সন্তানকে বড় করুন উদারনৈতিক পরিবেশে
প্রকাশিত : ১২:৪৫, ১৯ মার্চ ২০২১ | আপডেট: ১৩:৪৯, ১৯ মার্চ ২০২১
আমার বাসার কাছে একটা স্কুল আছে। রোজ সকালে বারান্দা থেকে দেখি, অনিচ্ছুক বাচ্চাগুলোকে মায়েরা টানতে টানতে নিয়ে যাচ্ছেন। অত সকালে তো কারো স্কুলে যেতে ইচ্ছা করে না, আবার বইয়ের ব্যাগটাও এত ভারী বাচ্চারা সোজা হয়ে হাঁটতে পর্যন্ত পারে না। স্কুলটা একটা তিন তলা বাড়ি। ওখানে না আছে কোনো মাঠ, না আছে কোনো খেলাধুলার ব্যবস্থা।
এই শিশুটি দুপুরে বাড়ি ফিরলে মা হয়তো বলে গোসল করো, খাও, ঘুমাও। তারপর হোমওয়ার্ক। ওটা শেষ করেও তার বাইরে যাওয়ার কোনো উপায় নেই। ফলে সে কার্টুন দেখে, তা-ও হিন্দি ভাষায়। এই বাচ্চাটি যদি সকালে বলে ওঠে ‘মা, মুঝে নাশতা চাহিয়ে, স্কুল যানা হ্যায়’, তাকে দোষ দেয়ার কিছু নেই। সে যা দেখছে ও শুনছে, তা-ই শিখছে।
পরদিন আবার স্কুলে যাওয়ার জন্যে সে তাড়াতাড়ি ঘুমোতে যায়। অর্থাৎ ক্লাস-হোমওয়ার্ক-কার্টুন, এই হলো এখন একটা বাচ্চার জীবন। ওর জীবনে নদী ফুল আকাশ পাখি কিছুই নেই। মা-বাবার সঙ্গেও যে তার খুব একটা কথা হয়, তা-ও না। মা-বাবা কেন, আজকাল তো স্বামী-স্ত্রীর মধ্যেই কথা হয় না। সবাই টিভি-সিরিয়াল আর খেলার চ্যানেল নিয়ে ব্যস্ত। এভাবে পরিবারগুলো ধীরে ধীরে বিচ্ছিন্ন হয়ে যাচ্ছে।
এই বাচ্চারা যখন আরেকটু বড় হবে তখন শুরু হবে ‘জিপিএ ফাইভ নির্যাতন’। গোল্ডেন জিপিএ না পেলে যেন জীবন বৃথা। কিন্তু বোঝার চেষ্টা করতে হবে যে ছেলেটা ভালো ফল করছে না, তার কেন পড়তে ভালো লাগছে না? নাকি আমিই ঠিকমতো ওকে শেখাতে পারছি না? ও কি ছবি আঁকতে চায়? গান গাইতে চায়? নাকি খেলতে চায়? গাক না একটু গান! খেলুক না একদিন। তাহলে পড়াটাও তার কাছে আনন্দময় হবে। আর যদি ভীতিকর হয় তাহলে তো পড়তে চাইবে না, এটাই স্বাভাবিক।
ক্লাসে সবাই ফার্স্ট-সেকেন্ড হবে না। যারা হবে না, তারা কি দেশের কোনো কাজে লাগবে না? তাহলে কি ওদের একটা জাহাজে তুলে বঙ্গোপসাগরে ফেলে দিয়ে আসব? সবার মধ্যে শক্তি আছে। আমরা সেটা আবিষ্কার করার চেষ্টা করি না, বরং নিজেদের মতটা সন্তানের ওপর চাপিয়ে দেই। কিন্তু যারা কোয়ান্টাম মেথড বা মেডিটেশন চর্চা করেন, তারা এই শক্তিতে বিশ্বাস করেন বলে আমি জানি।
একেকজনের চাওয়া একেক রকম। সেই চাওয়াটা নিশ্চিত না করে নিজের চাওয়াটা সন্তানের ওপরে চাপিয়ে দিলে তার বিকাশটা হবে কীভাবে? শুধু বইয়ের কিছু শুকনো পাতার মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকলে কখনোই একজন মানুষের সামগ্রিক বিকাশ সম্ভব নয়। প্রকৃত শিক্ষিত মানুষ হওয়ার জন্যে তাই সংস্কৃতিবান হতে হবে।
একবার এক মায়ের সঙ্গে কথা হচ্ছিল। তিনি বললেন, চিত্রকলা শিখিয়ে কী হবে? আমার ছেলে কি জয়নুল আবেদিন হবে? আপনারা খেলাধুলার পেছনে সময় দিতে বলেন। এতে ছেলেমেয়েদের ক্ষতি হয়। আমি জানতে চাইলাম, তিনি কী চান। তিনি বললেন, আমার সন্তান ভালো রেজাল্ট করবে, ভালো চাকরি পাবে, নিজের পায়ে দাঁড়াবে। জীবনে প্রতিষ্ঠিত হবে। আমি বললাম, সেটা আমরা সবাই চাই। আমিও চাই আমার সন্তান নিজের পায়ে দাঁড়াক। তার সুন্দর একটা জীবন হোক।
তবে শুধু পরীক্ষার রেজাল্টের ওপরে সাফল্য আসে না। পরীক্ষায় ভালো ফল করতে হবে। কিন্তু সেজন্যে জীবনের সবকিছু বাদ দিয়ে উঠেপড়ে লাগলে পরিণাম ভালো হবে না। যেমন, রবীন্দ্রনাথ বেশিদিন স্কুলে যেতে পারেন নি। বাড়িতে পড়াশোনা করেছেন। কুস্তি করেছেন, গান শিখেছেন। আর জাতীয় কবি কাজী নজরুল তো স্কুলে যাওয়ারই সুযোগ পান নি। অথচ তাদের বই পড়েই তো আমাদের জিপিএ ফাইভ পেতে হচ্ছে!
সেই অভিভাবককে আরো বললাম, আপনি নিশ্চয়ই সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বিজ্ঞানী আইনস্টাইনের নাম শুনেছেন। তিনি যেখানেই যেতেন তার হাতে একটা বাক্স থাকত, তাতে থাকত একটা বেহালা। তার মতো জগদ্বিখ্যাত বিজ্ঞানীর যদি বেহালা বাজানোর সময় থাকে, তাহলে আমরা সন্তানদের এমন কী মহাপণ্ডিত বানাচ্ছি যে, তার গান শেখার, কবিতা পড়ার বা খেলার সময় হচ্ছে না? তাহলে ওর জীবনের পূর্ণাঙ্গ মুক্তি ঘটবে কীভাবে? সে-তো মানসিকভাবে পঙ্গু হয়ে যাবে। আর রোবটের মতো করে তৈরি করলে সন্তানের বিপথগামী হওয়ার সম্ভাবনা থেকেই যায়।
মাননীয় প্রধানমন্ত্রীও বলেছেন, নতুন প্রজন্মকে কেবল ক্লাসের বই পড়ালে হবে না, তার সুকুমার বৃত্তিগুলো বিকাশের সুযোগ করে দিতে হবে। কারণ তার হৃদয়ে যে আবেগ আছে তা ভুল পথে পরিচালিত হলে মানুষের জন্ম না হয়ে অমানুষের জন্ম হতে পারে। কিন্তু আমরা তো দানবের সমাজ গড়তে চাই না। আমরা একটি মানবিক সমাজ গড়তে চাই।
বাংলাদেশের সম্ভাবনা অপার। আমাদের দেশটা একটা ফুলের বাগানের মতো করে আমরা গড়ে তুলতে চাই। ফুলের বাগানে যেমন নানা রঙের ফুল থাকে, এদেশটাও তা-ই। এখানে আছে নানা ধর্মের মানুষ, আছে সমতল ও পাহাড়ের মানুষ। আমরা একসাথে সুন্দরভাবে থাকতে চাই। সেজন্যে আমাদের সন্তানদের বড় করতে হবে উদারনৈতিক পরিবেশে।
একটা ঘটনা বলি। ১৯৭৪ সালে বাংলা একাডেমি আন্তর্জাতিক সাহিত্য সম্মেলন আয়োজন করে। প্রধান অতিথি হওয়ার জন্যে বঙ্গবন্ধুকে অনুরোধ জানালে তিনি বললেন, ‘আমি রাজনীতির মানুষ, আমি তো সাহিত্যের কিছু বুঝি না। তোমরা বড় কোনো সাহিত্যিককে অতিথি করো।’
তখন সবাই মিলে তাকে বোঝালেন, আপনি সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশের প্রধান ও জাতির পিতা। আপনি এলে সম্মেলনের গুরুত্ব অনেক বৃদ্ধি পাবে। তিনি কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বললেন, ‘ঠিক আছে। আমি যাব। কিন্তু মঞ্চে আমার পাশে তিন জন বসবেন পল্লীকবি জসীম উদ্দীন, শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিন এবং বিজ্ঞানী প্রফেসর মতিন চৌধুরী।’
বাংলা একাডেমির সাহিত্য জাদুঘরে সেই ঐতিহাসিক ছবিটি এখনো আছে।
এর মধ্য দিয়ে বঙ্গবন্ধু এদেশের মানুষকে যে বার্তাটি দিয়েছিলেন, তা হলো, পূর্ণাঙ্গ বাংলাদেশ গড়তে একজন রাজনীতিবিদের সঙ্গে কবি, শিল্পী, বিজ্ঞানীকেও থাকতে হবে। আমরা যদি এভাবে কর্মপরিকল্পনা গ্রহণ করি, তাহলে আমাদের কাঙ্ক্ষিত গন্তব্যে আমরা পৌঁছবই।
লেখক : সংসদ সদস্য, সাবেক মন্ত্রী, জনপ্রিয় অভিনেতা
কোয়ান্টাম ফাউন্ডেশনের মুক্ত আলোচনা, ৬ মার্চ ২০১৭
** লেখার মতামত লেখকের। একুশে টেলিভিশনের সম্পাদকীয় নীতিমালার সঙ্গে লেখকের মতামতের মিল নাও থাকতে পারে।