সাইবেরিয়ার গহীন জঙ্গলে বিজ্ঞাননগরী
প্রকাশিত : ১১:৩৭, ২৮ ডিসেম্বর ২০১৭
১৯৫৭ সালে সোভিয়েত সরকার সাইবেরিয়ার গভীরে একটা বিজ্ঞাননগরী গড়ে তোলার সিদ্ধান্ত নেয়। এ নগরীর নাম দেওয়া হয় অ্যাকাডেমিক সিটি বা আকাদেমগোরোদকের। সাইবেরিয়ার জঙ্গলে প্রায় ৬০ বছর আগে গবেষণা কাজের জন্য গড়ে তোলা এই শহরের বিজ্ঞানীরা এখন বাজারের চাহিদা ও বিশুদ্ধ বৈজ্ঞানিক গবেষণার তাগিদ দুইয়ের মাঝে টানাপোড়েনের শিকার।
শহরটি গড়ে তোলা হয়েছে একেবারে সাইবেরিয়ার বরফঢাকা বিরানভূমির মাঝখানে, গহীন জঙ্গলে, জীবনধারণ যেখানে কঠিন। সেখানে বাসিন্দা তখন ২৫ হাজার, যাদের প্রায় সবাই হয় বিজ্ঞানী, নয় বিজ্ঞানী হতে যাচ্ছেন।
অ্যাকাডেমিক সিটিতে প্রথম যেসব বিজ্ঞানী কাজ করতে গিয়েছিলেন তাদের একজন ছিলেন ভিক্টর ভারাণ্ড। তিনি সেখানে গিয়েছিলেন তার স্ত্রী ও শিশু সন্তানকে নিয়ে। তার স্ত্রীও ছিলেন বিজ্ঞানী। ১৯৬২ সাল থেকে সেখানে ভিক্টর ভারাণ্ড কাজ করেছিলেন ৪৬ বছর। ইনস্টিটিউট অফ ইনঅরগ্যানিক কেমিস্ট্রি সংস্থায় রসায়নবিজ্ঞানের গবেষক হিসাবে তিনি সেখানে কাজে যোগ দেন। ভিক্টর ভারাণ্ডের মতে ওই গহীন জঙ্গলের মাঝে বিজ্ঞানীদের জন্য শহর বানানোর একটা যৌক্তিকতা ছিল।
সেখানে গভীর বনজঙ্গলে ছিল প্রচুর গাছগাছালি- খনিজ সম্পদ ছিল অঢেল। এসব সম্পদের সন্ধান এবং কীভাবে সেসব আহরণ করতে হয় ব্যবহারের জন্য, তা জানা দরকার ছিল। আর সে কারণেই ওই বনভূমিতে তৈরি হয়েছিল আকাদেমগোরোদক।`
তিনি বলছেন, সোভিয়েতরা বিজ্ঞানের সেবায় উৎসর্গ একটা নগরী গড়ে তোলার জন্য ১৯৫৭ সালটা বেছে নিয়েছিল তার মূল কারণ দেশে তখন বিজ্ঞানীদের একটা অভাব তৈরি হয়েছে।
যুদ্ধের সময় ১৯২০ থেকে ৩০এর দশকে সোভিয়েতরা বিজ্ঞান চর্চায় পিছিয়ে পড়েছিল। কারণ বহু নামকরা, প্রথম সারির বিজ্ঞানী , এমনকি নোবেল বিজয়ী বিজ্ঞানীরাও হয় দেশ ছেড়ে চলে গিয়েছিলেন নয় তাদের জেলে ভরা হয়েছিল। কাজেই নতুন বিজ্ঞানী তৈরি করা জরুরি হয়ে পড়েছিল।
বিশ্ববিদ্যালয় ছাড়া ওই অ্যাকাডেমিক সিটি বা বিজ্ঞানী নগরীতে গড়ে উঠেছিল বিভিন্ন ধরনের বৈজ্ঞানিক প্রতিষ্ঠান- যেগুলো বিজ্ঞানের বিশেষ বিশেষ শাখা নিয়ে গবেষণার কাজ করত। কিন্তু তাদের পরস্পরের মধ্যে সম্বন্বয় ছিল- সংযোগ ছিল। ওই নগরীতে সবপ্রথম যে প্রতিষ্ঠানটি গড়ে ওঠে তাদের কাজ ছিল জলসম্পদ নিয়ে।
তারা আমাদের বেতন নিয়ে লোভ দেখায়নি। দারুণ সব কাজের সুযোগ এবং ভালো বাসস্থানের সুযোগ আমাদের আকৃষ্ট করেছিল। সেখানে পৌঁছনমাত্র ওরা আমাদের ভালো বাসাবাড়ি দিয়েছিল। সেসময় সোভিয়েত ইউনিয়নে বাসস্থানের দারুণ সঙ্কট ছিল। বেশিরভাগ তরুণ- এমনকি বিয়ের পর - বাচ্চাকাচ্চা হয়ে যাওয়ার পরও থাকত বাবা মায়ের সঙ্গে। আমরা অবশ্যই চাইতাম স্বাধীনভাবে থাকতে- কিন্তু সামর্থ্যে কুলাত না।
যারা শিক্ষাবিদ ছিলেন এবং যাদের ডক্টরেট ডিগ্রি ছিল তাদের বাসায় খাবার পৌঁছে দেওয়া হতো। শিক্ষাবিদদের ভাল খাবার খাওয়ার সুযোগ ছিল। তারা ফল, নানাধরনের মাংস, সসেজ এবং পনীর খেতে পারতেন।
তার মত, প্রতিভাবান বিজ্ঞানীরা ওই জনহীন প্রত্যন্ত সাইবেরিয়ায় ঘন্টার পর ঘন্টা কাজ করে যেতেন। কারণ তারা চাইতেন এমন কিছু করতে যা উৎসাহ- উদ্দীপনা জোগায় এবং যা মানুষের কাজে লাগে। এছাড়া কাজের জন্য সেখানে বৈজ্ঞানিক সরঞ্জাম পাওয়া দেশের অন্যান্য জায়গার তুলনায় সহজ ছিল, যদিও আমলাতান্ত্রিকতা ছিল পদে পদে। সেখানে যারা কাজ করতেন তাদের জন্য আরেকটা বড় সুবিধা ছিল শিক্ষা নগরীতে ছেলেমেয়েদের ভাল স্কুলে লেখাপড়ার সুযোগ।
নতুন নগরীতে ব্যতিক্রমী এক স্কুলে উন্নতধরনের শিক্ষার সুযোগ ছিল। ওই স্কুলে প্রতি বছর সোভিয়েত ইউনিয়নের বিভিন্ন অংশ থেকে সবচেয়ে প্রতিভাবান ছেলেমেয়েরা ভর্তি হতো। দেশব্যাপী প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষার মাধ্যমে শিক্ষার্থী বাছাই করা হতো। ওই স্কুল ছিল মেধাবীদের পীঠস্থান।
তবে সাইবেরিয়ায় অ্যাকাডেমিক সিটিতেও বিজ্ঞানীরা তাদের কাজে, ভাবনায় বা কথাবার্তায় স্বাধীন ছিলেন না। ভিক্টর বলছেন ১৯৩০এর দশকে স্তালিনের দমননীতির যুগ থেকে মানুষের যে শিক্ষা হয়েছিল তার আলোকে অবশ্যই মানুষ চুপচাপ থাকত।
আমরা ভাবতাম একরকম - কিন্তু মুখ খুলতাম যখন -তখন বলতাম অন্যকথা। অভিজ্ঞতাই আমাদের এভাবে কথা বলতে শিখিয়েছিল। কম্যুনিস্ট পার্টির বিরুদ্ধে কথা বলার সাহস সবার ছিল না।
বিজ্ঞানীরা মনে করেন ষাট বছর আগে গড়ে তোলা অ্যাকাডেমিক সিটি বা বিজ্ঞান-নগরীর পরীক্ষা সফল হয়েছিল। কারণ নতুন প্রজন্মের বিজ্ঞানীদের এখানে লালন করা হয়েছে। যারা এখন এখানে কাজ করছেন তারা এখানকার বিশ্ববিদ্যালয়েরই স্নাতক।
সূত্র: বিবিসি
একে// এআর
আরও পড়ুন