সমাবর্তন এবং সমাবর্তন ভাষণ
প্রকাশিত : ১৬:৩৯, ১৪ জানুয়ারি ২০১৮ | আপডেট: ১৪:৪৬, ১২ ফেব্রুয়ারি ২০১৮
জানুয়ারির ৭ তারিখে কুষ্টিয়ার ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাবর্তন অনুষ্ঠানে আমাকে সমাবর্তন ভাষণ দেওয়ার জন্যে অনুরোধ করা হয়েছিল। প্রায় ১০ হাজার গ্র্যাজুয়েটদের সামনে বক্তৃতা দেওয়ার সুযোগ আমার মতো মানুষের জন্য একটা অনেক বড় সুযোগ। আমি এর আগে যখনই সমাবর্তন ভাষণ দেওয়ার সুযোগ পেয়েছি, ঘুরে-ফিরে একই কথা বলেছি। এবারেও তাই। তবে আমার কাছে মনে হয়েছে, নতুন গ্র্যাজুয়েটদের নতুন একটা বিষয়ে সতর্ক করে দেওয়ার সময় হয়েছে। নতুন প্রজন্ম সতর্কবাণীটি কীভাবে নেবে আমি জানি না। কিন্তু তারপরেও আমি জোর করে তাদের সেটা শুনিয়ে এসেছি! শুনতে রাজি থাকলে অন্যদেরও এই ভাষণটি এখানে শুনিয়ে দেওয়া যায়! সেটি ছিল এরকম—
‘আমার প্রিয় ছাত্রছাত্রীরা,
আজকের দিনটি তোমাদের জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দিনগুলোর একটি। একইসঙ্গে এটি সবচেয়ে আনন্দেরও একটি দিন। আমার অনেক বড় সৌভাগ্য যে তোমাদের এই আনন্দের দিনটিতে আমি তোমাদের সঙ্গে কিছু সময় কাটাতে পারছি। আমি মোটামুটি নিশ্চিত, আজ থেকে অনেকদিন পর যখন তোমরা জীবনে প্রতিষ্ঠিত হবে, যখন তোমরা সমাজ, জাতি, দেশ কিংবা পৃথিবীকে কিছু দিতে শুরু করবে, তখনও তোমাদের এই দিনটির কথা মনে থাকবে। আমি যদি আজকে বক্তব্য দিতে গিয়ে তোমাদের বিভিন্ন ধরনের নীতিকথা শুনিয়ে, বিভিন্ন ধরনের উপদেশ দিয়ে এবং বড় বড় কথা বলে ভারাক্রান্ত করে না ফেলি, তাহলে হয়তো তোমাদের আমার কথাটিও মনে থাকবে! আমার জন্যে সেটি বিশাল একটা সম্মানের ব্যাপার। আমাকে এত বড় সম্মান দেবার জন্যে আমি তোমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের কাছে কৃতজ্ঞ।
আমি আমার বক্তব্য শুরু করতে চাই একটি দুঃসংবাদ এবং একটি সুসংবাদ দিয়ে। (এই জায়গায় আমি শিক্ষার্থীদের জিজ্ঞাসা করেছিলাম, তারা কোনটি আগে শুনতে চায়। তারা আগে দুঃসংবাদটিই শুনতে চেয়েছিল!) দুঃসংবাদটি হচ্ছে— তোমরা তোমাদের জীবনের সর্বশ্রেষ্ঠ সময়টি কাটিয়ে ফেলেছ। আজকে, এখন এই মুহূর্ত থেকে তোমাদের জীবনের সর্বশ্রেষ্ঠ সময়টি অতীতের কিছু স্মৃতিতে বদলে যাচ্ছে। তোমরা এখন যত চেষ্টাই করো, বিশ্ববিদ্যালয়ের সেই বাধা-বন্ধনহীন বেহিসেবি স্বপ্নিল উদ্দাম তারুণ্যের জীবনটি আর কোনোভাবেই ফিরে পাবে না। এখন যে জীবনটিতে পা দিতে যাচ্ছ, সেটি কঠোর বাস্তবতার জীবন।
সুসংবাদটি হচ্ছে— লেখাপড়া শেষ করে তোমরা যে বাংলাদেশে তোমাদের কর্মজীবনে প্রবেশ করবে, সেই বাংলাদেশ দারিদ্র্যপীড়িত ভঙ্গুর অর্থনীতির একটি দেশ নয়। এই বাংলাদেশের অর্থনীতি উন্নয়নের মহাসড়কে উঠে পড়েছে। আমি আমার ছাত্রজীবন শেষ করে যে বাংলাদেশে কর্মজীবনে প্রবেশ করেছিলাম, সেখানে আমাদের মাথাপিছু আয় ছিল মাত্র ১১০ ডলার। বিশ্ববিখ্যাত অর্থনৈতিক সাময়িকী ‘দ্য ইকোনমিস্ট’ জানিয়েছে, এখন বাংলাদেশে তোমাদের মাথাপিছু আয় এক হাজার ৫৩৮ মার্কিন ডলার, পাকিস্তানের চেয়ে ৬৮ মার্কিন ডলার বেশি (বক্তব্যের এই জায়গায় আমি পাকিস্তান নামক অকার্যকর একটি রাষ্ট্রের সঙ্গে বাংলাদেশের তুলনা করার জন্যে শ্রোতাদের কাছে ক্ষমা চেয়েছি!)।
আমি যখন কর্মজীবনে প্রবেশ করেছি, তখন অর্থনীতির আকার ছিল মাত্র আট বিলিয়ন ডলার। এখন তার আকার ২৫০ বিলিয়ন ডলারের বেশি। আমরা যখন বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে গিয়েছি, আমাদের শিক্ষকেরা আমাদের পরিস্কার করে বলে দিয়েছিলেন— পাস করার পর দেশে আমাদের কোনও চাকরি নেই। এখন গত বছর দেশ-বিদেশে ২৪ লাখ মানুষের কর্মসংস্থান হয়েছে। যুদ্ধবিধ্বস্ত বাংলাদেশে আমাদের স্বপ্ন দেখার কোনও সুযোগ ছিল না, তোমাদের এই বাংলাদেশ নিয়ে তোমরা স্বপ্ন দেখতে পারবে। কারণ যুক্তরাজ্যভিত্তিক প্রাইস ওয়াটারহাউস কুপারস এক প্রতিবেদনে বলেছে যে, সামনের বছরগুলোতে পুরো পৃথিবীতে যে তিনটি দেশ খুবই দ্রুতগতিতে প্রবৃদ্ধির ধারা বজায় রাখবে তার একটির নাম বাংলাদেশ (বক্তব্যে এই জায়গাটিতে আমি যে তথ্যগুলো ব্যবহার করেছি, সেগুলো পেয়েছি ড. আতিউর রহমানের একটি লেখা থেকে। তার প্রতি কৃতজ্ঞতা)।
তোমরা একটি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় থেকে লেখাপড়া শেষ করে জীবনের পরের ধাপে পা দিতে যাচ্ছো। প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে তুলনা করে তোমাদের ধারণা হতে পারে, তোমরা বুঝি খুব অল্প খরচে একটা ডিগ্রি পেয়েছ। সেটি কিন্তু সত্যি নয়। তোমাদের লেখাপড়ার জন্যে অনেক টাকা খরচ হয়েছে। তোমরা সেটি টের পাওনি, কারণ তোমাদের পেছনে এই খরচটুকু করেছে সরকার। সরকার এই অর্থটুকু পেয়েছে এই দেশের চাষিদের কাছ থেকে, শ্রমিকদের কাছ থেকে, খেটে খাওয়া মানুষদের কাছ থেকে। আমি তোমাদের শুধু মনে করিয়ে দিতে চাই, এই দেশের অনেক দরিদ্র খেটে খাওয়া মানুষ হয়তো তার নিজের সন্তানকে স্কুল-কলেজ শেষ করিয়ে ইউনিভার্সিটি পর্যন্ত পাঠাতে পারেনি। কিন্তু তার হাড়ভাঙা খাটুনির অর্থ দিয়ে তোমাদের লেখাপড়া করিয়েছে। এখন তোমরাই ঠিক করো, তোমার এই শিক্ষাটুকু দিয়ে তুমি কার জন্যে কী করবে! অবশ্যই তুমি তোমার কর্মজীবন গড়ে তুলবে, কিন্তু তার পাশাপাশি যাদের অর্থে তুমি লেখাপড়া করেছ সেই দরিদ্র মানুষের ঋণ তোমাদের শোধ করতে হবে।
আমরা আমাদের দেশকে জ্ঞান-বিজ্ঞানে এগিয়ে নিয়ে যেতে চাই। তোমাদের সেই দায়িত্ব পালন করতে হবে। তোমরা কি জানো, জ্ঞান-বিজ্ঞানে দেশকে এগিয়ে নেওয়ার জন্যে তোমাদের হাতে যে অস্ত্রটি রয়েছে সেটি কোনও হেলাফেলা করার বিষয় নয়? সেটার নাম হচ্ছে হচ্ছে মস্তিস্ক! এটি এই বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের সবচেয়ে মূল্যবান, সবচেয়ে জটিল, সবচেয়ে চমকপ্রদ, সবচেয়ে বিস্ময়কর এবং সবচেয়ে রহস্যময়। ১০ হাজার কোটি নিউরনের দেড় কেজি ওজনের এই মস্তিস্কটিকে আমরা কীভাবে ব্যবহার করব, তার ওপর নির্ভর করবে তোমার ভবিষ্যত, তোমার দেশের ভবিষ্যত এবং পৃথিবীর ভবিষ্যত। তোমরা কি জানো, এই মহামূল্যবান রহস্যময় মস্তিষ্কটি নিয়ে এখন সারাবিশ্বে একটি অবিশ্বাস্য ষড়যন্ত্র চলছে? আমি নিশ্চিত তোমাদের অনেকেই নিজের অজান্তে সেই ষড়যন্ত্রের ফাঁদে পা দিয়েছ। এই ষড়যন্ত্রের নাম সোশ্যাল নেটওয়ার্ক। (বক্তব্যের এই জায়গাটিতে সন্দেহের যেন কোনও সুযোগ না থাকে, সেজন্যে উদাহরণ হিসেবে স্পষ্ট করে ফেসবুক শব্দটি উচ্চারণ করেছি।) শিক্ষক হিসেবে আমি লক্ষ্য করেছি, ২০১৩-১৪ সাল থেকে শিক্ষার্থীদের মধ্যে এক ধরনের গুণগত অবক্ষয় শুরু হয়েছে। তাদের মনোযোগ দেওয়ার ক্ষমতা কমে এসেছে, তাদের বিশ্লেষণী ক্ষমতা হ্রাস পেয়েছে।
পৃথিবীর সব মানুষেরই বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি নিয়ে এক ধরনের মোহ রয়েছে। অনেকেরই ধারণা, প্রযুক্তি মানেই ভালো, প্রযুক্তি মানেই গ্রহণযোগ্য। আসলে সেটি পুরোপুরি সত্যি নয়। পৃথিবীতে ভালো প্রযুক্তি যেমন আছে, ঠিক তেমনই অপ্রয়োজনীয় প্রযুক্তি, এমনকি খারাপ প্রযুক্তি পর্যন্ত আছে। শুধু তাই নয়, সবচেয়ে বিপদজনক বিষয় হলো— একটি প্রযুক্তি কারও কারও কাছে ভালো প্রযুক্তি হতে পারে, আবার কারও হাতে সেটি ভয়াবহ বিপদজনক প্রযুক্তি হয়ে যেতে পারে। তার জ্বলন্ত একটি উদাহরণ হচ্ছে সোশ্যাল নেটওয়ার্ক।
আমি অনেকগুলো উদাহরণ দিতে পারব যেখানে সোশ্যাল নেটওয়ার্ককে কেউ একজন একটি বৈচিত্র্যময়-সৃজনশীল উদ্যোগের জন্য ব্যবহার করেছে। দুর্ভাগ্যক্রমে আমি এর চাইতে অনেক অনেক বেশি উদাহরণ দিতে পারব যেখানে আমি তোমাদের দেখাতে পারব— এই সোশ্যাল নেটওয়ার্ক কেবল সময় অপচয়ের কাজে ব্যবহৃত হয়েছে। শুধু যদি সময়ের অপচয় হতো, আমরা সেটা প্রতিরোধ করতে পারতাম। কিন্তু সারাবিশ্বের জ্ঞানীগুণী মানুষেরা এক ধরনের আতঙ্ক নিয়ে আবিষ্কার করেছেন, এটি আমাদের চিন্তা করার প্রক্রিয়াটিই পালটে দিয়েছে। আমরা এখন কোনও কিছু মন দিয়ে পড়ি না, সেটা নিয়ে চিন্তা করি না, বিশ্লেষণ করি না। আমরা এখন শুধু কিছু তথ্য দেখি, তাতে চোখ বুলাই এবং নিজেকে অন্য ১০ জনের সামনে প্রচার করি (বক্তব্যের এই সময়টিতে ‘প্রচার’ বলতে কী বোঝানো হচ্ছে, সেটা স্পষ্ট করার জন্যে আমি ‘লাইক দেওয়া’ কথাটি ব্যবহার করেছিলাম)।
বিজ্ঞানী ও গবেষকরা দেখিয়েছেন, একজন মানুষ যেমন কোকেন, হেরোইন কিংবা ইয়াবাতে আসক্ত হতে পারে, ঠিক তেমনই সামাজিক নেটওয়ার্কেও আসক্ত হতে পারে। মাদকে নেশাসক্ত একজন মানুষ নির্দিষ্ট সময়ে মাদক না পেলে অস্থির হয়ে যায়, তার মস্তিষ্কে বিশেষ ধরনের কেমিক্যাল নির্গত হতে শুরু করে। বিজ্ঞানীরা দেখিয়েছেন, সোশ্যাল নেটওয়ার্কে আসক্ত একজন মানুষ নির্দিষ্ট সময়ে তার সোশ্যাল নেটওয়ার্কে সময় অপচয় না করতে পারলে সেও অস্থির হয়ে যায়, তার মস্তিষ্কেও বিশেষ ধরনের কেমিক্যাল নির্গত হতে শুরু করে। খুব সহজ ভাষায় বলা যায়, সত্যিকারের মাদকাসক্তির সঙ্গে সোশ্যাল নেটওয়ার্কে আসক্তির মধ্যে কোনও পার্থক্য নেই।
যারা এখনও আমার কথায় বিশ্বাস করতে পারছে না, তাদের ফেসবুকের উদ্যোক্তা প্রেসিডেন্ট শন পার্কারের বক্তব্যটি শোনা উচিত। তিনি বর্তমান ভয়াবহ আসক্তি দেখে আতঙ্কিত হয়ে বলেছেন, ‘শুধু খোদাই বলতে পারবে আমরা না জানি পৃথিবীর বাচ্চাদের মস্তিষ্কের কী সর্বনাশ করে বসে আছি।’
আমি তোমাদের মোটেও নতুন প্রযুক্তি নিয়ে আতঙ্কিত করতে চাই না। আমরা অবশ্যই চাইব তোমরা নতুন ধরনের প্রযুক্তি নিয়ে আগ্রহী হও, সেটা নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করো। আমি শুধু একটা বিষয় আলাদাভাবে মনে করিয়ে দিতে চাই। যদি আমার এই সমাবর্তন বক্তৃতা থেকে তোমরা একটিমাত্র লাইন মনে রাখতে চাও, তাহলে তোমরা এই লাইনটি মনে রেখো— তোমরা প্রযুক্তিকে ব্যবহার করবে, কিন্তু প্রযুক্তি যেন কখনোই তোমাদের ব্যবহার করতে না পারে। মনে রেখো, এই সব আধুনিক প্রযুক্তি কিন্তু পরজীবী প্রাণীর মতো; সেগুলো তোমার পুষ্টি খেয়ে বেঁচে থাকে। (সমাবর্তন ভাষণ দেওয়ার পর সংবাদ মাধ্যমে খবর এসেছে, পৃথিবীর সবচেয়ে বড় একটি স্মার্টফোন নির্মাতা অ্যাপলের বিনিয়োগকারীরা স্মার্টফোন ব্যাবহারকারী শিশুদের মস্তিষ্কের বিকাশ নিয়ে আতঙ্কের কথা জানিয়েছেন!)
তোমরা সবাই জানো, এই দেশটির অর্থনীতির তিনটি পিলারের একটি হচ্ছে গার্মেন্টসকর্মী, যার প্রায় পুরোটাই নারী; দ্বিতীয়টি হচ্ছে চাষী, যাদের আমরা অবহেলার চোখে দেখি এবং তৃতীয়টি হচ্ছে প্রবাসী শ্রমিক, যারা বিদেশ-বিভূঁইয়ে নিঃসঙ্গ প্রবাস জীবনে দেশের জন্যে রেমিট্যান্স অর্জন করে যাচ্ছে। সবাই কি লক্ষ্য করেছে, এই দেশের অর্থনীতিকে ধরে রাখার জন্যে এই তিনটি পিলারই কিন্তু শরীরের ঘাম ফেলে কাজ করে যাচ্ছে? তোমাদের কিংবা আমাদের মতো শিক্ষিত মানুষ, যারা মস্তিষ্ক দিয়ে কাজ করি, তারা কিন্তু এখনও অর্থনীতির চতুর্থ পিলার হতে পারিনি। আমাদের চতুর্থ পিলার হতে হবে, আমাদের মেধাকে নিয়ে দেশের শ্রমজীবী মানুষের পাশে এসে দাঁড়াতে হবে। যতক্ষণ পর্যন্ত আমরা সেটি করতে না পারব, ততক্ষণ দেশের প্রতি আমাদের দায়িত্ব পালন করা হবে না।
কিন্তু, আমরা কেন আমাদের মেধা-মস্তিষ্ক-মনন নিয়ে এখনও দেশের শ্রমজীবী মানুষের পাশে এসে দাঁড়াতে পারছি না? তার বড় একটা কারণ— এই দেশের দরিদ্র মানুষেরা, যারা নিজের সন্তানকে বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠাতে পারেনি, তাদের অর্থে পড়ালেখা করে এই দেশের সবচেয়ে সফল বিশ্ববিদ্যালয়ের সবচেয়ে সফল শিক্ষার্থীদের জীবনের প্রথম স্বপ্ন হচ্ছে বিদেশে পাড়ি দেওয়া। এটি অসাধারণ একটি ব্যাপার হতো যদি জীবনের কোনও একটি সময়ে তারা দেশে ফিরে আসত। আমাদের খুব দুর্ভাগ্য, তারা ফিরে আসছে না। এই দেশের সবচেয়ে মেধাবী ছেলেমেয়েদের প্রতিভাটুকু আমরা আমাদের নিজেদের দেশের জন্যে ব্যবহার করতে পারি না।
তোমরা যারা সত্যিকারের জীবনে প্রবেশ করতে যাচ্ছ, তাদের একটি সত্য কথা জানিয়ে দিই। মাতৃভূমিতে থেকে মাতৃভূমির জন্যে কাজ করার মতো আনন্দ আর কিছুতে নেই। ডক্টর মুহম্মদ শহীদুল্লাহ একটা খুব সুন্দর কথা বলেছিলেন। তিনি বলেছিলেন, প্রত্যেকটা মানুষের তিনটি করে মা থাকে— জন্মদাত্রী মা, মাতৃভাষা ও মাতৃভূমি। কথাটি পুরোপুরি সত্যি, মাতৃভূমি আসলেই মায়ের মতো। আমার সহজ-সরল সাদাসিধে মা’কে ছেড়ে আমি যেরকম কখনোই উচ্চশিক্ষিত, চৌকস সুন্দরী একজন মহিলাকে মা ডাকতে যাই না, দেশের বেলাতেও সেটা সত্যি। আমি আমার এই সাদামাটা দেশকে ছেড়ে চকচকে-ঝকঝকে একটা দেশকে নিজের মাতৃভূমি হিসেবে গ্রহণ করে বাকি জীবন কাটাতে পারব না। আমি সেটা বলতে পারি। কারণ আমি নিজে এর ভেতর দিয়ে এসেছি।
তোমরা এই দেশের নতুন একটি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বের হয়ে যাচ্ছ, এই বিশ্ববিদ্যালয়ের মশালটি এখন তোমাদের হাতে। তোমরা কর্মজীবনে কী করো, তার ওপর নির্ভর করবে এই বিশ্ববিদ্যালয়ের সুনাম। তাই তোমাদের আকাশছোঁয়া স্বপ্ন দেখতে হবে।
মনে রেখো, বড় স্বপ্ন না দেখলে বড় কিছু অর্জন করা যায় না! এই দেশটি তরুণদের দেশ। বায়ান্ন সালে (১৯৫২) তরুণেরা এই দেশে মাতৃভাষার জন্যে আন্দোলন করেছে, রক্ত দিয়েছে। একাত্তরে সেই তরুণরাই মাতৃভূমির জন্যে যুদ্ধ করেছে, অকাতরে রক্ত দিয়েছে। যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবিটি আমাদের এই তরুণেরাই নিশ্চিত করেছে। এখন আমাদের দেশটি যখন পৃথিবীর বুকে মাথা তুলে দাঁড়াতে যাচ্ছে, আবার সেই তরুণেরাই সবচেয়ে বড় ভূমিকা রাখবে। তোমরা সেই তরুণদের প্রতিনিধি। তোমাদের দেখে আমি অনুপ্রাণিত হই, আমি ভবিষ্যতের স্বপ্ন দেখি।
তোমাদের প্রতি কৃতজ্ঞতা— ভবিষ্যৎ নিয়ে স্বপ্ন দেখায় আমাকে নতুন একটি সুযোগ করে দেওয়ার জন্য!
ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ে আমার সমাবর্তন বক্তব্য এটুকুই। কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাবর্তন নিয়ে দু’টি কথা বলে শেষ করি। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা তাদের সমাবর্তনে যোগ দেওয়ার জন্যে পাগল হয়ে থাকে। আমরা যখন পাস করেছি, তখন দেশের অবস্থা খুব খারাপ ছিল। সমাবর্তনের মতো বিলাসিতার কথা কেউ চিন্তা পর্যন্ত করেনি। আমি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র ছিলাম। কিন্তু নিজের বিশ্ববিদ্যালয়ে সমাবর্তন পাইনি। এখন আর দেশের সেই অবস্থা নেই। এখনও কিন্তু পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলো নিয়মিতভাবে সমাবর্তন আয়োজন করে না। বেশ কয়েকবছর পর পর সমাবর্তন করা হয় বলে গ্র্যাজুয়েটদের সংখ্যা অনেক বেড়ে যায়। তাই আয়োজনটি অনেক জটিল হয়ে পড়ে। যদি প্রত্যেক বছর সমাবর্তন করা হতো, তাহলে গ্র্যাজুয়টদের সংখ্যা এত বেশি হতো না, আয়োজনটাও হতো অনেক সহজ। যদি প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিবছর সমাবর্তন করতে পারে, তাহলে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় কেন পারবে না?
আমরা মনে করি সমাবর্তন করা হয় গ্র্যাজুয়েটের জন্যে। আসলে সেটা কিন্তু সত্যি নয়। একটি সমাবর্তন যেটুকু শিক্ষার্থীদের জন্য, ঠিক ততটুকু কিংবা তার চাইতে বেশি তাদের বাবা-মা ও অভিভাবকদের জন্য। পৃথিবীর সব জায়গায় সমাবর্তনের বড় উৎসবটি করে গ্র্যাজুয়েটদের অভিভাবকেরা। কিন্তু আমাদের দেশে আমরা সমাবর্তন উৎসবে ছেলেমেয়েদের বাবা-মায়েদের সমাবর্তন প্যান্ডেলে ঢুকতে পর্যন্ত দেই না। যদি আমরা গ্র্যাজুয়েটদের সঙ্গে সঙ্গে তাদের বাবা-মায়েদের এই আনন্দ অনুষ্ঠানে যোগ দিতে দিতাম, সেটি কী চমৎকার একটি ব্যাপার হতো!
** লেখার মতামত লেখকের। একুশে টেলিভিশনের সম্পাদকীয় নীতিমালার সঙ্গে লেখকের মতামতের মিল নাও থাকতে পারে।