সন্তানের সুস্থতা আপনার হাতেই
প্রকাশিত : ১০:২৫, ৫ এপ্রিল ২০১৯ | আপডেট: ১০:২৭, ৫ এপ্রিল ২০১৯
গত ২ এপ্রিল ছিল বিশ্ব অটিজম দিবস। বিশ্ব জুড়ে অটিজমের সমস্যায় ভোগা শিশুর সংখ্যা ক্রমবর্ধমান। ভারতীয় উপমহাদেশেও এর ব্যতিক্রম নয়। এই রোগ নিয়ে অজ্ঞানতাই সমস্যাটিকে আরও জটিল করে তুলছে। কী করা দরকার, এ বিষয়ে জানাচ্ছেন ভারতের চিকিৎসক শিবশঙ্কর মাহাতো।
প্রশ্ন: বাচ্চাদের শারীরিক স্বাস্থ্যের পাশাপাশি মানসিক স্বাস্থ্যের বিষয়ে নজর দেওয়া কতটা জরুরি?
যে কোনও মানুষের মানসিক এবং শারীরিক স্বাস্থ্য ওতপ্রোত ভাবে জড়িত। বাচ্চাদের ক্ষেত্রেও তাই। কিন্তু বাচ্চাদের ক্ষেত্রে সমস্যা হল, ওদের শারীরিক স্বাস্থ্যের খুঁটিনাটি বাড়ির লোকজন, আত্মীয় বা প্রতিবেশী সবাই কমবেশি বুঝতে পারলেও মানসিক স্বাস্থ্যের দিকটা সকলে তেমন লক্ষ্য করতে পারেন না। এ ক্ষেত্রে বাবা-মায়ের দায়িত্বই সবচেয়ে বেশি। তাদের উচিত শিশুর মানসিক বিকাশের দিকেও সমান ভাবে নজর দেওয়া।
প্রশ্ন: শারীরিক অসুস্থতার বাইরে বাচ্চাদের কী কী ধরনের সমস্যা হতে পারে?
বাচ্চাদের প্রধানত আচরণগত সমস্যা দেখা যায়। এর পর যেগুলি বেশি সমস্যা তৈরি করে তা হল, পড়াশোনায় অসুবিধা (ডিসলেক্সিয়া), অটিজ়ম বা এক বিশেষ ধরনের স্নায়ুগত সমস্যা যেখানে সামাজিক প্রতিবন্ধকতা, বারংবার একই কাজ করার প্রবণতা ইত্যাদি লক্ষ্য করা যায়। এ ছাড়া, ‘এডিএইচডি’ বা ‘হাইপারঅ্যাকটিভ’ শিশুও দেখা যায়। অনেক সময়ে কোনও শিশুর একটি মানসিক সমস্যার সঙ্গে আর একটিও জড়িয়ে থাকতে পারে। তা নির্ধারণ করা আরও জটিল।
প্রশ্ন: কী ভাবে বোঝা যাবে বাচ্চা অটিজ়মের সমস্যায় ভুগছে?
শিশুদের মধ্যে অটিজ়মের লক্ষণ তেমন ভাবে বোঝা সম্ভব নয়। সাধারণত ২-৪ বছর বয়সি বাচ্চাদের আচার-আচরণ দেখে বাবা-মায়েরা বুঝতে পারেন। লক্ষ্য করতে হবে, বাচ্চা কথা বলার সময়ে বা আপনার কাছ থেকে কিছু চাওয়ার সময়ে কি আপনার চোখের দিকে তাকাচ্ছে? যদি না তাকায়, তা হলে বুঝতে হবে কিছু সমস্যা থাকতে পারে। বাচ্চাকে একাধিক বার তার নাম ধরে ডাকলেও সে যদি সাড়া না দেয়, একা একা থাকে, অন্য বাচ্চাদের সঙ্গে বন্ধুত্ব করতে অপারগ হয় কিংবা একই জিনিস বারবার করতে থাকে বা বলতে থাকে, তখনও বুঝতে হবে তার কোথাও সমস্যা হচ্ছে।
বাচ্চা একটু বড় হলে তার ঠিকমতো বিকাশ হচ্ছে কিনা, বা কিছু শিখতে তার স্বাভাবিকের চেয়ে বেশি সময় লাগছে কি না, ভাষা শিখতে পারছে কি না, এ বিষয়ে নজর রাখতে হবে। দু’বছরের বেশি বয়সি বাচ্চাদের ক্ষেত্রে এই লক্ষণগুলি থাকলে অবশ্যই সচেতন হতে হবে।
বয়স একটু বাড়লে শিশুর বুদ্ধির বিকাশ কতটা হচ্ছে, সে দিকে নজর দিতে হবে। ‘লো আইকিউ’ অর্থাৎ, সাধারণের চেয়ে কম বুদ্ধি হলে শিশুরা সময়ের সঙ্গে তাল মিলিয়ে কথা বলতে পারে না, অন্যের সঙ্গে মিশতে পারে না, কী বলবে বুঝতে পারে না, বারংবার একই শব্দ ব্যবহার করে, সাধারণ প্রশ্নের উত্তর দেয় না।
নীচের তালিকাটি লক্ষ করুন—
৬ মাস: আপনার বা কারোর দিকে তাকিয়ে না হাসা, ৯ মাস: আপনি যা বলবেন তা নকল না করা, ১২ মাস: মুখ দিয়ে কোনও শব্দ না বার করা, ১৬ মাস: মুখ দিয়ে একটি-দু’টির বেশি শব্দ না বার হওয়া, ২৪ মাস: ২-৩টি শব্দ এক সঙ্গে না বলা।
এমন লক্ষণগুলি দেখা গেলে চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া উচিত। যে হাসপাতালে ‘চাইল্ড ডেভেলপমেন্ট’-এর ক্লিনিক রয়েছে, সেখানে যোগাযোগ করা উচিত।
প্রশ্ন: অনেক বাচ্চাই দেরিতে কথা বলতে শেখে। সে ক্ষেত্রে কত দিন পরে চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া উচিত?
কিছু বাচ্চা স্বাভাবিক ভাবেই দেরিতে কথা বলতে শেখে। এটা কোনও সমস্যা নয়। আবার, শিশুদের মধ্যে মেয়েরা সাধারণত একটু আগেই কথা বলা শেখে।
সাধারণত ৬ মাস থেকে ‘বা’, ‘মা’ এই শব্দগুলি বলতে শেখে। বাচ্চার এক বছর পরে সাধারণত ‘বাবা’, ‘মামা’ এগুলি বলতে শেখে। দেড় থেকে দু’বছরের মধ্যে আস্তে আস্তে আরও শব্দ বলার চেষ্টা করে। তিন বছরের পরে অনেক নতুন নতুন শব্দ বা বাক্য বলতে পারে শিশু।
প্রশ্ন: অটিজ়মের সমস্যায় ভোগা বাচ্চাদের কী ধরনের সমস্যা হতে পারে? এমন পরিস্থিতিতে কী করা উচিত? কী ভাবে যত্ন নেওয়া উচিত?
আগেই বলেছি, এমন শিশুদের কিছু শেখাতে খুব সমস্যা হয়। শুরুতে ইতিবাচক পদক্ষেপ নিলে সমস্যা পরে আর বাড়ে না।
এই ধরনের পরিস্থিতিতে প্রথমে বাবা-মাকে ঠান্ডা মাথায় ইতিবাচক কথা ভাবতে হবে। কখনই নেতিবাচক ভাবা চলবে না। দেখা যায়, অনেক সময়ে শিশুকেই দোষ দেওয়া হয়। আবার, বাবা-মা অনেক সময়ে একে অপরকেও দোষারোপ করেন। একটা কথা মাথায় রাখবেন, এগুলি স্বাভাবিক ঘটনা। ‘ডেভেলপমেন্ট ক্লিনিকে’ যান এবং বাচ্চার আচরণের কারণ বোঝার চেষ্টা করুন। সে কতটা পিছিয়ে রয়েছে, তাকে কী ভাবে সাহায্য করা যেতে পারে, এটা বোঝা খুব জরুরি। প্রয়োজনে শিশু মনোবিদের সঙ্গে কথা বলতে পারেন।
প্রশ্ন: কী কারণে অটিজ়ম হয়?
নির্দিষ্ট কোনও কারণ এখনও জানা যায়নি। অনেকে বলেন জিনগত কারণে অটিজ়মের সমস্যা হতে পারে। আশপাশের পরিবেশও খানিকটা দায়ী। ছোট বয়সে ভাইরাসের সংক্রমণ, গর্ভাবস্থায় মায়ের কোনও সমস্যা, অত্যধিক ওষুধ খাওয়া বা তার জেরে তৈরি হওয়া জটিলতার কারণেও এমন হতে পারে। তবে, অনেক সময়ে বলা হয়, ভ্যাকসিনের জন্য এই রোগ হয় , যা একেবারেই ভিত্তিহীন।
প্রশ্ন: কী ভাবে অটিজ়মের সমস্যা এড়ানো যেতে পারে?
যখনই দেখবেন বয়স অনুযায়ী শিশুর বিকাশ ঠিকমতো হচ্ছে না, সে ক্রমে পিছিয়ে যাচ্ছে, তখনই চিকিৎসকের কাছে যান এবং তাঁর পরামর্শ মতো এগিয়ে চলুন।
প্রশ্ন: ‘এডিএইচডি’ বা ‘অ্যাটেনশন ডেফিসিট হাইপারঅ্যাকটিভ ডিসঅর্ডার’ কী?
এই রোগে আক্রান্ত শিশু কোনও কিছুতেই মনোযোগ দিতে পারে না। জোর করেও কোনও নির্দিষ্ট বিষয়ে তার দৃষ্টি ঘোরানো যায় না, উল্টে তারা খুবই দুরন্ত প্রকৃতির হয়। যতক্ষণ জেগে থাকে চঞ্চল থাকে। শরীরে স্বাভাবিকের তুলনায় বেশি জোর থাকে। ‘লার্নিং ডিসএবিলটি’-র সমস্যাও এর সঙ্গে জড়িত।
প্রশ্ন: ‘অটিস্টিক’ বা ‘হাইপারঅ্যাকটিভ’ শিশুদের জন্য কাউন্সেলিং কতটা জরুরি?
ভীষণ জরুরি। শুধু বাচ্চার নয়, বাবা-মায়েরও কাউন্সেলিং সমান ভাবে জরুরি। বাবা-মায়ের কাউন্সেলিং হওয়ার পরে শিশুর কাউন্সেলিং দরকার। তবেই শিশুটি একটু একটু করে উন্নতি করতে পারবে।
প্রশ্ন: এমন বাচ্চাদের দেখভালের নেওয়ার জন্য বাঁকুড়া ও পুরুলিয়ায় কি কোনও বিশেষ কেন্দ্র বা প্রতিষ্ঠান রয়েছে?
রয়েছে। তবে সীমিত। ২০১৩ সালে পুরুলিয়া সদর হাসপাতালে ডিইআইসি (ডিস্ট্রিক্ট আরলি ইন্টারভেনশন সেন্টার) চালু হয়। এখানে শিশুরোগ বিশেষজ্ঞ, মনোবিদ, ডেন্টিস্ট, ফিজিওথেরাপিস্ট একই সঙ্গে থাকেন। এ ছাড়া বেসরকারি ভাবে একটি প্রতিষ্ঠান আছে। বাঁকুড়া মেডিক্যাল কলেজেও এই চিকিৎসা পাওয়া যায়। বিশেষ কিছু ক্ষেত্রে কলকাতার পিজি হাসপাতালেও আমরা শিশুদের পাঠানোর কথা বলি।
প্রশ্ন: বাচ্চাদের আরও কী কী ধরনের সমস্যা থাকতে পারে?
অটিজ়ম ও ‘এডিএইচডি’-এর সমস্যা ছাড়াও আরও বিষয় গুরুত্বপূর্ণ, তা হল—‘অ্যাডপটেড চাইল্ড সিনড্রোম’। যে শিশুরা অনাথ আশ্রম থেকে আসে তাদের অনেক সময়ে বাবা-মা কে মানিয়ে নিতে সমস্যা হয়। ‘পিকা’ নামক রোগের সমস্যা দেখা যায় গ্রামের দিকে। অনেক সময়ে শিশুরা মাটি খায়। এ ছাড়া ‘স্কুল রিফিউসল’, ‘বাইপোলার ডিসঅর্ডার’, ‘কন্ডাক্ট ডিসঅর্ডার’, ‘হাইপারলেক্সিয়া’, ‘স্টিরিওটাইপ ডিসঅর্ডার’ ইত্যাদিও দেখা যায়।
প্রশ্ন: শিশুর আচরণগত সমস্যা বা ‘বিহেভির্যাল ডিসঅর্ডার’-এর ক্ষেত্রে কী করা উচিত?
বিহেভির্যাল ডিসঅর্ডার-এর ক্ষেত্রে বাবা-মা বা শিশুকে যিনি বা যাঁরা দেখভাল করছেন, প্রত্যেককেই অত্যন্ত সংবেদনশীল হতে হবে। কাউন্সেলিং করে করে শেখাতে হবে শিশুটিকে। শিশুর ইতিবাচক কাজগুলিকে সবার সামনে প্রশংসা করলে অনেক সময়ে তারা বেশি ভাল করে শেখে। নেতিবাচক কাজগুলির ব্যাখ্যা দিয়ে দিয়ে তার থেকে বিরত থাকার কথা বলতে হবে। শিশু মনোবিদের সঙ্গে যোগাযোগ করে কী কী করণীয়, তা জেনে নিতে হবে।
প্রশ্ন: এই পরিস্থিতিতে বাবা-মায়ের ভূমিকা কেমন হতে হবে?
এই পরিস্থিতিতে বাবা-মা অনেক সময় একে অপরকে দোষারোপ করে এবং এমনকি একে অপরের বংশকেও দোষারোপ করেন। যা একেবারেই কাঙ্খিত নয়। আবার, কোনও সমস্যা হলে ‘যা হচ্ছে হোক’ বা ‘ভগবান যা করার করবে’ বা গ্রামে-গঞ্জে অনেক ‘অলৌকিক কারণ’ দেখিয়ে কুসংস্কারকে প্রশ্রয় দেওয়ার প্রবণতা দেখা যায়। এমনটা করা একেবারেই উচিত নয়।
প্রশ্ন: শিশুর আশপাশের লোকজন, আত্মীয়স্বজনের দৃষ্টিভঙ্গি কতটা সংবেদনশীল হওয়া জরুরি?
সন্তানের এমন সমস্যায় বাবা-মায়েরা অনেক সময়ই নিজেদের ছোট ভাবেন, দোষী ভাবেন। হীনমন্যতায় ভোগেন। সামাজিক অনুষ্ঠানে যোগ দিতে চান না। এটা ঠিক নয়। স্বাভাবিক জীবনযাপন করুন। সন্তানকেও সমাজে স্বাভাবিক ভাবে মিশতে উৎসাহিত করুন। প্রতিবেশীরা কিছু বললে স্বাভাবিক জবাব দিন। প্রতিবেশী ইতিবাচক হলে সুবিধা আপনারই। আত্মীয়স্বজনের উচিত নেতিবাচক কথা না বলা। আর যাঁরা তা করেন না, প্রয়োজনে তাঁদের এড়িয়ে চলুন।
সন্তানের এমন সমস্যায় বাবা-মায়েরা অনেক সময়ই নিজেদের দোষী ভাবেন। হীনমন্যতায় ভোগেন। সামাজিক অনুষ্ঠানে যোগ দিতে চান না। এটা ঠিক নয়। স্বাভাবিক জীবনযাপন করুন। সন্তানকেও উৎসাহিত করুন।
তথ্যসূত্র: আনন্দবাজার
এমএইচ/