‘সর্বত্র বাংলার প্রচলন না হওয়া দুঃখজনক’
প্রকাশিত : ১৭:২২, ৯ ফেব্রুয়ারি ২০১৮ | আপডেট: ২০:২২, ৯ ফেব্রুয়ারি ২০১৮
ভাষা শহীদ আবদুল জব্বারের একমাত্র সন্তান নুরুল ইসলাম বাদল। ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি আবদুল জব্বার যখন শহীদ হয়েছিলেন তখন তিনি মাত্র দেড় বছরের শিশু। পরে চাকরি করেছেন বাংলাদেশ সেনাবাহিনীতে। সৈনিক হিসেবে যোগ দিয়ে ওয়ারেন্ট অফিসার হিসেবে অবসর নেন। স্বাধীনতার পরে তেজগাঁওয়ে একটি বাড়ি সরকার ভাষা শহীদ জব্বারের পরিবারের জন্য বরাদ্দ দেন। সেই বাড়িতেই এখনও থাকছেন তিনি। তার সঙ্গে কথা বলেছেন একুশে টেলিভিশন অনলাইন প্রতিবেদক আলী আদনান।
একুশে টেলিভিশন অনলাইন: আপনি ভাষা শহীদের সন্তান। ছোট বেলা থেকে এ পরিচয়ে বড় হয়েছেন। অনুভূতি কেমন ছিল?
নুরুল ইসলাম বাদল: খুব ছোট বেলায় বুঝতাম না। পরে আস্তে আস্তে বড় হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে বুঝতে শিখেছি। আমাদের নিজের এলাকা ময়মনসিংহের গফরগাঁওয়ে খুব বেশি সমাদর পেতাম। সেনাবাহিনীতে চাকরি করার সময় কখনো কোন আলাপ প্রসঙ্গে অফিসারদের পরিচয় দিলে তারাও খানিকটা আন্তরিকতা বা শ্রদ্ধাপূর্ণ দৃষ্টিতে দেখতেন।
একুশে টেলিভিশন অনলাইন: আপনি মুক্তিযোদ্ধা। কিভাবে যুদ্ধে গেলেন?
নুরুল ইসলাম বাদল: আমি যখন আইএ (এইচএসসি) পড়ি তখন যুদ্ধ শুরু হলে মুক্তিযুদ্ধে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করি। পরবর্তীতে যুদ্ধ শেষ হলে ফিরে এসে পরীক্ষা দেই এবং সেনাবাহিনীতে যোগ দেই।
একুশে টেলিভিশন অনলাইন: আপনার বাবার মৃত্যু নিয়ে আপনার মা, দাদির অনুভূতি কেমন ছিল?
নুরুল ইসলাম বাদল: আমার বাবার মৃত্যুর সংবাদে আমার মা এক সপ্তাহ অজ্ঞান ছিলেন। পরে আমাকে নিয়ে তিনি অনেক লড়াই করেছেন। ২০১১ সালের ৫ সেপ্টেম্বর তিনি মারা যান। আমার দাদি মারা যান ১৯৭৮ সালের ২৯ ডিসেম্বর। যতদিন বেঁচে ছিলেন ততদিন তিনি ছেলের শোকে কাঁদতেন।
একুশে টেলিভিশন অনলাইন: ভাষা শহীদের পরিবার হিসেবে সরকারের কাছে কেমন সুযোগ-সুবিধা পেয়েছেন ও পাচ্ছেন?
নুরুল ইসলাম বাদল: ১৯৫৪ সালে যুক্তফ্রন্ট সরকার ভাষা শহীদদের পরিবারের জন্য একটি নির্দিষ্ট ভাতা ধার্য করে। নানা আনুষ্ঠানিক প্রক্রিয়া শেষে ১৯৫৮-৫৯ সালে বার্ষিক ২০০০ টাকা করে আমাদের দেওয়া হতো। কিন্তু আইয়ুব খান ক্ষমতায় এলে তা বন্ধ করে দেওয়া হয়। মুক্তিযুদ্ধ পরবর্তী সময়ে বঙ্গবন্ধু আমাদের জন্য এই বাড়িটির ব্যবস্থা করে দেন। কিন্তু পরে অন্য একটি প্রতারক চক্র তা ভাষা শহীদ জব্বারের পরিবার সেজে তা দখল করে ফেলে। ১৯৭৮ সালে নানা ঝামেলার ভেতর দিয়ে বাড়িটি পুনঃদখল করে আমাদের বুঝিয়ে দেওয়া হয়। ২০০৪ সালে সরকার সব ভাষা শহীদদের পরিবারের জন্য মাসিক পাঁচ হাজার টাকা ধার্য করে। বর্তমান সরকার ২০১২ সালে এটিকে ১০ হাজার টাকায় উন্নীত করে।
একুশে টেলিভিশন অনলাইন: ভাষা শহীদদের স্মরণে সরকারের গৃহীত পদক্ষেপগুলো কী?
নুরুল ইসলাম বাদল: তত্বাবধায়ক সরকার চারজন ভাষা শহীদ (সালাম, বরকত, রফিক, জব্বার) ও সাতজন বীরশেষ্ঠ মুক্তিযোদ্ধার গ্রামে তাদের স্মরণে পাঠাগার ও জাদুঘর স্থাপন করে। সেই ধারাবাহিকতায় আমাদের গ্রামেও ভাষাশহীদ জব্বার স্মৃতি পাঠাগার ও জাদুঘর স্থাপন করা হয়। তাছাড়া আমাদের গ্রাম (যেটি আগে পাচুয়া নামে পরিচিত ছিল) সেটিকে জব্বার নগর করা হয়।
একুশে টেলিভিশন অনলাইন: আপনার পারিবারিক জীবন নিয়ে বলুন।
নুরুল ইসলাম বাদল: আমি ১৯৭২ সালে বিয়ে করি। আমার স্ত্রী ফিরোজা বেগম। বর্তমানে আমাদের দুই মেয়ে ও এক ছেলে সন্তান আছে। বড় মেয়ে লুৎফুন্নাহার শোভা এমএ পাস করেছে। তার স্বামী স্বাস্থ্য বিভাগে স্যানিটারি ইন্সপেক্টর হিসেবে কর্মরত। বড় মেয়ের দুই সন্তান। দুই জনেই স্কুলে পড়ছে। ছোট মেয়ে আফরোজা বেগম রুবা বিএ পাস করেছে। তার স্বামী একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে কর্মরত। আমাদের এক ছেলে কামরুল ইসলাম সুজন ছোট বেলায় মারা যায়। বর্তমানে আরেক ছেলে ফারজুল ইসলাম বিজয় তেজগাঁও কলেজে স্নাতক তৃতীয় বর্ষে পড়ছে।
একুশে টেলিভিশন অনলাইন: কখনও কী বাবার মৃত্যু নিয়ে আফসোস হয়?
নুরুল ইসলাম বাবুল : না, গর্ববোধ করি। বাবার মৃত্যু আমার শৈশবকে অভাবের মুখে ফেলেছিল, প্রচুর লড়াই করতে হয়েছে। কিন্তু এটাও সত্যি বাবার নাম ইতিহাসে থাকবে। তাদের প্রাণের বিনিময়ে ভাষা এসেছে, নতুন রাষ্ট্র বিনির্মাণের পথ উন্মোচিত হয়েছে। এ মৃত্যু অবধারিত ছিল।
একুশে টেলিভিশন অনলাইন: সমাজের কাছে, রাষ্ট্রের কাছে কোন প্রত্যাশা?
নুরুল ইসলাম বাদল: সর্বত্র রাষ্ট্র ভাষা বাংলার প্রচলন হোক। বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের নামকরণের ক্ষেত্রে এ ব্যাপারে হাইকোর্টের আদেশ রয়েছে। কিন্ত এরপরও তা মানা হচ্ছেনা। যা খুবই দুঃখজনক।
একুশে টেলিভিশন অনলাইন: আপনাকে ধন্যবাদ।
নুরুল ইসলাম বাদল: আপনাকেও ধন্যবাদ।
এসএইচ/