ঢাকা, রবিবার   ২৯ ডিসেম্বর ২০২৪

‘শেখ হাসিনা নিজ হাতে ট্রে নিয়ে ঢুকলেন’

একুশে টেলিভিশন

প্রকাশিত : ১৬:৪৫, ২৮ সেপ্টেম্বর ২০১৮ | আপডেট: ১৯:১৪, ২৯ সেপ্টেম্বর ২০১৮

আমার স্নেহভাজন শেখ হাসিনার জন্মদিনে প্রাণঢালা শুভেচ্ছা জানাচ্ছি। শেখ হাসিনার পরিবারের সঙ্গে আমাদের পরিবারের দীর্ঘদিনের সম্পর্ক। আমার বাবা মোস্তাফিজুর রহমান খানকে (এদেশে বীমা জগতের পথিকৃৎ) বঙ্গবন্ধু `বড় ভাই` বলে ডাকতেন।

একটা মহান মুক্তিযুদ্ধের ভেতর দিয়ে বাংলাদেশের জন্ম। এই মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় যেন বাংলাদেশ দাঁড়াতে না পারে সে কারণে সপরিবারে বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করা হয়েছে। খুনিরা শুধু সেখানেই থেমে থাকেনি। ৭৫- এর পুণরাবৃত্তি ঘটানোর জন্য ২০০৪ সালের ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলার ঘটনা ঘটানো হয়েছে।

আমি এখনো প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে `তুমি` করে বলি। তিনি এখনো আমাকে `মাহফুযা আপা` বলে ডাকেন। আমরা আমাদের সময়ে মধ্য মধ্যবিত্ত পরিবার ও নিম্ন মধ্যবিত্ত পরিবার থেকে উঠে এসেছিলাম। এই মধ্যবিত্ত ও নিম্ন মধ্যবিত্ত পরিবারে কিছু মূল্যবোধ ছিল। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তার পরিবার থেকে সেই মূল্যবোধ পেয়েছেন এবং এখনো তা তার আচরণে পরিলক্ষিত হয়।

শেখ হাসিনা তিন তিনবারের প্রধানমন্ত্রী। অথচ দেখেন, তার আচরণ, পোষাকে যথেষ্ট সাধারণ জীবন যাপন করেন তিনি। শেখ হাসিনা এখন শুধু আওয়ামী লীগের সভানেত্রী বা বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীই নন, বরং আন্তর্জাতিক অঙ্গনে তিনি একজন প্রতিষ্ঠিত পলিসি মেকার।

একের পর এক স্বীকৃতি ও সম্মাননা পাওয়ার মধ্য দিয়ে তাই প্রমাণিত হয়। এই স্বীকৃতি  সম্মাননা অর্জন শুধু তার ব্যক্তিগত গৌরব নয় বরং জাতিগতভাবে আমাদেরই অর্জন।

কবি নির্মলেন্দু গুণ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে একটা চিঠি লিখেছিলেন কিছু ছবি চেয়ে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তার উত্তরে লিখেছিলেন, আমি গরীব লোককে কাপড় দিচ্ছি, সাহায্য দিচ্ছি এমন ছবি ছেপোনা। এটা আমার জন্য বিব্রতকর। এজন্য বিব্রতকর, আমি যে টাকাটা তাদের দিচ্ছি সেই টাকায় তাদের হক ছিল। হকটাই পূরণ করছি মাত্র। এ থেকে বুঝা যায়, তার মনোজগত কত বিশাল।

প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে যারা দেখা করতে যায়, তাদেরকে সে যেভাবে জড়িয়ে ধরে তা কিন্তু লোক দেখানো নয়। বরং এটা তার জীবনাচরন, বোধ, আদর্শ ও দর্শন।

জিয়াউর রহমান ক্ষমতা দখল করার পর সংবিধান কাটাছেঁড়া করেছিল। `ধর্মনিরপেক্ষতা ` উঠিয়ে দিয়েছিল। মুক্তিযুদ্ধে মুসলমান, হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিস্টান সবাই জাতি ধর্ম নির্বিশেষে অংশগ্রহণ করেছিল বলেই তার স্বীকৃতি সরূপ `ধর্মনিরপেক্ষতা` সংবিধানে সংযোজন করা হয়েছিল। জিয়াউর রহমান সার্বজনীন অধিকারকে বুটের তলায় পিষ্ট করেছিল। গোলাম আযমের মতো কুখ্যাত নাগরিককে নাগরিকত্ব দিয়েছিল। অর্থাৎ পুরো বাংলাদেশটাই মুক্তিযুদ্ধের আদর্শের বিপক্ষে হাঁটছিল। কিন্তু ১৯৯৬ সালে শেখ হাসিনা প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব নেওয়ার পর তাকে আবার মুক্তিযুদ্ধের আদর্শের পথে বাংলাদেশকে হাঁটানোর জন্য লড়াই শুরু করতে হয়।

 

২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ যখন সরকার গঠন প্রক্রিয়া শুরু করে তখন আমরা ভিয়েতনামে আমার মেয়ের কাছে। সেখানে একটা মেসেজ গেল। মেসেজ পেয়ে আমরা এলাম। এরপর ব্যারিস্টার শফিক সাহেব (মাহফুজা খানমের স্বামী) সুধাসদনে গেলেন। সেখানে শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানা ছিলেন।

শেখ হাসিনা শফিক সাহেবকে  `মুরুব্বী` ডাকেন। বললেন, `মুরুব্বী রেহানা আপনার সঙ্গে কথা বলবে`। এটা বলে তিনি ভেতরে চলে গেলেন। রেহানা বললেন, `মুরুব্বী আপনাকে আইন, বিচার ও সংসদ বিষয়ক মন্ত্রনালয়ের দায়িত্ব নিতে হবে।`

শফিক সাহেব বললেন, `আমি একটু ভেবে দেখি। আমার ছেলে মেয়ে ও স্ত্রীর সঙ্গে আলাপ করি`। এই আলাপের মধ্যেই শেখ হাসিনা নিজ হাতে ট্রে নিয়ে ঢুকলেন। এটা তার ব্যতিক্রম গুণ। নিজের হাতে চা নিয়ে আসে। দেখা গেল পানি নেই বা চামচ নেই। দৌড়ে গিয়ে নিজের হাতে চামচ নিয়ে আসবে, চিনি নিয়ে আসবে, পানি নিয়ে আসবে। একজন প্রধানমন্ত্রী হয়েও এই আচরণগুলোর মধ্য দিয়ে তিনি অন্য অনেককে ছাড়িয়ে যান।

যাক, আগের কথায় ফিরি। শফিক সাহেবকে মন্ত্রীত্ব নিতে বলা হয়েছে এমন খবরে আমার বাবার বাড়ি থেকে আপত্তি আসল। সবাই বলল, এসব ঝামেলায় যাওয়ার দরকার কী? শফিক সাহেবের ভাইরাও বলল, এসব করার দরকার নাই।

সবাই যখন আপত্তি করছেন তখন আমার বড় ছেলে রাতে তার বাবার সঙ্গে বসল। বলল, বাবা তুমি কী পতাকাওয়ালা গাড়িতে চড়ার জন্য মন্ত্রী হতে চাচ্ছ? এমন প্রশ্নে শফিক সাহেব চুপ করে থাকলেন। আমার ছেলে আবার বললেন, বাবা এটাও সত্য কথা যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবিতে তুমি সব সময় সোচ্চার। বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচারের দাবিতে তুমি সব ফোরামে বলছ। (শফিক সাহেব তখন গণতান্ত্রিক আইনজীবী সমিতির প্রেসিডেন্ট। সেই হিসেবে বিশ্বের বিভিন্ন প্ল্যাটফর্মে তিনি কথাগুলো বলার সুযোগ পাচ্ছেন।)  আমার ছেলে বলল, বাবা তুমি যদি যুদ্ধাপরাধীদের বিচার, বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচার নিয়ে কাজ করতে পার তবে তুমি যাও। হ্যাঁ এটাও জেনে রেখ, এটা খুব কঠিন। অনেক বড় ঝুঁকি তুমি নিচ্ছ। কোনো ভালো কাজের জন্য যদি আমরা আমাদের বাবাকে হারাই তাহলেও আমাদের একটা সান্ত্বনা থাকবে। কিন্তু যদি করতে না পার তাহলে আমরা দুই ভাই তোমাকে ক্ষমা করব না।

পরের দিন সকালে নাস্তা খেতে বসে শফিক সাহেব বললেন, তোমরা যেহেতু চাচ্ছ না সেহেতু আমি রেহানাকে `না` বলে দিই। কিন্তু তিনি ওইদিন যখন কোর্টে গেলেন, তখন দেখলেন সারাদেশ থেকে প্রচুর আইনজীবী বাসে করে করে আসছে। দুপুর দু`টার দিকে শফিক সাহেব ফোনে আমাকে জানালেন, `আমি ঘেরাও হয়ে আছি`। আইনজীবীরা আমাকে মন্ত্রিত্ব নেওয়ার জন্য চাপ দিচ্ছে।িআমি তখন বললাম, গতরাতে তোমার ছেলে তোমাকে যে কথা বলেছে, অর্থাৎ তুমি যদি পার তাহলে তুমি যাও।

শফিক সাহেব পাঁচ বছর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কেবিনেটে কাজ করেছেন। সৎ মানুষের সঙ্গে কাজ করার একটা মজা আছে। তৃপ্তি আছে। আমি গর্ব করি, দেশের গুরুত্বপূর্ণ সময়ে আমার স্বামী শেখ হাসিনার সঙ্গে কাজ করার সুযোগ পেয়েছেন। দু’জনেই নীতিতে অটল থাকা মানুষ। সত্যি কথা হচ্ছে এই সময়ে আমরা আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছি। শফিক সাহেব অন্য সময়ে প্রতিদিন চেম্বারে বসলে যা আয় হয়, মন্ত্রীত্ব করতে গিয়ে সারা মাসেও তা আয় করতে পারেন নি।

যুদ্ধাপরাধীদের বিচার কাজ সম্পন্ন করা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার অন্যতম সফলতা। আইনের নিজস্ব গতিতে সেই বিচার কাজ সম্পন্ন হয়েছে। আসামীরা উচ্চ আদালতে যাওয়ার সুযোগ পেয়েছে। পৃথিবীর অন্য কোন ট্রাইব্যুনালে এই সুযোগ নাই। শুধু বাংলাদেশেই এই সুযোগ আছে। এই আইন তৈরীতে ব্যারিস্টার শফিক আহমেদ কাজ করেছেন।

যুদ্ধাপরাধীদের বিচার করতে গিয়ে তাকে প্রচুর বিরোধিতার মুখোমুখি হতে হয়েছে। যেহেতু তখন আমার স্বামী ব্যারিস্টার শফিক সাহেব আইনমন্ত্রী তাই তারও জীবনের ঝুঁকি ছিল। আমার এই বাড়ি এ্যাটাক হলো কয়েকবার। কারওরান বাজারের ওখানেও আমার স্বামীর গাড়ীতে হামলা হয়েছিল। সেই হামলায় সাত আটজন পুলিশ আহত হন।

আন্তর্জাতিকভাবে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার ঠেকানোর জন্য অনেক লবিস্ট কাজ করেছে। সেই লবিস্টরা বিভিন্ন ভাবে সক্রিয় ছিল। আমেরিকান এ্যাম্বাসী, ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন এরা বিচার সুষ্ঠু হচ্ছে কিনা এমন তাগিদে বার বার নাক গলিয়েছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা খুব বিচক্ষণতার সঙ্গে সে সব কূটনৈতিক চাপ মোকাবেলা করেছেন। ইনডেমনিটি আইনের মাধ্যমে জিয়াউর রহমান বঙ্গবন্ধুর খুনিদের বাঁচাতে চেয়েছিল। কিন্তু প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা প্রচলিত আইনে তাদের বিচার কাজ সম্পন্ন করেছেন।

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বিস্ময়কর সফলতা তার আমলে উন্নয়ন। দেশের এমন কোন সেক্টর নেই যেখানে উন্নয়নের ছোঁয়া লাগেনি বা পরিবর্তনের হাওয়া আসে নি। মেয়েদের পড়ালেখা সম্পূর্ণ ফ্রি। স্নাতক পর্যন্ত তারা রাষ্ট্রীয় খরচে পড়ার সুযোগ পাচ্ছে। ৪১ কোটি বই বিনামূল্যে দেওয়া হচ্ছে। মেয়েরা আগে মাতৃত্বকালীন ছুটি পেত ছয় সপ্তাহ। এখন ছয় মাস ছুটি পাচ্ছে। আজকে মেয়েরা খেলাধূলায় কোনো সফলতায় গেছে আমরা তা দেখতে পাচ্ছি। হিমালয় জয় করছে আমাদের মেয়েরা। নারী ক্ষমতায়নের দিকে বাংলাদেশ এশিয়ার অন্য অনেক দেশকে পেছনে ফেলে এগিয়ে যাচ্ছে।

মানবিক গুণাবলীর দিক থেকে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এক অনন্য ব্যক্তিত্ব। সাধারন মানুষের সাথে তার মেশার যে ক্ষমতা অতুলনীয়। বঙ্গবন্ধু ট্রাস্টের ভেতর দিয়ে তিনি অসংখ্য ছেলেমেয়েকে পড়াশুনার ব্যবস্থা করেছেন। ব্যক্তিগতভাবে তিনি অনেক অনেক ছেলেমেয়েকে মানুষ করেন। ওর সাথে কারো তুলনা হয়না। এদেশে অটিস্টিক শিশুদের জন্য তার যে প্রচেষ্টা, কে কবে অটিস্টিক শিশুদের নিয়ে ভেবেছে? তার ( শেখ হাসিনা) সাথে অন্য কাউকে তুলনা করাটা ঠিক হবে না। অানপ্যারালাল পার্সন। তার ব্যক্তিত্ব দিয়ে তিনি যেখানে গেছেন সেখানে যেতে পারা সহজ কথা নয়।

শেখ হাসিনা তার মেধা ও যোগ্যতা দিয়ে প্রতিনিয়ত নিজেকে পাল্টাচ্ছে। আমাকে অনেকে আলাপ প্রসঙ্গে বলে, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার শক্তির জায়গাটা কোথায়? আমি বলি, শক্তির জায়গা তার বিশ্বাস। বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশটাকে যেভাবে দেখতে চেয়েছিলেন আমরা হয়তো এখনো সেই গন্তব্যে পৌঁছতে পারিনি। তবে যে যাত্রা শেখ হাসিনা শুরু করেছেন সেই যাত্রা আমাদের অনেক দূরে নিয়ে যাবে এটাই আমরা বিশ্বাস করি।

লেখক: সাবেক ভিপি, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। সিনেট সদস্য, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।

শ্রুতি লেখক: আলী আদনান।

/ এআর /

 

 

 


Ekushey Television Ltd.

© ২০২৪ সর্বস্বত্ব ® সংরক্ষিত। একুশে-টেলিভিশন | এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি