সর্বোত্তম দান
প্রকাশিত : ১২:৩৩, ১৫ এপ্রিল ২০২১
‘সাদাকা’ শব্দটির সাধারণ বাংলা অর্থ হল ‘দান’। শরীয়তে দান সাধারণত : দুই ভাগে বিভক্ত। একটি এমন দান যা বিশেষ কিছু শর্তে মুসলিম ব্যক্তির বিশেষ কিছু সম্পদে ফরয হয়, যা থেকে একটি নির্দিষ্ট অংশ দান করা তার উপর অপরিহার্য হয়। এমন দানকে বলা হয় যাকাত। আর অন্য দানটি এমন যে, মুসলিম ব্যক্তিকে তা করতে উদ্বুদ্ধ করা হয়েছে কিন্তু তার উপর অপরিহার্য করা হয়নি। এমন দানকে বলা হয় সাদাকা। তবে শরীয়ার ভাষায় অনেক ক্ষেত্রে ফরয যাকাতকেও সাদাকা বলার প্রচলন আছে।
প্রত্যেকটি ভালো কাজই সৎকর্ম, সাদাকা বা দান বা সেবা।
—জাবির ইবনে আবদুল্লাহ (রা); বোখারী, মুসলিম
সাদাকা বা দান বা অন্যের সেবা হচ্ছে ঈমানের প্রমাণ।
—আবু মালেক আশয়ারী (রা); মুসলিম, নববী
মহাবিচার দিবসে তোমাদের প্রত্যেকের সাথেই তার প্রতিপালক কথা বলবেন। এই কথাবার্তায় কোনো দোভাষী থাকবে না। যখন ডানে তাকাবে, তুমি তখন তোমার অতীত ভালো কাজ দেখতে পাবে। বামে তাকালে তুমি তোমার অতীত মন্দ কাজ দেখবে। আর সামনে দেখবে জাহান্নামের লেলিহান আগুন। তাই সময় থাকতে, এমনকি এক টুকরা খেজুর দান করে হলেও নিজেকে বাঁচাও। আর তা-ও যদি না পারো, তবে হাসিমুখে কথা বলে, ভালো কথা বলে ও ভালো ব্যবহার করে নিজেকে জাহান্নাম থেকে বাঁচাও।
—আদী ইবনে হাতিম (রা); বোখারী, মুসলিম
আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্যে দান করলে সেই সাদাকা বা দান গ্রহীতার হাতে পৌঁছার আগেই আল্লাহর কাছে পৌঁছে যায়।
—তাবারানী
নিজের প্রিয় ও পছন্দনীয় জিনিস থেকে দানই উত্তম দান।
—আনাস ইবনে মালেক (রা); বোখারী, মুসলিম
সর্বোত্তম দান হচ্ছে নিজের শ্রম দ্বারা অর্জিত অর্থ থেকে সাধ্যমতো দান করা।
—আবু হুরায়রা (রা); বোখারী
আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের জন্যে তুমি যা ব্যয় করবে, তোমাকে তার পুরস্কার দেয়া হবে, এমনকি স্ত্রীর মুখে এক লোকমা আহার তুলে দিলেও।
—সাদ ইবনে আবি ওয়াক্কাস (রা); বোখারী, মুসলিম
আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের লক্ষ্যে নিজের পরিবার-পরিজনের জন্যে যা খরচ করা হয়, তা-ও দান বা সাদাকা হিসেবে গণ্য হবে।
—আবু মাসউদ (রা); বোখারী, মুসলিম
হালাল উপার্জন থেকে কেউ যদি একটি খেজুরের মূল্যের সমপরিমাণ দান করে, আল্লাহ তা দানকারীর জন্যে বৃদ্ধি করতে থাকেন। এই বৃদ্ধির উপমা হচ্ছে—তোমরা কেউ একটি বাছুর দিলে আল্লাহ তাকে বৃদ্ধি করে পরিণত করলেন পাহাড়সম শক্তিমান বৃষে।
—আবু হুরায়রা (রা); বোখারী, মুসলিম
তোমরা রোগ নিরাময়ের জন্যে সাদাকা দাও।
—জামে উস-সগীর
তোমরা ক্ষুধার্তকে খাবার দাও। রোগীর সেবা করো। (মনোজাগতিক শৃঙ্খলে বন্দিসহ) বন্দিদের মুক্ত করো।
—আবু মুসা আশয়ারী (রা); বোখারী
ক্ষুধার্তকে পেটপুরে খাওয়ানো উত্তম দান।
—আনাস ইবনে মালেক (রা); মেশকাত
মৃত মায়ের জন্যে কোন দান উত্তম হবে? একজন সাহাবী প্রশ্ন করলেন। ‘পানি’—নবীজীর (স) উত্তর।
—সাদ ইবনে উবাদা (রা); আবু দাউদ, নাসাঈ, মেশকাত
[কূপ খনন, পুকুর-দীঘি, টিউবওয়েল বা পানি সরবরাহের ব্যবস্থা মৃতের জন্যে উত্তম সাদাকা।]
মৃত পিতামাতার নামে দান উত্তম সাদাকা।
—আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা); বোখারী, তিরমিজী
[মৃত পিতামাতার নামে বিশুদ্ধ খাবার পানি সরবরাহের ব্যবস্থা উত্তম সাদাকা। তাদের নামে কোরআনের জ্ঞান বিতরণও সদকায়ে জারিয়া।]
নবীজীর (স) কাছে একজন জানতে চাইলেন, ‘আমার মা হঠাৎ মারা যান। আমার মনে হচ্ছে, তিনি যদি মৃত্যুর আগে বলে যেতে পারতেন, তাহলে দান করার কথা বলতেন। এখন আমি যদি তার পক্ষ থেকে দান করি, তবে কি তিনি এর সওয়াব পাবেন?’ নবীজী (স) স্পষ্ট উত্তর দিলেন, ‘হাঁ! অবশ্যই পাবেন!’
—আয়েশা (রা); বোখারী, মুসলিম
দাতার হাত গ্রহীতার হাতের চেয়ে উত্তম। উদারতা শুরু করো নির্ভরশীলদের দান করে। প্রয়োজনের অতিরিক্ত সম্পদ থেকে দান করা উত্তম সাদাকা।
—হাকেম ইবনে হিজাম (রা), আবু হুরায়রা (রা); বোখারী, নাসাঈ
তুমি যদি এত গোপনে দান করো যে, তোমার বাম হাতও জানে না—ডান হাত কী দিয়েছে, তাহলে মহাবিচার দিবসে তুমি আরশের ছায়ায় থাকবে।
—আবু হুরায়রা (রা); বোখারী, মুসলিম, আশকালানী
সততার সাথে দান সংগ্রহকারী ও দান বিতরণকারী দাতার মতোই সমভাবে পুরস্কৃত হবে।
(দান সংগ্রহ ও বিতরণ ব্যবস্থাপনা উত্তম সাদাকা।)
—আবু মুসা আশয়ারী (রা); বোখারী, মুসলিম
নীরব ও গোপন দান আল্লাহর গজব থেকে রক্ষা করে।
—আনাস ইবনে মালেক (রা); মেশকাত
দান ও সাদাকায় (প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে) বাধা দান বা নিরুৎসাহিতকারীর ওপর লানত।
—আলী ইবনে আবু তালিব (রা); নাসাঈ, মেশকাত
দান করে কখনো তা ফেরত নেবে না। তোমার দান করা জিনিস যদি গ্রহীতা স্বেচ্ছায়ও তোমার কাছে বিক্রি করতে চায়, তবুও তা কিনবে না। এটাও দান ফেরত নেয়ার সমান। আর যে তা করবে, সে যেন নিজের বমি নিজে খেলো।
—ওমর ইবনে খাত্তাব (রা); বোখারী, মুসলিম
কৃপণ আবেদের চেয়ে নিরক্ষর দাতা আল্লাহর কাছে বেশি প্রিয়।
—আবু হুরায়রা (রা); মেশকাত
প্রতিদিন সকালে দুজন ফেরেশতা অবতীর্ণ হন। একজন (সকালে যে দান করেছে এমন) দাতার জন্যে প্রার্থনা করেন : ‘হে আল্লাহ! দাতাকে সর্বোত্তম পুরস্কার দান করো।’ আর অন্যজন (দান করা থেকে বিরত কৃপণের জন্যে) প্রার্থনা করে : ‘হে আল্লাহ! কৃপণের ধন বিনষ্ট করো।’
—আবু হুরায়রা (রা); বোখারী, মুসলিম
আমাকে যদি ওহুদ পাহাড়ের সমপরিমাণ ওজনের সোনা দেয়া হয়, তবে তিন রাতের মধ্যেই আমি আনন্দিতচিত্তে সব দান করে দেবো।
—আবু হুরায়রা (রা); বোখারী, মুসলিম
আল্লাহ বলেন, ‘হে আদম সন্তান! কল্যাণার্থে ব্যয় করো, তোমাকেও সেভাবেই দেয়া হবে।’
—আবু হুরায়রা (রা); বোখারী, মুসলিম
নারীদের উদ্দেশ্যে নবীজী (স) বলেন : ‘দান করো, দান করো।’ নারীরাই বেশি দান করেছিল।
—আবু সাঈদ খুদরী (রা); মুসলিম, নাসাঈ
পানি যেভাবে আগুনকে নিভিয়ে ফেলে, দানও তেমনি পাপমোচন করে।
—আনাস ইবনে মালেক (রা), মুয়াজ ইবনে জাবল (রা); তিরমিজী, ইবনে মাজাহ
প্রত্যেক দাতা মহাবিচার দিবসে বিচার শেষ না হওয়া পর্যন্ত তার সাদাকা বা দানের সুশীতল ছায়ার নিচে থাকবে।
—আবু মাসউদ (রা); ইবনে হিব্বান, হাকেম, আশকালানী
এক আবেদ পাহাড়ে হেঁটে বেড়ানোর সময় হঠাৎ গায়েবি আওয়াজ শুনতে পেলেন যে, ‘অমুকের বাগানে পানি দাও’। কিছুক্ষণ পরই বৃষ্টি শুরু হলো এবং পানি পাহাড়ের পাশে একটি নালা দিয়ে গড়াতে লাগল। তিনি কৌতূহলী হয়ে ঐ নালাকে অনুসরণ করলেন। কিছুদূর গিয়ে তিনি দেখলেন, একজন কৃষক কোদাল দিয়ে মাটি কেটে বাগানে পানি ঢোকার পথ করে দিচ্ছে। নাম জিজ্ঞেস করতেই তিনি চমকে উঠলেন। কারণ গায়েবি আওয়াজে এ ব্যক্তির বাগানেই পানি দিতে বলা হয়েছিল। তার কাছে জানতে চাইলেন যে, কোন পুণ্যের বিনিময়ে প্রকৃতি এভাবে তাকে সহযোগিতা করছে? তিনি তখন বললেন, পুণ্যের কথা আমি বলতে পারব না। তবে আমি এ বাগানের ফসলকে তিন ভাগ করি। একভাগ পরিবারের ভরণপোষণ, একভাগ জমিতে বিনিয়োগ এবং বাকি একভাগ দান করি। এজন্যেই হয়তো আল্লাহ আমাকে এভাবে সাহায্য করেন।
—আবু হুরায়রা (রা); মুসলিম
সাদাকা অকল্যাণ ও বালা-মুসিবতের দরজা বন্ধ করে।
—আলী ইবনে আবু তালিব (রা); রাজিন (মেশকাত)
আল্লাহর রসুল (স) একদিন আমাদের জিজ্ঞেস করলেন : তোমাদের মধ্যে এমন কে আছ, যার কাছে নিজের ধনসম্পদের চেয়েও উত্তরাধিকারীর ধনসম্পদ প্রিয়? সাহাবীরা বললেন, আমাদের মধ্যে এমন (বোকা) কেউ নেই। উত্তরাধিকারীর চেয়ে নিজের সম্পদই আমাদের কাছে প্রিয়। তখন নবীজী (স) বললেন : তাহলে শুনে রাখো, (পরিমিত জীবনোপকরণ ব্যবহার করে) যা তুমি দান করলে, সৃষ্টির কল্যাণে ব্যবহার করলে, তা-ই তোমার সম্পদ। আর যা জমিয়ে রেখে গেলে তা তোমার উত্তরাধিকারীর সম্পদ।
—আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রা); বোখারী
একজন মানুষের মৃত্যুর সাথে সাথে তার সকল সৎকর্মের সুযোগ বন্ধ হয়ে যায়। কিন্তু তিনটি সৎকর্মের সওয়াব বা নেকি সে সবসময় পেতে থাকবে—
১. সদকায়ে জারিয়া অর্থাৎ যে স্থায়ী দান থেকে মৃত্যুর পরও মানুষ উপকৃত হয়। যেমন: শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, সেবামূলক প্রতিষ্ঠান। (তাই মৃত্যুর আগেই নিজের এক-তৃতীয়াংশ সম্পত্তি সেবামূলক কাজে ওয়াকফ করুন।) ২. (কথন, লিখন প্রকাশ বা বিতরণের মাধ্যম) প্রচারিত জ্ঞান (কোরআনের জ্ঞান এবং এমন পুস্তক, যা সঠিক জীবনদৃষ্টি প্রদান করে মানুষকে দুনিয়া ও আখেরাতে সাফল্যের সরলপথ দেখায়)। ৩. সুসন্তান (যে তার জন্যে দোয়া ও দান করে)।
—আবু হুরায়রা (রা); মুসলিম, আবু দাউদ
সাতটি কাজের নেকি একজন মানুষ তার মৃত্যুর পরও পেতে থাকবে। ১. জ্ঞানাগার (অর্থাৎ বই বা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান), ২. খাল খনন, ৩. পানি সরবরাহ ব্যবস্থা,
৪. বৃক্ষরোপণ, ৫. মসজিদ নির্মাণ, ৬. কোরআনের কপি বিতরণ, ৭. নেক সন্তান, যে তার জন্যে দোয়া করবে।
—আনাস ইবনে মালেক (রা); বাজ্জার
[সদকায়ে জারিয়ার ধারণা বাংলার মুসলমানদের অন্তরে এত বদ্ধমূল ছিল যে, ইংরেজরা বাংলা দখল করার আগে বাংলার এক-তৃতীয়াংশ স্থাবর সম্পদই ছিল ওয়াকফ সম্পত্তি। এই ওয়াকফ সম্পত্তি দিয়েই মুসলমানদের শিক্ষাব্যবস্থা, এতিমখানা, মুসাফিরখানা ও সেবামূলক কাজ পরিচালিত হতো। ইংরেজরা বাংলা দখল করে প্রথমেই এই বিশাল ওয়াকফ সম্পত্তি গ্রাস করে। ফলে মুসলমানদের পুরো শিক্ষাব্যবস্থা ভেঙে পড়ে।]