সমুদ্র অর্থনীতির প্রতিবেদন জমা হতে পারে কাল
প্রকাশিত : ১৮:৪৯, ৩০ জুলাই ২০১৮ | আপডেট: ১৮:১১, ৫ ডিসেম্বর ২০২০
ব্লু-ইকোনমি বা সমুদ্র অর্থনীতির উন্নয়নে কর্ম-পরিকল্পনা প্রতিবেদন আগামীকাল মঙ্গলবার জমা হতে পারে। প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে সম্প্রতি এক বৈঠকে সমুদ্র অর্থনীতি বিষয়ক এ প্রতিবেদন জমার তাগিদ দেওয়া হয়। প্রতিবেদন উপস্থাপনের শেষ সময় দেওয়া হয় ৩১ জুলাই। ব্লু-ইকোনমি সেলসহ সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় ও বিভাগগুলো এরইমধ্যে প্রতিবেদন তৈরি করেছে বলে সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে।
ব্লু-ইকোনমি হচ্ছে সমুদ্র সম্পদনির্ভর অর্থনীতি। সাগরের অজস্র জলরাশি ও এর তলদেশের বিশাল সম্পদকে কাজে লাগিয়ে উন্নয়নের স্বপ্ন পূরণে এক অর্থনৈতিক বিপ্লব। বিশাল সমুদ্র জয়ের পর সেই বিপ্লব বাস্তবায়নের রোডম্যাপে দুর্বার গতিতে এগিয়ে যেতে প্রতিজ্ঞ বাংলাদেশ। সমুদ্র অর্থনীতি ঘিরে নতুন স্বপ্ন দেখছে দেশ।
সম্প্রতি প্রধানমন্ত্রীর মুখ্য সচিব নজিবুর রহমানের সভাপতিত্বে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে একটি বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। বৈঠক সূত্রে জানা যায়, বৈঠকে মুখ্য সচিব বলেন, গত ২০১৪ সালে সমুদ্র জয়ের পর সমুদ্র সম্পদগুলো কাজের লাগাতে যে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছিল তার বেশিরভাগ থমকে আছে। যা খুবই দু:খজনক।
মুখ্য সচিব এ সময় সব মন্ত্রণালয় ও বিভাগকে ৩১ জুলাইয়ের মধ্যে পাঁচ ধাপে ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য অনুরোধ জানান। ধাপগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিল- আগে নেওয়া সিদ্ধান্তগুলো চিহ্নিত করা। প্রাথমিক কর্মপরিকল্পনা প্রণয়ন করা। কর্মপরিকল্পনা বাস্তবায়নে উপযুক্ত অংশীদার চিহ্নিত করা। দ্রুতগতিতে বাস্তবায়নের জন্য ফাস্ট-ট্র্যাক বাস্তবায়ন পরিকল্পনা নেওয়া ও কার্যক্রমের তদারকি ও মূল্যায়ন পরিকল্পনা নেওয়া।
বিভিন্ন মন্ত্রণালয় ও বিভাগের নেওয়া পদক্ষেপের বিষয়ে একটি অন্তর্বর্তীকালীন প্রতিবেদনও এ সময় প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে পাঠাতে বলা হয়। মন্ত্রণালয় ও বিভাগগুলো স্বল্প, মধ্য ও দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনার অগ্রগতি প্রতিবেদনও একই সময়ে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় ও মেরিটাইম অ্যাফেয়ার্স ইউনিটে পাঠানোর নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।
ব্লু ইকোনমি সেল সূত্রে জানা যায়, প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের নির্দেশনা অনুযায়ী আগে থেকেই কাজ করছিল ইকোনমি সেল। সম্প্রতি অনুষ্ঠিত বৈঠক থেকে আসা নির্দেশনা সে কাজে আরও গতি সঞ্চার করা হয়েছে। এরইমধ্যে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা প্রতিবেদন তৈরিতে তৎপর হয়েছেন। প্রতিবেদন প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে জমা দেওয়া হবে। কার্যালয় থেকে বৈঠক ডাকলেই সেটা নিশ্চিত করে বলা যাবে কবে এবং কি কি বিষয়ে প্রতিবেদন জমা দেওয়া হচ্ছে।
ব্লু ইকোনমি সেলের মূল সমন্বয়ক অতিরিক্ত সচিব গোলাম শফিউদ্দিন এনডিসি বলেন, সুনীল অর্থনীতির বিপুল সম্ভাবনা কাজে লাগাতে আমাদের কার্যক্রম আগের তুলনায় বেড়েছে।
এ অসীম সম্পদ আহরণে সমুদ্রের সঙ্গে সম্পৃক্ত হতে পারে এমন ১৭টি মন্ত্রণালয় ও ১২ বিভাগের সমন্বয়ের কাজ করছে ব্লু -ইকোনমি সেল। এ কাজের অগ্রগতি আমরা নিয়মিত প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে উপস্থাপন করি। এবারও করা হবে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক সেলের অন্য এক কর্মকর্তা বলেন, আমাদের এ অস্থায়ী সেলটির জন্য আর্থিক বরাদ্দ নেই। লোকবলও প্রয়োজনের তুলনায় কম। আবার আইনি কর্তৃত্ব না থাকায় সেলটির সিদ্ধান্ত মানায় সরকারের অন্যান্য সংস্থার বাধ্যবাধকতা নেই। এ নানাবিধ সমস্যায় সেলের কার্যক্রম ব্যাহত হচ্ছে।
তবে আশার কথা হলো ব্লু-ইকোনমির কাজ এগিয়ে নিতে এরইমধ্যে কর্তৃপক্ষ গঠনের প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে। এ কর্তৃপক্ষ থাকবে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের অধীনে। তবে তার আগে এ-সংক্রান্ত আইন প্রণয়ন করতে হবে। কবে নাগাদ আইনটি চূড়ান্ত হবে, তা বলা যাচ্ছে না।
২০১২ সালে মিয়ানমার ও ২০১৪ সালে ভারতের সঙ্গে সমুদ্রসীমা বিরোধ নিষ্পত্তি হয়। জাতিসংঘের সমুদ্রসীমা বিষয়ক আন্তর্জাতিক ট্রাইব্যুনালের মাধ্যমে এক লাখ ৮২ হাজার ৮১৫ বর্গকিলোমিটার সমুদ্রসীমা অর্জন করে বাংলাদেশ। আন্তর্জাতিক আদালতের রায়ে ২০০ নটিক্যাল মাইল পর্যন্ত একচ্ছত্র অর্থনৈতিক অঞ্চল ও চট্টগ্রাম উপকূল থেকে ৩৫৪ নটিক্যাল মাইল পর্যন্ত মহীসোপানের তলদেশের সব প্রাণিজ-অপ্রাণিজ সম্পদে সার্বভৌম অধিকার প্রতিষ্ঠিত হয় বাংলাদেশের।
এ সমুদ্রসীমায় তেল, গ্যাস, মূল্যবান খনিজ সম্পদ, মৎস্য আহরণ এবং সমুদ্রসীমার নিরাপত্তার জন্য কেন্দ্রীয়ভাবে কৌশলগত পরিকল্পনা নেওয়া হয় ২০১৪ সালে।
সংশ্নিষ্ট সূত্রে জানায়, ভারত ও মিয়ানমারের কাছ থেকে বিশাল সমুদ্রসীমা অর্জন করলেও সমুদ্রকেন্দ্রিক অর্থনীতি বিষয়ে সংশ্নিষ্ট মন্ত্রণালয়, বিভাগ ও সংস্থাগুলোর নেওয়া কার্যক্রম এক প্রকার স্থবির হয়ে আছে। অর্জিত জলসীমায় সমুদ্রসম্পদ আহরণ ও সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনার লক্ষ্যে সংশ্নিষ্ট মন্ত্রণালয় ও বিভাগগুলো স্বল্প, মধ্য ও দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা প্রণয়ন এবং সিদ্ধান্ত নেয় ২০১৪ সালে। কিন্তু সিদ্ধান্তগুলোর দু-একটি ছাড়া কোনোটাই বাস্তবায়ন হয়নি। সিদ্ধান্তগুলি বাস্তবায়নে সমুদ্র সম্পদে একধাপ এগিয়ে যেত বাংলাদেশ।
জানা গেছে, বিশ্ব অর্থনীতিতে তিন থেকে পাঁচ ট্রিলিয়ন মার্কিন ডলারের কর্মকাণ্ড হচ্ছে সমুদ্র ঘিরে। বিশ্বের ৪৩০ কোটি মানুষের ১৫ শতাংশ প্রোটিনের জোগান দিচ্ছে সামুদ্রিক মাছ, উদ্ভিদ। ৩০ শতাংশ গ্যাস ও জ্বালানি তেল আসছে সাগর থেকে। সুনীল অর্থনীতি বাংলাদেশের মানুষের খাদ্য নিরাপত্তা এবং মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) প্রবৃদ্ধি ঘটিয়ে জাতীয় অর্থনীতিকে আরও সমৃদ্ধ করার সমূহ সম্ভাবনা রয়েছে।
অর্থনীতিবিদরা জানান, ইন্দোনেশিয়ার জাতীয় অর্থনীতির সিংহভাগই সমুদ্রনির্ভর। সম্প্রতি দেশটি ব্লু ইকোনমিকে কেন্দ্র করে বেশ কিছু পদক্ষেপ নিয়েছে, যেগুলো বাস্তবায়িত হলে সমুদ্র থেকে আহরিত সম্পদের মূল্যমান ইন্দোনেশিয়ার জাতীয় বাজেটের ১০ গুণ হবে। অস্ট্রেলিয়া সমুদ্রসম্পদ থেকে বর্তমানে প্রায় ৪৪ বিলিয়ন মার্কিন ডলার আয় করছে। ২০২৫ সাল নাগাদ এ আয়ের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ১০০ বিলিয়ন ডলার।
প্রতিবেশী দেশ মিয়ানমার ও ভারত তাদের সমুদ্র এলাকা থেকে প্রাকৃতিক গ্যাস ও তেল অনুসন্ধান ও উত্তোলনের কাজ এরই মধ্যে শুরু করেছে। প্রতিবেশী এ দুই দেশ সমুদ্র থেকে প্রাকৃতিক সম্পদ আহরণ শুরু করলেও বাংলাদেশ এখনও উল্লেখযোগ্য কিছু করতে পারেনি।
পল্লী কর্ম সহায়ক ফাউন্ডেশন (পিকেএসএফ) চেয়ারম্যান অর্থনীতিবীদ কাজী খলীকুজ্জমান আহমেদ এ বিষয়ে বলেন, মিয়ানমারসহ পার্শবর্তীদেশগুলোর অভিজ্ঞতা আমাদের বলছে সমুদ্রে আমাদের বিপুল সম্ভাবনা আছে। যেগুলো কাজে লাগাতে পারলে অর্থনৈতিকভাবে দেশ আরও এগিয়ে যাবে। আমরা সেখান থেকে তেল-গ্যাসসহ অন্যান্য সম্পদ আহরণ করতে পারি।
তবে সম্ভাবনা এক জিনিস আর সেটাকে কাজে লাগানো আর এক জিনিস। বাস্তবায়ন এক জিনিস। এ সব সম্ভাবনা কাজে লাগানোর ক্ষেত্রে আমরা পিছিয়ে আছি। এক্ষেত্রে যথাযথ উদ্যোগের ঘাটতি রয়ে গেছে। আমাদের বড় দুর্বলতা গবেষণাভিত্তিক বাস্তবায়নযোগ্য পরিকল্পনার অভাব। গবেষণার ক্ষেত্রে কী কী কাজ আগে করা দরকার, সেগুলো অগ্রাধিকার নির্বাচন করতে হবে। সর্বোপরি এ কাজকে এগিয়ে নেবে এমন উপযুক্ত পৃথক একটি প্রতিষ্ঠানের অভাব।
একটি বিষয় হলো বাংলাদেশে আমরা অনেক ক্ষেত্রে পরিকল্পনা করি। কিন্তু পরিকল্পনার অনেক ক্ষেত্রেই বাস্তবায়নে গিয়ে যেভাবে কাজ হওয়ার কথা সেভাবে হয় না। তো সমুদ্র অর্থনীতির বিষয়ে আমরা পরিকল্পনারও আগে রয়ে গেছি। সে জন্য এ ক্ষেত্রে আমাদের প্রথম কাজ হচ্ছে অগ্রাধিকার ঠিক করে পরিকল্পনা করা।
সরকারের একটা সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নের জন্য একটা প্রতিষ্ঠান লাগবে-ই। এ ক্ষেত্রে যে প্রতিষ্ঠানগুলো আছে সে প্রতিষ্ঠানগুলো যদি না করতে পারে, তবে নতুন প্রতিষ্ঠান করতে হবে।
সমুদ্রের এ সম্ভাবনা বিষয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমুদ্র বিজ্ঞান বিভাগের চেয়ারম্যান ও ইন্টারন্যাশন্যাল সেন্টার ফর অসিয়ান গভর্নেন্সের (আইসিওজি) পরিচালক অধ্যাপক ড. কাওসার আহমেদ বলেন, সমুদ্রের সম্ভাবনার একটি হচ্ছে গ্যাস। বর্তমানে আমাদের ল্যান্ডে গ্যাস আছে ১০ থেকে ১২ ডিসিএফ। প্রতিবছর আমরা ব্যবহার করি ১ডিসিএফ। তাহলে একটা বাচ্চাও সহজে বলতে পারবে যে আমাদের গ্যাসে আর মাত্র ১২ বছর চলবে। এখন ১২ বছর পর আমরা কি করবো?
সে জন্য আমি বলি ১২ বছর পর গ্যাসের সংকট মোকাবেলায় যে পরিমান উদ্যোগ নেওয়া দরকার ছিল। সে পরিমান উদ্যোগ কর্তৃপক্ষ আগে থেকে নেয়নি। তবে বর্তমান সরকার যদি এখনও সমুদ্রে সম্ভাবনাময় গ্যাস কাজে লাগাতে কার্যকরী উদ্যোগ নেই, আমাদের গ্যাস সংকট অনেকটা দূর হতে পারে।
তিনি আরো বলেন, সমুদ্রের এ বিপুল সম্ভাবনা কাজে লাগাতে যে পরিমান জনসম্পদ আমাদের দরকার সে পরিমান দক্ষজনসম্পদও আমাদের নেই। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে সমুদ্র বিজ্ঞান বিষয়ে সর্বপ্রথম পাঠদান করছি আমরা।পাঁচ বছর আগে থেকেই এ পাঠদান চলছে।তবে এ ক্ষেত্রে এখনও আমাদের কোন গ্রাজুয়েট বের হয়নি।আশা করি এ ক্ষেত্রে অনার্স মাস্টার্স করে আগামী ২০১৮ সালে কিছু গ্রাজুয়েট বের হবে।এর আগে যারা বেরিয়েছে তারা সাধারণ মাস্টার্স পাশ করে বেরিয়ে গেছে।তিনটি ব্যাচে মোট ৫০ থেকে ৬০ জন্ মতো বের হয়েছে।কিন্তু তারা তেমন দক্ষ না। সমুদ্র বিষয়ে দক্ষ মানবসম্পদ গড়ে তুলতেও সরকারকে উদ্যোগী হতে হবে।
/ এআর /
আরও পড়ুন