বিসিএসের ক্যাডার চয়েস
সঠিক ক্যাডার পছন্দক্রম নির্ধারণ করবেন যেভাবে
প্রকাশিত : ২৩:৩৪, ১ ডিসেম্বর ২০২০ | আপডেট: ১৭:০৫, ৩ ডিসেম্বর ২০২০
এসসপি আনোয়ার হোসেন
গতকাল (৩০ নভেম্বর)) রাতে পিএসসি ৪২ ও ৪৩তম বিসিএসের বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করেছে। নিজের উপযোগী সঠিক ক্যাডার চয়েস নির্ধারণই হলো বিসিএস পরীক্ষার আবেদন প্রক্রিয়ায় প্রথম এবং সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ধাপ। ভাল পরীক্ষা দেওয়া সত্ত্বেও শুধু চয়েস ভুল দেওয়ার কারণে প্রত্যাশিত ক্যাডার যেমন হাতের মুঠো থেকে ফসকে যেতে পারে, তেমনি ভাইভা বোর্ডের সামনেও প্রার্থী পড়তে পারেন বিব্রতকর পরিস্থিতিতে।
সুতরাং আবেদন করার পূর্বেই এ সংক্রান্ত সুচিন্তিত সঠিক সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা প্রত্যেক বিসিএস পরীক্ষার্থীর অবশ্য কর্তব্য। অনেকেরই জিজ্ঞাসা, কোন কোন ক্যাডার চয়েস দিব এবং সেগুলোর মধ্যে কোনটি ফার্স্ট, সেকেন্ড, থার্ড চয়েসে রাখব?
প্রথমেই বলে রাখি- চাকুরীরত না থাকলে যে যে ক্যাডার চয়েস দেওয়ার যোগ্যতা আপনার আছে, চয়েস লিস্টে তার সবগুলো রেখে দেওয়াই সমীচীন হবে। আর আপনি যদি কোনও সরকারি/বেসরকারি জবে থাকেন, তাহলে শুধু সেই ক্যাডারগুলোই চয়েস দিন, যেগুলোতে সুপারিশকৃত হলে আপনি যোগদান করবেন।
পছন্দক্রম নির্ধারণ
সঠিক ক্যাডার পছন্দক্রম ঠিক করার জন্য বিসিএসের ক্যাডারসমূহকে আমরা প্রধানত চারটি শ্রেণীতে ভাগ করতে পারি-
ক. আইন প্রয়োগ ও প্রশাসন সংক্রান্তঃ
১. পুলিশ
২.প্রশাসন
৩.আনসার
খ. অর্থ, বাণিজ্য রাজস্ব, আর্থিক প্রক্রিয়া সংক্রান্তঃ
১. কাস্টমস
২.ট্যাক্সেশন
৩.অডিট এন্ড একাউন্টস
৪. বাণিজ্য
গ. পেশাগত
১. স্বাস্থ্য
২.শিক্ষা
৩. কৃষি
৪. বন
৫. প্রকৌশল
ঘ. অন্যান্য
১. পররাষ্ট্র
২. খাদ্য
৩. রেলওয়ে
৪. পরিবার পরিকল্পনা ইত্যাদি
এখন যদি আপনি-
ক. মাঠপর্যায়ে নিত্যনতুন চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করে আপনার কর্মজীবনে দায়িত্ব পালন করতে চান-
খ. আইন প্রয়োগ, বিচার ইত্যাদি প্রক্রিয়ায় ভূমিকা রাখতে চান-
গ. অন্যায় প্রতিরোধ ও সামাজিক সুবিচার প্রতিষ্ঠায় ভূমিকা রাখার আগ্রহ আপনার থাকে-
ঘ. ছুটি শব্দটি ভুলে যেতে হতে পারে- যদি এই বাস্তবতা হাসিমুখে মেনে নিতে পারেন-
ঙ. জনগণের দোরগোড়ায় পৌঁছে সরাসরি সেবা দেওয়ার ইচ্ছা থাকে-
চ. সমাজে, কর্মস্থলে নিজেকে গুরুত্বপূর্ণ দেখার প্রবল বাসনা-
ছ. রোদে পুড়ে, ঘামে ভিজে দায়িত্ব পালন করতে আপত্তি নেই-
তাহলে, নিশ্চিন্তে আপনার ক্যাডার পছন্দক্রম হতে পারে- ক>খ>গ>ঘ। অর্থাৎ এক্ষেত্রে আপনার প্রথম তিনটি ক্যাডার চয়েস হবে- পুলিশ, এডমিন ও আনসার। এ তিনটি ক্যাডারের মধ্যে আপনার পছন্দ ও বাস্তবতা বিবেচনায় ১, ২, ৩ ক্রম নির্ধারণ করুন। এরপর ৪, ৫, ৬....... নম্বরে খ, গ, ঘ-এর ক্যাডার সমূহ চয়েস দিন। (পররাষ্ট্র ছাড়া, কারণ প্রথম তিনটি ক্যাডার চয়েস যেহেতু পুলিশ, এডমিন, আনসার। তাই পররাষ্ট্র চয়েস দেওয়া এখানে অর্থহীন)।
আবার যদি আপনি-
১. ঝামেলামুক্ত জীবন যাপন করতে চান
২. নয়টা-পাঁচটা অফিস করার ইচ্ছা থাকে
৩. এসি রুম ছাড়া আপনার চলে না
৪. বেতনের বাইরেও প্রচুর বৈধ আর্থিক প্রণোদনা পেতে চান
৫. বিদেশ ভ্রমণ, ট্রেনিং ইত্যাদির দিকে ঝোঁক
তাহলে নিশ্চিন্তে আপনার ক্যাডার পছন্দক্রম হতে পারে- খ>ক>গ>ঘ।
যদি আপনি-
১. আপনার একাডেমিক অর্জিত জ্ঞানকে সরাসরি পেশাগত কাজে লাগাতে চান।
২. অর্থবিত্তের (আমি বৈধ অর্থের কথা বলছি) বদলে সততাকে, ক্ষমতার বদলে সদাচারণকে, কৃত্রিম অভিজাততন্ত্রের বদলে মানুষের শ্রদ্ধা ভালবাসা লাভকে জীবনের চরম লক্ষ্য জ্ঞান করে থাকেন,
তাহলে আপনার পছন্দের ক্যাডারক্রম হওয়া উচিত- গ>ক>খ>ঘ।
এছাড়াও-
আপনি যদি আন্তর্জাতিক অঙ্গণে দেশকে প্রতিনিধিত্ব করতে চান বা কূটনৈতিক উচ্চ মর্যাদা ভোগ করতে চান, তাহলে পররাষ্ট্র ফার্স্ট চয়েস হিসেবে রাখতে পারেন। পূর্বেই উল্লেখ করেছি, পররাষ্ট্র ক্যাডার সাধারণত অন্য সব ক্যাডারের আগেই পূরণ হয়ে যায়, তাই চয়েস দিতে চাইলে পররাষ্ট্র ক্যাডার এক নম্বরেই দেওয়া উচিত বলে মনে করি। অন্য ক্যাডার ফার্স্ট চয়েস দিয়ে পরের দিকে পররাষ্ট্র ক্যাডার চয়েস দেওয়ার ক্ষেত্রে আইনগত কোন বিধিনিষেধ না থাকলেও এটা ভাইভাবোর্ড সদস্যগনের নিকট আপনার চিন্তার অপরিপক্বতা ও ক্যাডার চয়েস সংক্রান্ত সিদ্ধান্তের অযৌক্তিকতাকেই প্রকাশ করবে।
জেনে রাখুন-
১. জাতীয় পরিচয়পত্রে যে স্বাক্ষর ব্যবহার করছেন (এমনকি যদি বাংলা বা ইংরেজিতে নামও লিখে থাকেন), বিসিএসের আবেদন করার সময় সেই একই স্বাক্ষর ব্যবহার করুন। অনেক অনাকাঙ্ক্ষিত জটিলতা থেকে রেহাই পাবেন।
২. আবেদন করার সময় সাম্প্রতিক ছবি ব্যবহার করুন। ছবিটি যেন এমনভাবে এডিট করা না হয়, যাতে আপনার বয়স, গায়ের রঙ, স্বাস্থ্য ইত্যাদি পরিবর্তিত হয়ে যায়।
৩. পররাষ্ট্র ক্যাডার চয়েস দিতে চাইলে ফার্স্ট চয়েস হিসেবেই দেওয়া উচিত। ইংরেজিতে দক্ষতা না থাকলে এই ক্যাডার চয়েস দেওয়ার চিন্তা বাদ দেওয়াটাই মঙ্গলজনক হবে।
৪.আপনি যে ক্যাডারেই চাকুরী করুন, সেখান থেকেও আপনি উপসচিব, যুগ্মসচিব, অতিরিক্ত সচিব, সচিব হতে পারবেন। উপসচিব পদের ৭০% পূরণ করা হয় প্রশাসন ক্যাডার থেকে অবশিষ্ট ৩০% পূরণ হয় অন্যান্য ক্যাডার থেকে।
৫.অনেকেই আমার নিজের পছন্দক্রম জানতে চেয়েছেন। আমার নিজের পছন্দক্রম ছিল নিম্নরূপ--
ক. পুলিশ,
খ. প্রশাসন,
গ. আনসার,
ঘ. পুলিশ ও আনসার ক্যাডারে আবেদন করতে হলে ন্যূনতম উচ্চতা ছেলেদের ক্ষেত্রে ৫'৪" আর মেয়েদের ক্ষেত্রে ৫'০" চাওয়া হয়েছে। এই উচ্চতার শর্ত যাদের পূরণ হয় না, তারা কোনওভাবেই এই দুটি ক্যাডার পছন্দ তালিকায় রাখবেন না। এছাড়াও যাদের মেজর শারীরিক সমস্যা আছে, তাদেরও এ দুটি ক্যাডার চয়েস দেওয়া হতে বিরত থাকা সমীচীন হবে।
৭. পুলিশ ও আনসার ব্যতীত অন্যান্য ক্যাডারের জন্য ন্যূনতম উচ্চতা পুরুষ প্রার্থীদের ৫'০" আর নারী প্রার্থীদের ৪'১০" প্রয়োজন হবে। (অনেকে জানতে চান, এর চেয়ে কম উচ্চতাসম্পন্ন প্রার্থীদেরকে বাদ দিয়ে দেওয়া হবে কিনা বা তারা বিসিএসে আবেদন করতে পারবেন কিনা। আমার ধারনা, এই উচ্চতার শর্ত অনেকটাই আনুষ্ঠানিক, কারণ আজ পর্যন্ত এমন কোনও উদাহরণ পাওয়া যায়নি যে, সুপারিশকৃত কোনও প্রার্থীকে শুধু উচ্চতার কারণে বাদ দেওয়া হয়েছে। তাই আবেদন করতে পারেন নিশ্চিন্তে)।
৮. বর্তমান ঠিকানায় আপনি যদি দীর্ঘদিন অবস্থান না করেন বা ওই এলাকায় আপনার তেমন চেনাজানা না থাকে, ভবিষ্যৎ ঝামেলা এড়ানোর জন্য আপনার স্থায়ী ঠিকানাকেই বর্তমান ঠিকানা হিসেবে উল্লেখ করতে পারেন। অর্থাৎ স্থায়ী ও বর্তমান ঠিকানা একই দিতে পারেন। আর একজন পুলিশ কর্মকর্তা হিসেবে আমার পরামর্শ থাকবে, আপনার বাবা/মায়ের নামে রেজিস্ট্রিকৃত জমি আছে, এমন জায়গাকে স্থায়ী ঠিকানা হিসেবে দিতে সচেষ্ট হোন। স্থায়ী ঠিকানা সম্পর্কিত ঝামেলার কারণে প্রতি বিসিএসেই অনেক প্রার্থী পুলিশ ভেরিফিকেশন প্রক্রিয়ায় বাদ পড়ে যান। তাই সাবধানতার বিকল্প নেই।
সবশেষে একটা বিষয় মনে করিয়ে দিতে চাই। বিসিএস পরীক্ষার মাধ্যমে আপনি যে ক্যাডারেই চাকুরী লাভ করেন না কেন, আক্ষরিক অর্থে আপনি জনগণের চাকরই হতে যাচ্ছেন। আপনি যদি মনে করে থাকেন- নির্দিষ্ট কোনও ক্যাডার ফকির থেকে আপনাকে আমির বানিয়ে দিবে, সমাজের নগণ্য বাসিন্দা থেকে কেউকেটার স্তরে আপনার উত্তরণ ঘটাবে, ক্ষমতার প্রবল দাপটে চাকরের পদে থেকেও মালিকায় ভূমিকায় অবতীর্ণ হতে পারবেন, আইন প্রয়োগের অধিকার, বৈধ-অবৈধ অর্থবিত্তের জোরে যা খুশি তা করার লাইসেন্স পেয়ে যাবেন!
তাহলে করজোড়ে ক্ষমা চেয়ে মিনতি রাখব- আমার এ পরামর্শ আপনার জন্য নয়। এ গরীব দেশের সিভিল সার্ভিসকে কলুষিত না করে আপনি বরং অন্য পেশায় ট্রাই করুন। হয়তো আপনি আপনার লক্ষ্য অর্জন করতে পারবেন। আর একজন শিক্ষিত, সচেতন, দেশপ্রেমিক নাগরিক হিসেবে জনগণের প্রকৃত চাকরের দায়িত্ব পালনের সুযোগ পাওয়ার জন্য আপনারা যারা দিনরাত নির্ঘুম একাগ্রচিত্তে অধ্যবসায় করে চলেছেন, ভবিষ্যতের একটি সমৃদ্ধ বাংলাদেশের জনবান্ধব, দুর্নীতিমুক্ত ও নাগরিক সেবামুখী সিভিল সার্ভিসে আপনাকে স্বাগতম।
লেখক- বিসিএস (পুলিশ); এএসপি-রাঙ্গুনিয়া সার্কেল, চট্টগ্রাম জেলা পুলিশ।
এনএস/
** লেখার মতামত লেখকের। একুশে টেলিভিশনের সম্পাদকীয় নীতিমালার সঙ্গে লেখকের মতামতের মিল নাও থাকতে পারে।