সিএনজি চালক ফোরকান মিয়ার ‘ফ্রি অ্যাম্বুলেন্স সার্ভিস’
প্রকাশিত : ১৫:০৭, ৮ মার্চ ২০২০ | আপডেট: ১৫:১১, ৮ মার্চ ২০২০
নিজের সিএনজি অটোরিক্সার পাশে ফোরকান মিয়া- সংগৃহীত
আপনি যদি গাজীপুরের বোর্ড বাজার এলাকায় যান তাহলে দেখতে পাবেন এক সিএনজি চালিত অটোরিক্সাওয়ালাকে। তিন চাকার এ বাহনটির ছাদে, ডানে-বামে লেখা রয়েছে, ‘এই সিএনজি গরীব, অসহায় ও প্রতিবন্ধী রোগীদের জন্য ভাড়া ফ্রি।’ শুধু কি তাই? রোগীদের জন্য ফ্রিতে অ্যাম্বুলেন্স সেবা দিয়ে থাকেন এর চালক। তিনি ফোরকান মিয়া। নয় বছর আগে এক মারাত্মক দূর্ঘটনার কবল থেকে বেঁচে ফিরে এ কাজকে জীবনের উদ্দেশ্য ঠিক করেছেন।
৪০ বছর বয়সী ফোরকান বিভিন্ন দূর্ঘটনাস্থল থেকে আহত ব্যক্তিদেরকে উদ্ধার করে যেমন শহরের বিভিন্ন হাসপাতালে ভর্তি করেন তেমনি অসুস্থদেরকে বাসা থেকে হাসপাতালেও আনে নেওয়া করেন একদম বিনা ভাড়ায়। তিনি যদি জানতে পারেন গাজীপুরের কোথায় দূর্ঘটনা ঘটেছে তাহলে সিএনজি নিয়ে সেখানে ছুটে যান। আহতদের উদ্ধার করে হাসপাতালে নেন। নিজের উপার্জনের একটা অংশ তিনি এ কাজে ব্যয় করেন। ফোরকান বলেন, ‘আমি এক রকম মৃত্যুর মুখ থেকে ফিরে এসেছি। এখন যে জীবনটা অতিবাহিত করছি তা হলো এক প্রকার বোনাসের জীবন। এরপর থেকে আমি আমার জীবন মানুষের উপকারে ব্যয় করার সীদ্ধান্ত গ্রহণ করি। তাদের কাছ থেকে আমি কোন ভাড়া গ্রহণ করি না।’
ফোরকান জানান, দূর্ঘটনার কবলে পড়ার আগে তিনি একটি গাড়ি চালাতেন। ঐ গাড়িতে করে তিনি দূরদূরান্তে যাত্রী ও পণ্য পরিবহন করতেন। ২০১১ সালে পবিত্র ঈদ-উল আযহার সময় তিনি একটি ভাড়া নিয়ে ময়মনসিংহ যাওয়ার সময় গাজীপুরের একটি হাসপালের নিকটবর্তীস্থানে দূর্ঘটনার কবলে পড়েন। এতে তার মাথাসহ শরীরে বিভিন্ন স্থানে গুরুতর যখম হয়। স্থানীয়রা তাকে উদ্ধার করে প্রথমে গাজীপুর সদর হাসপাতালে নিলে কর্তব্যরত চিকিৎসক তার মৃত্যু ঘোষণা করেন। পরে তাকে ঢাকার চারটি হাসপাতালে নিয়ে গেলেও কোন ফল না হওয়ায় স্বজনরা তাকে বাড়িতে নিয়ে কবর দেওয়ার প্রস্তুতি নেয়। এমন সময় তিনি জ্ঞান ফিরে পেলে তাকে দ্রুত হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়। সুস্থ্য হয়ে তিনি ঐ বছরের নভেম্বরেই একটি সিএনজি ভাড়ায় নিয়ে বিনামূল্যে রোগীদের হাসপাতালে বহন করা শুরু করেন। তিনি বলেন, ‘আল্লাহ বলেছেন, তোমরা আমার সৃষ্টিকে ভালোবাস তাহলেই আমাকে খুঁজে পাবে। মানুষ তো তারই সৃষ্টি।’
প্রায় ছয় বছর আগে তিনি তার চাচাতো ভাইয়ের কাছ থেকে ৬ লাখ টাকা ঋণ নিয়ে একটি সিএনজি অটোরিক্সা ক্রয় করেন। অ্যাম্বুলেন্সের মতো তিনি সেটায় বিশেষ বাতি ও সাইরেন যুক্ত করেন। এগুলো জরুরী রোগী বহনের সময় রাস্তা ফাঁকা করতে কাজে আসে বলে জানান ফোরকান। তিনি বলেন, ‘রাস্তায় ট্রাফিক পুলিশ আমাকে থামিয়ে এই বিশেষ বাতি ও সাইরেনের বিষয়ে জিজ্ঞাসা করলে আমি আমার উদ্দেশ্য বলি এবং তারা তখন আমাকে যেতে দেয়।’
২০১৮ সাল থেকে ফোরকান একটি রেজিস্ট্রার খাতা ব্যবহার করছেন। এ খাতায় তিনি কতজন রোগী কোন হাসপাতালে নিয়েছেন তা লিখে রাখেন। এ রেজিস্ট্রারে দেখা যায়, তিনি ২০১৮ সাল থেকে এ পর্যন্ত ৮৯ জন রোগীকে বহন করেছেন। এসব রোগীদের মধ্যে ২৭ জনের জন্য ঔষুধও কিনে দিয়েছেন। তার এ অটোরিক্সায় একটা অনুদান বাক্স আছে যেখানে যাত্রীরা সামান্য কিছু সহযোগিতা করেন। এতে তার কিছু উপকারও হয় বলে জানান ফোরকান।
গাজীপুরের কুনিয়া এলাকার শারীরিক প্রতিবন্ধী জাকির হোসেন বলেন, ‘আমি গত চার বছরে ফোরকানের সিএনজিতে করে বেশ কয়েকবার সাভারের পক্ষাঘাতগ্রস্থদের পূর্নবাসন কেন্দ্রে (সিআরপি) ও ঢাকার পঙ্গু হাসপাতালেও গিয়েছি। তবে ফোরকান আমার কাছ থেকে কোন ভাড়া নেননি।’ কুনিয়া চৌধুরী মার্কের এলাকার মুন্নি আক্তার কয়েক বছর আগে এক দূর্ঘটনার শিকার হন। তিনি বলেন, ‘আমি তিন বছর আগে সড়ক দূর্ঘটনায় গুরুতর আহত হই। এরপর আমি অনেকবারই ফোরকানের সিএনজিতে করে বিনা ভাড়ায় হাসপাতালে গিয়েছে এবং হাসপাতাল থেকে বাসায় ফিরেছি।’
তবে এসব রোগী বহন করতে গিয়ে মাঝে মধ্যে বিড়ম্বনায়ও পড়েছেন ফোরকান। তিনি বলেন, ‘আমি একবার এক রোগী নিয়ে ঢাকায় গিয়েছিলম। সেখান থেকে ফেরার পথে ঝামেলায় পড়েছিলাম। কারন সিএনজিটার রেজিস্ট্রেশন গাজীপুরের হওয়ায় ঢাকায় চালানো যায় না। যখন রোগী গাড়িতে থাকে তখন ঝামেলা হয় না। কিন্তু রোগী হাসপাতালে দিয়ে খালি ফেরার পথে প্রশাসন ঝামেলা করে।’
এমএস/