ঢাকা, মঙ্গলবার   ২২ এপ্রিল ২০২৫

Ekushey Television Ltd.

সাইবার আসক্তি উন্নয়নের পথে বড় বাধা

প্রকাশিত : ২৩:০৪, ৩১ জানুয়ারি ২০১৯

Ekushey Television Ltd.

কিছুদিন আগে অফিশিয়াল কাজে সরকারি একটি প্রতিষ্ঠানে গিয়েছিলাম। সেখানে কর্মরত আমার এক পরিচিত ব্যক্তি পাশ দিয়ে হেঁটে গেলেন, কিন্তু আমাকে যেন দেখতেই পেলেন না। এর কারণ অনুসন্ধানে দেখলাম, তিনি স্মার্টফোনের স্ক্রিনের দিকে তাকিয়ে এতটাই মগ্ন যে আশপাশে দেখার মতো ফুরসত তার নেই।

আমার ছেলে-মেয়ের স্কুল সরকারি গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনার কম্পাউন্ডের মধ্যে অবস্থিত। নিরাপত্তা সেখানে সবার আগে বিবেচনা করা হয়। এমন প্রতিষ্ঠানের মেইন গেটে নিরাপত্তাকর্মীদের আমি স্মার্টফোন ব্যবহারে মগ্ন থাকতে দেখেছি। কোনো একটি প্রতিষ্ঠানে রাতে যখন গেট দিয়ে ঢুকলাম কোনো বাধার সম্মুখীন হলাম না। কারণটি জানতে সন্তর্পণে নিরাপত্তাকর্মীর কাছে গিয়ে দেখি তিনি স্মার্টফোনে নাটক দেখছেন। এই চিত্র শুধু আমার দেখা প্রতিষ্ঠানগুলোতে নয়, এটি এখন দেশের বেশির ভাগ প্রতিষ্ঠানের দৈনন্দিন চিত্র।

অফিস সময়ের এই কাজগুলো যদি নিজের ব্যক্তিগত না হয়ে অফিশিয়াল হয়, তবে তা কর্মঘণ্টা হিসেবে পরিগণিত হবে। কিন্তু ব্যক্তিগত হলেই এ ধরনের কাজকে সাইবার স্ল্যাকিং (Cyber Slacking) বলা হয়। সাইবার অর্থ ইন্টারনেট এবং কম্পিউটার সম্পর্কিত, আর স্ল্যাক অর্থ (ধীর)। অফিস সময়ে ইন্টারনেট ব্যক্তিগত কাজে ব্যবহারের কারণে আমাদের দাপ্তরিক কাজের গতিতে সার্বিকভাবে যে মন্থরতা সৃষ্টি হয়, তা সাইবার স্ল্যাকিং নামে পরিচিত। একটি গবেষণা রিপোর্ট থেকে দেখা যায়, বছরে ৪০ হাজার ডলার বেতন পান এমন চাকরিজীবী ব্যক্তি যদি অফিস সময়ে এক ঘণ্টা ইন্টারনেটে ব্যক্তিগত কাজের জন্য অপচয় করেন তাহলে তাঁর দ্বারা বছরে প্রতিষ্ঠানের পাঁচ হাজার ডলার ক্ষতি হয়।

বিপুল জনসংখ্যার এই দেশে জনশক্তিই একমাত্র ভরসা। কর্মক্ষেত্রে জনশক্তির কর্মঘণ্টা যদি নিছক আনন্দ গ্রহণের জন্য অযথা ব্যয় হয়, তাহলে তা জাতিকে এগিয়ে নেওয়ার পথে অন্তরায় হয়ে উঠবে। উন্নত বিশ্বে অফিস অটোমেশন ও ইনফরমেশন টেকনোলজির ব্যবহার সবার আগে শুরু হয়েছে। শুরুতে মানুষের কাছে শুধু এর ইতিবাচক দিকটিই প্রতিভাত হয়েছিল। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে এর নেতিবাচক প্রভাব আমাদের ব্যক্তিগত ও রাষ্ট্রীয় জীবনকে ভীষণভাবে প্রভাবিত করছে। এর নেতিবাচক প্রভাব থেকে পরিত্রাণের জন্য বিষয়টি নিয়ে অনেক আগেই উন্নত বিশ্বে শুরু হয়েছে গবেষণা। গবেষণালব্ধ জ্ঞানের ওপর ভিত্তি করেই তারা কর্মক্ষেত্রের কর্মঘণ্টার সর্বোচ্চ ব্যবহারের জন্য বিভিন্ন ধরনের পদক্ষেপ নিয়েছে।

ইন্টারন্যাশনাল ডাটা করপোরেশনের একটি সার্ভেতে দেখা যায় কর্মস্থলের ৩০ থেকে ৪০ শতাংশ ইন্টারনেট ব্রাউজিং হয় কর্মক্ষেত্রের সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত নয়, এমন বিষয়ের ওপর। বিশ্বের এক হাজার বড় কম্পানির ৪৬ শতাংশ নিজেদের মধ্যে যোগাযোগের জন্য ইনস্ট্যান্ট মেসেজ (আইএম) ব্যবহার করে থাকে। তথ্যমতে, ৬৪ শতাংশ চাকরিজীবী কর্মক্ষেত্রে তাদের ব্যক্তিগত কাজে ইন্টারনেট ব্যবহার করেন। ৩৭ শতাংশ চাকরিজীবী কর্মক্ষেত্রে সব সময়ই নেটওয়ার্ক ব্রাউজ করার চেষ্টা করে থাকেন।

সাইবার স্ল্যাকিং যেকোনো কর্মপ্রতিষ্ঠানের জন্য নিঃশব্দ ঘাতক। প্রতিষ্ঠানে চাকরিরত মানুষ জানতেও পারেন না কেন তার কর্মের গতিশীলতা কমছে এবং কেন প্রতিষ্ঠান তার লাভজনক অবস্থান ধরে রাখতে পারছে না। ব্যক্তিগত ব্রাউজিংয়ে ইন্টারনেট ব্যবহারের সময় মানুষের সময়জ্ঞান থাকে না। জীবনের মূল্যবান সময় তার অজান্তেই সে জীবন বা ক্যারিয়ার গড়ার কাজে ব্যবহার না করে স্রেফ আনন্দ লাভের মাধ্যম বা সময় কাটানোর মাধ্যম হিসেবে ইন্টারনেট ব্যবহার করে।

আমাদের দেশও ডিজিটাল ব্যবস্থাপনায় এগিয়ে চলেছে। ইন্টারনেটের অ্যাকসেস তৃণমূল পর্যায় থেকে শুরু করে জাতীয় পর্যায়ের সব ক্ষেত্রে বিস্তার লাভ করেছে। তাই সাইবার স্ল্যাকিং সম্পর্কে সচেতন না হলে ভবিষ্যতে সমৃদ্ধ বাংলাদেশ গড়ার স্বপ্ন আমাদের অধরাই থেকে যাবে।

পশ্চিমা বিশ্বের দেশগুলো আমাদের অনেক আগেই ডিজিটাল সিস্টেমের আওতায় এসেছে। তাই সাইবার স্ল্যাকিং রোধে তাদের অনুসৃত পদক্ষেপগুলো অনুসরণ করা বাঞ্ছনীয়। সাইবার স্ল্যাকিং নামের অর্থনীতির গুপ্তঘাতক জাতীয় অগ্রগতির বড় বাধা। আমাদের দেশের কর্মক্ষেত্রগুলোয় ইন্টারনেটের ব্যবহারে সাইবার স্ল্যাকিং পর্যবেক্ষণের জন্য বিশেষ ব্যবস্থা গ্রহণ করা উচিত। এ ক্ষেত্রে কোনো প্রতিষ্ঠানের ইন্টারনেট সার্ভার রেকর্ড পর্যবেক্ষণ করার ব্যবস্থা থাকতে হবে। কার্যকর মনিটরিং সেল স্থাপিত হলে প্রতিষ্ঠানে কর্মরত ব্যক্তিরা তাদের কর্মঘণ্টার সঠিক ব্যবহার সম্পর্কে সচেতন থাকবে বলে আমার বিশ্বাস। দুর্নীতিমুক্ত সমাজ গড়তে ডিজিটাল ব্যবস্থাপনা যেমন জরুরি তেমনি সম্পদের সুষম বণ্টন, উৎপাদকের ন্যায্য মূল্য প্রাপ্তি, সরকারি কাজের জটিলতা নিরসন, আউটসোর্সিংয়ের মাধ্যমে কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টিতে ডিজিটাল বাংলাদেশের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে। তাই এর সঠিক সুফল পেতে আমাদের ডিজিটাল সিস্টেমের নেতিবাচক প্রভাবগুলো বিশ্লেষণ করতে হবে। এর জন্য চাই বিষয়গুলো নিয়ে মানসম্মত গবেষণা। গবেষণালব্ধ জ্ঞানের ওপর ভিত্তি করে সমস্যাগুলোর সমাধান করতে হবে।
লেখক : অধ্যাপক, কম্পিউটার সায়েন্স অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগ, ঢাকা প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, গাজীপুর


Ekushey Television Ltd.

© ২০২৫ সর্বস্বত্ব ® সংরক্ষিত। একুশে-টেলিভিশন | এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি