেকে দূরে প্রেরিত হয়েছেন। অনেকে বিয়ে করে সংসারী হয়েছেন। অনেকে শহিদ হয়েছেন। তারপরও পাঁচজন সর্বাধিক হাদীস বর্ণনাকারীর তিন জনই হচ্ছেন আহলে সুফফা। এরা হচ্ছেন আবু হুরায়রা, আবদুল্লাহ ইবনে ওমর এবং আবু সাঈদ খুদরী।
এ ছাড়াও শতাধিক আহলে সুফফার মধ্যে রয়েছেন বেলাল ইবনে রাবাহ, আবু যর গিফারী, সাকীফ ইবনে আমর, সাওবান, জারহাদ ইবনে খুয়াইলিদ আল আসলামী, হুজাইফা ইবনে আল ইয়ামন, হারিসা ইবনে আন-নুমান, হানযালা ইবনে আবি আমির আর রাহীব, খাব্বাব ইবনে আল-আরাত, খুরাইম ইবনে ফাতিক আল আসাদী, খুবাইব ইবনে ইয়াসাফ ইবনে উতবা, যুল বুজাদাইন, জায়েদ ইবনে আল খাত্তাব, সালমান ফারসি, সাদ ইবনে আবি ওয়াক্কাস, সালিম, সালিম ইবনে উবাইদ, সালিম ইবনে উমাইর, শুহাইব ইবনে সিনান, আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ, আবদুল্লাহ ইবনে উম্মে মাখতুম, আবদুল্লাহ ইবনে আমর, উকবা ইবনে আমির আল জুহানী, কাব ইবনে মালিক।
আসহাবে সুফফারা বিশ্বাস করতেন কোরআনের সুস্পষ্ট ঘোষণা: ‘(মহা বিচার দিবসে) কেউ কারো পাপের বোঝা বইবে না। কারো পাপের বোঝা ভারী হলে, সেই বোঝা বহন করার জন্যে কাউকে ডাকলেও সে এগিয়ে আসবে না, এমনকি কোনো নিকটাত্মীয়ও না। হে নবী! তুমি শুধু তাদেরকে সতর্ক করতে পারো, যারা না দেখেও প্রতিপালক সম্পর্কে সচেতন থাকে এবং নামাজ কায়েম করে। যে ব্যক্তি নিজেকে পরিশুদ্ধ করে, সে তা করে নিজের কল্যাণের জন্যে। আল্লাহর কাছেই সবাইকে ফিরে যেতে হবে।’ (সূরা ফাতির : ১৮)
ঘর গোছানোর শুরুতেই তরুণদের একটা আগ্রহী অংশকে জ্ঞানের জন্যে ধর্মের জন্যে নিজেদের উৎসর্গ করার সুযোগ প্রদান নবীজীর একটি দূরপ্রসারী সিদ্ধান্ত। আত্মশুদ্ধি ও আলোকিত মানুষ নির্মাণে নামাজের গুরুত্বের কারণে জোহর, আসর ও এশার ফরজ নামাজ চার রাকাতে উন্নীত করার নির্দেশ এলো। মেরাজে পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ ফরজ হওয়ার পর থেকে জোহর, আসর ও এশার নামাজ দুই রাকাত করে আদায় করা হতো।
নামাজের গুরুত্ব সম্পর্কে পরিষ্কারভাবে বলা হলো: ‘হে নবী! তোমার ওপর নাজিলকৃত কিতাবের বাণী সবার কাছে পৌঁছে দাও। নামাজ কায়েম করো। মনে রেখো, নিশ্চয়ই নামাজ মানুষকে অন্যায় ও অশ্লীলতা থেকে রক্ষা করে। নিশ্চয়ই আল্লাহর স্মরণ (জিকির) সবচেয়ে ভালো কাজ। তোমাদের সকল কাজ সম্পর্কেই আল্লাহ জানেন। (সূরা আনকাবুত : ৪৫)
‘এরপর নামাজ শেষ করে দাঁড়িয়ে, বসে বা শুয়ে আল্লাহকে স্মরণ করবে। যখন পারিপার্শ্বিক নিরাপত্তা লাভ করবে তখন যথাযথভাবে নামাজ কায়েম করবে। নির্ধারিত সময়ে নামাজ কায়েম করা বিশ্বাসীদের জন্যে ফরজ। (সূরা নিসা : ১০৩)
‘তোমরা সবর ও নামাজের মাধ্যমে সাহায্য প্রার্থনা করো। নিশ্চয়ই বিনয়াবনতরা ছাড়া অন্যদের জন্যে নামাজ কঠিন কাজ। অবশ্য যারা বিশ্বাস করে যে, জবাবদিহিতার জন্যে তাদেরকে মহান প্রতিপালকের মুখোমুখি হতে হবে এবং তাঁর কাছেই তারা ফিরে যাবে, তারাই বিনয়াবনত হতে পারে। (সূরা বাকারা : ৪৫-৪৬)
মুহাম্মদ পরিষ্কার বুঝতে পেরেছিলেন সমাজকে বদলাতে হলে শুধু বাইরের আচরণ বদলালে হবে না। প্রতিটি মানুষকে বদলাতে হবে ভেতর থেকে। আর ভেতর থেকে বদলানোর জন্যেই তিনি নামাজকে এত গুরুত্ব দিয়েছেন। মসজিদে এসে জামাতে নামাজ আদায় আবশ্যিক করার মধ্য দিয়ে তিনি তাদের সঙ্ঘবদ্ধ করেছেন নতুন জীবনদৃষ্টিতে।
প্রথমত তারা মসজিদে সমবেত হচ্ছে নিজেকে সমর্পণের জন্যে। আন্তরিক সেজদা দিনে পাঁচ বার স্মরণ করিয়ে দিচ্ছে তাদের অবস্থান। নামাজ তার দৈনন্দিন ব্যবসা বা উপার্জনের কাজে স্বাভাবিক বিরতি সৃষ্টি করছে। মনে করিয়ে দিচ্ছে তার প্রথম কর্তব্য বা পছন্দ কী। আত্মগর্বী বা দাম্ভিক কোনো মানুষের পক্ষে দাসের মতো ভূমিতে মস্তক নত করা সবচেয়ে বিরক্তিকর কাজ। অনেক দাম্ভিক কোরাইশের ইসলাম সম্পর্কে প্রাথমিক আপত্তির কারণই ছিল এই সেজদা।
আর জামাতে নামাজ আদায়ের জন্যে সাদা-কালো, দাস-অভিজাত নির্বিশেষে সারিবদ্ধভাবে দাঁড়ানো, একসাথে রুকু-সেজদা দেয়ার মধ্য দিয়ে ‘আমি’ত্বের বিনাশ যেমন ঘটে, তেমনি বিনাশ ঘটে আভিজাত্যবোধের। সেই সাথে তা হয়ে ওঠে উম্মাহর ঐক্যের প্রতীকী প্রকাশ। আসলে একজন বিশ্বাসী সমর্পিত নারী বা পুরুষ সে-ই, যে নিজেকে আল্লাহর দাস ভাবতে গর্ববোধ করে। আর নিয়মিত নামাজ ভেতর থেকেই এ অনুভূতিকে জাগ্রত করে। এ জন্যে মদিনায় পৌঁছেই নামাজ কায়েমের ওপর নবীজী সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দিয়েছেন।
ঘর গোছানোর লক্ষ্যে মসজিদ নির্মাণ শুরুর সাথে সাথে তিনি মৌলিক একটি কাজে হাত দিলেন-মদিনার মুসলমানদের আদমশুমারি। আনসার ও মোহাজিরসহ সকল মুসলমানের নাম বয়স ও লিঙ্গ অনুসারে লিপিবদ্ধ করতে নির্দেশ দিলেন হুজাইফাকে। হুজাইফা ঘরে ঘরে গিয়ে ১৫০০ মুসলমানের নাম লিপিবদ্ধ করলেন। সকল কর্মক্ষম পুরুষের করলেন আলাদা তালিকা। আত্মরক্ষা ও যে-কোনো সংগ্রামে অংশগ্রহণে আগ্রহীদের নিয়ে তৈরি করা হলো বিশেষ তালিকা। অসম সামাজিক ও অসম সাংস্কৃতিক দুটি ধারাকে মেলানোর দুরহ কাজ!
মদিনার তখন সবচেয়ে বড় বাস্তব সমস্যা শরণার্থী। গ্রামীণ ধাঁচের একটি জনপদ। তাও কৃষিকেন্দ্রিক। কিছুটা মাতৃতান্ত্রিক। পরিবারে নারীর কর্তৃত্ব রয়েছে যথেষ্ট। আউস ও খাজরাজরা মূলত নিরক্ষর, অনেকটা গেঁয়ো। আর শরণার্থীরা ব্যবসা ও রমরমা তীর্থকেন্দ্র মক্কার অধিবাসী। শহুরে সংস্কৃতিতে অভ্যস্ত। সবাই শিক্ষিত ও কেতাদুরস্ত। কৃষির কিছুই তারা বোঝে না। ব্যবসা তাদের জীবিকা। মক্কার পুরুষশাসিত সমাজে নারীর কোনো অবস্থান নেই।
সামাজিক ও সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে দুই বিপরীতমুখী ধারা ঘটনাচক্রে মিলিত হয়েছে। শরণার্থীরা এসেছে সবকিছু হারিয়ে। একেবারে শূন্য হাতে। এদের সবাইকে মেশাতে হবে একধারায়, স্থানীয়দের দান-দক্ষিণায় বেঁচে থেকে বেড়ে ওঠা পরজীবীর মতো নয়। সমস্যা এত জটিল! কিন্তু নবীজী এর সমাধান করলেন একেবারে অভিনব পন্থায়। তিনি বুঝলেন, এক স্থায়ী ভ্রাতৃবন্ধন সৃষ্টির মাধ্যমেই এ সমস্যার সমাধান হতে পারে। তিনি আনাসের বাড়িতে এক ভ্রাতৃ-সম্মেলন আহ্বান করলেন। সেখানে প্রথম দফায় ৪০ জন স্থানীয় ৪০ জন শরণার্থীকে তাদের পরিবারের সদস্য হিসেবে গ্রহণ করলেন। দুটো পরিবার একত্র হয়ে একটি পরিবারে রূপান্তরিত হলো। কেউ সাহায্যদাতা বা সাহায্যগ্রহীতা থাকল না।
এক পরিবারের দুজন ও অপর পরিবারের দুজন মিলে চার সদস্যের এক পরিবারে রূপান্তরিত হলো। ফলে পরিবার বড় হলো। কাজ ও উপার্জন বেড়ে গেল। পরিবারে শরণার্থী গ্রহণকারীরা অভিহিত হলেন ‘আনসার’ নামে। আর শরণার্থীরা অভিহিত হলেন ‘মোহাজির’ নামে। ক্রমান্বয়ে ১৮৬টি শরণার্থী পরিবার মিশে গেল মদিনার সমসংখ্যক পরিবারের সাথে।
আনসাররা নিজের বাড়িঘর ধনসম্পত্তি সমভাবে বণ্টন করে ভ্রাতৃত্ব ও মমত্বের অসাধারণ নজির স্থাপন করলেন। আনসার ও মোহাজিরদের মধ্যে স্থায়ী ভ্রাতৃত্ববন্ধনে আন্তরিকতা ও আবেগের অভূতপূর্ব প্রকাশ ঘটল; যা এর আগে কোনো সমাজে কখনো ঘটেনি। রক্তীয় ও গোত্রীয় বন্ধনের চেয়েও আত্মিক বন্ধন মনোজগতে কী অভাবনীয় পরিবর্তন এনেছিল তা একটি ছোট ঘটনা থেকে বোঝা যায়।
মোহাজির আবদুর রহমান ইবনে আউফ-এর আনসার ভাই সাদ ইবনে আল রাবী। সাদ অনুভব করলেন তার ভাইকে মদিনায় নিজের বাড়ির মতো থাকতে দিতে হবে। তিনি আবদুর রহমানকে বললেন, ‘আল্লাহর শোকর। আল্লাহ আমাকে পর্যাপ্ত দিয়েছেন। আমি সিদ্ধান্ত নিয়েছি তোমার সাথে আমার সকল কিছু সমভাবে ভাগ করে নেব। আমার স্ত্রীও দুজন। আমাকে বলো তুমি কাকে পছন্দ করবে? তাকে আমি তালাক দেবো, যাতে তুমি তাকে বিয়ে করতে পারো।’
আবদুর রহমান তার প্রস্তাবে অভিভূত হয়ে পড়লেন। তবে তিনি তার আনসার ভাইয়ের কাছ থেকে কিছু নিতে অস্বীকৃতি জানালেন। তিনি শুধু বললেন, আমাকে বাজারে একটু জায়গার ব্যবস্থা করে দিলেই হবে। সেখানে তিনি ছোটখাটো ব্যবসা শুরু করলেন। ব্যবসা বিস্তার লাভ করল। অল্প কিছুদিনের মধ্যেই সম্মানজনক দেনমোহর দিয়ে তিনি এক আনসার মহিলাকে বিয়ে করলেন।
আনসারদের এই সমমর্মিতা এত প্রবল ছিল যে, মোহাজিররা একদিন নবীজীকে বলল, ‘আমাদের মেজবানদের মতো এত সমমর্মী মানুষ আমরা দেখি নি। উপকরণ সীমিত থাকলে সমবেদনায় তারা প্রবল আর উপকরণ পর্যাপ্ত থাকলে তারা দানে মহা উদার। আমাদেরকে সকল প্রকার কষ্ট থেকে দূরে রাখে আর তাদের আরাম-আয়েশের সবটুকুতেই অংশীদার করে। আমাদের মনে হয় তারা আল্লাহর কাছ থেকে সবটুকু পুরস্কার নিয়ে নেবে। আমরা খুব অল্পই পাব।’
নবীজী বললেন, ‘তোমরা যদি তাদের প্রতি সত্যিকার কৃতজ্ঞ থাকো ও তাদের জন্যে আন্তরিক দোয়া করো, তাহলে তোমরাও সমান পুরস্কার পাবে।’ যা হতে পারত ক্রমাগত বিবদমান পাশাপাশি অবস্থানকারী দুটি সমাজ, তা-ই পরিণত হলো একক আত্মিক সমাজে। সাধারণভাবে শরণার্থী ও ভূমিপুত্র বলে আলাদা কিছু থাকল না। থাকল শুধু সমমর্মিতা।
৬২৩-৬২৪ : বিশ্বের প্রথম মানবাধিকার সনদ: নবীজীর আগমনের আগে মদিনায় কোনো কেন্দ্রীয় কর্তৃত্বের অস্তিত্ব ছিল না। ৩০টি গোত্র এই এলাকায় স্বাধীনভাবে বসবাস করত। পরিণামে রেষারেষি শত্রুতা দাঙ্গা-ফ্যাসাদ ছিল নিত্যনৈমিত্তিক ঘটনা। নবীজী এই শূন্যতা পূরণের উদ্যোগ নিলেন। তিনি মুসলমান, পৌত্তলিক ও ইহুদিসহ সকল গোত্রের কাছে প্রতিনিধি দল পাঠালেন। তারা বহিঃশত্রুর আক্রমণ থেকে পারস্পরিক সুরক্ষা, অর্থনৈতিক ও সামাজিক উন্নয়নে পারস্পরিক সহযোগিতার জন্যে নবীজীর দেয়া প্রস্তাবে দৃশ্যত ইতিবাচক সাড়া দিল। একটি সত্যিকার কল্যাণরাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার নিমিত্তে তখন তিনি বিশ্বের প্রথম মানবাধিকার সনদ প্রণয়ন করলেন।
‘মদিনা সনদ’ নামে পরিচিত এই সনদে মুসলমান, খ্রিষ্টান, ইহুদি ও পৌত্তলিক আরব সবাইকে নিজ নিজ ধর্মপালনের স্বাধীনতা এবং নারী-পুরুষ, অভিজাত-দাস নির্বিশেষে প্রতিটি মানুষের মৌলিক মানবিক ও নাগরিক অধিকারের নিশ্চয়তা প্রদান করা হলো।
মদিনা আক্রান্ত হলে দেশরক্ষায় প্রত্যেকপক্ষই নিজ নিজ দায়িত্ব পালন করবে। একপক্ষের সাথে অন্য কোনো পক্ষের কোনো বিষয়ে মতবিরোধ সৃষ্টি হলে মুহাম্মদ একক সালিশের দায়িত্ব পালন করবেন। ইহুদি, পৌত্তলিক গোত্রসহ সবপক্ষই এই চুক্তিতে স্বাক্ষর করল। এই চুক্তি বাস্তবায়নের মধ্য দিয়ে নবীজী (স) সার্বজনীন মানবাধিকারের প্রথম সার্থক রূপকারের মর্যাদা লাভ করলেন এবং কার্যত মদিনার কেন্দ্রীয় কর্তৃত্বে বিরাজমান শূন্যতা পূরণের পথে একধাপ এগিয়ে গেলেন।
নবীজী মদিনায় আসার আগে শহরের কোনো সীমানা নির্দিষ্ট ছিল না। তিনি কাব ইবনে মালিককে নির্দেশ দিলেন মদিনার চারপাশের পাহাড়ে সীমানা পিলার স্থাপন করার। কাব নির্দেশ অনুসারে পাহাড়ে পাহাড়ে সীমানা পিলার স্থাপন করলেন। মদিনার সীমান্ত চিহ্নিত করলেন। নিঃসন্দেহে মদিনা প্রতিরক্ষার প্রথম পদক্ষেপ হচ্ছে এই সীমান্ত চিহ্নিতকরণ। নাগরিক শান্তি ও নিরাপত্তা রক্ষার জন্যে মদিনায় পুলিশ বাহিনী গঠন করা হলো। কায়েস ইবনে আস-এর অধীনে এই বাহিনী কাজ শুরু করল প্রথম হিজরির মধ্যভাগে।
মদিনা ও তার চারপাশে বেদুইন গোত্রগুলোর মধ্যে ইসলাম সম্পর্কে ব্যাপক কৌতূহল সৃষ্টি হলো। বর্ণবাদ, অভিজাততন্ত্র, অবিচার, অসহিষ্ণুতা ও নিষ্ঠুরতার বিপক্ষে সামাজিক সাম্য ও সুবিচারের বাণী, দয়া ও সমমর্মিতার বাণী মরুভূমির সর্বহারা বঞ্চিত তরুণদের বিশেষভাবে উজ্জীবিত করল। এক এক করে দূরদূরান্ত থেকে তারা ইসলামের ছায়াতলে আসতে শুরু করল। এসময় বিশিষ্ট ব্যক্তিদের মধ্যে ইহুদি ধর্মযাজক আবদুল্লাহ ইবনে সালাম, খ্রিষ্টান দরবেশ আবু কায়েস সারহা ইসলাম গ্রহণ করলেন।
তরবারি বহন করা ছিল আরব ঐতিহ্য। কিন্তু নবীজী মদিনায় নিরাপত্তা নিশ্চিত করার উদ্যোগ নেয়ার আগে কখনো তরবারি বহন করেন নি। মদিনার সুরক্ষা ও নাগরিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করার লক্ষ্যে প্রথমেই প্রয়োজন দক্ষ লোকবল। কারণ কোরাইশরা তাঁকে ধরতে বা হত্যা করতে না পেরে ক্রোধে তখনো হায়েনার মতো ফুঁসছিল। পাশাপাশি আবদুল্লাহ ইবনে উবাই-এর নেতৃত্বে মুনাফেকরা ভেতর থেকে অসন্তোষ ও সংঘাত সৃষ্টিতে তৎপর হয়ে উঠল। আউস ও খাজরাজদের ওপর ইহুদি প্রভাব কমে যাওয়ায় নবীজীর ব্যাপারে ইহুদিদের মধ্যেও অস্থিরতা বাড়তে লাগল। আর চারপাশের জাহেলিয়াতে নিমজ্জিত আরব গোত্রপতিরা এই নতুন ধর্মের মধ্যে দেখতে পাচ্ছিল তাদের আভিজাত্যবাদের বিনাশ। তাই এরাও কোরাইশ, ইহুদি, মুনাফেক চক্রের সাথে মিশে গেল।
তখনকার মদিনার মনোজাগতিক অবস্থার চমৎকার বিশ্লেষণ পাওয়া যায় সূরা বাকারায়। তখন নাজিল হওয়া এই সূরায় পুরো পরিস্থিতি সম্পর্কেই সতর্ক করে দেয়া হয়।
‘আলিফ-লাম-মীম। এ সেই কিতাব, যাতে কোনো সন্দেহ নেই। এই কিতাব আল্লাহ-সচেতনদের পথপ্রদর্শক। আল্লাহ-সচেতনরা গায়েবে (মানুষের সীমাবদ্ধ জ্ঞানে বোধগম্য না হওয়া সত্ত্বেও অদৃশ্য বাস্তবতায়) বিশ্বাস করে, নামাজ কায়েম করে, প্রাপ্ত রিজিক থেকে অন্যের জন্যে ব্যয় করে (অর্থাৎ নিয়মিত দান করে)। আর (হে নবী!) তোমার ও তোমার পূর্ববর্তীদের প্রতি যা নাজিল হয়েছে তা তারা বিশ্বাস করে। সেইসাথে বিশ্বাস করে আখেরাতে (প্রতিটি কাজের জবাবদিহিতায়)। তারাই তাদের প্রতিপালকের নির্দেশিত সঠিক পথের অনুসারী এবং তারাই সফলকাম।’ (সূরা বাকারা : ১-৫)
‘আবার কিছু মানুষ মুখে বলে, আমরা আল্লাহ ও আখেরাতে বিশ্বাসী। কিন্তু ওরা আদৌ বিশ্বাসী নয়। ওরা আল্লাহ ও বিশ্বাসীদের ঠকাতে চায়। আসলে ওরা নিজেদেরই ঠকাচ্ছে, যদিও ওরা তা বোঝে না। ওদের অন্তর রোগগ্রস্ত কলুষিত আর আল্লাহ ওদের এই রোগ ক্রমান্বয়ে জটিল হতে দেন। ক্রমাগত মিথ্যাচার (ও ভন্ডামির) পরিণামে ওদের জন্যেও অপেক্ষা করছে কঠিন শাস্তি।’ (সূরা বাকারা : ৮-১০)
‘বিশ্বাসীদের কাছে এলে এই বিভ্রান্তরা বলে, ‘আমরা তো (তোমাদের মতোই) বিশ্বাসী।’ আবার যখন দুরাচারীদের কাছে যায় তখন বলে, ‘আসলে আমরা তো তোমাদের সাথেই রয়েছি। বিশ্বাসীদের সাথে আমরা তো শুধু তামাশা করি।’ (সূরা বাকারা : ১৪)
‘সুস্পষ্টভাবে সত্য সম্পর্কে অবহিত হওয়ার পরও স্বার্থপরতা ও ঈর্ষার কারণে কিতাবিদের মধ্যে অনেকেই তোমাদেরকে বিশ্বাস থেকে বিচ্যুত করে সত্য অস্বীকারকারীরূপে ফিরে পেতে চায়। তোমরা ওদের ক্ষমা করো ও উপেক্ষা করো, যতক্ষণ পর্যন্ত না আল্লাহ এ বিষয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত দেন। নিশ্চয়ই আল্লাহ সর্ববিষয়ে সর্বশক্তিমান।’ (সূরা বাকারা : ১০৯)
নবীজীকে পরিষ্কার নির্দেশনা দেয়া হয়, শুধু মুশরিক মুনাফিকদের ব্যাপারেই নয়, নব্য রাজনৈতিক মিত্র ইহুদিদের ব্যাপারেও সতর্ক থাকতে হবে। নবীজীর প্রজ্ঞা তাঁকে বলে দিল কী করতে হবে। আত্মিক পরিশুদ্ধির প্রক্রিয়াকে সুবিন্যস্ত করতে হলে, কল্যাণরাষ্ট্রকে বাঁচাতে হলে, সমাজ বিপ্লবকে এগিয়ে নিতে হলে মুসলমানদের শক্তিকে সংহত করতে হবে। প্রয়োজন নতুন রণকৌশল। নতুন স্বেচ্ছাসেবী জনযোদ্ধার সুসংহত বাহিনী।
তিনি ইতিহাসে প্রথমবারের মতো উদ্ভাবন ও প্রয়োগ করলেন অহিংস রণকৌশল। প্রতিপক্ষকে মনস্তাত্ত্বিকভাবে অসহায়, ভীত, দ্বিধাগ্রস্ত ও কিংকর্তব্যবিমূঢ় করে ন্যূনতম রক্তপাত ও সমঝোতার মাধ্যমে বিজয় নিশ্চিত করাই এই রণকৌশলের বিশেষত্ব। আরবের ইতিহাসে প্রথমবারের মতো তিনি একক কমান্ডের অধীনে সব গোত্রের লোকদের একত্র করে স্বেচ্ছাসেবী জনযোদ্ধা দল গঠন এবং প্রশিক্ষণ দান শুরু করলেন।
এর আগে আরবে প্রত্যেক গোত্রই নিজ নিজ নেতৃত্বে বাহিনী নিয়ে উপস্থিত হতো। প্রত্যেক গোত্রই আলাদা কমান্ডে পরিচালিত হতো। বাহিনীর কোনো একক কমান্ড ছিল না। আনুগত্যের সবটাই ছিল গোত্রীয়। লক্ষ্য ছিল গোত্রীয় কর্তৃত্ব বা খুনের বদলে প্রতিপক্ষের কাউকে খুন করা এবং লুটপাট করা। যুদ্ধ ছিল ব্যক্তিগত বীরত্ব প্রকাশ করার আর গোত্রীয় শ্রেষ্ঠত্ব প্রতিষ্ঠার মাধ্যম। আর সবটাই নির্ভর করত ত্বরিৎ সাফল্যের ওপর।
হিজরি সপ্তম মাস থেকে শুরু হলো একক কমান্ডের অধীন জনযোদ্ধাদের টহল ও গেরিলা তৎপরতা। লক্ষ্য-চারপাশের পরিমন্ডল অর্থাৎ ভৌগোলিক অবস্থা, চলাচল পথ ও জনবসতির বিন্যাস-সম্পর্কিত জ্ঞানে সমৃদ্ধ হওয়া। একইসাথে বাণিজ্য চলাচল পথকে অনিরাপদ করে কোরাইশদের বিরুদ্ধে অর্থনৈতিক অবরোধ গড়ে তোলা। কারণ বাণিজ্যপথের নিরাপত্তার ওপরই নির্ভরশীল ছিল কোরাইশদের অর্থনীতি।
হামজার নেতৃত্বে প্রথম ৩০ জনের দল সাইফুল বাহার পর্যন্ত, পরের মাসে ওবায়দা ইবনে হারেসের নেতৃত্বে ৮০ জনের দল রাবেগ পর্যন্ত, এর পরের মাসে সাদ ইবনে আবি ওয়াক্কাসের নেতৃত্বে ২৫ জনের দল খররর পর্যন্ত টহল দেয়। নবীজী স্বয়ং প্রথম হিজরির দ্বাদশ মাসে ৮০ জনের দল নিয়ে টহল দিলেন ওয়াদ্দান পর্যন্ত। এই অভিযাত্রায় বনু দামরার সাথে মৈত্রীচুক্তিও সম্পাদন করলেন।
এদিকে, নামাজের জন্যে আজান দেয়া শুরু হলো। আকাবার দ্বিতীয় বায়াতে অংশগ্রহণকারী আবদুল্লাহ ইবনে জায়েদ স্বপ্নে দেখেন যে, নামাজের জন্যে সবাইকে আজান দিয়ে ডাকা হচ্ছে। আজানের পুরো শব্দমালাই তিনি স্বপ্নে শোনেন। নবীজীকে বিষয়টি বললে তিনি তা সেভাবেই অনুমোদন করেন।
আজান বিশ্বাসীদের দিনে পাঁচ বার নামাজের কথা প্রকাশ্যে স্মরণ করাতে শুরু করল। আজান দেয়ার জন্যে ইসলামের প্রথম মুয়াজ্জিন হলেন হাবশি বেলাল। কোরআন ও হাদীসের জ্ঞানে যেমন তিনি পান্ডিত্য অর্জন করেছিলেন, একইভাবে ছিল তার সুললিত দরাজ কণ্ঠস্বর। ফলে তার তেলাওয়াত বা আজান ছিল চিত্তহারী। ধর্মানুরাগ, প্রজ্ঞা ও সদাচরণের জন্যে নবীজী তাকে কতটা ভালবাসতেন তা বোঝা যায় একটা ছোট্ট ঘটনা থেকে।
আবিসিনিয়ার রাজা নাজ্জাসী নবীজীকে তিনটি বল্লম উপহার পাঠিয়েছিলেন। তিনি এর একটি বল্লম দেন বেলালকে। বেলাল এই বল্লম দিয়ে নামাজের কেবলা ঠিক করতেন। নবীজীর সফরেও বেলাল থাকতেন সাথে সাথে। সফরে নামাজের আজানও তিনিই দিতেন। বেলালের জীবনের শ্রেষ্ঠ আজান ছিল কাবা ঘরের ছাদে উঠে দরাজ কণ্ঠে দেয়া আজান।
যদিও নবীজীর ওফাতের পর মদিনায় সময় কাটানো বেলালের কাছে খুব কষ্টকর হয়ে দাঁড়ায়। তিনি আবু বকরের কাছে সিরিয়ার জেহাদে যাওয়ার অনুমতি নিয়ে মদিনা ত্যাগ করেন। তিনি জীবনের বাকি সময় সিরিয়ায় কাটান। মদিনা থেকে যাওয়ার পর বেলাল শুধু দুবার আজান দেন। একবার খলিফা ওমরের জেরুজালেম সফরের সময়। বেলালের আজান শুনে সেখানে উপস্থিত সাহাবারা অঝোরে কাঁদতে শুরু করেন।
এর কিছুদিন পর বেলাল স্বপ্নে দেখেন নবীজী তাকে বলছেন, ‘বেলাল! তোমার কী হয়েছে? তুমি আমার সাথে দেখা করলে না!’ বেলাল মদিনায় এসে নবীজীর রওজা মোবারকে কাঁদতে কাঁদতে মুখ ঘষতে লাগলেন। ওখানে নবীজীর নাতি হাসান-হোসেনকে দেখে দৌড়ে তাদের বুকে জড়িয়ে ধরেন। তাদের অনুরোধে বেলাল মসজিদে নববীতে আজান দেন। আজান দিতে গিয়ে তিনি কান্নায় ভেঙে পড়েন। চোখে পানির ধারা নামে। বেলালের আজান শুনে চারদিক থেকে লোকজন মসজিদে নববীর দিকে ছুটে আসে। নবীজীর স্মৃতিকে মনে করে সবাই কাঁদতে থাকে। এটাই বেলালের শেষ আজান।
এরপর তিনি সিরিয়ায় ফিরে যান। শেষ জীবন সেখানেই কাটান। ১৮ হিজরিতে তিনি মারা যান। মৃত্যুশয্যায় তার স্ত্রী হিন্দ কেঁদে কেঁদে বলছিলেন, ‘ওয়া হাজানা’ (কী কষ্টের!)। জবাবে বেলাল বললেন, ‘ওয়া তারাবা’ (কী আনন্দের!)। আগামীকাল আমি আমার প্রিয় নবী ও তাঁর সঙ্গীদের সাথে মিলিত হবো।’
ইসলাম সাবেক ক্রীতদাস বেলালের সামাজিক মর্যাদা কতটা সুউচ্চ করেছিল তা বোঝা যায়, খলিফা হওয়ার পরও লৌহমানব অভিজাত ওমর তাকে সম্বোধন করতেন ‘সাইয়্যেদেনা’ (আমাদের নেতা) বলে।
এনএস/