ঢাকা, রবিবার   ২০ এপ্রিল ২০২৫

Ekushey Television Ltd.

সহযোগিতা সবার সাথে, প্রতিযোগিতা নিজের সাথে 

একুশে টেলিভিশন

প্রকাশিত : ১৭:৪৮, ১১ জানুয়ারি ২০২৩

Ekushey Television Ltd.

আমাদের দেশের একজন বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ ও খ্যাতিমান পরমাণুবিজ্ঞানী দুর্গম অঞ্চলের প্রত্যন্ত একটি স্কুল পরিদর্শন করছিলেন। মেধাদীপ্ত কৌতূহলী শিক্ষার্থীদের সাথে সেদিন নানা গল্প হচ্ছিল তার। গল্প-কথার ফাঁকে সুন্দর ও মানবীয় কিছু জীবনদর্শনে তিনি তাদের উদ্বুদ্ধ করছিলেন। একপর্যায়ে শিক্ষার্থীদের উদ্দেশে ছুড়ে দিলেন একটি অন্যরকম ধাঁধা। 

ব্ল্যাকবোর্ডে একটি সরলরেখা টানলেন। তারপর বললেন, এবার আমি এটিকে ছোট করতে চাই। কিন্তু একে কেটে বা মুছে ছোট করা যাবে না। এখন বলো, কীভাবে এই কাজটা করতে পারি? বুদ্ধির খেলা, সন্দেহ নেই। 

প্রিয় পাঠক, শিক্ষার্থীদের পাশাপাশি আপনিও চিন্তা করতে থাকুন-এর সমাধান কী হতে পারে। 

এই সুযোগে আমরা মূল লেখায় প্রবেশ করি। সহযোগিতা আর প্রতিযোগিতা। আদতে পাঁচটি অক্ষরের কাছাকাছি দুটো শব্দ, কিন্তু শব্দার্থে পার্থক্য যোজন যোজন। প্রথমটায় সুখ শান্তি সাফল্য। দ্বিতীয়টায় স্ট্রেস অশান্তি আর ব্যর্থতার আশঙ্কাই বেশি। 

সবই বুঝি বটে, তবু জীবনের বিভিন্ন সময় আমরা প্রতিদ্বন্দ্বিতামূলক দৃষ্টিভঙ্গির আগ্রাসনে পড়ি। এ যে খুব বুঝেশুনে বা ইচ্ছাকৃতভাবে আমরা করি তা-ও নয়। জীবনে চলার পথে বিভিন্ন ক্ষেত্রে পারিপার্শ্বিকতার প্রভাবে কিংবা অবচেতনভাবেই এটা আমাদের ভেতর কাজ করতে শুরু করে। ছাত্রজীবনে, পেশাজীবনে এমনকি সংসার এবং পারিবারিক জীবনেও আমরা প্রতিদ্বন্দ্বিতামূলক দৃষ্টিভঙ্গির আগ্রাসনের শিকার হই। আগ্রাসনের শিকার হই বলার কারণ, প্রতিযোগিতার মনোভাব পোষণ করি অন্যের সাথে ঠিকই, কিন্তু ক্ষতিটা হয় আসলে আমাদের নিজেদের।

একটু খতিয়ে দেখা যাক। প্রথমেই আমরা দেখি, এ দৃষ্টিভঙ্গির উৎস কী? এর উৎস খুঁজলে দেখা যাবে এর মূল কারণ হলো ঈর্ষা, যা হতে পারে বন্ধু সহকর্মী সহপাঠী যে-কারো প্রতিই। 

উদাহরণ : এমবিএ ক্লাসে একবার শিক্ষক তার ছাত্রছাত্রীদের প্রশ্ন করেছিলেন-ধরো, তোমার একটি কোম্পানি আছে। এখন তোমার সামনে আছে দুটি কর্মপ্রক্রিয়া। একটি প্রক্রিয়া অনুসারে কাজ করলে তোমার কোম্পানির ১% লাভ হবে, তোমার প্রতিদ্বন্দ্বী কোম্পানিরও ১% লাভ হবে। অন্য আরেকটি প্রক্রিয়া অনুসারে কাজ করলে তোমার ২% লাভ হবে, আর তোমার প্রতিদ্বন্দ্বীর লাভ হবে ৩%। এখন তুমি কোন প্রক্রিয়া অনুসারে তোমার প্রতিষ্ঠান পরিচালনা করবে? বিস্ময়কর হলেও সত্যি যে, ঐ ক্লাসের ৯৯% ছাত্রছাত্রী উত্তর দিয়েছিল, আমার ২% লাভের দরকার নেই, তাহলে তো প্রতিদ্বন্দ্বী ৩% লাভ করবে। তার চেয়ে বরং আমি সেই প্রক্রিয়া অনুসরণ করব যাতে আমার ১% লাভ হোক এবং অন্য কোম্পানিরও ১% লাভই থাকুক! 

এটাই হলো ঈর্ষা। অথচ এখানে যদি চিন্তা করা হতো-আমার প্রতিদ্বন্দ্বীর ৩% লাভ হচ্ছে হোক, আমারও তো ২% লাভ হচ্ছে। এতে আমার কোম্পানির আর্থিক উন্নতি হবে। আমার কর্মীরা উপকৃত হবে। কোম্পানির সুনাম হবে। এই মুনাফার মাধ্যমে আমি ভবিষ্যতে নতুন প্রজেক্টে হাত দিতে পারব। আরো পরিশ্রম করলে একদিন প্রতিদ্বন্দ্বীকেও ছাড়িয়ে যেতে পারব। কিন্তু তা না করে অসুস্থ প্রতিযোগিতার ফাঁদে পড়ে আমরা আসলে নিজেদের সমৃদ্ধির পথেই বাধার সৃষ্টি করি। অন্যের সাথে প্রতিদ্বন্দ্বিতামূলক দৃষ্টিভঙ্গি ও এর ফলে আত্মঘাতী আচরণের ফলে নিজেদের সাফল্যকেই বাধাগ্রস্ত করি। পাশাপাশি শারীরিক-মানসিকভাবেও ক্ষতিগ্রস্ত হই। কারণ এ ধরনের আচরণ ও দৃষ্টিভঙ্গি সবসময় একজন মানুষকে স্ট্রেসের নির্মম জালে বন্দি করে রাখে। বন্ধু আমার চেয়ে এগিয়ে গেল, প্রতিবেশী আমার চেয়ে এগিয়ে গেল, সহপাঠী আমার চেয়ে এগিয়ে গেল, সহকর্মী আমার চেয়ে এগিয়ে গেল। আমি যে পিছিয়ে রইলাম! 

এসব সার্বক্ষণিক স্ট্রেস প্রকারান্তরে নানা রকম সাইকো-সোমাটিক রোগ ও বিশেষত করোনারি হৃদরোগের অন্যতম প্রধান কারণ। আমরা জানি, স্ট্রেস মানবদেহের সিমপ্যাথেটিক নার্ভাস সিস্টেমকে উদ্দীপ্ত করে। এড্রেনাল গ্ল্যান্ড থেকে কর্টিসোল হরমোনের নিঃসরণ বাড়িয়ে দেয় যা স্ট্রেস হরমোন নামে পরিচিত। ফলে করোনারি ধমনী সংকুচিত হয়, স্বভাবতই রক্তপ্রবাহ কমে যায়। গত শতকের ষাটের দশকে যুক্তরাষ্ট্রের সানফ্রান্সিসকোর দুজন চিকিৎসাবিজ্ঞানী ডা. মেয়ার ফ্রেডম্যান ও রে রোজেনম্যান তাদের যৌথ গবেষণায় দেখান হৃদরোগের সাথে অস্থিরচিত্ততা, বিদ্বেষ ও প্রতিদ্বন্দ্বিতামূলক দৃষ্টিভঙ্গি এবং ভুল জীবনাচরণের সরাসরি যোগাযোগ রয়েছে। এ-ছাড়াও প্রতিযোগিতামূলক দৃষ্টিভঙ্গির ফলে সৃষ্ট স্ট্রেস শরীরে বিষাণু বা টক্সিন সৃষ্টি করে, যা শরীরের রোগ-প্রতিরোগ ব্যবস্থাকে দুর্বল করে দেয়। প্রতিনিয়ত প্রতিদ্বন্দ্বিতামূলক আচরণ নার্ভাস সিস্টেমকে দুর্বল করে এবং শরীর-মনকে করে তোলে অবসন্ন ও অবসাদগ্রস্ত। কাজে গতি কমে যায়। কোনো কাজে মনোযোগ থাকে না। ব্যাহত হয় স্বাভাবিক চিন্তাশক্তি। বিষণ্নতার ঝুঁকি বাড়ে।

সাইকোথেরাপিস্টরা বলেন, প্রতিদ্বন্দ্বিতামূলক দৃষ্টিভঙ্গির কারণে শরীরে ঘটে চলে এত রকম বিপদ, অথচ সত্য হলো-কারো সাথেই কারো প্রতিযোগিতা হয় না। কারণ প্রত্যেকটা মানুষের জীবনের প্রেক্ষাপট ভিন্ন। জীবনদর্শন ভিন্ন। জীবনের লক্ষ্য আর উদ্দেশ্যও তো অধিকাংশ ক্ষেত্রেই পুরোপুরি ভিন্ন। 

তাই বলা যায়, প্রতিযোগিতা আসলে হয় নিজের সাথে নিজের। আমার বর্তমান অবস্থানকে ক্রমাগত প্রচেষ্টায় ছাড়িয়ে যেতে পারলেই আমি সফল। এ প্রতিযোগিতা আজকের আমি র সাথে আগামীকালের আমি র। 

কোয়ান্টাম ফাউন্ডেশন আয়োজিত একটি দিনব্যাপী ওয়ার্কশপে গুরুজী শহীদ আল বোখারী মহাজাতক এ বিষয়ে একটি দীর্ঘ ও সমৃদ্ধ আলোচনা উপস্থাপন করেন এবং উপসংহার টানেন সংক্ষিপ্ত কিন্তু অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ একটি বাক্য দিয়ে, সেটি হলো, সহযোগিতা সবার সাথে, প্রতিযোগিতা নিজের সাথে। 

আসলে নিজের ভেতর থেকে প্রতিযোগিতামূলক দৃষ্টিভঙ্গি ও ঈর্ষার বিষ সমূলে উৎপাটনের মূল সূত্র এটাই। পৃথিবীর সফল মানুষেরা নিজেদের জীবনে এটাই চর্চা করেছেন। বিভিন্ন ক্ষেত্রের তিনশ জন খ্যাতিমান ও সফল মানুষের সাফল্যের রহস্য ও জীবনদর্শন নিয়ে সমাজবিজ্ঞানীরা একবার একটি অনুসন্ধান চালিয়েছিলেন। তাদের সাফল্যের পেছনে অনেকগুলো কারণও শনাক্ত করা হয়েছিল। কিন্তু দেখা গেছে, একটি কারণ সবার মধ্যেই বিদ্যমান-আমি জিতব, কিন্তু আমার প্রতিদ্বন্দ্বী যেন না হারে। অর্থাৎ আমিও জিতব সেও জিতবে। আমার অগ্রযাত্রায় যেন অন্যের কোনো ক্ষতি না হয়। 

তাহলে অশুভ প্রতিদ্বন্দ্বিতা ও ঈর্ষার আগ্রাসন থেকে বেরিয়ে আসার উপায়? 

পূর্বে উল্লিখিত আলোচনায় গুরুজী তার সমৃদ্ধ জীবন-অভিজ্ঞতার আলোকে দিয়েছিলেন কিছু বাস্তব পরামর্শ: প্রথমত, জীবনদৃষ্টির পরিবর্তন অর্থাৎ সর্বাবস্থায় শুকরিয়া। যা আছে তার জন্য পরম স্রষ্টার কাছে কৃতজ্ঞচিত্ত থাকুন। নিজের কর্মক্ষমতা, শক্তি ও সম্ভাবনা সম্পর্কে বেশি বেশি ভাবুন। দ্বিতীয়ত, নিয়মিত মেডিটেশন করুন। মন প্রশান্ত হলে সকল নেতিবাচকতা আপনার ভেতর থেকে বেরিয়ে যাবে। তৃতীয়ত, আপনার প্রতিদ্বন্দ্বী বা যার প্রতি ঈর্ষা অনুভব করেন তার জন্যে দোয়া করুন। অন্যের সাফল্যে নিজের সাফল্যের মতোই আনন্দিত হোন। 

এ প্রসঙ্গে নবীজীর (স) একটি হাদীস আমরা মনে রাখতে পারি। নিজের জন্যে যা আকাঙ্ক্ষা করো অন্যের জন্যেও তা-ই আকাঙ্ক্ষা করো। তাহলেই তুমি প্রকৃত বিশ্বাসী হতে পারবে। 

এবার ফিরে আসা যাক ধাঁধার উত্তরে। ঘটনার স্থান আর পাত্রদের পরিচয়টা এবার জানিয়ে দেই। পরমাণুবিজ্ঞানী ড. এম শমশের আলীর সাথে কথা হচ্ছিল বান্দরবান লামায় কোয়ান্টাম ফাউন্ডেশনের সার্বিক তত্ত্বাবধানে পরিচালিত কোয়ান্টাম কসমো স্কুল এন্ড কলেজের শিক্ষার্থীদের। ওরা যখন কোনোভাবেই এর কোনো কূলকিনারা খুঁজে পাচ্ছিল না, তখন অধ্যাপক শমশের আলী নিজেই দিলেন এর উত্তর আর তুলে ধরলেন এর নৈতিক শিক্ষাটি। 

তিনি বলেন, আমি যখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াতাম, ওখানকার ছাত্রদেরও একবার এটা জিজ্ঞেস করেছিলাম। একজন ছাত্র বলেছিল, স্যার, সরলরেখাটিকে একটু মুছে দিলেই তো হয়ে যেত। কিন্তু দেখ, এটা মুছে দেয়ার দরকার ছিল না। এর পাশে যদি একটা বড় সরলরেখা টানো, তাহলে তো ওটা এমনিতেই ছোট হয়ে যায়! এটাই হলো সুস্থ প্রতিযোগিতা। যে জোরে দৌড়াতে পারে, ওকে পেছন থেকে টেনে ধরব না, ওর পথের মধ্যে এমন কিছু রাখব না, যাতে সে পড়ে যায়। আমাদের চিন্তাটা হওয়া উচিত এমন যে, সে দৌড়াচ্ছে দৌড়াক, তাকে থামানোর দরকার নেই, আগে যাওয়ার দরকার হলে একটু কষ্ট করে আমি ওর চেয়ে কিছুটা বেশি দৌড়াই। আরেকজন বড় হয়ে গেছে, তাকে কাটার দরকার নেই। স্রষ্টা আমার মধ্যে যে গুণ দিয়েছেন, আমি বরং সেটা কাজে লাগিয়ে বড় হওয়ার চেষ্টা করি। এই প্রতিযোগিতাই পছন্দ করেন মহান স্রষ্টা। 

তাই কাউকে কোনোদিন কোনোভাবে মুছে ছোট করতে যেও না। কারো কীর্তিকে ছোট করতে যেও না। তাকে বরং সাহায্য করো এই বলে যে, তুমি আরো বড় হও। সেই গল্পটা তো তোমরা সবাই জানো-বাংলার বারো ভূঁইয়াদের প্রধান ঈসা খাঁর সাথে মোঘল সেনাপতি মানসিংহের তরবারি যুদ্ধ চলছিল। একসময় মানসিংহের তরবারি ভেঙে যায়। ঈসা খাঁ তখন অনায়াসে প্রতিপক্ষকে ধরাশায়ী করতে পারতেন, হত্যা করতে পারতেন। কিন্তু তিনি সেটা করলেন না, বরং প্রতিপক্ষকে আরেকটি তরবারি নেয়ার সুযোগ দিলেন। এই মহানুভবতার জন্যেই কিন্তু এত বছর পরও তার কথা আমরা মনে রেখেছি, তিনি স্মরণীয় হয়ে আছেন। যে-কোনো প্রতিযোগিতায় তোমরাও এমন বড় মনের পরিচয় দেবে। তোমাদের চেষ্টা থাকবে যে, নিজের গুণগুলোকে বিকশিত করে তোমরা আরো বড় হবে। জ্ঞান-বিজ্ঞানে বড় হবে। সংগীতে বড় হবে। সাহিত্যে বড় হবে। শিল্পে বড় হবে। বাণিজ্যে বড় হবে। খেলাধুলায় বড় হবে। কিন্তু কাউকে কখনো ছোট করবে না। এটাই সত্যিকারের প্রতিযোগিতা। তাহলেই তোমাদের জীবন সার্থক হয়ে উঠবে।

এমএম/


Ekushey Television Ltd.

© ২০২৫ সর্বস্বত্ব ® সংরক্ষিত। একুশে-টেলিভিশন | এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি