সাংবাদিকরা হাওয়া খেয়ে বাঁচে!
প্রকাশিত : ২০:১৫, ৩ এপ্রিল ২০১৮ | আপডেট: ১০:২৭, ৪ এপ্রিল ২০১৮
কদিন আগে বন্ধুরা গল্প করছিল অবসরের পর কে কত টাকা পাবে। কেউ বলছে দেড় কোটি, কেউ এক কোটি, কেউ বলছে ৯০ লাখ, কারও বা ৭০ লাখ। আমি বললাম, শূন্য হাতে আমি বাসায় ফিরবো। সবাই অবাক! কেন? একটু বিষণ্ন সুরেই বললাম সাংবাদিকদের পেনশন নাই তাই! ওরা অবাক। তোমরা অবসরে যাওয়ার পর ভাতা পাওনা? বললাম বেশিরভাগ সাংবাদিকদের পেনশন ভাতা নেই। তাদের টাকা লাগে না। কথাটা বলার পর কেন জানি নিজেকে খুব ছোট আর অসহায় লাগলো। কেন এ অবস্থা আমাদের? সারাজীবন ভালোবেসে এ পেশায় কাজ করে একজন সাংবাদিকদের কেন কোন সঞ্চয় থাকবে না? কেন নিশ্চিন্ত মনে তারা কোটি বা লাখ টাকা নিয়ে অবসরে যেতে পারবেন না? কেন মধ্যবয়সে একজন সাংবাদিককে খালি হাতে মলিন মুখে বাড়ি ফিরতে হবে? কেন তার স্ত্রী আর সন্তানরা চিন্তিত মুখে থাকবেন ভবিষ্যৎ নিয়ে? কপালে দ্রুত বলিরেখা পড়বে তাদের?
বেশিরভাগ বেসরকারি গণমাধ্যমের সাংবাদিকদের একই অবস্থা। কি পত্রিকা, কি ইলেকট্রনিক গণমাধ্যম। প্রায় সব জায়গায় একই অবস্থা। কয়েকটি সংস্থা বা অফিস অবশ্য কিছু কিছু ভাতা দেয়ার নিয়ম চালু করেছে। তবে বেশিরভাগ অফিসেই তা নেই। চট্টগ্রামে এক প্রবীণ সাংবাদিক অবসরে যাওয়ার সময় কর্তৃপক্ষ দয়া করে ২ লাখ টাকা দিবেন। এ টাকা পাবার আশায় রোদ, বৃষ্টি, ঝড়, শারীরিক অসুস্থতা উপেক্ষা করে প্রতিদিন তিনি অফিস করেন। পরিবার সন্তানদের সঙ্গে কাটে না তার মধুর সময়! দেখা হয় না তার বসন্তের বিকেল! চাকরিরও কোনো নিশ্চয়তা নেই একজন সাংবাদিকদের। সব সময় সবাইকে থাকতে হয় দুরুদুরু বুকে। এই বুঝি গেল! পছন্দ না হলে, মতের মিল না হলে, তেলবাজি না করতে পারলে এক সময় তা চলেও যায়। চাকরির নিশ্চয়তা না থাকায় মনোযোগ দিয়ে কাজও করতে পারেন না তারা। সৃজনশীলতা চাপা পড়ে যায় লাল ইটের নিচে। জীবনের জটিলতায় বেকার হয়ে পড়েন নামকরা সাংবাদিকরাও। এ হাউস ও হাউস ঘুরে বেড়ান সংবাদকর্মীরা। কখনও কারও চাকরি হয়। কখনও হয় না। ক্লান্ত পায়ে, ঘামে ভেজা শার্টে অনেকে দীর্ঘশ্বাস ফেলেন। চুপচাপ বসে থাকেন তারা রিপোর্টার্স ইউনিটিতে কিংবা প্রেসক্লাবে! কখনওবা উদভ্রান্তের মতো হাঁটতে থাকেন রাজপথে। মেয়েদের অবস্থা আরও করুণ। অনেক অফিস বলেই দেয় মেয়েদের তারা চাকরি দেবেন না। একটু সিনিয়র হয়ে গেলেই তাদের আর জায়গা হয় না কাজে। চলে যেতে হয় পেশা ছেড়ে।
অনেক ভালোবেসে, অনেক মমতা মাখা মন নিয়ে এ পেশায় আসেন কিছু সৃজনশীল মানুষ। তারা দেশ ও সমাজের জন্য কিছু করতে চান। এই তার অপরাধ! সাংবাদিক মানেই যেন দুঃখময় জীবন! তার জীবনে কোন সখ আহ্লাদ থাকবে না। তার জীবনে যেন কোন সচ্ছলতা থাকবে না। সেই ছোটবেলা থেকে দেখে আসছি টিভি নাটকে, চলচ্চিত্রে সাংবাদিকদের চরিত্র দেখানো হয় দুখী-দুখী ভাবে। সৎ, অভাবী। তাদের ঘরে ভাত থাকে না। পোশাক থাকে মলিন। ছেলেমেয়েদের কোন সখ পুরণ করতে পারেন না সাংবাদিক বাবা কিংবা মা। তাদের অসহায় চেহারা দেখে করুণা জাগে মানুষের। সমাজ রাষ্ট্র ধরেই নেয় অভাব থাকাই হবে একজন সাংবাদিকের নিত্যসঙ্গী। সে হবে আদর্শবান। কাঁধে ঝোলা, গায়ে পাঞ্জাবি বা সাদামাটা শাড়ি, পায়ে স্যান্ডেল নিয়ে সে ঘুরে বেড়াবে দ্বারে দ্বারে চাকরির জন্য। সব জায়গায় থাকবে নো ভ্যাকেনসি। তার বউ মøান মুখে দরজা খুলে দিবে। একটা সাইকেলের জন্য কান্না করে ঘুমিয়ে পড়বে তার ছেলে। মেয়ের জন্য কিনতে পারবেন না ঘড়ি! সেই কয়েক যুগ থেকে চলে আসা সময় খুব কি পাল্টেছে আজও? আগেও ছিল যা, এখনও আছে তা। রিপোর্টার্র্স ইউনিটি কিংবা প্রেসক্লাবে বেকার কিংবা প্রবীণ সাংবাদিকদের দেখা যায় সেই অভাবী রূপেই। প্রেসক্লাবে হাজারের বেশি সাংবাদিকের মধ্যে হয়তো ১শ সাংবাদিকের অবস্থা ভালো। বাকি সবার অবস্থাই কম বেশি খারাপ। তারা অসহায় আর মানবেতরভাসাংবাদিকরা হাওয়া খেয়ে বাঁচে!
আহমেদ মুশফিকা নাজনীন বে জীবন যাপন করেন। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক সিনিয়র সাংবাদিক জানান প্রেসক্লাবে অনেক প্রবীণ সাংবাদিক খাবারের বিল দিতে পারেন না। তাদের বিল অন্যরা দিয়ে দেন। আর্থিক অনটন যেন তাদের নিত্যসঙ্গী। মনখারাপ হয়ে যায় তাদের দেখলে। সারাজীবন যারা সমাজ, মানুষ, রাষ্ট্রকে সচেতন করেছেন, তুলে ধরেছেন নানা অসঙ্গতি, দুর্নীতির চিত্র, তাদের সংসার আজ অচল। মেনেই যেন নিতে হবে প্রবীণ/ নবীন সাংবাদিকদের আর্থিক অনটন থাকবে। তাদের তো টাকার দরকার নেই। কি করবে টাকা নিয়ে তারা! কলম থাকলেই হলো। কোন পেশায় দুস্থ বলে ভাতা দেয়া হয় কিনা জানি না। কিন্তু সাংবাদিকতা পেশায় দুস্থ অসহায় ভাতা দেয়া হয় রাষ্ট্রীয় কোষাগার থেকে! এ দয়া কি একজন সাংবাদিকের প্রাপ্য? কেন তাকে করুণা করবে রাষ্ট্র সমাজ? তিনি যদি অন্য সরকারি বেসরকারি পেশার মতো সম্মানজনক বেতন পেতেন, তার যদি অবসর ভাতা থাকতো তাহলে এই দুস্থ ভাতা হাত পেতে নিতে হতো না তাকে। এই ভিক্ষা কেন নিতে হবে তাকে? সম্মান নিয়ে মাথা উঁচু করে বাঁচবার অধিকার তো তারও আছে! অনেকেই হলুদ সাংবাদিকতার কথা বলেন। সাংবাদিকদের নীতি বহির্ভূতভাবে টাকা নেয়ার কথাও বলেন। তারা গুটিকয়েক। তারা উদারহণ হতে পারেন না। তাদের বিচারে আইন করবে। কিন্তু বেশিরভাগ সাংবাদিকই সৎভাবে জীবন যাপন করেন। করার চেষ্টা করেন। তারা আর কতকাল দুস্থ শব্দ মাথায় নিয়ে বাঁচবেন? কোন সাংবাদিক হঠাৎ মারা গেলে তার পরিবারের মাথায় আকাশ ভেঙে পড়ে। জমানো কিছুই নেই।
সাংবাদিক বন্ধুরা কিছু টাকা তুলে ২/৩ লাখ টাকার একটা অঙ্ক তার পরিবারের হাতে হয়তো দেন। তাও সবার ভাগ্যে জোটে না। কিন্তু এ টাকায় কি সারাজীবন চলা যায়? চলা সম্ভব? এসব পরিবারের কষ্টের গল্প কেউ কি জানেন? কেমন আছে সাংবাদিক পথিক সাহার পরিবার? কিংবা অন্য কোনো নাম না জানা কিংবা আমাদেরই ভুলে যাওয়া কোন সহকর্মীর পরিবার! জানা হয় না। সম্মান বাঁচাতে অনেকেই সেসব গল্প বলেন না। কিন্তু সাংবাদিকরা আজ সবাই যদি অবসর ভাতা পেতেন, তাহলে আর্থিক ভরসা থাকতো এসব পরিবারগুলোর। টাকা অনেক মানসিক শক্তি জোগায়। স্বপ্ন বাঁচায়। সেদিন ইলেকট্রনিক মিডিয়ার এক সাংবাদিক দুঃখ করে বলছিলেন, প্রায় ১৪ বছর হয়ে গেল কাজ করছি এ পেশায়। আজ যদি চাকরি চলে যায় খালি হাতে চলে যেতে হবে। শুধু সে মাসের বেতন নিয়ে। কিভাবে চলবো আমি বুড়ো বয়সে? আমার ছেলেমেয়েরা পড়াশোনা শেষ করবে কিভাবে? সংসারই বা চলবে কিভাবে? তার দীর্ঘশ্বাসের কোন উত্তর সেদিন কেউ দিতে পারেননি। আরেক সাংবাদিক চোখ ছলছল করে বলেন, মিডিয়ার মতো এত দ্রুত চাকরি চলে যাওয়ার নজির আর কোন পেশাতে নেই। জানান ৬ মাস হলো তিনি বেকার। এক সকালে অফিসে গিয়ে দেখেন তার চাকরি নেই। স্কুলের বেতন দিতে পারেন না মেয়ের। ধার-দেনা করে চলছেন। তার বলা টুকরো টুকরো কথাগুলো বিষণ্ন বাতাস হয়ে তখন যেন ভেসে চলছিল আমাদের চারপাশে। আমরা লজ্জায়-বেদনায় নুয়ে পড়ি আমাদের জন্যই! দুঃখ করে একজন বললেন, সাংবাদিকদের আসলে টাকা লাগে না। হাওয়া খেয়ে বাঁচে তাদের জীবন। কথাগুলো ভীষণ ভাবে মনে বেজে ওঠে। ভাবায়। চোখের সামনে ভেসে ওঠে প্রতিদিনের দেখা, চেনা, কথা বলা সুখ-দুঃখের সব সাংবাদিক বন্ধুদের মায়াময় কিছু মলিন মুখ! সংসারে টাকা না থাকলেও যাদের কলম থামে না! কি এক ঘোর লাগা জীবনের মায়ায় পড়ে কেটে যায় তার সারাটা জীবন। সাংবাদিকদের সংগঠন বা রাষ্ট্র কি কখনো এগিয়ে আসবে এসব সমস্যা সমাধানে? নাকি যেভাবে চলছে সেভাবেই চলতে থাকবে সাংবাদিকদের পাওয়া না পাওয়ার জীবন! হাওয়া খেয়ে বাঁচা জীবন!
[লেখক : সাংবাদিক]
musfica@gmail.com
/ এআর /
** লেখার মতামত লেখকের। একুশে টেলিভিশনের সম্পাদকীয় নীতিমালার সঙ্গে লেখকের মতামতের মিল নাও থাকতে পারে।