শৈশবে পয়সা কুড়ানো!
প্রকাশিত : ১৩:০৮, ১৯ মার্চ ২০২১
আশির দশকের কথা। তখন গ্রামে থাকতাম। প্রাথমিকে পড়ি। অসাধারণ একটা পরিবেশে সময় কাটত। আমাদের বাড়ির পাশে এবং স্কুলের আঙ্গিনায় সপ্তাহে দু’দিন হাট বসত। (এখন বাজার, প্রতিদিন বসে)৷ শালের হাটে কয়েকটা খড়ের ঘর ছিল। স্কুল ঘরগুলো ছিল টিনশেডের। এছাড়া টিনের ঘর ছিল অভিজাত কৃষকদের বাড়িতেও।
যাক গে, আসল কথায় আসি। সোমবার, শুক্রবার দু’দিন হাট বসত। বিকাল থেকে সন্ধ্যা- এমনকি রাত ১০টা পর্যন্ত বিকিনিকি হতো। এরপর হাট ভাঙতো। বন্ধু ইউসুফসহ একসঙ্গে হাটে যেতাম। বাবা আমাকে দু’টাকা দিতেন। ইউসুফের বাবা অবশ্য তাকে বেশিরভাগ সময়ই ৫ টাকা দিতেন। আমরা তা দিয়ে পিয়াজু, বাদাম, চানাচুর খেতাম। আবার এক টাকা বা ৫০ পয়সা করে জমাতামও।
হাটের পরদিন ভোর সকালে ঘুম থেকে উঠে হাট প্রাঙ্গণে যেতাম। আরও অনেকে যেতেন। শীতকালে টর্চলাইট নিয়ে যেতাম। উদ্দেশ্য পয়সা খোঁজা। আগের দিন হাটে বেচাকেনার সময় অসর্তকতার কারণে কারও কারও হাত থেকে পাঁচ, দশ, পঁচিশ কিংবা পঞ্চাশ পয়সা পড়ে যেত। সেটা ধুলার ভেতরে লুকিয়ে থাকতো। সেটাই গিয়ে খুঁজতাম ভোরবেলা। মাঝে মাঝে হরিণ ও দোয়েলের ছবি সম্বলিত এক, দুই টাকার নোটও পেতাম। তখন খুব খুশি হতাম। যত্ন করে মাটির ব্যাংক কিংবা ঘরের বাঁশের খুঁটিতে মুখ কেটে তার ভেতরে সে টাকা জমাতাম। বছর শেষে ব্যাংক ভেঙে তা দিয়ে শখের জিনিস কিনতাম। কখনও কখনও ইংলিশ প্যান্ট (পকেট, চেইন ও হুকওয়ালা প্যান্ট) কিনতাম। আবার কখনও কখনও রেড-লিফ কলম কিনতাম। মেলা থেকে খেলনা পিস্তল কেনাও ছিল একটা বড় শখ।
সময়ের ব্যবধান আর জীবনের প্রয়োজনে এখন ঢাকা শহরে বসবাস। ২৪ ঘণ্টাই হাটের শহর। এখানকার হাট কখনও ভাঙেই না। হয়তো ভাঙবে সেদিন, যেদিন আল্লাহ চাইবেন। এখানে টাকা উড়ে বেড়ায় কিন্তু সবাই তা ধরতে পারে না। আমার বাবা বলতেন, উড়ন্ত টাকা ধরতে যেও না, তাহলে পকেটের টাকাও উড়ে যাবে। সেটাই মানি। জীবন বড় কঠিন এখানে। সৎ, সততা, নিষ্ঠা আর জীবিকা এখানে প্রত্যহ যুদ্ধ করে। সে যুদ্ধে যে আমাকে জয়ী হতেই হবে। জীবন এখানে বহমান স্রোত। তবে কারও কারও জীবন চলে স্রোতের বিপরীতে। তারাই তো প্রকৃত জীবন যোদ্ধা। এখানে ধমক দিয়ে টাকা রোজগার করা যায় খুব সহজে। কিন্তু কলুর বলদেরা সংগ্রাম করে টিকে থাকে। হয়তো আপনিও, আমিও।
গতকাল অফিস যাওয়ার প্রাক্কালে পল্টন মোড়ে সহকর্মী সাইফুল ইসলামকে বিদায় জানিয়ে বাস ধরতে মরিয়া। ঠিক তখনই কেউ একজন পেছনে এসে ধাক্কা দিল। আমি কোনও প্রতিবাদ না করে সামনে এগুলাম। গ্রীনঢাকা নামক বাসে উঠলাম। প্রায় সোয়া ঘণ্টা পর বাস থেকে নামলাম। বসুন্ধরা গেটে নেমেই চমকে গেলাম। রাস্তায় একটা খাকি খাম। দেখে মনে হলো ভেতরে কিছু আছে। ধরব না, ধরব না করেও ধরলাম। তুলে দেখি মুখটা আটকানো। পিনটা খুললাম। খুলেই হতবাক। অনেকগুলো টাকা। সবই হাজার টাকার নোট। রাবার দিয়ে আটকানো। হাতে থাকা আড়ংয়ের শপিং ব্যাগটায় ভরে রাখলাম।
অফিসে ঢোকার পর মনটা খুব খচখচ করছিল। তাই প্যাকেটটা আবার খুললাম। তখন রাত ৮টা। ভেতরে হাজার টাকার দুটো বান্ডেল। গুণে দেখার প্রয়োজন হল না। ব্র্যাক ব্যাংকের সীল মারা। দুটোতে ১০০টা করে নোট। ছোট্ট একটা চিরকুটও পেলাম। তাতে লেখা সোহেল টাকাটা তোমার মেয়ের বিয়েতে খরচ করিও। শেষে দুটি গ্রামীণফোন নম্বর দেয়া। সাথে সাথে কল করলাম। ওপারে কান্নার আওয়াজ পেলাম। ভদ্রলোক কাঁপা কাঁপা গলায় সালাম দিল। আমি আমার পরিচয় দিলাম।
ওপার থেকে জানতে চাইল। কি চাই? আমি বললাম সোহেলকে চাই। বলল, সে তো মারা গেছে তিনদিন আগে। বললাম আপনি কাঁদছেন কেন? সোহেল আপনার কি হয়? বলল বাবা। এবার আমি বললাম আপনার নাম কি? সে বলল হারিছ। বললাম, পুরো নাম কি? বলল হারিছুল। এবার বললাম তোমার বাবার কি টাকা হারিয়েছে। তার কান্নার আওয়াজ বেড়ে গেল। হাউমাউ করে কেঁদে বলল জি। আমি বললাম কতো। বলল, বাবা বলছে দুই লাখ। কথা না বাড়িয়ে, নাম ঠিকানা জিজ্ঞেস করে আজ সকালে খিলগাঁও আসার পরামর্শ দিলাম। সাত সকালে এই বিশ্ব ঘুম দিবসে না ঘুমিয়ে ভোরবিহানে টাকাটা হস্তান্তর করলাম।
হারিছরা থাকে চট্টগ্রামে। বাবার লাশ নিতে ঢাকা এসেছিল। বাবা একটা ব্যাংকের মেসেঞ্জার পদে চাকরি করতো। স্ট্রোক করে মারা গেছে। এক সপ্তাহ বাদে সোহেলের মেয়ের বিয়ে। টাকাটা তাকে দান করেছিল হয়তো কেউ। হয়তো সে তার পরিবারের সাথে বিষয়টা শেয়ারও করেছিল। কিন্তু পুরো ঘটনাটা আমার কাছে একটা রহস্য, অদ্ভূত রহস্য বলে মনে হচ্ছে। এতটা কাকতালীয় তা আবার আমার সাথে। ঠিক বুঝতে পারছি না।
তবে স্বস্তি হলো- কুড়িয়ে পাওয়া টাকটা ফেরত দিতে পেরে নিজের মনটাতে বেশ হালকা হালকা অনুভব হচ্ছে। আল্লাহ জান্নাত নসিব করুন সোহেলকে। সুখী করুন তার মেয়ে ও পরিবারকে। বন্ধুদের সাথে শেয়ার না করে পারলাম না।
এনএস/
** লেখার মতামত লেখকের। একুশে টেলিভিশনের সম্পাদকীয় নীতিমালার সঙ্গে লেখকের মতামতের মিল নাও থাকতে পারে।