সম্রাট বাবরের মৃত্যু ও পিতৃস্নেহের জয়
প্রকাশিত : ২২:৫০, ৩০ জানুয়ারি ২০২০
সম্রাট বাবর ও পুত্র হুমায়ুন
‘মরিয়া বাবর অমর হইয়াছে, নাহি তার কোনও ক্ষয়, পিতৃস্নেহের কাছে হইয়াছে মরণের পরাজয়।’ কবিতার এই চরণ দুটি মুঘল সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠাতা দিল্লির সম্রাট বাবরকে নিয়ে লেখা। তিনি স্বীয় বীরত্ব ও বিচক্ষণতায় ভারতবর্ষে মুঘল সাম্রাজ্যের ভিত রচনা করেন। একইসঙ্গে প্রাণপ্রিয় পুত্র হুমায়ুনের প্রতি অকৃত্রিম ভালোবাসা প্রদর্শন করে তিনি বিশ্বের ইতিহাসে স্নেহবৎসল পিতা হিসেবেও স্থাপন করে গেছেন অনন্য নজির।
পুরো নাম জহির উদ্দিন মোহাম্মদ বাবর, তবে বাবর নামেই সমধিক পরিচিত। বাবর জন্মেছিলেন ১৪৮৩ সালের ১৪ ফেব্রুয়ারি ফারগানা (বর্তমানে উজবেকিস্তান) প্রদেশের আনদিজান শহরে। তিনি ফারগানা প্রদেশের শাসনকর্তা ওমর মির্জার বড় পুত্র ছিলেন। পিতার মৃত্যুর পর মাত্র ১২ বছর বয়সেই সিংহাসনে বসেন। তবে চাচার ষড়যন্ত্রের কাছে পরাজিত হয়ে সেখান থেকে বিতাড়িত হন বাবর। পরে ধীরে ধীরে শক্তি সঞ্চয় করে হিন্দুকুশের দিকে পা বাড়ান বাবর।
১৫২৯ সালে ঘাঘরার যুদ্ধে আফগানদের বিরুদ্ধে চূড়ান্ত বিজয় মুঘল সাম্রাজ্যকে হিন্দুস্তানে পাকাপোক্ত একটি অবস্থান গড়ে দেয়। অবশ্য এর আগেই, ১৫২৭ সালের ১৬ মার্চ, খানুয়ার যুদ্ধে রাজপুতদের পরাজিত করে সম্রাট বাবর নিজের পরিবারের জন্য হিন্দুস্তানকে নিরাপদ ভাবতে শুরু করেন। কাবুল দুর্গে অবস্থানরত তার পরিবারকে আগ্রা আসার অনুমতি দেন। পুরো পরিবার নিয়ে আগ্রা দুর্গে বেশ কিছুদিন শান্তিতেই সময় কাটাতে লাগলেন সম্রাট বাবর। এসময় অবশ্য সাম্রাজ্য সংক্রান্ত বিভিন্ন সমস্যা নিয়ে কাজ করতে হচ্ছিলো বাবরকে, তবে এ সময়টুকু তিনি নিজেরমতো করে পরিবারের সঙ্গেই অতিবাহিত করেন। এ সময় তিনি তার প্রিয়তমা স্ত্রী মাহাম বেগমকে নিয়ে ধোলপুর থেকেও একবার ঘুরে আসেন।
কিন্তু এর তিন মাস পরেই বাবরের পরিবারে নেমে আসে বেদনাদায়ক এক বিপর্যয়। হঠাৎ করেই প্রচন্ড পেটের অসুখে মারা যান সম্রাটের এক পুত্র। সম্রাট বাবর ও দিলদার বেগমের এই পুত্রের নাম ছিলো আলোয়ার মির্জা। ঘটনার আকস্মিকতায় পুরো মুঘল পরিবার হতভম্ব, বিমর্ষ। মুঘল রাজদরবারে নেমে আসে শোকের ছায়া।
এরকম থমথমে অবস্থা কাটাতে সম্রাট বাবর আবারও তার স্ত্রীদের নিয়ে ধোলপুরের দিকে যাত্রা করেন। এমন শোকের সময় স্থান বদল করলে হয়তো শোকের তীব্রতা কমে আসবে, এটাই ছিলো পরিবারের প্রধান হিসেবে মুঘল সম্রাট বাবরের একমাত্র আশা।
তবে ধোলপুর গিয়েও তেমন একটা স্বস্তি পেলেন না বাবর। কারণ দিল্লি থেকে মাওলানা মুহাম্মদ ফারঘালি একটি পত্র পাঠান। পত্রে বাবরের প্রিয়পুত্র হুমায়ুনের অসুস্থতার খবর জানান মাওলানা ফারঘালি। পত্র পেয়ে বাবর দ্রুত হুমায়ুনকে দিল্লি থেকে রাজধানী আগ্রা নিয়ে আসার নির্দেশ দিয়ে আগ্রার দিকে যাত্রা করেন। তখন বাবরের সঙ্গী ছিলেন হুমায়ুনের মাতা মাহাম বেগম। পুত্রের অসুস্থতার কথা শুনে তিনি ইতোমধ্যেই বেশ কয়েকবার জ্ঞান হারান।
হুমায়ুন ছিল বাবরের পুত্রদের মধ্যে অত্যধিক প্রিয়। কারণ, হিন্দুস্তান অভিযানের সময় শাহাজাদা হুমায়ুনই সঙ্গ দিয়েছিলেন পিতাকে, সেই সময় থেকে দুজনের মধ্যে আত্মিক বন্ধন গড়ে ওঠে। যা বাবরের মৃত্যুর পূর্ব পর্যন্ত বজায় ছিলো।
হুমায়ুনের অবস্থা দিন দিন খারাপ হচ্ছিলো। মাহাম বেগমের মাতৃআবেগ ধীরে ধীরে লাগামছাড়া হয়ে যাচ্ছিলো। একদিন তিনি সম্রাট বাবরকে পুত্রের জন্য বিচলিত হতে দেখে বলে বসলেন, ‘আমার ছেলের জন্য আপনার আর কতটুকু দুশ্চিন্তা আছে? আপনার আরও ছেলে আছে, কিন্তু আমার তো মাত্র একটিই ছেলে।’
কিন্তু মাহাম বেগম কখনওই ধারণা করতে পারেন নি যে, বাবর তার এই পুত্রের জন্য নিজের মনে কতোটা ভালোবাসা সঞ্চয় করে রেখেছিলেন। সম্রাট বাবর নিজে জানতেন হুমায়ুনকে তিনি কতোটা ভালোবাসতেন। আর তাই পুত্রের রোগশয্যার পাশে বসে পুত্রের জন্য একমনে তিনি আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করতেন। তারপরও চিকিৎসা কিংবা প্রার্থনা- হুমায়ুনের জন্য এর কোনওটিই কাজ করছিলো না।
এ সময় বাবরের দরবারের বেশ কয়েকজন (হেকিম ও দরবেশ) পরামর্শ দিলো, বাবর যদি তার নিজের জীবনের সবচেয়ে প্রিয় বস্তুটি উৎসর্গ করে দেন, তাহলে হয়তো আল্লাহ তার পুত্র হুমায়ুনের জীবন ভিক্ষা দিতে পারেন।
এই কথা শোনামাত্র বাবর ভাবতে লাগলেন, এমন কী আছে, যা তিনি সবচেয়ে বেশি ভালোবাসেন। হঠাৎ বাবরের মাথায় আসলো প্রতিটি মানুষই তার নিজের জীবনকে অন্য সবকিছুর চেয়ে বেশি ভালোবাসে। আর তাই বাবর তার পুত্র হুমায়ুনের জন্য নিজের জীবন উৎসর্গ করার সিদ্ধান্ত নিলেন।
এরপরেই একরাতে তিনি পুত্রের শয্যার পাশে চক্রাকারে ঘুরতে লাগলেন, আর বিড়বিড় করে বলতে লাগলেন, ‘হে আল্লাহ, যদি একজনের প্রাণ নিয়ে আরেকজনের প্রাণ ফিরিয়ে দেয়া সম্ভব হয়, তাহলে পুত্রের প্রাণের বিনিময়ে আমার নিজের প্রাণ উৎসর্গ করতে আমি প্রস্তুত।’ ‘হুমায়ুন কে সুস্থ করে দাও, আর হমায়ুনের অসুখ আমাকে দাও’-এমন সব প্রার্থনা।
আশ্চর্যজনক হলেও সত্য, এর কিছুদিন পরেই হুমায়ুন ধীরে ধীরে সুস্থ হয়ে উঠতে লাগলেন। আর সম্রাট বাবর ধীরে ধীরে অসুস্থ হতে শুরু করলেন। তবে, হুমায়ুনের সুস্থ হয়ে ওঠা আর সম্রাট বাবরের অসুস্থ হয়ে বিছানায় যাওয়ার মাঝে ব্যবধান ছিলো কয়েক মাস।
সুস্থ হয়ে ওঠার পরও পুরোপুরি আরোগ্য লাভের জন্য শাহজাদা হুমায়ুন ২/৩ মাস বিশ্রাম নেন। এই সময়ে ধীরে ধীরে সম্রাট বাবরের ভেতরে অসুস্থতার লক্ষণ ফুটে উঠতে শুরু করে। এই অসুস্থতার ভেতরেই বাবর হুমায়ুনকে রাজকীয় কাজে কালিঞ্জর যেতে নির্দেশ দেন। পিতার এই অসুস্থতায় হুমায়ুন কালিঞ্জর যেতে একটু দ্বিধান্বিত ছিলেন। কিন্তু সম্রাটের আদেশ তো মানতেই হবে। তাই তিনি তার পিতা ও সম্রাটের আদেশ মেনে নিয়ে কালিঞ্জর চলে যান। কিন্তু কালিঞ্জর যাওয়ার কিছুদিনের মধ্যেই পিতার মারাত্মক অসুস্থতার খবর তাকে জানানো হলে তিনি দ্রুত আগ্রায় ফিরে আসেন।
হুমায়ুন ফিরে এসে পিতাকে খুবই অসুস্থ অবস্থায় পেলেন এবং রাজকীয় দুর্গে বাবরের দ্রুত উন্নত চিকিৎসার ব্যবস্থা করা হলো। কিন্তু তারপরও ধীরে ধীরে বাবরের রোগের প্রকোপ বাড়তে থাকলো। কিছুদিন পরেই সম্রাট বাবর অসুস্থতার কারণে আরও দুর্বল হয়ে যেতে লাগলেন। এমনকি হাঁটাচলা কিংবা বিছানা থেকে উঠে বসার শক্তিটুকুও হারিয়ে ফেললেন তিনি। তার মুখমন্ডল ফ্যাকাশে হয়ে যেতে লাগলো।
হিন্দুস্তানের মহান অধিপতি সম্রাট বাবর বুঝতে পারলেন, পৃথিবীতে তার সময় শেষ হয়ে আসছে। নিজের যা কাজ ছিলো পৃথিবীতে, তা তিনি শেষ করে ফেলেছেন। তবে তখনও একটা কাজ বাকী ছিলো। তিনি সেই কাজটি সম্পাদনের জন্য তার দরবারের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাদের রাজ দরবারে ডাকলেন।
১৫৩০ সালের ২২ ডিসেম্বর, আগ্রার পুরাতন দুর্গ। নিজের শারীরিক দুর্বল অবস্থা নিয়েই সম্রাট বাবর রাজ দরবারে তার সিংহাসনে গিয়ে বসলেন। পরিবার আর সভাসদের সবাই অনুরোধ করছিলেন, যা বলার তা নিজের ব্যক্তিগত কক্ষ থেকেই ঘোষণা করতে। কিন্তু সম্রাট বাবর চাইছিলেন যা বলার তা এই সিংহাসন থেকেই বলবেন। অসুস্থ সম্রাট সিংহাসনে বসে আছেন। দরবার আর পরিবারের লোকেরা উৎসুক দৃষ্টিতে সম্রাটের দিকে চেয়ে আছেন।
সম্রাট বাবর হঠাৎ বলতে শুরু করলেন। কথা বলতে তার বেশ কষ্ট হচ্ছিলো। তারপরও তিনি বলতে লাগলেন, ‘আল্লাহর কৃপায় ও আপনাদের সমর্থনে আমি আমার জীবনে সব কিছুই অর্জন করতে সক্ষম হয়েছি। পৃথিবীতে আমার সব ইচ্ছাই পূরণ হয়েছে। তবে আমি সুস্থ অবস্থায় নিজের সব কাজ সম্পন্ন করতে পারলাম না। আজ আপনাদের সামনে আমি নিজের শেষ ইচ্ছা প্রকাশ করছি। আমার পরে আমি মুঘল সিংহাসনে হুমায়ুনকে বসিয়ে যেতে চাই। আমি আশা করবো, আমার প্রতি আপনারা যেমন অনুগত ছিলেন, বাদশাহ হিসেবে আপনারা হুমায়ুনের প্রতিও ঠিক তেমনই অনুগত থাকবেন। তার সকল কাজকে সমর্থন জানাবেন। আমি আশা করছি, মহান আল্লাহর দয়ায় হুমায়ুন সফলভাবে তার দায়িত্ব পালন করতে সক্ষম হবে।’
দরবারে উপস্থিত বাবরের সভাসদরা কান্নাভেজা চোখে তাদের প্রিয় সম্রাটের সামনে শপথ করলেন, তারা নিজেদের জীবন দিয়ে হলেও তাদের সম্রাটের শেষ ইচ্ছা অক্ষরে অক্ষরে পালন করবেন। এরপর সম্রাট বাবর হুমায়ুনের দিকে তাকিয়ে দুর্বল কন্ঠে বললেন, ‘হুমায়ুন, প্রিয় পুত্র আমার, আমি তোমাকে, তোমার ভাই-বোন, আত্মীয়স্বজন ও তোমার প্রজাদের আল্লাহর হাতে সমর্পণ করে যাচ্ছি।’
হুমায়ুনকে মুঘল সাম্রাজ্যের পরবর্তী সম্রাট ঘোষণা দেয়ার তিন দিন পর, ১৫৩০ সালের ২৬ ডিসেম্বর হিন্দুস্তান ও মহান মুঘল সাম্রাজ্যের প্রথম সম্রাট জহির উদ্দিন বাবর পৃথিবীকে বিদায় জানিয়ে পরপারে মহান রবের কাছে চলে গেলেন। পেছনে রেখে গেলেন নিজের জীবনের বিশাল এক কীর্তি আর বীরত্বপূর্ণ ও স্নেহবৎসল্যের এক অসমাপ্ত অধ্যায়।
পুনশ্চ: আধুনিক ইতিহাসবিদদের মতে, ইব্রাহিম লোদীর মা বাবরকে হত্যার জন্য বিষ প্রয়োগ করেছিলেন, সেই বিষের ক্রিয়া তার শরীরকে ধীরে ধীরে অসুস্থ করে দিচ্ছিল। জানা যায়, শারীরিকভাবে প্রবল শক্তিশালী বাবর ভারতীয় আবহাওয়ার সাথেও মানিয়ে নিতে পারছিলেন না। হুমায়ুননামায় গুলবদন বেগম বলেছেন, বাবর অনেক আগে থেকেই পেটের অসুখে ভুগতেন। এছাড়া এই সম্রাটকে মানসিক ও শারীরিক অসুস্থতায়ও অনেক যুদ্ধে লড়তে হয়েছে। তথ্যসূত্র- বাবরনামা, হুমায়ুননামা, ভারতের ইতিহাস (১৫০০-১৮১৮)।
এনএস/