ঢাকা, শুক্রবার   ২২ নভেম্বর ২০২৪

সমাজ উন্নয়ন, শিক্ষাবিস্তার ও শিক্ষক

একুশে টেলিভিশন

প্রকাশিত : ১৯:১১, ১৮ এপ্রিল ২০১৮ | আপডেট: ২০:২৪, ১৮ এপ্রিল ২০১৮

মানুষ আল্লাহ্ তায়ালার শ্রেষ্ঠ সৃষ্টি- আশরাফুল মাখলুকাত। মানুষ শ্রেষ্ঠত্ব অর্জন করে তার শিক্ষা, আচার-আচরণ, বুদ্ধিমত্তা, মানবতাবোধ এবং সততা দিয়ে; এই চারিত্রিক গুণাবলীই তাকে সমাজে আলাদা করে অবস্থান করে দেয়। সব গুণাবলীর কথা বলতে ও শুনতে ভালো লাগে বটে কিন্তু সত্যিকার অর্থে তা অর্জন করা কঠিন, তবে অর্জন অসাধ্য নয়। এজন্য চাই প্রতিশ্রুতি, দৃঢ় মনোবল, সুষ্ঠু পারিবারিক ও সামাজিক পরিবেশ। মানুষ সমাজ গড়ে, সমাজ মানুষ গড়ে না। যখনই সমাজের ওপর মানুষ নির্ভরশীল হয়ে যায় তখনই মানুষ পড়ে যায় বিপাকে।

যতক্ষণ পর্যন্ত উপরোক্ত মানবিক ও চারিত্রিক ওণাবলী একজন মানুষের মধ্যে পরিলক্ষিত না হয়, ততক্ষণ তার শরীরে জন্তুর বাস বলে ধরা হয়। এটা অনস্বীকার্য যে, প্রত্যেক মানুষের মধ্যে পশুসুলভ অভ্যাস বিরাজমান থাকে। পুঁথিগত শিক্ষা নয় বরং সুশিক্ষা বা সামাজিক প্রশিক্ষণের মাধ্যমে উপরোক্ত গুণাবলী অর্জন করে একজন মানুষ সুশিক্ষিত হিসেবে সমাজে প্রতিষ্ঠিত হয়।

অনেক ত্যাগের বিনিময়ে নয় মাসের রক্তমাখা সংগ্রামের মধ্য দিয়ে আমরা দেশ স্বাধীন করেছি। দেশের এই স্বাধীনতা সমগ্র মানবগোষ্ঠীর অর্জন এবং এর কৃতিত্ব আমাদের সকলের। আজ আমরা স্বাধীন সার্বভৌম দেশের গর্বিত নাগরিক। দেশে শিক্ষার হার বেড়েছে, উন্নতিও হয়েছে, তবুও উন্নত জাতি হিসাবে মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে পারিনি। কারণ শিক্ষিত হলেও এখনও আমরা প্রকৃত মানুষ হতে পারিনি। যেহেতু সুশিক্ষার যথেষ্ট অভাব রয়েছে, সেহেতু শিক্ষার হার বেড়েছে বটে মান বাড়েনি- এই নিয়ে অনেক আলোচনা সমালোচনা হচ্ছে। অহরহ প্রশ্নপত্র ফাঁস হচ্ছে। শিক্ষক যিনি মানুষ গড়ার কারিগর- তার ওপর হাত উঠছে। অনেক শিক্ষিতজনই আজকাল নানা অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডে জড়িত হচ্ছেন। রাষ্ট্রের মালিক জনগণ, অথচ সেই জনগণই আজ অনেক ক্ষেত্রে অবহেলিত, বঞ্চিত, নিপীড়িত। স্বাধীনতা হলো এক বিশেষ অর্জন, নিয়মনীতি, সামাজিক দায়িত্ব ও কর্তব্যবোধের সঠিক ধারণার ওপরই প্রতিষ্ঠিত। হাত-পা যথেচ্ছ ছুড়তে পারাকেই স্বাধীনতা বলে না। স্বাধীনতা অর্জন করা যথা সহজ, তাকে রক্ষা করা আরো কঠিন।

শিক্ষা একটি চলমান প্রক্রিয়া- সমাজের উন্নয়নে সুশিক্ষাই বিশেষ প্রয়োজন। এই সুশিক্ষাই মানুষের মধ্যে ঐক্য ও মানবতাবোধ জাগ্রত করে। স্বাধীনতার চেতনায় উদ্বুদ্ধ হয়ে সুশিক্ষা যত বেশি প্রসারিত হবে, মানুষের মন ততই বড় হবে এবং সুষ্ঠু সমৃদ্ধ সমাজ গড়ে উঠবে।
একজন শিক্ষক যদি শুধু টাকার বিনিময়ে শিক্ষা বিতরণ করেন, তা হলে কি শিক্ষার্থী তার কাছ থেকে শিক্ষা কিনে প্রকৃত শিক্ষিত মানুষ গড়তে পারবেন? না পারবেন না।

শিক্ষাই জাতির মেরুদণ্ড, মেরুদণ্ড শক্ত হলে মানুষ দাঁড়াতে পারে। কিন্তু জাতির মেরুদণ্ড যদি দুর্বল ও শক্তিহীন হয়, জাতি তখন কীভাবে দাঁড়াবে? যে জাতি যত বেশি সুশিক্ষায় শিক্ষিত, সে জাতি তত উন্নত ও শক্তিশালী। উন্নত পশ্চিমা দেশগুলো এর উৎকৃষ্ট উদাহরণ। অক্লান্ত পরিশ্রম ও প্রচেষ্টায় অর্জিত জ্ঞান এক প্রজন্ম থেকে আর এক প্রজন্মে নবায়ন করা এবং ঐতিহ্যের সম্পদ হস্তান্তরের ক্ষেত্র হচ্ছে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। এবং এটাই সর্বাপেক্ষা গুরুত্বপূর্ণ বাহন। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শিক্ষাদান করেন শিক্ষক, তারাই মানুষ গড়ার কারিগর। তাদেরকে উপযুক্ত সম্মান ও মর্যাদার আসনে বসতে দিতে হবে। সেই আসনে আসীন হয়ে শিক্ষক-শিক্ষার্থীর আত্মবিশ্বাস সৃষ্টি ও মানব কল্যাণে আগ্রহ, অন্যায় ও অসত্যের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করার সৎ-সাহস ও উৎসাহ প্রদান করবেন, এটাই কাম্য। তবেই তিনি হবেন প্রকৃত শিক্ষক ও জীবন গড়ার কারিগর।

কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর লিখেছিলেন, ‘শিক্ষা সম্বন্ধে একটা মহা সত্য আমরা শিখিয়াছিলাম, মানুষ মানুষের কাছ থেকেই শিখতে পারে, যেমন জলের দ্বারাই জলাশয় পূর্ণ হয়, শিক্ষার দ্বারাই শিখা জ্বালিয়ে উঠে। প্রাণের দ্বারাই প্রাণ সঞ্চারিত হইয়া থাকে।’ সেই শিক্ষকের দ্বারাই শিক্ষার্থী পূর্ণতা লাভ করবে এবং সমাজ উপকৃত হবে। একজন ভালো মানুষ শিক্ষক যে কোনো দেশের একজন গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি। আমাদের প্রয়োজন ভালো শিক্ষক তার নিজ পাঠকে চিত্তাকর্ষক করে তোলেন এবং প্রত্যেক শিক্ষার্থীর মধ্যে যে গুণ বা মেধা লুক্কায়িত তা তিনি আবিষ্কার করবেন; আবার তেমনিভাবে শিক্ষকরাও তাদের কাজের পরিধি বিস্তার ও জ্ঞান বৃদ্ধিকল্পে সচেষ্ট হবেন। শিক্ষক হবেন আদর্শের প্রতীক। তারা নিজেদের কার্যকলাপের দ্বারা এমন বৈশিষ্ট্য উপস্থাপন করবেন যাতে ছাত্রছাত্রীরা তাদেরকে অনুসরণ করে নিজেদের জীবন গড়ে তুলতে পারে। কাজেই শিক্ষকদের কর্তব্য হবে নিজেদের মধ্যে সততা ও নৈতিকতার উদাহরণ স্থাপন করা।

যে ব্যক্তি চিন্তা, কর্ম ও অনুশীলনে সৎ নয়, সে ব্যক্তি প্রকৃতপক্ষে সৎ নয়। এ কথাটি স্বয়ং রাসুল (সা.) বলেছেন। এই কথাটি অনুধাবনযোগ্য ও তাৎপর্যপূর্ণ; কারণ সততা কখনও আংশিক হয় না, সততা মানেই হচ্ছে মন প্রাণ চিন্তা ও কর্মের সার্বিক ও সর্বতোমুখী পরিচ্ছন্নতা। এভাবেই গড়ে ওঠে সুখ সমৃদ্ধ সমাজ। শিক্ষার কোনো বিকল্প নেই, প্রকৃত সংজ্ঞা দেয়াও সম্ভব নয়। শিক্ষা মানেই কোনো না কোনো জ্ঞান; এই জ্ঞানই আলো। জ্ঞানকে শক্তি বলে বিবেচনা করা হয়। সূর্য যেমন জগতের আলো, জ্ঞান তেমনি হৃদয় ও মনের আলো। ইংরেজ চিন্তাবিদ Lord Brougham বলেছেন, ‘Education makes a people easy to lead but difficult to drive; easy to govern but impossible to enslave.

বিশ্বের সর্বত্র সংঘাত-সংঘর্ষ-বিক্ষুব্ধ পরিস্থিতি বিরাজমান। আমাদের নিজেদের ও সমাজের দিন দিন নীতি নৈতিকতার অবক্ষয় চলছে। সমাজ সত্যের পথ থেকে অনেকটা মিথ্যার দিকে ধাবিত। মিথ্যার গায়ে সত্যের পোশাক পরিয়ে সত্যের নামে অশান্তির বীজ বপন চলছে। মহানবী (সা.) বলেছেন, সত্যবাদিতা সর্বদাই মুক্তির পথ প্রশান্ত করে এবং মিথ্যাচারিত ধ্বংসের পথ ত্বরান্বিত করে। ভারতের জাতির পিতা গান্ধীজি বলেছেন, ‘সত্যই ঈশ্বর’। ‘God is truth & Truth is God’ আক্রোশের বশে মিথ্যাচার করে যত সহজে মানুষে মানুষে অনৈক্য ও বিভেদ এবং জাতিতে জাতিতে বিভাজন সৃষ্টি করা যায়, তত সহজে তাদেরকে ঐক্যবদ্ধ করা যায় না। এতে করে কারো কোনো উপকার হয় না; বরং ক্ষতি হয় দেশ ও জনগণের।

জীবন ক্ষণস্থায়ী সত্য ও মানব কল্যাণ চিরস্থায়ী। মানুষের জন্য কল্যাণকর কিছু করাই মানব জীবনের ধর্ম; সর্ব ধর্মই কল্যাণের কথা, সত্যের কথা বলেÑ সকল মানুষই যার যার ধর্ম মানে। ছেলেমেয়েদের সাধারণ শিক্ষার পাশাপাশি ধর্মীয় শিক্ষাদানেরও প্রয়োজন আছে । ধর্ম ছাড়া জীবন চলে না; কারণ ধর্ম ছাড়া একজন মানুষ পশুতে পরিণত হতে পারে। আল্লাহ যে আমাদেরকে সৃষ্টির সেরা জীব হিসেবে তৈরি করেছেন এবং সামান্যতম কৃতজ্ঞতাবোধ জানানোর জন্য স্রষ্টার কাছে নত হওয়া উচিত। ধর্মীয় আচার-আচরণের মাধ্যমে মানুষ তার জীবন নিয়ন্ত্রণ করেই কেবল সেই কৃতজ্ঞতাটুকু জানাতে পারে।

দেশ জাতি ও মানবগোষ্ঠীর শ্রেষ্ঠ সম্পদ যুবকেরা, যৌবন দীপ্ত তরুণ-তরুণীরা ভাঙা ও গড়ার শক্তিশালী কারিগর। ইদানীং একশ্রেণির যুবক অবৈধ পণ্যের ব্যবসা, পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ফাঁস ও নানাবিধ অপকর্মের সাথে জড়িত হয়ে গোটা যুবসমাজকে কলুষিত করছে। তরুণ সমাজ বিপথে চালিত হওয়া শুভ কল্যাণ নয়। প্রত্যেক তরুণ-তরুণীর আত্মোপলব্ধির প্রয়োজন। নিজেকে চিনতে হবে, দেশকে ভালোবাসতে হবে। সুশিক্ষায় শিক্ষিত হয়ে দেশের ভবিষ্যতের নেতৃত্বদান- দেশ পরিচালন করার দক্ষতা ও ক্ষমতা অর্জন করে একটি সুন্দর সমৃদ্ধ শক্তিশালী দেশগড়ার প্রত্যয় গ্রহণ করতে হবে, তাদের নিরাশ হলে চলবে না।

একটি প্রাচীন উক্তি ছিল- Know your work, know your food and your mate. এখন আধুনিক প্রবাদ হচ্ছে- Know your nation, your religion and your civilization. ইতিহাস অতীতের কথা বলে। তৎকালীন ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী Sir Winston Churchill এর একটি বিখ্যাত উক্তি- ‘The longer you can look back, the further you can look ahead’ বাংলায় বললে যত দূরবর্তী অতীত ইতিহাস তুমি জানবে, তত দূরতম ভবিষ্যৎ তুমি দেখবে। পৃথিবীতে যেসব জাতি উন্নতি লাভ করছে, তাদের ব্যাপারে একটি সত্য কথা হলো, তারা তাদের সুদূর অতীত থেকে তাদের ইতিহাস ঐতিহ্য ও মানবচরিত্র সম্পর্কে তথ্য-উপাত্ত অনুসন্ধান করে এবং সেই সুবাদে প্রেরণা লাভ করে এবং বর্তমানের সঙ্গে সমন্বয় সাধনের মাধ্যমেই কেবল সুন্দর ও স্থিতিশীল ভবিষ্যৎ গড়তে পারে। যে জাতি অতীত নিয়ে ভাবে না, তার সুন্দর ভবিষ্যৎ নির্মাণ সম্ভব নয় বলেই বিবেচিত হয়।

পরিশেষে বলতে চাই, ভারসাম্য ও শৃঙ্খলা বজায় রাখার জন্যই সমাজে আইন প্রণয়ন হয়। আইনের প্রয়োগ সকলের ক্ষেত্রেই সমান্য। এতে ব্যত্যয় হলেই মানুষ তার নিজের হাতে আইন তুলে নেয়, সমাজে অঘটন ঘটে, দেখা দেয় সামাজিক বিপর্যয়, যা মোটেই কাম্য নয়। যাই হোক, অপরাধে অভিযুক্ত ব্যক্তির বিচার যেন বিলম্ব না হয়, বিচার বিলম্ব হওয়া মানে বিচার অস্বীকার করা। ইংরেজিতে বলা হয়, ‘Justice delayed, Justice denied’। আবার সমাজে আইন-শৃঙ্খলার নামে বেশি বেশি আইন প্রণয়ন করাও ঠিক নয়। বেশি ন্যায়বিচার হওয়াই বাঞ্ছনীয়। এরই প্রেক্ষাপটে প্রায় হাজার বছর আগে খ্রিষ্টপূর্ব এক রোমান দেশীয় আইনজ্ঞ ডাস্টিনিয়ান বলেছিলেন, ‘What the society need today not more laws but more justice.’ অর্থাৎ বেশি বেশি আইন প্রণয়নের চেয়ে দরকার বেশি বেশি ন্যায়বিচার।

লেখক: বাংলাদেশের সাবেক প্রধান বিচারপতি ও শায়েস্তাগঞ্জ উচ্চ বিদ্যালয়ের ১৯৫৬ সালের এসএসসি ব্যাচের ছাত্র


** লেখার মতামত লেখকের। একুশে টেলিভিশনের সম্পাদকীয় নীতিমালার সঙ্গে লেখকের মতামতের মিল নাও থাকতে পারে।
Ekushey Television Ltd.










© ২০২৪ সর্বস্বত্ব ® সংরক্ষিত। একুশে-টেলিভিশন | এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি